হারানো সুর পর্ব-৪

0
878

হারানো সুর-৪র্থ পর্ব
©শাহরিয়ার

রুমন এক নাগারে কথা গুলো বলে চলছে চাচীকে। খুব মায়া লাগছে ভাইটার জন্য। কিন্তু সব মায়া যে আমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাকে যে আমার ছোট সাবার জন্য বেঁচে থাকতে হবে। আমি জানি আমাকে লড়াই করতে হবে এ সমাজে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা মুহুর্তে আমাকে লড়াই করতে হবে। যে সমাজে নারীর স্বামী থাকতেও একা বেঁচে থাকতে হয় সে সমাজে তাকে কতটা লড়াই করে বাঁচতে হয় একমাত্র সেই নারীই জানে। কত রকমম কলংক, কত রকম মানুষের জগণ্যতম ভাষা শুনে বাঁচতে হয়। কত মানুষের হিংস্র খারাপ হাত ছুটে আসবে আমার দিকে। ভয়ংকর লোভার্ত চোখ গুলো প্রতিটা মুহুর্তে গিলে খাবে, খাবরে ছিড়ে খেতে চাইবে আমাকে। নিজেকে শক্ত করতে হবে আমাকে, এমন ভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে যেন সে সকল নরপশুরা কাছে আসার সাহস না পায়।

এ সমাজে অংসখ্য স্বামী পরিত্যক্ত নারী রয়েছেন, যারা বেঁচে রয়েছে, সমাজে নিজের একটা অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। সন্তানদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে ঘরে তুলেছেন তবে আমি কেন পারবো না? আমিও নারী অন্ন বস্ত্র গৃহের জন্য লড়াই করার ক্ষমতা আমারও আছে।

কতক্ষণ যাবৎ রুমান ডেকে চলছে সেদিকে আমার কোন খেয়ালই নেই, আমিতো আমার আগামির চিন্তায় মশগুল ছিলাম। যখন ওর কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসলাম, তখন ওর দিকে তাকাতেই ও প্রশ্ন করলো কি হয়েছে বুবু তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে? আমি কি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসবো?

আমি রুমনকে বাঁধা দিয়ে বললাম না আমি একদম ঠিক আছি ডাক্তার ডাকতে হবে না। এতো সময় আমি যখন অন্য কিছু চিন্তা করছিলাম তখন রুমন চাচীকে হয়তো অনেক কিছু বলছে যার কারণে চাচী সেখান থেকে চলে গেছে।

রুমান, আচ্ছা তাহলে চলো ভাত খাবে মুখটা কেমন শুকিয়ে রয়েছে সারাদিন নিশ্চই পেটে কোন দানা পানি পরেনি। এ বাড়িতে একজন আছে কেউ খেয়ে আছে কিনা সেদিকে খেয়াল না করে পাশের বাড়ির মানুষ কি বললো সে সকল কান পরা নিয়ে পরে আছে।

রুমনের কথায় আমি কাঁদবো না হাসবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কবে থেকে ও মেয়ে মানুষের মত করে ঝগড়া করতে শিখেছে? যে ছেলে দু’বছর আগেও শরমে ঠিকমত কথা বলতো না, সে ছেলে ঝগড়া করে চলছে কি এক অদ্ভুত ব্যপার। সময় মানুষকে সব পরিস্থিতে মানিয়ে নিতে শিখিয়ে দেয়। তাইতো বলা হয় সময়ের চেয়ে বড় আর কোন শিক্ষক হয় না। সময় আপনাকে আসল শিক্ষাটা দিয়ে থাকে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমন খাবার বেড়ে রেডি করে ফেলেছে। আমার দিকে তিকিয়ে সাবা কি ভাত খায় বুবু?

নারে ভাই ও ভাত খায় না।

রুমন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ভাত খেয়ে নাও। আমি ওর জন্য জুস, বিস্কুট, দুধের প্যাকেট, ফিটার সব কিনে নিয়ে আসবো।

আমি রুমনের ব্যবহারে বেশ অবাক হলাম, ও হঠাৎ কি করে এতোটা কেয়ারিং হলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম তুই এতো টাকা কোথায় পাবি?

রুমন, হাসতে হাসতে আমার কাছে টাকা আছে, আমি টিউশনি করাই সেখান থেকে যে টাকা পাই পুরোটাইতো আমার জমা থেকে যায়। আমার ভাগিনি এসেছে সেখান থেকে না হয় একটু ভাগ নিবে।

আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি, ছোট ভাইটা আজ সত্যিই বড় হয়ে গেছে, নিজের কি দায়িত্ব তাও সে বুঝে। হয়তো আর তিন চার বছর পর ওর নিজের ছোট সুখের সংসার হবে। আচ্ছা তখন কি শাকিলের মত রুমন ও বদলে যাবে? নারীর শরীর লোভ কি ওকে মানুষ থেকে অমানুষ বানিয়ে দিবে?
আজকের এই দিনে আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। সময় এর সঠিক উত্তর বলে দিবে।

রুমন, আপু খাচ্ছিস না কেন?

রুমনের কথায় আমি মাথা নাড়া দিয়ে খেতে শুরু করলাম। আজ দু’দিন আমি ঠিক মত খায়নি। খাবার যেন অমৃতর মত লাগছিলো। অনেক তৃপ্তি নিয়ে পেট ভরে খেলাম। আমার খাবার খেতে দেখে এক দৃষ্টিতে রুমন আমার দিকে চেয়ে ছিলো। খাওয়া শেষ হতেই রুমন বলে উঠলো। আপু আর কয়টা ভাত দেই। তোর মনে হয় খুব ক্ষুদা পেয়েছে।

আমি নারে ভাই আর লাগবে না পেট ভরে গেছে। তুই খুব ভালোরে ভাই।

রুমন, কি যে বলো না , আচ্ছা তুমি রুমে যেয়ে রেস্ট করো আমি সাবার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে আসি।

তুই রুমে নতুন চাদর লাগিয়েছিস তাই না?

রুমন, হুম আমি জানতাম তুমি আসবে।

আচ্ছা যা, রুমন চলে গেলো বাজারের দিকে সাবার জন্য কেনাকাটা করতে আমি রুমে এসে সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে নিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। শরীর এতোই ক্লান্ত যে চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরলাম। দুদিনের ক্লান্ত শরীর খুব বেশী সময় জেগে থাকতে পারলো না।

তবে ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, চাচীর চেঁচামেচিতে খুব বেশী সময় আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই চোখ মেলে তাকালাম। পাশের রুমে চাচী চাচার সাথে চেঁচামেচি করছে আর তাদের চেঁচামেচির বিষয় আমি।

চাচী চাচাকে বলে চলছে তোমার ভাইয়ের মেয়েকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি তাড়াও। আমার ছেলে বড় হয়েছে দশ জনে দশ রকম কথা বলে। আমার ছেলেটার শেষে ভালো ঘরে বিয়ে হবে না।

চাচীর এমন কথায় আমার মাথায় যেনো পুরো আকাশ ভেঙে পড়লো। যাকে আমি নিজের আপন ছোট ভাই ভাবি তাকে নিয়েই আমার দিকে খারাপ ইঙ্গিত। ছিঃ ছিঃ আমি না হয় পরের মেয়ে কিন্তু রুমনতো তার নিজের সন্তান। মানুষ কি করে এতোটা নিচু মনের হতে পারে। কি করে এতোটা হীন, নিচ চিন্তা করতে পারে। এই মুহুর্তে নিজের উপর নিজের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। কেন মরতে মরতে এখানে আসছিলাম।

চাচী এতো কথা বলছিলো অথচ চাচা তার একটুও প্রতিবাদ করলো না। চাচা এক সময় বলতো আমার দু’টো সন্তান একটা মেয়ে আর একটা ছেলে। আমি নাকি উনার বড় মেয়ে অথচ আজ আমার বিরুদ্ধে চাচী এতো এতো জগন্য ভাষা ব্যবহার করছে চাচা এর কোন প্রতিবাদ করছে না।

মাথাটা কেমন ভারী ভারী হয়ে আসছিলো, মনে হচ্ছিলো ছিড়ে পরে যাবে। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দু’চোখের পাতা বন্ধ করে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় হঠাৎই রুমনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সাথে সাথেই চাচী সব শব্দ বন্ধ করে দিলেন।

রুমন আমার রুমের দিকে ছুটে আসলো। রুমে এসে সব কিছু আমার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সাবাকে কোলে তুলে নিয়ে বসলো।

আমি ওকে সাবাকে নিয়ে রুমে বসতে বলে দুধ গরম করার জন্য রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফিটারটা ভালো করে গরম পানি করে দুয়ে নিলাম। তারপর দুধটা গরম করে ফিটারে ঢেলে নিয়ে আসলাম। রুমনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম সাবাকে আমার কাছে দে।

রুমন সাবাকে আমার কোলে দিয়ে পাশেই বসে রইলো। আমি সাবার মুখে ফিটার তুলে দিয়ে রুমনের দিকে তাকিয়ে বললাম। আমি আজ রাতটাই শুধু এখানে থাকবো। কাল ভোর হলেই চলে যাবো।

রুমন, আমার কথা শুনে জেনো চমকে উঠলো। কি সব বলছিস বুবু কোথায় যাবা তুমি? আর আমার ভাগিনিই বা কোথায় যাবে কার কাছে থাকবে?

আমি একটু হেসে শোন ভাই আল্লাহর দুনিয়াতে মানুষের থাকার জায়গার অভাব নাই। এই দুনিয়াতে যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন। কোথাও না কোথাও নিশ্চই আল্লাহ একটু জায়গা এক টুকরো আহার আমার জন্যও লেখে রেখেছেন। আর আল্লাহ যার আহার যেখানে লেখে রেখেছেন সেখানে যেয়েই তাকে তা গ্রহণ করতে হবে। এ বাড়িতে কিংবা এ শহরে হয়তো আমার আর রিজিক নেই। তাই যেখানে আমার রিজিক আছে সেখানেই যেতে হবে আমাকে।

রুমন, আমি কি তবে তোমার কেউ না?

পাগল একটা কে বলছে তুই আমার কেউ না? তুইতো আমার সাত রাজার ধন। একদিন তুই অনেক বড় হবি। যেনো কেউ তোর বুবুরে কিছু বললে প্রতিবাদ করতে পারিস। পুরো সমাজের সাথে লড়াই করার মত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবি। দেখবি বুবু ঠিকই তোর পাশে তোর সাথে আছি।

আমার কথার কি বুঝলো রুমন আমি বুঝতে পারিনি। তবে রুমন বুঝতে পেরেছে আমি আর বেশী সময় এ বাড়িতে নেই, তাই রুমন আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। বুবুরে মা তোকে কিছু বলে থাকলে আমাকে বল আমি মাকে বকে দিবো তবুও তুই যাসনে। কোথায় যাবি একা একা এই ছোট বাচ্চাটারে নিয়ে। নানান রকম কথা বলছে আর কান্না করছে রুমন।

আমি রুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর বলছি কাঁদিস না ভাই, পুরুষ মানুষকে খুব শক্ত হতে তাদের চোখে পানি মানায় না। আমি রুমনের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে রুমন আমাকে একটা কথা দিবি ভাই।

রুমন, বলো বুবু কি শুনতে চাও।

জীবনে কোন মেয়েকে কষ্ট দিবি না। যেমন তোর দুলাভাই করছে তেমন কাজ ভুলেও কোন দিন করবি না আমাকে তুই কথা দে।

রুমন, আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কথা দিলাম বুবু জীবনেও এমন কাজ করবো না। আমার বুবুকে দেয়া ওয়াদা আমি মরে গেলেও ভাঙবে না।

আমার নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে আমি রুমনকে বললাম। কাল সকালেই আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। তুই এখন তোর রুমে যা আমি নামায পড়ে একটু ঘুমাবো।

রুমন বাধ্য ছেলের মত রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কলপাড়ে এসে ওযু করে নিজের রুমের ভিতর ঢুকে নামাযে দাঁড়িয়ে পরলাম। এই নামাযে দাঁড়ালে হৃদয়ের সব ব্যথা গুলো হালকা হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে এই নামাযের মাধ্যমেই আমি আমার সব কষ্ট গুলো জানাতে পারি। সিজদায় লুটিয়ে আমি আমার আল্লাহর কাছে কষ্ট গুলোকে বলি। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। কেননা,

“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি!”
[সূরা ইনশিরাহ: ৬]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here