হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
১৮.
হিমির শিওরে জড়সড় হয়ে বসে আছেন মুহিব রহমান। দুপুরে জ্বর ছেড়েছে অনেকটা। তবে গা গরম এখনো। আপাতত বেঘোর হয়ে ঘুমোচ্ছে সে। তীব্র অপরাধ বোধ কাজ করছে মুহিব রহমানের মাঝে। মেয়ের শীর্ণ ফ্যাকাসে মুখের দিকে নির্বিকার ভঙ্গীতে চেয়ে আছেন। দু একবার মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমিনা বেগম ক্ষনিক পর পরই কপালে ঠান্ডা তোয়ালে ছুঁয়াচ্ছেন। পায়ের তলায় তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। গরম খাবার খাওয়াচ্ছেন। তবে হিমির দূর্বলতা কমে নি। নিজে থেকে উঠে বসতে অব্দি পারে না সে। মুহিব রহমানের মনটা বিষিয়ে উঠে। মেয়েকে সামান্যতম ভালোবাসা দিতে অক্ষম বাবার এর চেয়ে আর কিই বা করার আছে? তিনি ভাবেন। ভাবনার অন্ত নেই।
_______________
সন্ধ্যে ঘনিয়েছে। বসার ঘরে চায়ের আসর জমেছে। কলিং বেল বাজতেই কাজের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। হাতে বড়সড় এক ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে মিশ্মি। রোশন আরা মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকান। মিশ্মি তা পরোয়া করে না। অনাহিতা নাহার মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন,
‘এর সন্ধ্যে বেলা কার সাথে এলি তুই মিশু? একা? তোর বান্ধবী এখন কেমন আছে?’
মিশ্মি শুকনো হেসে জবাব দেয়,
‘ভালো আছে। তাই চলে এলাম।’
রোশন আরা মেয়েকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলেন,
‘ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। কাল অথৈরা আসবে। কাজে হাত লাগাও এসে।’
মিশ্মি মাথা দুলিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে। ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো হতে দেখতে পারতো না বলেই বান্ধবীর অসুস্থতার মিথ্যে নাটক সাজিয়ে বিয়ের দিন সকাল বেলাতেই চলে গেছিলো মিশ্মি। সে নাটকের ইতি ঘটেছে অথৈর রিসেপশনের পর। না চাইতেও সব মেনে নিতে হবে মিশ্মিকে। মিশ্মি জানে এসব খুব কঠিন। ইয়াসিরকে অথৈর সাথে দেখলে বুক ফেটে কান্না আসে তার, শরীরে কাঁপুনি ধরে, অসার হয়ে আসে শরীর। তবুও তাদের সামনে মুখে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে থাকতে হবে তাকে। ভাবতে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে করতে তার থেকেও দ্বিগুন কষ্টের হবে। মিশ্মির মনে প্রশ্ন জাগে, ইয়াসির কি কখনোই বুঝে নি ওই মেয়েটা মিশ্মি ছিলো? কখনোই কি মিশ্মির অনুভূতির সম্মান করতে পারে নি? কাউকে ভালোবাসার পরিণাম যে এতো ভয়ানক শাস্তি হতে পারে জানতো না মিশ্মি। জানলে হয়তো কখনো ভালোই বাসতো না সে।
____________
মতিউর রহমানের সামনে আসামির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে দুই তরুণী। দুজনের পরনেই সাদা মাটা থ্রি পিস। চুল পরিপাটি করে আঁচরে বেনি করা। মাথার অর্ধেক ওড়নায় ঢাকা। কাধে ঝুলানো ব্যাগ। হিমিকে দেখতে এসে এভাবে ক্রিমিনালের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, ভাবে নি সোহিনী-দোহা। রাত আটটা বাজার পর মেয়েরা কি করে বাড়ির বাইরে থাকে আর তাদের বাবা মায়েরা কি করে মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা নেই সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনায় লেগেছেন মতিউর রহমান। ওনার কথার সাথে তাল মিলিয়ে রাদিবাও এ যুগের মেয়েদের কিছুটা গোষ্ঠী উদ্ধার করলেন। সোহিনী আর দোহা ঢোক গিলে একে অপরকে দেখলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে একসাথেই বললো,
‘হিমিকে দেখতে যাই?’
মতিউর রহমান সরু চোখে তাকালেন। দুজনকেই আগাগোড়া দেখে বললেন,
‘যা জিজ্ঞেস করেছি আগে তার উত্তর দাও। বাবা মাকে কি বলে এসেছো তোমরা? এতো রাতে এলে কি করে এতোদূর? কে দিয়ে গেছে?’
দোহা কিছু বলতে নিলেই সোহিনী তার হাত চেপে ধরে। শীতল গলায় বলে,
‘আম্মু আব্বুকে বলেছি বান্ধবীকে দেখতে যাবো। ওর অসুখ। প্রথমে এলাও করেন নি। পরে ভাইয়াই নিয়ে এলো আমাদের।’
মতিউর রহমান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘দুজনেরই ভাইয়া?’
‘জি না দাদু। ভাইয়া তো আমার। দোহাকে তো ওর বাবা দিয়ে গেছেন।’
‘দিয়ে গেছেন! বাড়ির ভেতরে এলেন না কেনো তবে?’
সোহিনী জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দোহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। দোহা তরিঘরি করে বললো,
‘বাবার কাজ ছিলো দাদু। এবার যাই। তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে মা বকবে।’
মতিউর রহমান এবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তাদের দিকে। তাদের বাবা মা স্ট্রীক্ট আছেন শুনে স্বস্তি পেলেন। মাথা নেড়ে তাদের ভেতরে যেতে সায় দিলেন। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে দুজনেই হিমির শোবার ঘরে ঢোকলো। হিমি তখন বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলো। সোহিনী আর দোহাকে দেখে গোল গোল চোখে তাকালো। দুজনে ঘরে ঢোকে দরজা ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার পাশেই। হিমি কৌতুহলী গলায় বললো,
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো তোরা? ভেতরে আয়!’
সোহিনী চাপা স্বরে বললো,
‘দাঁড়া আগে ওরা তো আসুক।’
হিমি বুঝার চেষ্টা করলো কাদের কথা বলছে সোহিনী। হঠাৎই চোখ মুখ উজ্জল করে স্মিত গলায় বলে উঠলো দোহা,
‘এসে গেছে এসে গেছে। সর সর দরজা আটকা।’
হিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দরজার বাইরের দিকে তাকাতেই দেখা গেলো নিচু হয়ে দৌড়ে এসে ঢোকলো মেঘ। তার পিছু পিছুই ইমন আর সূর্যর প্রবেশ। হিমি চমকালো এবার। বার কয়েক চোখ পিট পিট করে বললো,
‘তোরা কি করে এলি? দাদু কিছু বলে নি?’
সূর্য ক্লান্ত ভঙ্গীতে খাটে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে বললো,
‘তোর দাদু দেখলে তো!’
হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাকিদের দেখলো। মেঘ টি টেবিল থেকে পানির বোতল উঠিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে শান্ত হয়ে বসলো। ইমন হিমির বিপরীতে বসে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
‘এখানে আসার জন্য কতো প্ল্যান যে করেছি তার হিসেব নেই। শেষমেষ এই প্ল্যান কাজে দিলো।’
‘প্ল্যান কার দেখা লাগবে না!’
শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিয়ে কথাটা বললো মেঘ। হিমি অসহায় গলায় বললো,
‘আরে ইয়ার! কি প্ল্যান সেটা তো বলো!’
‘তোর দাদু যখন আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন কৌশলে বড়মা বাড়ির পেছনের দরজা খোলে দিয়েছিলেন। ওরা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলো এতক্ষন। আমরা তোর ঘরে আসতেই বড়মা বসার ঘরের পর্দা ফেলে দিয়েছেন আর এই খচ্চর গুলা সোজা তোর ঘরে প্রবেশ করতে সক্ষম!’
সূর্য পাশে রাখা বালিশ ছুড়ে দিলো দোহার দিকে। সেটা সজোরে মুখে গিয়ে লাগলো তার। অস্ফুট স্বরে ‘আহ’ বলেই তেড়ে এলো দোহা। সোহিনী আটকে দিলো তাকে। থমথমে গলায় বললো,
‘গাইজ স্টপ ইট। আমরা হিমিকে দেখতে এসেছি ঝগড়া করতে না। আর তাছাড়া বড়মা ছাড়া আর কেউ জানে না ঘরে ছেলেরা আছে। জানলে উপায় নেই। আস্তে আস্তে কথা বলতে হবে আমাদের।’
হিমি খুক খুক করে কাশতেই কাধে হাত রাখলো সোহিনী। মেঘ পানির বোতল এগিয়ে দিলো। হিমি পানি খেলো না। গলা কেশে বললো,
‘দাঁড়িয়ে না থেকে বস। বেশিক্ষন তো থাকবি না।’
‘না রে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তোর দাদু বাইরে বসে আছে। নির্ঘাত তোর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। উফ, এতো সেকেলে কেনো?’
দোহার কথায় হাসে হিমি। সে জানে দাদু সেকেলে নয় বরং রাগি, গম্ভীর আর ভীষন ডিসিপ্লীন। যদিও এসব শুধু হিমির ক্ষেত্রে। তবুও আক্ষেপ নেই হিমির। সূর্য চোখের দৃষ্টি সিলিংএর দিকে স্থির করে বলে,
‘জ্বর বাঁধাইলি কেমনে?’
‘কি জানি! হুট করেই,,,’
‘হুট করেই না হিমি। নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করছিলি কিছু নিয়ে। খাওয়া দাওয়াতেও তো অনিয়ম করিস। যদি বড় কোনো অঘটন হতো!’ (দোহা)
‘সেটাই তো ও চায়। নিজের খেয়াল রাখলে পৃথিবীর একাংশ ডুবে যাবে কি না!’ (ইমন)
‘ডাক্তার দেখিয়েছিলি?’ (মেঘ)
‘না। একজন ডাক্তার নিজ দায়িত্বে ঔষধসহ আমায় আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে গেছেন। এখন তো সুস্থই!’ (হিমি)
‘কোন ডাক্তার?’ (ভ্রু উচিয়ে কথাটা বললো সূর্য)
‘ওই যে সোহিনীর বফের নাম্বার ভেবে যাকে কল করেছিলাম! সেই ডাক্তার।’
বন্ধুমহলের চোখ ছানাবড়া। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন, সেই ডাক্তার হিমিকে পেলো কোথায়? সূর্য সবার তরফ থেকেই প্রশ্নটা করলো। জবাবে হিমি অলস ভঙ্গীতে বললো,
‘বলতে পারবো না।’
সাথে সাথেই তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললো দোহা,
‘কেনো কেনো? বলতে পারবি না কেনো? ওই ডাক্তার তোকে বলতে মানা করেছে? উনি মানা করলেন আর তুই শুনলি! এসবের মানে কি হিমি?’
দোহা থামতেই ইমন খোঁচা মারা গলায় বললো,
‘তুমি দেখি মামা ছুপা রুস্তাম! প্রেম পিরিতি সেরে ফেলছো এইদিকে আর আমাদের বলো ‘এসব প্রেমের মতো ফাউল কাজে আমি নাই’! বাহ বাহ! কালে কালে আর কতো কি দেখবো।’
হিমি হতভম্ব চোখে তাকালো এবার। সোহিনী দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,
‘দোস্ত! তুই আমাদের এভাবে ধোয়াশায় রাখবি? আমরা কি খুব বড় প্রশ্ন করে ফেললাম না কি? খালি জানতে চাইলাম ডাক্তার বাবু তোকে কোথায় পেলো? তুই এইটুকু কথার জবাব দিতে পারছিস না!’
হিমি খেঁকিয়ে উঠা গলায় বললো,
‘চুপ করতো। আশ্চর্য! আমি বলি কি আর এরা বলে কি! ডাফার। আমি “বলতে পারবো” দ্বারা এটা বুঝাই নি যে বলতে মানা বরং এটা বুঝিয়েছি যে আমার মনে নেই কোথায় তিনি আমায় পেয়েছেন, কি করে এখানে এনেছেন। বড়মা বললো একজন ডাক্তার দিয়ে গেছেন আমায়। তিনি আমার নামটাও জানেন। আর তার যা ডেস্ক্রিপশন বড়মা দিয়েছে তা থেকে আমি শিওর ওই ওই ডাক্তার! বুঝছো গাধাদের দল?’
সবার মুখ চুপসে গেলো মুহুর্তে। দরজায় হালকা ঠখঠখ আওয়াজ হতেই ছেলেরা হুরমুরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দোহা সোহিনী ঢোক গিলে হিমিকে দেখছে। হিমি ভড়কে গেছে। কে হতে পারে বুঝতে পারছে না ঠিক। মেয়েদের থেকে সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে তিনজন ছেলেই মেঝেতে চিৎ শুয়ে পরলো। হাত পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে খাটের তলায় আশ্রয় নিলো। দোহা এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খোললো। ভেতরে ঢোকলেন আমিনা বেগম। ভয়ার্ত চেহারায় ঘরে চোখ বুলিয়ে বললেন,
‘তোমাদের বন্ধুরা কই? জলদি পালাতে বলো। আব্বা হয়তো হিমিকে দেখতে আসবেন এখন। তোমরাও বেরিয়ে পরো সময় থাকতে। কোথায় ওরা?’
হিমি চোখের ইশারায় খাটের নিচে ইশারা করতেই সোহিনী আর দোহা নিচে ঝুঁকে তাদের বেরিয়ে আসতে বললো। একে একে বেরোলো মেঘ, সূর্য আর ইমন। আমিনা বেগম দোহা আর সোহিনীকে আগে বাইরে গিয়ে বসার ঘরে সবার থেকে বিদায় নিতে বললেন। আসলে বিদায়ের বাহানায় তাদের ব্যস্ত রাখার ছক কষেছেন। ওই সময়টাতেই ছেলেদের রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেবেন তিনি। ওনার কথামতোই দোহা সোহিনী হিমির থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে চলে গেলো। ছেলেরা ওত পেতে রইলো, কখন সবার চোখ এদিক থেকে সরবে। আমিনা বেগম দরজা হালকা ফাক করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা সুযোগের অপেক্ষা শুধু, তারপর সব ঠিক।
________________
‘তাহির?’
‘হ্যা মা!’
‘এই অসময়ে কোথায় বেরচ্ছো?’
‘হাসপাতালে এমার্জেন্সি!
‘মিথ্যে কথা বলো না তাহির। তুমি জানো আমি মিথ্যে সহ্য করতে পারি না। তুমি এও জানো আমি তোমার উপর রাগ করতে পারি না। সুতরাং এমন কিছু করো না যার কারনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো। আমি বসছি এখানেই। আজ আর ঘুম হবে না। যাও।’
মায়মুনা জামানের শীতল কন্ঠে বলা ভারি কথা গুলো শুনেই বুক ধ্ক করে উঠলো তাহিরের। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা দুলিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো সে। অস্থির লাগছে খুব। ভেতরটা জ্বলছেও ভীষন। কাউকে ফিরিয়ে দেয়াটা বুঝি খুব কষ্টের! খুব করুণ! তাহির নিজেকে বুঝায়, তাকে মায়ের মতো কঠোর হতে হবে। কারো কান্নায় বুকে হাহাকার হবে না। কারো কথার মারপ্যাচে আটকে যাবে না। শক্ত করতে হবে নিজেকে। এতোটাই শক্ত যেনো দীর্ঘশ্বাসগুলো জমাট বেধে ভেতরেই মিলিয়ে যায়।
চলবে,,,,,,,