“হালাল প্রেম”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
শারমায়া ভাবনায় বিলীন হয়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই নিধি বললো,
“আন্ডা কোথায়? আমি তো বসে আছি দেখার জন্য যে, কিভাবে তুই বুসরার মাথায় আন্ডা ফাটিয়ে দিস!”
শারমায়া ভাবতে ভাবতেই বিড়বিড় করে জবাব দিলো,
“আন্ডা তো দেয়নি, কিন্তু মাথাভর্তি ভাবনা দিয়ে দিয়েছে স্যার! বুঝতে পারছি না কিছু!”
“কেন কি হয়েছে? স্যার ডাকলো কেন?”
“আচ্ছা, স্যার কি তোদের এড্রেস নিয়েছে? আই মিন বাসার এড্রেস?”
“না তো…!”
“স্যার আমাকে ডেকে আমার বাসার এড্রেস নিলো। বাবার ফোন নম্বরও।”
বুসরা বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“আল্লাহ! স্যার কি গার্জিয়ানদের ডেকে রেজাল্ট দিবে নাকি!”
“আমিও সেটাই ভাবছি!”
“তাহলে তো আমি গেছি! এইবার ফাজলামো করে যা পরীক্ষা দিলাম! একটা পরীক্ষাতেও ফিফটি মার্কসের উপর আন্সার করিনি!”
“আমিও সেভেন্টি-এইট্টির মধ্যে সবগুলো পরীক্ষা দিলাম। ধুর, বাদ দে। যা হবার হবে। রেজাল্ট খারাপ করলেই পড়ায় মনযোগ বসবে আর ফাইনালে প্রেজেন্টেশন ভালো হবে। ভালো রেজাল্ট করলে তো আর পড়তে ইচ্ছে করে না।”
টেনশনকে আর মেনশন না করে তারা গল্পগুজবে জমে উঠলো। প্রায় দেড় ঘন্টা আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো সবাই। ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল বাজাতে লাগলো শারমায়া। দুই বোনের পছন্দের কলিং বেল লাগানো হয়েছে ফ্ল্যাটে। প্রথমদিকের মিউজিকটা খুব ভালো লাগে তাদের। তাই একবার নয় একাধিকবার বেল চেপে শুনে সেই মিউজিক। আর এমন ঘনঘন বেল বাজানোর কারণে বাবা-মা বুঝেই যায় দুই মেয়ের একজন বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু আজ মা নয়, চেচামেচি করতে করতে দরজা খুলেছে সাফওয়ানা।
“এতোবার বেল বাজাতে হয়! একবার বাজালে কি শুনি না? তোমার মতো ধ্যান্দী মনে করো সবাইকে! এসব ধ্যান্দী ট্যান্দী যে কোথা থেকে আসে বাড়িতে!”
“অই, অই? তুই কাকে কি বলিস? হু? নিজে এসে যে আট-দশটা একসাথে দেন, তখন?”
“তখন কি হয়, তুমি জানো না? তখন তুমিও তো এতো কথাই শুনাও আমাকে! তাই এখন আমার সময় এসেছে।”
“সময় কোথায়? আমি তো দেখছি অসময়! এই অসময়ে তুই বাড়িতে কেন?”
“অই অই! আমি অসময়ে বাড়িতে না। আমার টিচারদের ট্রেইনিং আছে তাই টিফিন টাইমে ছুটি। বরং তুমি অসময়ে বাড়িতে। তোমার তো আরও দুইঘন্টা আগে বাড়ি ফেরার কথা। এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? হুম?”
“তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে!”
“অবশ্যই!”
“তাহলে নেক্সট টাইম থেকে আমার সাথে কলেজে যাবি। জবাবদিহি করতে আমার মুখে ব্যাথা লাগে। তুই বরং নিজের চোখেই দেখে নিবি।”
“ইশ! ঠেকা কত! আমি যেন তার চামচা, যে তার পিছু পিছু ঘুরে খবরাখবর রাখবো।”
“চামচা কেন হতে যাবি? তুই তো আমার চামচী! এজন্যই তো আমার খবরাখবর নেওয়া শুরু করেছিস যে এতোক্ষণ কোথায় ছিলাম না ছিলাম!”
সাফওয়ানা এর উপযুক্ত জবাব খুঁজে না পাওয়ায় মায়ের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“মা, দেখো তোমার বড় মেয়ে কোথা থেকে যেন ঘুরে আসছে। কিছু বলো…!”
ওদিকে মায়ের উল্টো জবাব,
“যেখানে খুশি সেখানে গেছে, তোর এতো মাথাব্যাথা কেন?”
মায়ের উল্টো জবাবে হিজাব খুলতে খুলতে হেসে উঠলো শারমায়া। তার হাসি শুনে সাফওয়ানা রেগে তার মাকে বললো,
“ও, আমি লেট করে এলেই তোমাদের যতো জিজ্ঞাসা! বড় মেয়ের বেলায় উল্টো বিচার! আমার উপর এতো অবিচার কেন তোমাদের? আমি কি নদীর জলে ভেসে এসেছি।”
মায়ের আগে শারমায়া জবাব দিলো,
“তোকে ফুটপাত থেকে কুড়িয়ে এনেছি রে সাফু… হি হি হি..!”
ওদিকে শারমিন সাখাওয়াত ধমক দিয়ে বললেন,
“দুইটারে এমন মাইর দিবো! একটা মিনিটের জন্যও চুপ নেই! একাধারে ঠোকরাঠুকরি লেগেই থাকে!”
শারমায়া হাসতে হাসতে বললো,
“মা, সাফওয়ানাকে কি তোমার কাক মনে হয়ে যে ঠোকরাঠুকরি করবে! আমারও মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, যখন সে নুডলস খায়!”
“আবার!”
শারমায়া হাসতে লাগলো। ওদিকে সাফওয়ানা ফুসতে লাগলো যে বাবা এলে বিচার দিবে। সারাক্ষণ এভাবেই চলে তাদের খুনসুটি। একজনকে ছাড়া অন্যজনের সময়ই কাটে না, আবার দুজন সমজোতায় চলতেও পারে না! ঠেসাঠেসি না লাগলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না! পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া যাকে বলে!
গত সপ্তাহে মডেল টেস্ট শেষ হলো। আগামী সপ্তাহে এইচএসসি পরীক্ষা। আজ মডেল টেস্টের রেজাল্ট এবং এডমিট কার্ড একসাথে বিতরন করা হবে কলেজে। বরাবরের মতো শারমায়া আজও লেট। তার চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে বরাবরের মতো লেট কলেজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। শারমায়ার আসার কথা নয়টায়। সে এসেছে দশটায়। আর শুনতে হয়েছে বন্ধুবান্ধবদের বিদ্রুপ। কিন্তু এতে তার কিছুই আসে যায় না। সে অভ্যস্ত। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা দশটায়। অথচ বন্দোবস্তকারী টিচারদের সবাই এখনো কলেজে উপস্থিতই হয়নি। তারা কেউ না কেউ অনুষ্ঠানের দিন সবসময়ই লেট করে! প্রিন্সিপাল তো যেন হাফ ডে ছুটি কাটিয়ে আসে। তবে আশরাফ স্যারসহ দু-চারজন শিক্ষক আছে যারা যথাসময়ে উপস্থিত থাকে। অবশেষে অনুষ্ঠান শুরু হলো বারোটার দিকে। একে একে প্রত্যেক শাখার রেজাল্ট প্রকাশ হলো।অনেকের রেজাল্ট পূর্বের তুলনায় ভালো হলেও কয়েকজনের রেজাল্ট জঘন্য খারাপ। শারমায়ার গ্রুপই এমন অবতীর্ণে এগিয়ে। এই ভালো গ্রুপের জঘন্য অবস্থা দেখে শিক্ষকগণ হতাশ! আলভী স্যার তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিলো বাকি শিক্ষকদের কাছে। তবে এতে শিক্ষকরা তিরস্কার করা বন্ধ রাখেনি! তাদের একত্রে অফিস রুমে ডেকে চ্যালেঞ্জ নিতে বাধ্য করেছে যে, ফাইনাল রেজাল্টে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত রেজাল্ট নিয়ে কলেজে আসতে হবে। নতুবা কলেজে পা রাখবে না। সাথে সাবধানও করে দিলেন ভবিষ্যতে যেন এমন ফাজলামো করে পরীক্ষা না দেয়! মডেল টেস্ট হোক আর যাই হোক! কোনো পরীক্ষাই এমন ফাজলামোর জন্য নেওয়া হয় না। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য তারা কতটা প্রস্তুত কেবল তা যাচাইয়ের জন্যই নেওয়া এই পরীক্ষা।
জবাবদিহি করতে হবে তা জানতো কিন্তু এমন অপমানিত হতে হবে তা জানা ছিলো না! যার ফলে সকলেরই মন খারাপ। ইচ্ছে তো করছে এখনই বাড়ি ফিরে বই ভাজা ভাজা করে ফেলুক! কিন্তু এডমিট কার্ডের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে এখন। যাদের রেজাল্ট ভালো তারা হাসিখুশি আর কেবল তাদের গ্রুপের মেজাজ মহাদুঃখী। তাদের সবার ফ্যামিলির ফোন নং নিয়েছে রেজাল্টের অবস্থা এবং চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানানোর জন্য।
অফিস রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো থোকা থোকা মানুষজন সবাই তাকিয়ে আছে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে। ব্যাপারটা কি তা বুঝার জন্য বুসরা অন্য একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রিন্সিপালের রুমের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে কেন? কি হয়েছে?”
“জয় স্যার এসেছে।”
“জয় স্যার কে?”
“কে আবার! জয় স্যার, জয় স্যারই।”
বুসরা কিছুই বুঝতে পারলো না। এমন জবাব দিয়ে এদিকে মেয়েগুলোও হাসতে লাগলো। আর তাদের গ্রুপের কাছে মেন্টাল বলে আখ্যায়িত হলো। মেন্টালদের কাছে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বিষয়টি বুঝার জন্য তারা প্রিন্সিপালের রুমের দিকে অগ্রসর হতেই দেখলো একটি ছেলে সানগ্লাস পড়তে পড়তে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছে। মুখে ঝুলে আছে হাসি। ফর্সা চেহারায় কালো সানগ্লাসে দারুণ লাগছে আর মেয়েরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। নিধি বলে উঠলো,
“ও! এই স্যার!”
তার উক্তিতে শারমায়ার প্রশ্ন,
“এই স্যার মানে? কলেজে নতুন স্যার এসেছে?”
“না, অনেকেই স্যার বলে। কীজন্য বলে সেটা জানি না। হয়তো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তবে প্রিন্সিপালের সাথে আরও একদিন এসেছিলো কলেজে, বৃষ্টির দিনে। তোরা আসিস নি সেদিন। ওইযে, আমি যে একা একা ক্লাস করলাম। ”
“তো এখানে আসে কেন? প্রিন্সিপালের ছেলে নাকি?”
“হবে হয়তো ছেলে কিংবা কোনো আত্মীয়। তবে আমি ফিদা!”
“লুচি মেয়ে! ফর্সা ছেলে দেখলেই তুই ফিদা!”
নিজেরা দুষ্টুমি করে সমানতালে হেসে উঠলো। আশেপাশে কারো কারো মুখে ছেলেটির নাম জানার আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে আবার কারো কারো মুখে শুনা যাচ্ছে,
“ওফ্ফ! মাই ক্রাশ চলে যাচ্ছে!”
নানান কথার সাথে সাথে গেইটের বাইরে বেরিয়ে লাল রঙের গাড়িতে উঠে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলো মেয়েগুলো। পরনেও লাল টিশার্ট । যেকেউ ভেবে নিবে প্রিয় রঙ লাল। শারমায়া ছেলেটার দিকে যতক্ষণ না তাকিয়েছে তার চেয়ে বেশি তাকিয়ে দেখছিলো ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের কান্ডকারখানা! আর মনে মনে হেসেছে এই ভেবে যে, তাদের ক্রাশ তো তাদের দিকে ফিরেও তাকালো না! যদিও জয় স্যারের স্মার্টনেস প্রশংসার মতো তবুও ক্রাশিতদের অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে শারমায়ার!