হারানো সুর ২য়-পর্ব
©শাহরিয়ার
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিতেই বাহির থেকে শাশুড়ি আম্মা ডাক দিলো। আমি সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে দরজা খুলে দিতেই আম্মা ঘরের ভিতর ঢুকলো।
আম্মা, মারে সারাদিনতো কিছু খাইলি না। আয় কিছু খেয়ে নে।
আমার ক্ষুদা নেই মা আপনি খেয়ে নেন ওদের সঙ্গে নিয়ে।
আম্মা, আমি ওদের সাথে খাবো এইটা তুমি কি করে ভাবতে পারলে? আমি যদি খাই তবে তোমার সাথে আর আমার নানতীর সাথে খাবো। নয়তো না খেয়েই কাটিয়ে দিবো জীবনের বাকি দিনগুলো।
আম্মা প্লীজ পাগলামি করবেন না। আপনি অসুস্থ মানুষ যেয়ে খেয়ে নিন।
কথা শেষ হতে না হতেই শাশুড়ি হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। কান্না করতে করতে সে বার বার বলতে থাকলো শাকিল এতো বড় পাপ এতো বড় অন্যায় আমার মৃত্যুর পর করতো। আমি বেঁচে থাকতে কেন করতে হবে?
শাশুড়ির কান্না দেখে আমারও প্রচণ্ড খারাপ লাগছিলো। এদিকে শাশুড়ির কান্নার সাথে সুর মেলাতে শুরু করলো কোলে শুয়ে থাকা সাবা। শাশুড়ি আম্মা আমার একটা হাত টেনে রান্না ঘরে নিয়ে আসলেন। সে এতো সময় বসে রান্না করেছে। আমাকে সঙ্গে নিয়েই খেতে বসলেন। কিন্তু কেন জানি খাবার আমার মুখের ভিতর নিতে পারছিলাম না শত চেষ্টা করেও। আম্মা বার বার বলে চলেছে অল্প হলেও খেতে হবে নিজের জন্য না হলেও সাবার জন্য। আমি অনেকটা সময় খাবার হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে একটা সময় কয়েক নলা খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর হাত মুখ ধুয়ে পানি খেয়ে সেখান থেকে উঠে দ্রুত নিজের রুমের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলাম।
ঘরের দরজার সামনে আসতেই পাশের ঘর থেকে ফিসফিসানির শব্দ কানে ভেঁসে আসতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রনায় যেন বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসছিলো। কোন রকমে বুকটাকে শক্ত করে চেঁপে ধরে রুমের ভিতর ঢুকে আসলাম।
মেয়েটাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশেই মাথা লাগিয়ে কান্না করছি আর আল্লাহর কাছে জানতে চাচ্ছি বার বার কি এমন ভুল আমার ছিলো যার জন্য এমন শাস্তী পেতে হচ্ছে আমাকে?
কত ভালোবাসতো মানুষটা আমাকে সব কিছু মিথ্যা প্রমাণ করে দিলো। মানুষ যে বলে সময় বদলে যায়, প্রতিশ্রুতি বদলে যায় বদলে যায় ভালোবাসার মানুষটাও। তাদের কথা গুলোই কি তবে সত্যি? কিন্তু আমিতো বদলে যায়নি, দিনের পর দিন এই মানুষটাকে ভালোবেসেছি। আজও ভালোবেসে চলেছি এই মানুষটাকে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দু’চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাএকা হয়ে গেলো। তবুও যেনো দু’চোখের পানি শেষ হচ্ছে না। দূর মসজিদ থেকে দিনের সর্বশেষ আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে দু’চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ছোট বেলা থেকে আর যাই হোক না কেন নামায, রোযা, সঠিক নিয়মে দান ক্ষয়রাত কখনো আমি বন্ধ করিনি।
তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে রুম থেকে বের হয়ে আসতেই চোখে পড়লো শাকিল আর তার নতুন বউয়ের হাসাহাসি আর মাতামাতির শব্দ। খাবার খাওয়ার জন্য তারা ঘর ছেড়ে কিচেনের সাথে লাগোয়া ডাইনিং এ এসেছে। বুকটা ছেদ করে উঠলো। এই শাকিল আমি এক বেলা না খেয়ে থাকলে আমাকে খাওয়ানোর জন্য কতই কি না করতো। অথচ আজ আমি একা একটা ঘরে পরে রয়েছি। খেয়েছি কি না খেয়েই পরে রয়েছে সে একটি বারের জন্যও এসে জিজ্ঞাসা করলো না।
কথা গুলো ভাবতেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এতোদিন কাকে আমি ভালোবেসে এসেছিলাম? যে মানুষটাকে এতো এতো পরিমাণ ভালোবাসলাম সেই মানুষটা মুহুর্তের ভিতর আমাকে ভুলে গেলো। ভালোবাসা নিয়ে মানুষ অভিনয় করতেই পারে তাই বলে নিজের স্ত্রী সন্তানদের ভালোবাসা নিয়ে অভিনয়? আমার ভালো মন্দ না জানতে চাইতেই পারে কিন্তু সাবা? ওতো ওরই রক্ত তবে কি করে ওকে উপেক্ষা করে সে চলতে পারছে? না আর ভাবতে পারছি না, হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো আমার। কোন রকমে ওদের কথা এড়িয়ে ওয়াশ রুমে এসে ওযু করে নিয়ে, সোজা নিজের রুমের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
জায়নামায বিছিয়ে নামাযে লুটিয়ে পড়লাম। যার কেউ নেই তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট্য। নামায শেষ হতেই সাবার কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। আমি উঠে যেয়ে মেয়েকে বুকের সাথে লাগিয়ে নিলাম। আমি কষ্ট করে বেঁচে থাকতে পারলেও আমার মেয়েটা কি করে এতো কষ্ট সহ্য করবে?
আর চাচা চাচী, চাচাত ভাইটা যদি জানতে পারে? তবে তারা কিভাবে রিয়াক্ট করবে? কথা গুলো ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে উঠছিলো। এ বাড়ি ছেড়ে গেলে শুধু মাত্র ঐ একটাই জায়গা রয়েছে আমার যাওয়ার মত। কিন্তু তারাও যদি আমাকে আর আশ্রয় না দেয়। নানান রকম কথা ভাবতে ভাবতে রাত গভীর হয়ে আসছে। সেই সাথে পাশের রুমের ফিঁসফিঁস শব্দে যেন আমার দম আরও বন্ধ হয়ে আসছে।
দুই দিন আগেও কত কথা বলতাম দু’জন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে আর আজ শাকিল অন্য কারো সাথে জেগে রাত কাটাচ্ছে। সেও তার বিবাহিত স্ত্রী। আমি তার স্ত্রী ছিলাম। কত রকম গল্প বলতাম দু’জন জ্যোৎস্নার আলো নাকি আমার সমস্ত শরীরে মাখিয়ে দিবে। আমি কখনো ঢাকা শহরে যাইনি এবার বৈশাখি মেলায় আমায় ঢাকায় নিয়ে যেয়ে। ঢাকাই শাড়ি রেশমী চুড়ি কিনে দিতে চেয়েছিলো মানুষটা, সবটাই ছিলো শুধুই তার অভিনয়। এতো ভালোবাসার পরও মানুষটা আমার হইলো না। এই দুঃখে না পারবো আমি বেঁচে থাকতে না পারবো আমি মরে যেতে।
নানান রকম চিন্তায় এক সময় ক্লান্ত দু’চোখ ঠিকই বন্ধ হয়ে এলো। ফজরের আযানে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে এসে নামাযে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নামায শেষে মোনাযাতে আল্লাহর নিটক প্রার্থনায় লুটিয়ে পরলাম যেন যা হয় ভালো কিছু হয়।
“আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতাগুলো আল্লাহ্’র সমীপেই নিবেদন করছি!” [সূরা ইউসুফ: ৮৬]
মোনাজাত শেষ করতেই বাহির থেকে চাচাত ভাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। যে জিনিসের ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো। আমি চাইনি চাচার বাড়ি পর্যন্ত এ খবর পৌঁছে যাক কিন্তু এ গ্রাম আর ঐ গ্রাম মুহুর্তে মানুষের কান থেকে কান অব্দি পৌঁছে যায়। চাচাত একমাত্র ছোট ভাই এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে রক্ত গরম। সব চেয়ে বড় কথা চাচা চাচীর চেয়ে সে আমাকে অনেক বেশী ভালোবাসে। আপন বড় বোনের চেয়ে কোন অংশে কম ভালোবাসে না। আমি ছোট বেলা থেকেই তাকে ছোট ভাইয়ের মত করেই আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছি। রুমানের আওয়াজে এবার আমি দ্রুত রুমের ভিতর থেকে বের হয়ে আসলাম। না জানি আর কার কার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আমাকে দেখে রুমান একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রুমান।
এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ভাই?
রুমান, বুবু তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে এক রাতে?
আমি মুখে মিথ্যে হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে কই আমারতো কিছু হয়নি।
রুমান, বুবু তুই মিথ্যা হাসি দিয়ে তোর সুন্দর চোখের নিচের কালো দাগ লুকাতে পারবি না। পারবি না লোকাতে তোর মুখের ক্লান্তির চিহ্ন। আমিতো আমার বুবুকে চিনি। তুই সব কিছু ব্যাগে ভরে নে আমার সাথে এখুনি চল। এখান থেকে সোজা তুই আমাদের বাড়ি যাবি। তারপর বিকেলে থানায় যেয়ে মামলা করবো।
তুই কি পাগল হইছিস ভাই? কার বিরুদ্ধে মামলা করবি? উনি তোর দুলাভাই, আর আমি এ বাড়ি ছেড়ে আপাতত যাচ্ছি না। তুই বস আমি তোর জন্য চা নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি।
রুমান, দুলাভাই ঐ লোকটা আমার কিছু হয়না। যে আমার বোনের কোমল হৃদয়টি ভাঙতে বিন্দু পরিমাণ কার্পন্ন করেনি সে কোন দিনও আমার দুলাভাই হতে পারে না। আমিতো উনাকে জেলের ভাত খায়িয়েই ছাড়বো। তুমি তাড়াতাড়ি সাবাকে নিয়ে আমার সাথে চলো।
ভাই তুই পাগলামি করিস না মাথা ঠাণ্ডা কর, এটা আমার স্বামীর বাড়ি, আর মেয়েরা স্বামীর বাড়ি আসে লাল শাড়ি পরে, আর বের হয় সাদা কাফনের কাপড় পরে। আমিও যেদিন মরবো সেদিন না হয় সাদা কাপড় পরিয়ে নিয়ে যাস।
রুমান, তুমি যাই বলো আপু আমি ঐ লোককে কোনদিন ও ছাড়বো না। আজ হোক কাল হোক তাকে আমি শাস্তি দিবোই।
কথা গুলো বলে রাগে গজ গজ করতে করতে রুমান বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে গেলো অনেক ডেকেও ওকে আর থামাতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে রইলাম। কি করবো না করবো কোন কিছুই যেনো বুঝতে পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে নিজের স্বামী সংসার সব অন্য এক মহিলার হয়ে যাচ্ছিলো অথচ আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। কিছুই করতে পারছিলাম না। চাইলেই রুমানের সাথে বের হয়ে যেয়ে শাকিলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতাম। কিন্তু সত্যিই কি মানুষ আমাকে ভালো চোখে দেখতো? আর যে মানুষটাকে এতো ভালোবেসেছি সেই মানুষটার বিরুদ্ধেই কি করে আমি মামলা করতাম। প্রচণ্ড রকম মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে আমি শুধু মা বলে একবার চিৎকার করে উঠলাম। তারপর সব কিছু শুধুই অন্ধকার।
চলবে…