“হালাল প্রেম”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে ঘনিষ্ঠ সকল ফ্রেন্ডকে কল করলো শারমায়া৷ সবাইকে আজ রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে আর আড্ডা দিবে সেজন্য মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিলো আর নিজের কাছে জমাকৃত থেকে কিছু। যদিও টাকা বাবা ই দেয়, মা শুধুমাত্র উছিলা। অর্থাৎ মায়ের কাছে চায়, মা বাবার কাছে বলে টাকা নিয়ে দেয়। ক্লাস নাইন থেকেই বাবার কাছ থেকে সরাসরি টাকা চাওয়া বন্ধ করেছে শারমায়া। সরাসরি বাবাকে বলতে ভালো লাগে না তার। তবে মাঝে মাঝে ক্ষেত্রবিশেষে বলতে হয় বাবাকে। আর সাফওয়ানা! সে তো মজা খাওয়ার জন্য পাঁচ টাকাও চেয়ে নেয়। এমন কোনো দিন তার বাদ যায়না যে সে টাকা চায় না। স্কুলে যাওয়ার সময় তো নিবেই, বাসায় থাকলেও নেয়। বাবাকে না পেলে মায়ের পিছু ঘুরে ঘুরে মাথা ধরিয়ে ফেলে, “মা, পাঁচটা টাকা দাও। মা, দশটা টাকা দাও। বেশি চাইনি তো, মাত্র… টাকাই চেয়েছি।”
আর শারমিনের বাধাই করা উক্তি,
“হু, আমি তো টাকার গাছ! আমাকে ঝাকা দিবি আর টাকা উড়ে উড়ে পড়বে।”
মায়ের কথার প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে সত্যিই সাফওয়ানা মাকে ঝাপটে ধরে ঝাকানোর চেষ্টা করে। কখনো শারমিন মাইর দিয়ে তাড়া করে, কখনো বা নিজেই হেসে উঠে।
সকাল দশটার দিকে তারা ছয়জন ফ্রেন্ড মিলে বেরিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ একত্রে ঘুরাফেরা করে বারোটার দিকে রেস্টুরেন্টে এলো লাঞ্চের জন্য। খাওয়ার সময় ফ্রেন্ডরা শারমায়ার সাথে কথা বলছে,
“দোস্ত, জোভান ভাইয়া কি কাজ করে?”
“গাড়ির শোরুম আছে।”
“বাব্বাহ! ভালোই তো৷ বউ এক গাড়িতে চড়বি, বর আরেক গাড়ি নিয়ে। ভবিষ্যৎ পোনা পুনি আরেক গাড়িতে।”
“হু, ব্যবসার পণ্যসামগ্রী তো নিজেদের ব্যবহারের জন্য আনা হয় তাই না?”
“কেন, ব্যবহার করেনা আবার! দশটা না করুক, একটাও তো ব্যবহার করে।”
“সে তো করবেই।”
“দোস্ত, এতো বড় ব্যবসায়ীর বউ তুই। আমার বিয়েতে দাওয়াত করলে একটা গাড়ি গিফট করে দিস। আজী….বন মনে রাখবো তোকে।”
“ওকে, দোস্ত। কি গাড়ি দিবো সেটাও বলে দে। বাস গাড়ি নাকি ঠেলা গাড়ি?”
“হুহ! বাস গাড়ি নিয়ে কি করবো! আমার হাসব্যান্ড কি বাস চালক হবে! স্টুপিড মাইন্ড তোর৷ অবশ্যই একটা প্রাইভেট কার প্রত্যাশা করেছিলাম তোর কাছে।”
“অহ, আচ্ছা। যা প্রাইভেট কারই দিবো।”
“সত্যি নাকি, সাদিয়া?”
“তুই চাইবি আর আমি দিবো না তা কি করে হয়। তা প্রাইভেট কার কি স্প্রিংযুক্ত হবে নাকি নরমাল। ওইযে, সুতা দিয়ে বেধে টেনে টেনে যে চালায়?”
“মানে কি! তুই খেলনা গিফট করবি আমাকে? আমি কি বাচ্চা, যে তোর কাছে খেলনা চাইবো!”
“তুই কেন বাচ্চা হতে যাবি! তোর ভবিষ্যৎ পোনাপুনি আসবে না? তারা খেলবে। তাদের জন্যও তো তোকে কিনতেই হবে। আমিই না হয় গিফট করে দিলাম একটা প্রাইভেট কার।”
“জীবনেও শুধরাবি না তুই।”
তা নিয়ে চললো তাদের হাসিঠাট্টা। কখনো সবাই মিলে শারমায়াকে কুপোকাত করছে কখনো বা শারমায়া তাদের। এভাবে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো। নিধি বললো,
“এবার তো বল, হঠাৎ কেন ট্রিট দিলি? ”
“এমনি খাওয়ালাম।”
“সাদিয়া, এই একই জবাব এপর্যন্ত সাত বার দিয়েছিস। এমনি ট্রিট দিবি তুই? হুহ্! কারণ ছাড়া তুই কিছু করবি না আমরা নিশ্চিত। তোর কাছ থেকে তো দশ টাকার ঝালমুড়ি আদায় করতেও বিশ টাকার শক্তি খরচ করতে হয়। আর তুই বিনা কারণে ট্রিট দিবি সেটা আমরা বিশ্বাস করে নিবো! এনগেজমেন্টের ট্রিট দেওয়ার জন্য কি ভাইয়া টাকা দিয়েছে নাকি?”
“ই….শ! বাপের টাকায় খায়িয়েছি।”
“তোর হবু তাহলে কিপটে নাকি রে?”
বলেই হেসে উঠলো তারা। শারমায়া তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
“মোটেও না। তোদের ট্রিট দিবো সে বিষয়ে উনি কিছুই জানেন না। ট্রিট দেওয়ার কারণটা হচ্ছে, গত সন্ধ্যায় আমাদের বিয়ে ছিলো। বলেছিলাম বিয়েতে তোদের দাওয়াত করবো। কিন্তু আমার বিয়েতে আমিই দাওয়াত পেলাম না! এভাবে চুপিচুপি বিয়ে হবে ভাবতেও পারিনি। তাই ভাবলাম আজ তোদের ট্রিট দেই।”
রিফা চেচিয়ে বললো,
“সাদিয়া, তোর উপর বমি করে দিতে ইচ্ছে করছে। ছি! ছি! ছি! দাওয়াত করবিই না যেহেতু, আশায় রাখলি কেন? কত আশা নিয়ে বসেছিলাম, কত পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলাম সব ভেস্তে দিলি!”
“দোস্ত, বিশ্বাস কর। আত্মীয়দের মধ্যেও কেউ উপস্থিত ছিলো না।”
বুসরা অতি বিস্ময়করভাবে বলে উঠলো,
“চুপিচুপি বিয়ে কেন রে? তোদের কি লাভ ম্যারেজ? তোরা বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিস? আর আংকেল আন্টি মেনেও নিলো তোদের!”
“জাস্ট শাট আপ! পালিয়ে বিয়ে মেনে নিবে আমার বাবা-মা! আর লাভ ম্যারেজ, যার সাথে নাকি আমার এনগেজমেন্ট এর দিন পরিচয় হলো! আমার ফ্যামিলি আমাকে বিয়ে দিয়েছে। উনার প্ল্যান আর দুই পরিবারের কর্মকাণ্ড। ব্যাস, হয়ে গেলো বিয়ে। অনেক সময় ধরে একসাথে আছি, এবার বিদায় নেওয়ার পালা। আমি কোচিং-এ যাবো।”
নিধি তার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“ওই, দাঁড়া! এমনিতেই অনেক ছাড় পেয়েছিস। আজ আর ছাড়ছি না। ভাইয়ার ছবি দেখা আগে। এখন তো আর ভয় নেই যে আমরা নজর দিয়ে ফেলবো! অন্তত তোর সতীন হওয়ার স্বাদ কারো নেই৷ ফ্রেন্ড হয়েই আধমরা। সতীন হলে ইন্না-লিল্লাহ!”
“কি শুরু করলি, কোচিং-এ দেরি হয়ে যাবে৷”
“সে যাক। আজ ছবি দেখাতেই হবে।”
সবাই মিলে জোরাজোরি করে নিয়ে নিলো শারমায়ার ফোন। তাদের এনগেজমেন্ট ও বিয়ের ছবিতে তার সাথে জোভানকে দেখে তারা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে! তাদের ক্রাশ কি না এখন দুলাভাই! ছবি দেখে নিধি ফোন দিয়ে দিলো। শারমায়া বললো,
“এবার শান্তি তো? আমিও শান্তি। এবার যাওয়া যাক।”
সবাই একত্রে প্রশান্তির সাথে হেসে উঠে বললো,
“দোস্ত, হেব্বি লাগছিলো দুজনকে। মনেই হয় না তুই আছিস ছবিতে। এ তো জয় স্যারের বউ আমাদের ট্রিট দিলো রে! আ’ম শকড।”
“আ’ম রকড! চল তো এবার।”
দুদিন পর শারমায়া জোভানের সাথে বের হলো বাসা থেকে। জোভান শারমিনের কাছে কল করে অনুমতি নিয়েছে শারমায়াকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যাবে সে। তাই শারমায়া আজ কোচিংএ যায়নি। দুপুরের পর জোভান গাড়ি নিয়ে এসেছে বাসায়। অতপর শারমায়াকে নিয়ে বেরিয়েছে৷ গাড়িতে বসে জোভান বললো,
“সারমায়া, তুমি কি নার্ভাস?”
“উহুম।”
“এমন চুপচাপ আছো যে?”
“কি বলবো?”
“আমার সম্পর্কে কিংবা আমাদের সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করে জানতেও পারো। নাকি জানো সবটা?”
“উহুম।”
“আমিও কিন্তু এখনো সবটা জানি না তোমার সম্পর্কে ৷ তবে জিজ্ঞাসা করে জানবো না কিছু, নিজ প্রচেষ্টায় জেনে যাবো বাকিটা। তুমিও কি এমন কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছো নাকি?”
শারমায়া মৃদু হেসে বললো,
“করিনি তবে এখন আপনাকে অনুসরণ করলাম।”
জোভান নিঃশব্দে হেসে বললো,
“আমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে নার্ভাস ফিল করো না। তারা আমার ফ্যামিলি মেম্বার্স। একদমই আপন ভাইদের মতো আমাদের সম্পর্ক। তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি দেখা করতে। তাছাড়া একদিন না একদিন তো দেখা হবেই। আর বিয়ের ব্যাপারে তাদের ইনফর্ম করিনি বলে তারা তো আমার শ্বশুর বাড়ি খুজতে শুরু করেছে স্বেচ্ছায় দাওয়াত খেয়ে আসবে।”
“তো, বাসায়ই নিয়ে আসতেন।”
“হু, তারপর শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে যাক।”
“কেন?”
“ওইযে, এনগেজমেন্টেও ইনভাইটেশন পেলো না, দাওয়াতেও না।”
“এখন কি মুক্তি পেয়ে গেছেন?”
“উহুম, তাইতো তোমাকে বাইরে নিয়ে আসা। আমার ব্যাপারে কি শোনাবে তোমাকে আল্লাহই ভালো জানেন। তবে যাই বলুক, আমার ইজ্জত কেবল তোমার কাছেই সংরক্ষিত থাকুক।”
শারমায়া পথের সামনে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে জোভান বললো,
“শারমায়া, আমাদের গ্রুপটা মোটেও অন্যান্যদের মতো ইডিয়ট না। স্পেশালি মেয়েদের সম্মান করতে জানে খুব। কারো সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্য করবে না কখনো। তবে নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি ফাজলামো অলওয়েজ কন্টিনিউ। নিজেদের নিয়ে গর্ব করছি তা নয়, সত্যটা বলছি। তুমি একটু ইজিলি নিলেই নিজে প্রমাণ পাবে। আর যারা ইডিয়ট ছিলো তাদের সাথে বন্ধুত্ব ত্যাগ করেছি শুরুতেই। অর্থাৎ ঘনিষ্ঠতায় জড়াইনি।”