“হালাল প্রেম” পর্ব- ৪৩

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৩
(নূর নাফিসা)
.
.
এয়ারপোর্ট থেকে জোভান ও তার বাবা সাখাওয়াত সাহেবের সাথে শারমায়াদের বাসায় এসেছে। সাখাওয়াত সাহেবের মনটাও বেশ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। হয়তো কেঁদেছেনও মনে মনে। বাবারা তো আর হাউমাউ করে কাঁদতে পারে না। শারমায়ার ব্যাপারে নিজেরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে শারমায়ার পরিবার হতে বিদায় নিলো বাবা ছেলে। আসার সময় সাফওয়ানা জোভানকে ডেকে গতরাতে আনা লাগেজটা ধরিয়ে দিয়েছে। লাগেজ আর নিলো না তার প্রিয়া। অযথা আনিয়েছে। তখন না বুঝলেও জোভান পরে বুঝতে পেরেছে লাগেজ নয়, বরং তার প্রয়োজন ছিলো। মন্দ লাগেনি তার পাগলামো। কিন্তু এমন পাগলামো করে মনের শূন্যতাটা যে আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়ে গেলো।
গাড়িতে লাগেজ তুলে দিয়ে বাবাকে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে জোভান চলে গেলো কর্মস্থলে। শারমায়ার বাসায় থাকতে ইফাজ কল করে বলেছিলো ফ্রি থাকলে যেন অফিস যায়। তারও ভাবনা, কাজে ব্যস্ত থাকলে হয়তো শূন্যতার অনুভূতি থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যাবে। পথ চলতে চলতে এতো বিষন্নতার মাঝেও অভিমানী শেষ দৃষ্টির সাথে তার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তকে মনে পড়ছে বারবার। সকালে তৈরি হয়ে রুম ছেড়ে বের হওয়ার পূর্বে শত অভিমান নিয়ে শারমায়া দৌড়ে এসে তার গলা ঝাপটে ধরে গলায় সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিয়েছিলো। তার পরপরই জোভান তার কপালে ও ঠোঁটে উষ্ণ ছোয়া দিয়েছে। এর ফলে শারমায়া কয়েক সেকেন্ড নিরবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। কামড়টা এমন জায়গায় দিয়েছে যে শার্ট পরা সত্ত্বেও লক্ষ্য করলে বুঝা যায়। সে সূত্রেই গলায় রুমাল বেঁধে রেখেছে সকাল থেকেই।
পথে সাদাত কল করে জিজ্ঞেস করেছে শারমায়া চলে গেছে কি-না। অফিসে আসতেই ইফাজ বললো,
“হোয়াটস আপ ব্রো? মন কি খুব বেশিই খারাপ?”
জোভান ঠোঁটের কোণে বেদনাগ্রস্ত হাসি ফুটিয়ে তুললো। শার্টের কলারের অভ্যন্তরে জোভানের গলায় রুমাল বাঁধা দেখে মিরাজ বললো,
“কিরে! শীত না আসতেই গলায় পট্টি? ভাবি চলে গেছে বলে কি কান্না করে গলা ভেঙে ফেলেছিস নাকি?”
“সবসময় তোর ফাজলামো না করলেও চলবে।”
“করি না একটু মন ভালো করার বৃথা চেষ্টা।”
“প্রয়োজন নেই। যেটা করা প্রয়োজন সেটা কর।”
“গল্পসল্পই তো আমাদের পেশা। কাস্টোমার এলে কাস্টোমারের সাথে গল্প, নয়তো নিজেদের মধ্যে।”
ইফাজ বললো,
“মিরাজ, কিছু নিয়ে আয় খাওয়া যাক। জোভান খায়নি বোধহয় কিছু।”
জোভান বললো,
“না, খেয়েছি আমি। তোরা লাঞ্চ করেছিস?”
“হুম, করেছি। হজম হয়ে গেছে। মিরাজ যা তো।”
মিরাজ চলে গেলো। জোভান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পেপার ওয়েট ঘোরাতে লাগলো টেবিলে। ইফাজ বললো,
“ফ্লাইট কয়টায় ছিলো?”
“এগারোটায়।”
“তারমানে দশটা চৌত্রিশে ভাবি এয়ারপোর্টের ভিতরে?”
“হুম, সাড়ে দশটার দিকে সে ওয়েটিংরুম ছেড়েছে। কিন্তু দশটা চৌত্রিশের ঘটনা কি?”
“দ্যাটস মোস্ট পাওয়ারফুল লাভিং ইভেন্ট।”
কথাটা বলেই ইফাজ মুচকি একটা হাসি দিয়ে নিজের ফোনটা জোভানের সামনে ধরলো। জোভান ফোনে তাকিয়ে শারমায়ার নম্বর হতে আসা মেসেজ দেখলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। আমি চলে যাচ্ছি, আপনারা সবসময়কার মতো ভালো থাকবেন। জোভান আজ অনেক হার্টেড। তার মনটা ভালো করতে তার সঙ্গ দিবেন প্লিজ। তার ভেতরের চাপা ডিপ্রেশনটা যেন বেরিয়ে আসে। নয়তো সে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
ফোন হাতে নিয়ে লেখাটা জোভান তিন-চার বার পড়লো এবং ডিলিট করে দিলো। ইফাজ বললো,
“তুই মন খারাপ করে থাকবি, সেই চিন্তায় ভাবিও ভালো থাকতে পারবে না। আই হোপ ব্যাপারটা ইজিলি নিলে সবাই ভালো থাকতে পারবি।”
একটু থেমে ইফাজ আবার বললো,
” সন্ধ্যায় একটা পার্টি এরেঞ্জ করলে কেমন হয়?”
জোভান বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাতেই ইফাজ শব্দযোগে হেসে উঠলো। স্পিড ক্যান ও প্যাটিস হাতে মিরাজকে আসতে দেখে ইফাজ বললো,
“মিরাজ, আজ কলাবাগানে ডিনার হবে। জোভান ট্রিট দিবে। আউটলুকে সেল্ফিশুট হবে, আর সেগুলো ভাবির কাছে পৌঁছাবে।”
“ওপ্স! থ্যাংকস মেরে ভাই। কতোদিন হলো তুই ট্রিট দেস না!”
বলতে বলতে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে মিরাজ জোভানের গলা জড়িয়ে ধরলো। জোভান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই মিরাজ তাকে ছেড়ে দিয়ে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“ওকে, যা। ছেড়ে দিলাম। তবে ট্রিট দিস কিন্তু, হুম?”
“ইফাজ বলেছে যেহেতু ইফাজই দিবে।”
ইফাজ হেসে বললো,
“এইযে, এখন আমি দিলাম। রাতে তুই দিবি কনফার্ম। নয়তো ছিনতাই হয়ে যাবি।”
গল্প করতে করতে খাওয়া শুরু করতেই মিরাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বললো,
“ভাই, আমার চোখ শুধু ওইটাতেই যাচ্ছে। এইটা খুলে ফেল তো।”
বলতে বলতে সে-ই জোরাজুরি করে খুলে ফেললো। রক্ত জমাট বাঁধা অংশ চোখে পড়তেই মিরাজ হা হয়ে গেলো! সে বিস্ময়ের সাথে বললো,
“লাভ বাইট?”
“হুম, আরও দেখবি?”
জোভান শার্ট খুলে শরীরের কয়েকটা আচড় দেখাতেই মিরাজ ঢোক গিললে জোভান বললো,
“এবার খুশি?”
“উহুম, শকড! দোস্ত, বিয়ে করলে এসবও সহ্য করতে হয়? তোর শান্তশিষ্ট বউটাই এই অবস্থা করেছে তাহলে আমার অশান্তিটা আমাকে কি করবে! আমি তো ছেড়া রুটি হয়ে যাবো! এই যে ভাই দেখ তোরা, কান ধরলাম এই জীবনে আমি বিয়ে করবো না।”
“তুই বিয়ে করবি না? তোর ঘাড়ে একটা না, দুইটা না, তিনটা না। চারটা বউ পড়ুক। আর দিনে চার বেলা তোকে আছাড় মাড়ুক।”
ইফাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললো,
“আমিন। জোভানের দোয়া কবুল হোক, মিরাজের ঘরে চার সতিন আসুক, সাথে চার হালি বাচ্চা ফ্রী। সারাদিন আনলিমিটেড স্লোগান, আব্বা, আব্বু, বাবাই, ডেডি, পাপা, পেঁপে… ”
এতোক্ষণ যাবত ফাজলামোর কারণে তাদের উপর রাগ দেখালেও শার্ট পরতে পরতে ইফাজের কথায় এবার একটু হাসলো জোভান। ওদিকে মিরাজ তার গার্লফ্রেন্ডকে সাথে সাথেই কল করে বলতে লাগলো,
“বাবুই, টিয়া, ময়না, আমরা সারাজীবন প্রেম করবো কিন্তু বিয়ে করবো না। ঠিক আছে?”
“কথার আগা গোড়া কিছুই নেই, কিসব বলছো? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
“এতোক্ষণ ভালোই ছিলাম, এখন দুর্ঘটনাবশত হয়ে গেছি পাগল।”
“মানে?”
“মানে কিছু না। প্রেমজীবনে একটু স্পেশাল টাস্ক রাখতে চাইছি। ওকে, পরে কথা হবে। বায়…”
রাতে কলাবাগান রেস্টুরেন্টে ডিনার হলো জোভানের পকেটের টাকাতেই। তবে জোভানের পকেটে টাকা কম থাকায় কিছুটা ভর্তুকি দিতে হয়েছে মিরাজকেই। আর সেটা আদায় করে নিয়েছে ইফাজ। মিরাজ নিজের বাসায় চলে গেলেও ইফাজ আজ জোভানের বাসায় চলে এসেছে। জোভান তার কারণ জানতে চাইলে সে জবাব দিলো,
“তোর মন পাহাড়া দিতে হবে। ভাবির আদেশ তো। অমান্য করা যাবে না।”
বাসায় ফিরে ইফাজ জুলেখা ইয়াসমিনের সাথে গল্প করতে থাকলে সে শাওয়ার নিয়েছে। বাইরে থেকে খেয়ে আসায় বাসায় আর কিছু খেলো না। একে তো মন খারাপ, গত রাতে ঘুম হয়নি বিধায় শরীরটাও নিস্তেজ। কিন্তু রাতে ঘুম নামছে না চোখে। তার চোখের ঘুম কেড়ে নিতে শারমায়ার শেষ দৃষ্টিটাই যথেষ্ট। আজও রাতের অধিকাংশ সময় গল্প করে কাটালো ইফাজের সাথে। বেস্টের মাঝেও কিছু বেস্ট থাকে। অনেক ফ্রেন্ডের মাঝে তারা চারজন বেস্ট ফ্রেন্ড। আর এই চারজন বেস্ট ফ্রেন্ডের মধ্যেও ইফাজ একটু বেশিই বেস্ট। ইফাজের সাথে জোভানের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। তারা একে অপরের মাঝে মনের অনেক কথাই শেয়ার করে যা সবার সাথে করা যায় না। আজ বেদনার কিছু কিছু কথা শেয়ার করে জোভানের মন অনেকটা হালকা হয়েছে। ইফাজও তার জীবনের প্রায় সব ঘটনাই সে জোভানকে জানায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here