হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৬.
উদ্বিগ্ন চেহারায় মিশ্মি বলে উঠলো,
-তুমি মিথ্যে কেনো বললে আপু?
হিমি শার্টের হাতা গুটালো। কলার ঠিক করতে করতে বললো,
-সত্য বলতাম?
মিশ্মি অস্বস্তি নিয়ে বললো,
-অন্য কিছু বলতে নাহয় আমায় মার খেতে দিতে। তা না করে শুধু শুধু নিহান ভাইয়াকে জড়ালে এতে। এখন যদি জেঠিমা তোমার মামার বাড়ি যায়?
হিমি দায়সারা গলায় জবাব দিলো,
-গেলে যাবে। আমি কি করবো?
-তোমার কোনো দায় দায়িত্ব নেই? নিহান ভাইয়া তো ফেঁসে যাবে। সাথে তুমি বকা খাবে মিথ্যে বলার জন্য। আমার অবস্থা তো বাদই দিলাম।
হিমি শান্ত গলায় বললো,
-তোর কথা বাদ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। তোকে উদুম কেলানি দেয়া উচিত। দিন রাত নিয়ম করে চড় থাপ্পড় লাগানো উচিত বেয়াদব! কখন কি আকাম ঘটাচ্ছিস তার বিন্দু বিসর্গও জানতে দিচ্চিস না। আবার সহজভাবে ধরাও পরছিস। নিজে তো মরবি সাথে যে তোকে বাঁচাতে চাইবে তাকেও মারবি। গাধী কোথাকার।
মিশ্মি যেনো লজ্জা পেলো হিমির কথায়। মুখ নামিয়ে স্মিত গলায় বললো,
-সরি তো।
-তোর সরি দিয়ে আমি আচার বানাবো? চিঠি দিয়েছিস দিয়েছিস সেগুলোর কাগজপত্র রাখতে গেলি কেনো আহাম্মক? ছবি তুলেছিস মানলাম। তা বলে এতো ছবি? একটাতে হয় নি? চেহারাটাও দেখা যায় নি হুদাই টাকা নষ্ট! আর ভাই পুড়াবিই যখন তখন চুলায় দিয়ে দিতি। তা না করে অর্ধেক পুড়িয়ে বাকি অর্ধেক রেখেছিস কোন আক্কেলে?
মিশ্মি মুখ কাচুমাচু করে বললো,
-একসাথে সব পুড়ালে তো অতিরিক্ত ধোয়ায় সবাই সন্দেহ করতো!
-হ্যা আর এখন যেমন করছে না! যা তুই নিজের ঘরে যা।
-আপু?
হিমি হাই তুলে বললো,
-আবার কি হলো?
মিশ্মি চোখে জ্বল নিয়ে বললো,
-যদি সবাই জেনে যায় ছবিগুলো নিহান ভাইয়ার নয় ইয়াসির স্যারের?
-তাহলে কিছুই না। তোকে এক দড়িতে ঝুলাবে আমাকে আরেক দড়িতে ঝুলাবে। তারপর দুম করে মরে যাবো দুজন। তাই বলছি ডিস্টার্ব করিস না। কাজ আছে। জীবন বাঁচাতে হলে এক্ষুনি কাজে লেগে পরতে হবে বুঝলি!
মিশ্মির কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো হিমি। মুঠোফোনে বার বার কারো নাম্বার ডায়াল করছে সে। অপর প্রান্তের ব্যক্তি ফোন উঠাচ্ছে না দেখে অসম রাগ লাগছে তার। কিন্তু এখন মাথা গরম করলে চলবে না। সবকিছু শান্তিতে গোছাতে হবে।
________________
ছয়জনের আড্ডাগ্রুপে আজ সবে চারজন। আড্ডাটা ঠিক জমছে না তাদের। সবার মনই বিষন্ন। রোজকার অসাধারন চা বিস্বাদ। সুন্দর দিনটাও বিশ্রী মনে হচ্ছে। সূর্য চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
-সবকটা হারামী। আরে ভাই, নিজেরে লইয়া ব্যস্ত হবি হ! ব্যস্ততার ফাঁকে একটু খানি সময় আমাদেরও দে নাহয়। তা না করে কয়দিন ধরে লাপাত্তা হয়ে আছে। কোনো মানে হয়?
ইমন চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের উপর দু হাত বেঁধে বললো,
-এখন তাদের উকি মারারও সময় নাই মামা। আর তুমি বলো কিছু সময় আমাদের দিতে!
সোহিনী ক্লান্ত গলায় বললো,
-এই আমাদের সেমিস্টার কবে রে? কোনো আইডিয়া আছে?
সূর্য বড় বড় চোখ করে বললো,
-থাপ্ড়াইয়া তোর দাঁত ফালাই দিমু বেক্কল। আমরা কি নিয়া কথা কই আর তুই কি কস! এখন সেমিস্টার ফেমিস্টার নিয়ে ভাববার সময় নাই এখন ভাবতে হবে ওই দুই শয়তানের খালার সমস্যা কি? দেখা পাওন যায় না ক্যান? পারলে এই বিষয়ে আলোচনা কর নয়তো চুপ করে থাক।
সূর্যের কথায় সোহিনীর ভাবাবেগ হলো না। অলস ভঙ্গীতে টেবিলে একহাত কাত করে রেখে অন্যহাতের কনুই ঠেকালো। গালে হাত রেখে বললো,
-একজন হবু বরের সাথে বাইরে ঘুরতে ব্যস্ত আর অন্যজন পারিবারিক সমস্যার নিচে যাতাকলে পিষ্ট!
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-বুঝলাম না।
সূর্য দুষ্টু হেসে বললো,
-প্রেমিকরা প্রেমিকার চোখের ভাষা বুঝে যায় আর তুমি মামা আমাগো সোহুর কথা বুঝো না! এইটা তো ঠিক না মামা। এই ইমন? মেঘের এই অন্যায় কাজের লাইগা কি করা যায় ক তো!
ইমন সিরিয়াস ভঙ্গীতে বললো,
-থাম তো এখন। ভালো লাগছে না মজা ফজা।
-তা কি ভালো লাগছে? হবু বউয়ের কথা ভাবতে?
মেঘের এহেন কথায় ভড়কায় সোহিনী। গোল গোল চোখে তাকায় ইমনের দিকে। ইমন হাসলো। সূর্য দুষ্টু হেসে বললো,
-কি ভাবো মামা? আমাদের কওন যাইবো না কি কইতে শরম লাগবো?
মেঘ উচ্চস্বরে হাসলো। সোহিনী ভরাট গলায় বললো,
-তুই বিয়ে করছিস? আমাদের জানালি না তো!
-তুই ছাড়া সবাই জানে সোহু।
সূর্যের কথায় এবার রাগ লাগলো সোহিনীর। তারমানে দোহা হিমিও জানে? তবে সে কেনো জানে না? তাকে জানানো হলো না কেনো? অপমানিত বোধ হয় তার। ইমন অপরাধী গলায় বলে,
-সরি দোস্ত। আসলে যখনই এই বিষয় নিয়ে কথা হতো তুই থাকতি না।
-কোথায় থাকতাম আমি?
-ব্যস্ত থাকতি। তোর ওই হারামজাদা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে।
সোহিনী চোখ কপালে তুলে বললো,
-এতো আগে থেকে তোর বিয়ে ঠিক! কার সাথে? এই তুই প্রেম করতি?
ইমন মাথা নাড়লো। বললো,
-প্রেম করার চান্স পাই নি।
-এরেঞ্জ ম্যারেইজ?
সূর্য বলে উঠলো,
-আরেহ না। বন্ধু তো বহু আগে থেকে ডুবে ডুবে জ্বল খেতো। আমাদের জানায় নাই লজ্জায়!(দুষ্টুমি করে)
-এসব কিছু না রে সোহু। খালাতো বোনের উপর ক্রাশ্ড ছিলাম। সেটা সে জানতো। তবে ভাবি নি ব্যাপারটা এতোদূর গড়াবে। কি করে কি হয়েছে সেসবও জানি না। হঠাৎ একদিন বাবা বললো পাত্রী দেখতে যাবে। বিয়ের তারিখও ঠিক করবে। আমি তখনও জানতাম না পাত্রী কে। পাত্রী হিসেবে সুপ্তিকে দেখে ভয়ানক চমকেছিলাম।
-তোর চমক তো এখনো যায় নি ভাই। দিন রাত চমকাচ্ছিস।
মেঘের কথায় হেসে ফেললো ইমন। সোহিনীও হাসলো। তবে মন খারাপ হয়ে গেছে তার। এতোগুলো দিন পর কেনো তাকে জানতে হবে তারই বন্ধুর বিয়ে? কেনো ওরা আগে জানালো না? সোহিনীর বোধ হয় তাদের কাছে খুব ইম্পর্টেন্স নেই! হিমি দোহা না থাকায় তারা যেমন আড্ডার আসর বসাতে পারছে না সোহিনী না থাকলে নিশ্চয় তাদের আড্ডা থেমে থাকবে না? সবকিছুই স্বাভাবিক থাকবে। নিজেকে খুব মূল্যহীন মনে হয় সোহিনীর। এ জীবনে কখনোই কারো কাছে মূল্যবান হতে পারলো না। কারো জীবনের উদ্দেশ্য, কারো প্রিয়জন, কারো খুব আপন হতে পারলো না। বুকে জমে হাহাকার। তবু হাসে সোহিনী। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে বড় গলায় গানও গায়।
_________________
পিনপতন নিরবতা ভেঙে সতর্কতা মিশ্রিত গলায় কাশলেন মতিউর রহমান। ভর দুপুরে হানিফ শরীফ পরিবার সমেত ওনার বাড়িতে কেনো এসেছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। কদিন আগেই তাদের মেয়ের বিয়েতে ইনভিটেশন পেয়ে স্বপরিবারে উপস্থিত হয়েছিলেন বিধায় এখন কটু কথাও শোনানো যাচ্ছে না। কি এক মুসিবত! আমিনা বেগম ট্রেতে করে চা বিস্কুট দিয়ে গেলেন। রাদিবা পেছন পেছন ট্রে তে করে স্ন্যাকস নিয়ে এলেন। হানিফ শরীফ শুকনো হেসে বিনয়ী গলায় বললেন,
-আপনাদের না জানিয়ে হঠাৎ চলে আসায় হয়তো আপনারা বিব্রত বোধ করছেন। তার জন্য আমরা দুঃখিত। আসলে বিষয়টাই এমন যে না এসে পারলাম না।
মতিউর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
-না ঠিক আছে। তা কি বিষয়?
অনাহিতা নাহার দাপটের স্বরে বললেন,
-আপনাদের ছেলে নিহান কোথায়?
রাদিবা চমকে উঠলেন। চমকানো স্বরেই বললেন,
-কেনো? ওর সাথে কি দরকার আপনাদের?
-দরকারটা আপনাদের সামনেই বলবো। ডাকুন ওকে।
রাদিবা ঢোক গিলে মতিউর রহমানের দিকে তাকালেন। মতিউর রহমানের কপাল কিছুটা কুঁচকানো। তিনিও ভাবছেন নিহানকে ডাকার কারন। সেই সময় বসার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন মুহিব রহমান। হানিফ শরীফ এগিয়ে গিয়ে গলা মিলিয়ে কুশলাদি করলেন। অনাহিতার গায়ে যেনো জ্বালা ধরলো। কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন,
-নিহান বাড়ি নেই?
-আছে। ছোট বউমা? ডাকো তো ওকে। বলো আমি ডাকছি।
শ্বশুরের কথায় রাদিবা মাথা নেড়ে ভেতর ঘরে ঢোকেন। তুমুল গতিতে ছুটা হৃদপিন্ডের সহিতই ছেলেকে ডেকে আনেন বসার ঘরে। নিহান অমায়িক হেসে তাদের সালাম জানায়। মতিউর রহমান পান চিবোতে চিবোতে বলেন,
-এনাদের চিনেছো?
নিহান মাথা দুলিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। অনাহিতা ভণিতা না করেই বলেন,
-মিশ্মিকে কবে থেকে চেনো? কতোদিনের আলাপ?
নিহান ঢোক গিলে আশেপাশে তাকায়। তার পরিবারের সবাই ভ্রু কুটি করে দেখছে তাকে। নিহান জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখলো। অনাহিতা ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললেন,
-উত্তর দাও।
-ইয়ে মানে,,,,,,
হানিফ শরীফ স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,
-কি জানতে এসে কি জানতে চাইছো? নিহান, তুমি কি আমাদের মিশ্মিকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছো?
অনাহিতা তাচ্ছিল্য গলায় বলেন,
-কয়েকটা!
হানিফ শরীফ নিজের কথা শুধরে বলেন,
-মানে অনেকগুলো। দিয়েছো?
নিহান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। হানিফ শরীফ আবারও প্রশ্ন করেন,
-মিশ্মির কাছে চিঠির সাথে যে এক গাদা ছবি রয়েছে সেগুলোও কি তোমার?
নিহান এবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। হানিফ শরীফ আবারও বললেন,
-মিশ্মির থেকে নিজের পরিচয় লুকাতে এসব করেছো। মিশ্মি তো জানতেও পারে নি ওটা তুমি। আর আমরা সবাই,,,,,
হাশিম শরীফ স্ত্রী রোশন আরার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠেন,
-দেখলে? আমার মিশুর কোনো দোষ ছিলো না। শুধু শুধু ওকে মারলে এতো!
মতিউর রহামন কড়া গলায় বললেন,
-কি নিয়ে কথা হচ্ছে কিছুই বুঝছি না। এই মিশ্মি কে?
অনাহিতা নরম গলায় বললেন,
-আমাদের বাড়ির ছোট মেয়ে। আপনাদের ছেলে আর আমাদের মেয়ে একই কলেজে পড়ে। নিহান মিশ্মিকে অনেকগুলো চিঠি দিয়েছে। সাথে নিজের কিছু ছবি। ছবিগুলোতে নিহানের চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না বলে আমরা অন্য কাউকে ধরে নিয়েছিলাম। মিশ্মি এসবের কিছু জানতোও না। সেসব না জেনেই অনেক কথা বার্তা বলে ফেলেছি ওকে। দোষটা মিশুর ছিলো না আপনাদের ছেলে নিহানের ছিলো। ভালোবাসে বলেই চিঠি লিখে প্রেম নিবেদন করতে হবে? তাও আবার এতো চিঠি!
সবার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। আমিনা বেগম চোখ উজ্জল করে ভাতিজা কে দেখছেন। ছেলে তাহলে মিশ্মিকে নিয়ে সিরিয়াস। রাদিবা কম্পিত গলায় বললেন,
-নিহান? এসব ওনারা কি বলছেন?
-আমরা ঠিকই বলছি। আপনাদের ছেলের জন্য কাল আমার মেয়েটা প্রচুর কথা শুনেছে। রাতে খায় নি অব্দি।
হাশিম শরীফের কথা শেষ হতেই রোশন আরা বলেন,
-তুমি আমাদের মেয়েকে ভালোবাসো? না কি মজা করতে গিয়েও ওসব লিখেছো?
রাদিবা আশা নিয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। নিহান নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমিনা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
-মজা নয় আপা। নিহান সত্যি ভালোবাসে মিশ্মিকে। ওর বইয়ের পাতায় মিশ্মির ছবিও ছিলো। আমি তো ওই বিয়েতে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগে হয়ে উঠে নি।
-তুমি কি করে জানলো আপা? কে বলেছে নিহান ওই মেয়েকে ভালোবাসে? কার না কার ছবি ছিলো!
রাদিবার কথার জবাবে এক গাল হেসে আমিনা বললেন,
-তোর ছেলে নিজে আমাকে বলেছে ছোট! ওই ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার ঘরে এসেছিলো মনে নেই? সেদিনই তো বলছিলো যেনো তাড়াতাড়ি ওর পরিবারের সাথে কথা বলি।
রাদিবার পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেলো বলে মনে হলো। ছেলে ওনার অথচ উনি কিছুই জানেন না? অন্য একজন ওনার ছেলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছেন? সেই অধিকারটাও আবার ছেলের দেয়া। প্রচন্ড অভিমানে বুক ভরে আসে তার। এদিকে মতিউর রহমান চরম হতাশ। আদরের নাতিও ভালোবাসার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত! বাড়ি বয়ে লোক এসে কথা শুনাচ্ছে তাদের। এসব অনাচার তো মানা যায় না। মানা যায় না অপমানও। যে করেই হোক এদের বিদায় করতে হবে। এ পরিবারের সাথে আর কোনো সম্পর্ক গড়া যাবে না। কিছুতেই না। নিহানের বিয়ে এ বাড়ির মেয়ে সাথে হবে না। ধমকা ধমকিতে কাজ না হলে মারধর করবেন। দরকার পরলে ধরে বেঁধে রাখবেন। যে করেই হোক নিহানে মাথা থেকে ভালোবাসার ভুত নামাবেন তিনি।
চলবে,,,,,,,,