হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০২.
ভার্সিটি চত্বরে ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে আছে একদল ছেলে মেয়ে। চেহারায় তাদের সুখী সুখী ভাব। আজকের ক্লাসটেস্ট সবারই ভালো হয়েছে। অথৈ উৎসাহিত কন্ঠে বললো,
“এই আজ কে ট্রীট দিবি রে?”
নীতু বিষ্মিত কন্ঠে বললো,
“কিসের ট্রীট?
“কিসের আবার? পরীক্ষা ভালো হয়েছে সো ট্রীট তো চাই ইয়ার!”
অথৈয়ের জবাবে নীতু মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
“আমার পরীক্ষা তো ভালো হয় নি। যার পরীক্ষা ভালো হয়েছে সে দিক। আমি ওসবে নেই।”
তৎক্ষনাৎ গর্জে উঠলো লিজা,
“থাপ্পড় খাবি হারামী! ট্রীট তো তুইই দিবি। ভুলে যাস না আজ তোর দেয়ার কথা ছিলো!”
“আমার? কেনো? আমার কেনো?”
“কেনো মানে? তোর কি স্মৃতিশক্তি লোপ পাইছে? তোর পয়দা দিবসে এক গাদা টাকা খরচ করে গিফ্টের মেলা লাগাইছিলাম। পরিবর্তে তোর ট্রীট দেয়ার কথা মনে নাই? গিফ্ট তো একটাও ছাড়োছ নাই আর ট্রীটের বেলায় ন্যাকামো!”
পলাশের কথার রেশ ধরে সবাই চাপ দিতে লাগলো নীতুকে। বেচারি শেষমেষ রাজি হলো। অথৈ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“বান্ধবী আমরা কিন্তু সমুচা, সিঙারা আর চা খেতে যাচ্ছি না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভর পেট খাবো।”
নীতু অসহায়ত্ব নিয়ে দেখলো সবাইকে। অথচ তারা অনায়াসেই নীতুর অসহায়ত্ব হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বসে আছে। নীতু অনেক ভেবে মেনে নিলো তাদের কথা। অথৈরা উঠে দাঁড়াতেই কালো রঙের বাইক এসে ব্রেক কষলো তাদের সামনে। বন্ধুমহল ঘাবড়ে গেছে তাতে। বাইক চালক মাথা থেকে হেলমেট খোলে দু হাতের তালুতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। থমথমে গলায় বললো,
“মামানি কল দিচ্ছে কখন থেকে। উঠাস না কেনো?”
হিমির প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অথৈ। তাড়াহুড়া করে ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে চোখ বুলায় তাতে। মায়ের সাত খানা মিস্ড কল! হিমি বিরক্তি নিয়ে বললো,
“এতোক্ষন যখন ফোন চেক করিস নি এখন করারও কোনো দরকার নাই। চল জলদি। আমার কাজ আছে।”
অথৈ দ্বিধা নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকালো। পলাশ বিরোধীতা করে বললো,
“অথৈ এখন যেতে পারবে না।”
হিমি স্থির নয়নে তাকিয়ে বললো,
“কেনো?”
পলাশ ঢোক গিলে বললো,
” আমরা একটু খাওয়া দাওয়া করবো। দেরি হবে তো।”
হিমি চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে বললো,
“তোমরা খেয়ে নাও। ও এখন বাড়ি ফিরবে। মামানি ডেকে পাঠিয়েছে দেরি হলে দু চার ঘা খেতে পারে।”
বন্ধুদের মুখ ছোট হয়ে গেলো। তারা জানে হিমি চাইলেই অথৈকে রেখে যেতে পারে। অথৈয়ের মাকেও সামলে নিতে পারে। কিন্তু সে করবে না। কোনো কারনে হয়তো রেগে আছে হিমি। চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে ঠেকছে তার। হিমি শান্ত গলায় বললো,
“তুই আসছিস?”
অথৈ এক মুহুর্ত না ভেবে চটপট বাইকে চেপে বসলো। সাই করে বেরিয়ে গেলো হিমির বাইক। পলাশ, নীতু, লিজা, তপন, সৃষ্টি সবাই আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
_________________
অথৈকে বাড়ি পৌঁছিয়ে আবারও বাইক ছুটিয়ে চলছে হিমি। মেয়েদের বাইক চালানোয় হাজারও আপত্তি থাকে সমাজের। কিন্তু হিমির পরিবারের নেই। তার দুই পরিবারই তার কোনো কার্যকলাপে আপত্তি করে না। আবার প্রশংসাও করে না। বাধাও দেয় না আবার পরামর্শও দেয় না। তারা আসলে হিমিকে নিয়ে কিছুই ভাবে না। হিমিকে নিয়ে ভাবার একমাত্র সেই আছে। ভাবলেই হাসি পায় হিমির। মুঠোফোন তুমুল ধ্বনি তুলে বাজতে লাগলো। হিমি বাইক দাঁড় করিয়ে হেলমেট খোলে রাখলো । পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ঠেকালো সে। ওপাশ থেকে সোহিনী কিছু বলবে তার আগেই হিমি বলে উঠলো,
“পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে। অপেক্ষা কর তোরা। আসছি।”
তারপর ফট করে কেটে দিলো ফোন। অন্য পাশের ব্যক্তিরও যে কিছু বলার থাকতে পারে তা হিমির মাথায় এলো না। সে আপন গতিতে চলছে আবার। রাস্তার পাশে বড় এক গাড়ির সামনে ডক্টর তাহিরকে দেখে বাইক থামালো হিমি। উজ্জল শ্যামবর্ণ গায়ে হলদে শার্ট। পরনে জিন্স, কালো শু। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, বাম হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি, ডান হাতে এপ্রোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। তাকে ভালো করে নিরক্ষন করেও সেদিনের আগে কোথায় দেখেছে তা হিমি মনে করতে পারলো না। পায়ে দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাইক নিয়ে দাঁড়ালো লোকটার সামনে। তাহিরের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে এই অসময়ে। আর্জেন্টলি হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। অথচ কোনো গাড়ি রিকশা পাচ্ছে না সে। হিমিকে দেখেই কপাল কুঁচকালো তাহির।
“মে আই হেল্প ইউ ডক্টর?”
তাহির আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে, আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে কিন্তু কিছু পাচ্ছি না যে,,,,”
তাহিরের কথার মাঝেই হিমি বললো,
“আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।”
তাহির আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বাইকের পেছন উঠে বসলো। হাসপাতাল যাওয়া পর্যন্ত কারো মধ্যে কোনো কথা হলো না। দু একবার হিমির ফোন বাজলেও যথারীতি কেটে গেলো। হিমি কল রিসিভ করে নি। বাইক থামলো সোজা হাসপাতালের সামনের পার্কিং জোনে। তাহির বাইক থেকে নেমে ছোট্ট করে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ জানিয়ে চলে যেতে নিলো। পেছন থেকে হিমি ডেকে উঠলো,
“ডাক্তার?”
তাহির পেছন ঘুরলো। হিমি বাইক সাইডে রেখে দৌড়ে তাহিরের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। খোপা থেকে বেরিয়ে পরা চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বললো,
“আমি কি আপনাকে চিনি? মানে, এর আগে কোথাও দেখা হয়েছে আমাদের?”
তাহির শান্ত গলায় বললো,
“ওই দিন এখানেই দেখা হয়েছিলো। প্যাশেন্ট খোঁজে পাচ্ছিলেন না বলে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন।”
হিমি চটপট মাথা নাড়লো। হাতের উল্টো পিঠে নাকের নিচে জমে থাকা ঘাম মুছে নিয়ে বললো,
“সেদিনের কথা মনে আছে আমার। এরও আগে কখনো দেখা হয়েছিলো কি? আমি মনে করতে পারছি না। আচ্ছা ডাক্তার, আপনারও কি তাই মনে হয়?”
তাহির কপাল কুঁচকে তাকালো। এই মেয়েটা ডাক্তার ডাক্তার করছে কেনো? পাঁচ বছরের ডাক্তারি জীবনে কেউ তাকে ডাক্তার বলে সম্বোধন করে নি। হয় ডক্টর তাহির, নয় ডাক্তার বাবু অথবা সাহেব। অথচ এই মেয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে ডাক্তার ডেকে চলেছে। তাহিরের অস্বস্তি হিমির চোখে পরলো না। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“কি হলো? বললেন না যে?”
তাহির ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললো,
“হ্যাঁ। মিনিমাম দু সপ্তাহ আগে ব্রীজে আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো! তখনই আমার সাথে দেখা। আর সময় দিতে পারছি না। আই হেভ টু গো!”
কথাটা বলে হনহন করে হাসপাতালের ভেতর ঢুকে পরলো তাহির। হিমি অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে দেখছে তাহিরের যাওয়া। দু সপ্তাহ আগের কথা হিমি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো? তার তো এতো ভুলো মন নয়! তবে? পরোক্ষনে ভাবতে লাগলো লোকটাই কি তাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে?
*******
রাত পৌনে বারোটা বাজে। বন্ধুরা সব বাড়ি ফিরেছে দশটায়। হিমিই এখনো রাস্তায় রাস্তায় বাইক নিয়ে ছুটছে। ব্রীজের উপর দিয়ে যেতে নিলেই সামনে থেকে হুট করে চলে এলো এক ট্রাক! পাশ কাটানোর চেষ্টায় বাইক নিয়েই উল্টে পরেছিলো সে। ডান পায়ের গোরালির উপর থেকে ঠাকনু অব্দি চামড়া উঠে গেছে। কনুই, হাতের কবজ্বিও জখম হয়েছে। কোমরেও লেগেছে অনেক। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই মোটেও। বাইকের ডান মিরর টাও ভেঙে গেছে তার। আরো কিছু ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে হয়তো। হিমির তখন এতো ভাবার সময় নেই। কোনোরকম হাটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। কোনো যানবাহনের দেখা মিললো না কয়েক মিনিট। পরে যাও মিলেছে কেউ দাঁড়ায় নি। পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করলো হিমি। মোবাইল অক্ষত দেখে খানিক খুশি হলো সে। তাড়াতাড়ি ডায়াল করলো বড় মামা হানিফ শরীফের কাছে। তিনি তাড়াতাড়ি আসছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। হিমি যখন বাইক টেনে তুলার চেষ্টায় তখনই বিনা নোটিশে সাদা রঙের কার এসে থামলো তার সামনে। হিমি তো তাকে দাঁড়াতে বলে নি। আর না সাহায্য চেয়েছে। তবুও কার থেকে বেরিয়ে এলো ছয় ফুট উচ্চতার এক ব্যক্তি। হিমিকে একপলক দেখেই প্রশ্ন করলো,
“আপনার কি এক্সিডেন্ট হয়েছে? আমি একজন ডক্টর। চাইলে হ্যাল্প করতে পারি।”
হিমি উত্তর দিলো না। নিজের কাজেই ব্যস্ত সে। লোকটি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে নিজের কারে ফিরে গেলো। আবারও ফিরে আসলো হাতে একটা বক্স নিয়ে। হিমির কাছে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে বললো,
“এদিকে আসুন। প্রাথমিক চিকিৎসা করে দিই!”
হিমি ভ্রু কুঁচকালো। ফু দিয়ে মুখের উপর উড়ে আসা চুল উড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আপনার থেকে সাহায্য চেয়েছি আমি? এতোক্ষন ধরে যাদের থেকে সাহায্য চাইলাম তারা তো দাঁড়ালোই না, আর এখন যখন বাড়ির লোক আসছে তখন যেচে পরে একজন এসেছে মায়া দেখাতে। যান তো আপনি। কোনো চিকিৎসার দরকার নেই আমার।”
লোকটা হিমির কথা কানে তুললো না। বরং ওখানেই নিচে বসে পরলো। হিমির ডান পা তুলে নিলো নিজের উড়ুর পর। হিমি ভড়কে গিয়ে লোকটির চুল মুঠো করে ধরলো।
“কি করছেন কি? বলেছি তো সাহায্য চাই না। কেনো যেচে পরে আসছেন বলুন তো? নিজের কাজে যান না রে ভাই!”
না, লোকটার তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। দিব্যি পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে উঠে দাড়ালো। হাত টেনে নিয়ে তাতেও মলম লাগিয়ে দিলো। সব শেষ করে তবেই চোখ তুলে তাকালো হিমির দিকে। মৃদু গলায় বললো,
“ডাক্তারের থেকে কেউ সাহায্য চাইবে তারপর সে চিকিৎসা করবে এ কথায় আমি বিশ্বাসী নই। আমার মতে আমার চোখের সামনে যেকোনো রুগ্ন ব্যক্তি থাকলেই তার চিকিৎসা করা বাঞ্চনীয়! এই স্প্রে টা রাখুন। কোথাও ব্যাথা পেয়ে থাকলে ইউজ করবেন। আর কোথাও লেগেছে?”
হিমি মাথা নাড়লো। কোমরে আর ঘাড়ে পাওয়া ব্যাথার কথা মুখ ফুটে বললো না। লোকটা হিমির বাইক তুলে সাইডে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনাকে নিতে কেউ আসবে? না কি ড্রপ করে দেবো?”
হিমি গমগমে গলায় বললো,
“প্রয়োজন নেই। ফ্যামিলি মেম্বার আসছেন।”
লোকটা ঘাড় ঝাঁকিয়ে কারে চেপে নিজ গন্তব্যে ছুটলো। হিমি দু একবার ডেকেছিলো ফিস দেবে বলে। কিন্তু সে তা না শুনার ভান ধরে চলে গেলো।
******
ওইদিন প্রায় মিনিট পনেরো লোকটার থেকে চিকিৎসা নিলেও নাম জানা হয় নি তার। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় লোকটার চেহারাও মনে গাঁথে নি হিমির। সুতরাং, ভুলে যাওয়াটা ভয়ঙ্কর কিছু না। কিন্তু তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিলো। ভাবনার মাঝে আবারও বেজে উঠলো হিমির ফোন। বিরক্তির শীষ টেনে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর এক কন্ঠ,
“বাসায় আসো!”
ব্যাস। এইটুকু বলেই ফোন কাটলেন হিমির বাবা মুহিব রহমান। হিমি ভেবেছিলো হয়তো তার পল্টনের কেউ ফোন করেছে। কিন্তু বাবার কন্ঠ শুনেই থম মেরে গেলো সে। তাড়াহুড়া করে ফোন পকেটে পুরে বাইকে বসলো। দ্বিগুন স্পীডে উল্টো দিকের রাস্তায় যেতে লাগলো হিমি।
চলবে,,,,,,,,,,