হারানো সুর-৭ম পর্ব
©শাহরিয়ার
বিকেলে চোখ মেলে তাকালাম, জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়া। বাহির থেকে সূর্যের আলো বেশ খানিকটা ঘরে ঢুকে আমার মুখের উপর পরছে। আমি উঠে বসলাম। এমন সময় মা ঘরে ঢুকলো সাবাকে কোলে নিয়ে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। মা সাবাকে আমার কোলে তুলে দিলো। আমি বললাম খুব জ্বালিয়েছে আপনাকে তাই না?
মা, হেসে দিয়ে মোটেও না, এতো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা আমি এর আগে খুব কমই দেখেছি। বিন্দু পরিমাণ কান্নাকাটি বা জ্বালানত করেনি। মনেই হয়নি সারা দিন এ বাড়িতে কোন বাচ্চা আছে। তোমার কথা বলো এখন কেমন লাগছে?
জ্বি “আলহামদুলিল্লাহ” আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি আমি।
মা, আচ্ছা তোমার নাম কি? কোথায় থেকে তুমি এসেছো আর কোথায় যাবে তুমি?
আমার নাম রত্না, এরপর আস্তে আস্তে সব খুলে বললাম। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। আর জানালাম এ শহরে আমার যাওয়ার বা থাকার কোন জায়গা নেই।
মা, সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললো মন খারাপ করো না মা। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। আর আমাকে যেহেতু মা বলে ডেকেছো সেহেতু তোমার আর কোন চিন্তার কারণ নেই। তুমি আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকবে। আমি আর জাহাঙ্গীর ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না। আমি ভার্সিটির প্রফেশর ছিলাম অবসর নিয়েছে। ওর বাবা সেনাবাহিনিতে ছিলো। দীর্ঘ দিন দেশের সেবা করে অবসর নেয়। বেশ ছিলো আমাদের সংসার। হঠাৎ একদিন রাতে হার্ট এট্যাক করে মারা যায় লোকটা। তারপর থেকে আমার সময়ও কাটে একা একা। ছেলেটার নেশাও হয়েছে বাবার মতই দেশের সেবা করবে। তাই পুলিশে চাকরি নিয়েছে। কতবার করে বললাম আমার বয়স হয়েছে ওবার একটা বিয়ে করে নে। কিন্তু আমার কথা শুনতেই চায়না। কি আর করার ছেলের মতের বিরুদ্ধেও যেতে পারি না। সারাদিন এতো বড় বাড়িতে আমার একা কাটে। আমি বলি তুমি আমার সাথে এখানেই থেকে যাও। আর আমার ছেলে যেহেতু পুলিশ, তুমি তোমার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে দাও। ওকে জেলে ঢুকিয়ে দেই।
আমি মাকে বললাম না মা এমনটা করবেন না প্লীজ। সে যদি আমাকে ছাড়া যদি সুখে থাকে তবে থাকুক সুখে। সব কিছুর শেষেও সে আমার সন্তানের পিতা। আমি চাইনা আমার আর উনার ভুলে আমার সন্তানের জীবনটা নষ্ট হয় যাক।
মা, আমরা বাঙালী মেয়েরা সারা জীবন সহজ সরল থেকে যাবো এমনি করে। আর স্বামীরা দিনের পর দিন অত্যাচার করে যাবে। এর জন্য আমরা দ্বায়ী, আসলে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাই না।
আমি জানি মা আমি চাইলেই শাকিলকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি। তার অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু মা আপনার মত সেখানে আমার শাশুড়ি রয়েছে সে আমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবেসেছে। সে এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। আর আমি সন্তান হয়ে মাকে কি করে কষ্ট দিবো? আমি জানি আমি ঐ বাড়িতে নেই, তাতেই খুব কষ্টে আছেন উনি। তার উপর যদি শাকিলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে উনি হয়তো সে কষ্ট সহ্যই করতে পারবে না।
মা, বেশতো আমি তোমাকে কোন রকম চাপ দিবো না। তুমি রেস্ট করো, আমি পরে আসবো আবার।
মা, চলে গেলেন আমি সাবাকে পাশে শুয়িয়ে দিলাম, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সাবা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। জানিনা আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি রেখেছে। শুধু জানি ওর জন্য আমি পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারবো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম।
মুহুর্তে পুরো ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো। জানালার পর্দা লাগানোর জন্য সেদিকে যেয়ে জানালার বাহিরে চোখ রাখতেই আলোকিত একটা শহর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। গতকাল রাতে আসলেও এভাবে এই শহরটাকে দেখা হয়নি। আজ যতটা ভালো লাগা নিয়ে দেখছি। আমার জীবনেও একদিন এমন আলোয় আলোকিত হবে এটা আমার বিশ্বাস।
হঠাৎ করেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠায় আমি কিছুটা চমকে উঠি, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় যেয়ে সাবাকে জড়িয়ে ধরি। একটু পরেই দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে আসে। আমি মেয়ের পাশে বিছানায় বসে আছি এমন সময় আমার কানে ভেসে আসে।
মা মেয়েটার কি জ্ঞান ফিরেছে?
মা, হ্যাঁ ফিরেছে কেন?
জাহাঙ্গীর, মেয়েটার বাড়ি ঘর কোথায়? কোথায় যাবে কিছু কি জেনেছো?
মা, মেয়েটার যাবার মত কোন জায়গা নেই, এই শহরে নতুন এসেছে। মেয়েটার জীবনে অনেক কষ্ট আমি মেয়েটাকে আমার সাথেই থাকতে বলেছি। মেয়েটা এখন থেকে এখানেই থাকবে।
জাহাঙ্গীর, চিনো না, জানো না, হুট করে একটা মেয়েকে বাড়িতে রেখে দিবে? যদি মেয়েটার খারাপ কোন মতলব থাকে। যদি বাড়ি থেকে চুরি করে পালিয়ে যায় তখন তুমি বুঝবে।
মা, সব কিছুতেই পুলিশের চোখে দেখা বাদ দে, মানুষের মত করে একটু দেখার চেষ্টা কর। দেখবি পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ না। আর আমি একজন মা আমার চোখে ফাঁকি দেয়া এতো সহজ না। ওর ঐ নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় মেয়েটা কত কষ্ট করে বেঁচে আছে।
জাহাঙ্গীর, হয়েছে হয়েছে বুঝতে পেরেছি, তোমরা মায়েরা সব বুঝ আর আমরা কিছুই বুঝি না।
মা, তোকে এতো বুঝতেও হবে না, যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি নাস্তা দিচ্ছি নাস্তা করে নিবি।
জাহাঙ্গীর, মেয়েটা কিছু খেয়েছে কি? আর ঐ পিচ্চি বাচ্চাটা?
মা, হ্যাঁ খেয়েছে দুপুরে, এখন নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাক দিবো। তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়।
মা ছেলের কথা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিলো, কোন রকমে হাসি চেপে দু’জনের কথা শুনে চলছিলাম। মানুষটাকে বাহির থেকে যতটা শক্ত মনে হয় ভিতর থেকে ঠিক ততটাই নরম।
মা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাক দিলো। আমি উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দিয়ে মাকে ভিতরে আসতে বললাম।
মা, ভিতরে ঢুকে বিছানায় সাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে। ওতো ঘুমাচ্ছে তুমি চলো চা নাস্তা খেয়ে নিবে। জাহাঙ্গীর এসেছে যদি কোন কিছু প্রশ্ন করে তবে খুব সাবধানে উত্তর দিও। এ ছেলেকে কোন বিশ্বাস নেই, সবাইকে ওর কাছে চোর মনে হয়। সবাইকে সন্দেহ করে, এই ছেলেকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি।
আমি মায়ের হাত শক্ত করে চেপে আপনার কোন ভয় নেই মা। আমি সব কিছু সামলে নিবো। আর আপনার ছেলে মানুষ হিসেবে অনেক ভালো নয়তো আমার মত অপরিচিত একজন মানুষকে নিশ্চই রাস্তা থেকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে আসতো না।
মা, এটা তুমি ঠিক বলেছো, আমার ছেলের মনটা বিশাল বড়।
এমন সময় বাহির থেকে মা বলে ডেকে উঠলো। মা আমাকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বের হতে বলে, বাহিরের দিকে হাঁটা শুরু করলো। মা রুম থেকে বের হয়ে যেতে আমি ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। সাবা ঘুমাচ্ছে তাই ওকে আর ডাক দিয়ে তুললাম না। আমি একাই ভয়ে ভয়ে রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে যেতে।শুরু করলাম। ডাইনিং এর সামনে যেয়ে চমকে গেলাম। সেখানে শুধু জাহাঙ্গীর বসে আছে মা নেই, মা সম্ভবত কিচেন রুমে আমি কি করবো না করবো দ্বিধাদ্বন্দ্বয় পরে গেলাম। একবার ভাবলাম রুমে ফিরে আসবো। পরক্ষণে ভাবলাম ব্যাপারটা তাহলে ভালো দেখাবে না। তাই আরও কয়েক পা গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখে জাহাঙ্গীর টেবিলে বসা অবস্থায় কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো এদিকে এসে বসুন।
উনার কণ্ঠ শুনে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে, হয়তো উনি পুলিশ সে জন্যই এমনটা হচ্ছে। গতরাতে উনি যে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে সেই সব ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে উঠছে। আমি কোন রকমে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। বেশী সময় দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ভয়ে গলা শুকিয়ে মাথা ঘুরে আরেক পরে জ্ঞান হারাতে হতো।
হঠাৎ করেই জাহাঙ্গীর আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পানি খেয়ে নিন। আপনার কি খারাপ লাগছে?
আমি দ্রুত পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে গ্লাসের সব পানি টুকু খেয়ে নিলাম। তারপর মাথা নিচু করে খুব আস্তে উত্তর দিলাম জ্বি না আমি ঠিক আছি।
জাহাঙ্গীর, ঠিক থাকলেই ভালো, আপনার বেবীটা কোথায় সাথে নিয়ে আসলেন না?
আমি মাথা নিচু অবস্থায় উত্তর দিলাম ও ঘুমাচ্ছে, পরে উঠলে তখন নিয়ে আসবো।
এমন সময় মা চা আর নাস্তা নিয়ে ডাইনিং এ আসলো। আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো কি তোদের দু’জনের কি আলোচনা হলো।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি, জাহাঙ্গীর হেসে দিয়ে বলতে শুরু করলো। এ মেয়েতো এখনো মনে হয় ভয়ে আছে। আর একটু হলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। এর ভিতর থেকে ভয় এখনো কাটেনি। দেখো এখনো কেমন করে কাঁপছে।
আমি অবাক নয়নে লোকটার দিকে চেয়ে ভাবছি, একটু আগেও যে মানুষটাকে আমার কাছে প্রচন্ড কঠিন মনে হয়েছে। সেই মানুষটাকে এই মুহুর্তে একদম সহজ সরল মনে হচ্ছে। কেউ এই মুহুর্তে দেখলে বুঝতেই পারবে না। মানুষটা একজন পুলিশ অফিসার। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে মানুষটার হাসি দেখছি। একজন কঠিন মানুষও এতো সুন্দর করে হাসতে পারে। তা আমি আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম। আস্তে আস্তে আমার ভয় কেটে যেতে শুরু করলো।
আমি মনে মনে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম। এতো ভালো একটা পরিবারে আমাকে থাকার জন্য আশ্রয় করে দেবার জন্য এবং আমি বিশ্বাস করি।
“আল্লাহ্ কষ্টের পর সুখ দিবেন!”
[সূরা ত্বলাক: ৭]
ইনশা আল্লাহ আমার ও সুখের দিন শুরু হবে। কথা গুলো যখনি ভাবছিলাম ঠিক তখনি সাবার কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড়ে সেদিকে ছুটলাম। আমার সব সুখ বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমার মেয়ে, তার কান্না যে আমি সহ্য করতে পারি না।
চলবে…