হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৭.
ঢকঢক করে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেললো নিহান। হাত দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে ঢোক গিলে বললো,
-পরের পদক্ষেপ কি হবে?
হিমি চুইঙ্গাম চিবোচ্ছিলো। দীর্ঘ এক ঘন্টা যাবতই চিবোচ্ছে। অনেকক্ষন আগেই চুইঙ্গামের মিষ্টি স্বাদ বিস্বাদ হয়ে গেছে। এখন কিছুটা তেতো লাগছে। তবুও হিমি আপন মনে চিবিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জিব দিয়ে ঠেলে চুইঙ্গাম মুখের বাইরে বের করছে। কখনো ফুলাচ্ছে। নিহানের কথায় আড়চোখে তাকে দেখলো হিমি। বাঁকা হেসে বললো,
-এখন তোর আমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। যা চিন্তা করার সব আমাদের পরিবার করবে। তুই রেস্ট নে। অনেক ধকল গেছে।
নিহান আশ্বস্ত হলো না। তার চিন্তা দ্বিগুন বেড়ে গেলো। চিন্তিত গলায় বললো,
-তোর কথা মতো আমি ওদের সব সৃজনশীল প্রশ্ন এভয়েড করে সত্য মিথ্যা প্রশ্নের উত্তরে মাথা দুলিয়ে হ্যা জানালাম। কিন্তু কথা হলো, যেসব উত্তর হ্যা তে দিয়েছি সবগুলোই তো মিথ্যে ছিলো! একটা ছাড়া।
হিমি প্রত্যুত্তর করলো না। নিহান হিমির দিকে কাতর চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
-সত্যি কি হিমি? বল না! চিঠি ছবি এসবের মানে কি?
হিমি মুখে আরেকটা চুইঙ্গাম পুরলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দু হাত বুকের উপর বেঁধে বললো,
-এসব নিয়ে ভাববার সময় নাই তোর। এখন তোকে তৈরি হতে হবে।
-আবার কিসের জন্য তৈরি করবি তুই আমায়?
-সবে তো মিশুর পরিবার জিজ্ঞাসা বাদ করলো। এখনো তোর পরিবারের কাছে জবাবদিহি করা বাকি আছে।
নিহান ভয়ার্ত গলায় বললো,
-মানে?
হিমি স্টাডি টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো,
-স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছি। ঝটপট মুখস্ত করে নে। আমার ধারনা ঠিক হলে এছাড়া আর কিছু বলতে হবে না। আর যদি স্ক্রিপ্টের বাইরে থেকে কোনো প্রশ্ন করা হয় তাহলে সেটা তুই তোর মগজে থাকা একটু খানি বুদ্ধির প্রয়োগ করে জবাব দিয়ে দিস। টাটা!
হিমি চলে যেতে নিলে নিহান দৌড়ে এসে তার পথ আটকায়। গমগমে গলায় বলে,
-দাঁড়া বলছি। শোন, আমি আর তোর কথায় কোনো কাজ করছি না।
হিমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
-করিস না! আমি তো তোর জন্য বলছিলাম। যতোই হোক, তুই মিশুকে ভালোবাসিস! ভালোবাসার খাতিরে বিশ্ব ইতিহাসের প্রেমিকরা জান দিয়ে দিতো। আর তুই জবাব দিতে পারবি না? না দে, আমার কি? কিছুই না। পথ থেকে সরে দাঁড়া আমি বেরুবো!
নিহান মুখ কাঁচু মাঁচু করে সরলো। সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে দৌড় লাগালো হিমি। দুরু দুরু বুক নিয়ে স্টাডি টেবিলে রাখা কাগজটা তুললো নিহান। সম্পূর্ণ কাগজ পরে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিহান। কাগজের মাঝখানে ছোট ছোট অক্ষরে দুটো লাইন লিখা। “আমি মিশ্মিকে ভালোবাসি। যা করেছি ওর জন্য করেছি।” নিহান হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। বুঝলো এরা যাই প্রশ্ন করুক না কেনো ওর উত্তর হতে হবে হিমির লিখে দেয়া দুই লাইন। ঘুরেফিরে বাঁশ নিহানই খাবে!
………………………
-কেমন আছেন?
তাহিরের প্রশ্নে এক ভ্রু উচিয়ে তাকায় হিমি। বলে,
-এটাই জানার ছিলো?
তাহির হাসি মুখে জবাব দেয়,
-জানার তো অনেক কিছু আছে। শুরুটা কেমন আছেন জেনেই হোক!
হিমি শান্ত গলায় বললো,
-ভালো। আপনি?
-আমিও ভালো।
কিছুক্ষন নিরবতায় কাটিয়ে তাহির গলা কেশে বললো,
-এখানে কোথাও চা পাওয়া যাবে?
হিমি হতচকিত হলো। সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
-আপনি খাবেন?
-চা দিয়ে গোসল করা যায়?
হিমি নিঃশব্দে হাসলো। উজ্জল দৃষ্টিতে তাহিরকে দেখে বললো,
-চলুন। ওদিকে একটা স্টল আছে। দেখি খোলা কি না।
তাহির মাথা দুলিয়ে পা মেলালো হিমির সাথে। দুজনেই ধীর গতিতে হাঁটছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়াও চাঁদের ফর্সা আলো রয়েছে। ঝিরঝির বাতাস। হিমির খোপায় মোড়ানো চুলের কিছু অংশ খোপা থেকে বেরিয়ে পরেছে। বাতাসে ঘাড়ের উপর অবাধ্যের মতো উড়ছে। হিমি শান্ত ভঙ্গীতে চললেও তাহিরের মনে হতে লাগলো অশান্ত হয়ে আছে হিমির মন। কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বলে উঠলো,
-পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন কেনো? একবার রেজাল্ট খারাপ করলেই যে পড়া বাদ দিতে হবে, এমন তো নয়!
হিমি মনে মনে অনেক কথা বললেও মুখে বললো,
-পড়তে ভালো লাগে না।
তাহির মৃদু হেসে বললো,
-পড়াশোনার বয়সে কারোরই পড়তে ভালো লাগে না। সময় চলে গেলে মনে হয় পড়া উচিত ছিলো। আপনারও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। এট লিস্ট ভালো চাকরি করতে পারতেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতেন।
-এখনও তো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি।
-হিমি!
হিমি হাসলো। বললো,
-আমি মজা করে বলি নি কথা টা। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি মানে এখন ছোটখাট একটা চাকরি করছি।
তাহির চমকানো গলায় বললো,
-চাকরি? আপনি তো ইন্টারের পর আর পড়েন নি। কি চাকরি পেয়েছেন?
-ম্যানেজমেন্ট অফিসের চাকরি। জন্মদিন, বিয়েসহ যেকোনো উৎসবে ডেকোরেটিং, ক্যাটারিংএর বড় এক কোম্পানির ছোট একজন কর্মচারি আমি।
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। হিমি বললো,
-অফিসের বাকি সবার মতো আমার জন্য আলাদা বসার জায়গা নেই ঠিক তবে কাজ সবার মতোই করতে হয়। যদিও আমি সব ঠিক ঠাক পারি না তবে ফুলের স্টক, গেস্ট লিস্ট, মেনু লিস্ট এগুলোতে পারদর্শী।
তাহির শান্ত শীতল গলায় বললো,
-আপনার কাজের কথা সবাই জানে?
হিমি মাথা নেড়ে বললো,
-মামু আর বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে না।
-কেনো?
-জানাতে ইচ্ছে করে না আমার। আসুন, চায়ের স্টোলের দেখা পেয়েছি। চাচা? দু কাপ দুধ চা দিও। কড়া করে।
তাহির হিমির পিছু পিছু এসে দাঁড়ালো স্টোলের কাছে। হিমি চানাচুরের ছোট একটা প্যাকেট ছিড়ে তাহিরকে ইশারায় খেতে বললো। তাহির চোখ মুখ ছোট করে মাথা নাড়িয়ে খাবে না জানালো। হিমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডান হাতের তালুতে অনেকটা চানাচুর ঢেলে নিয়ে মুখে পুরে বললো,
-এবার আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করি?
তাহির সরু চোখে তাকালো। হিমি তার জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো,
-পিয়ানোটা কে দিয়েছিলো?
তাহির তটস্থ হলো। বেশ কিছুক্ষন নিরব থাকার পরও হিমির দৃষ্টি তার থেকে সরলো না। বরং প্রতি সেকেন্ডে তীক্ষ্ণ হলো। তাহির কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-আমার বাবা।
হিমি কৌতুহলী হয়ে বললো,
-আপনার বাবা আপনাকে এমন জিনিস কেনো দিলেন যা আপনি বাজাতে পারেন না? উনি হয়তো চেয়েছিলেন আপনি পিয়ানো বাজানো শিখেন। তাই না?
-না। পিয়ানোটা বাবার ছিলো।
হিমি উৎসুক গলায় বললো,
-আপনার বাবা পিয়ানো বাজাতে পারেন!
-পারতেন। এখন পারেন কি না জানি না।
হিমি থমকালো। তাহিরের কথা বুঝার চেষ্টা করলো। দোকানি স্টোল থেকে চা এগিয়ে দিতেই তাহির এগিয়ে গেলো। হিমিকে তার চা দিয়ে নিজের কাপে ফুঁ দিয়ে চুমুক বসালো সে। হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তাহির হিমির চাহনি উপেক্ষা করে বললো,
-চা টা দারুণ হয়েছে। সব চায়ের দোকানেই সেইম স্বাদ?
দোকানি পান খাওয়া লাল দাঁত কপাটি মেলে হাসলো। হিমি কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে উঠলো,
-আপনার বাবাও আপনাকে ভালোবাসেন না?
তাহির বুকের গভীর থেকে শ্বাস টেনে বললো,
-বাসতেন বলেই নিজের এতো প্রিয় জিনিস আমায় উপহার হিসেবে দিয়ে গেছেন। হয়তো এখনো বাসেন। আমি জানি না।
হিমি মাথা দুলালো। চানাচুরের খালি প্যাকেট রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে এক ঢোক চা খেলো। তাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললো,
-উনি কি মারা গেছেন?
তাহির চোখ তুলে হিমির দিকে দেখলো। তাহিরের দৃষ্টি শান্ত। চেহারায় উদ্বিগ্নতা নেই। কোনো ভাবাবেগ হলো না তার। নির্বিকার গলায় বললো,
-বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় উনি জীবিত আছেন। কোথায় আছেন সেসব জানি না। স্টিল, আই ফিল লাইক হি ইজ এলাইভ!
হিমি কপালে ভাজ ফেললো। তাহির মৃদু গলায় বললো,
-আপনার চা ঠান্ডা হচ্ছে।
হিমি কেঁপে উঠলো খানিক। কোনো এক ঘোরে চলে গেছিলো সে। তাহিরের কথায় বাস্তবে ফিরলো।গলার স্বর নিচু করে বললো,
-আপনার কথা শোনে মনে হলো আপনার বাবা আপনার সাথে থাকেন না। তবুও আপনি জানেন উনি আপনাকে ভালোবাসতেন এবং বাসেন হয়তো। অথচ আমি!
-আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আপনার বাবা আপনাকে ভালোবাসেন। খুউব ভালোবাসেন।
-এখনো আমায় ঠিক করে চিনে উঠতে পারলেন না আর আমার বাবার কথা বলছেন! হাসালেন ডাক্তার!
তাহির বাঁকা হেসে বললো,
-হাসি পেলে হাসুন। তবে আমি সত্যি বলছি। মুহিব আঙ্কেল আপনাকে সত্যি ভীষন ভালোবাসেন।
হিমি চমকে উঠলো। ‘মুহিব আঙ্কেল’ অর্থাৎ তার বাবা। তাহির কি করে জানলো হিমির বাবার নাম? হিমি তো তাকে এসব বলে নি। আশ্চর্যান্বিত গলায় হিমি প্রশ্ন করলো,
-আমার বাবাকে চিনেন আপনি?
-খুব বেশি না। একটু আধটু চিনি।
হিমি ঢোক গিললো। এই লোককে অচেনা ভেবে কতো কথাই বলে ফেলেছে। যদি লোকটা তার বাবাকে বলে দেয় এসব? বাবার কাছে অপমানিত হবে না? নিশ্চয় সবার চোখে করুণার পাত্রী হবে হিমি। দয়া দেখাবে কেউ কেউ? হিমির মাথা ঝিনঝিন করে উঠলো। সত্যি ভীষন বোকা সে। নাহলে যাকে তাকে পারিবারিক কথাবার্তা জানায়? সেদিন নাহয় জ্বরের ঘোরে বলে ফেলেছিলো কিছু কথা আজ কেনো বলতে গেলো চাকরির ব্যাপারে? বাবা জেনে গেলে কি করবে? কোনোভাবে যদি দাদু মামানি এরা জানে? তবে? ভেবে পায় না হিমি। সমস্যা বাড়ছে। সমাধান নেই। মাথায় হাত রেখে কাঁদো কাঁদো চেহারায় সামনে তাকায়। তাহির রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হিমির থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে সে। হিমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড়তে গিয়েও থেমে যায়। দোকানির দিকে তাকিয়ে বলে,
-কতো টাকা চাচা?
-স্যার টেকা দিয়া দিছে। আর কইছে আপনেরে কওনের লাইগা।
-আচ্ছা।
হিমি দৌড়তে গেলে আবারও আটকে দেয় দোকানি। ব্যস্ত গলায় বললো,
-কি কইতে কইছে হেইডা তো হুইনা লন।
হিমি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। দোকানি কিছু একটা মনে করে বললো,
-হ হ, স্যার কইছে কাইল রাইত ওই জায়গায় যাইতে। ওই একই সময়ে।
হিমি ভাবুক গলায় বললো,
-কোন জায়গায় কখন? আর আমায় না বলে আপনাকে বললো কেনো?
-আপনি কিসব ভাবতেছিলেন! হের লাইগা স্যার আমারে কইয়া গেছে গা। দৌড়াইয়া নাগাল পাইবেন না। বাড়ি চইলা যান। কাইল আবার আইবেন!
হিমি দ্বিধান্বিত হয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। তাহির অনেক আগেই চোখের সীমানার বাইরে চলে গেছে। এতক্ষনে হয়তো গাড়িও স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য! চা খেতে এসে তাকে একা ফেলেই চলে গেলো? দুদিন ধরে ‘দরকারি কথা’ আছে বলে বলে বলে এত রাতে এতদূর এসে শুধু এক কাপ চা খেয়ে হাজারটা প্রশ্ন উৎপন্ন করে দুম করে চলে যাওয়ার মানে কি? ফাইজলামি করে লোকটা? হিমির আকাশচুম্বি রাগ লাগে। সেই রাগটাও তুলোর মতো মিলিয়ে যায় তাহিরের বলা কথায়। মনে বার বার একটাই কথা আসছে, বাবাও কি ডাক্তারকে চিনে? কথা হয় ডাক্তারের সাথে?
চলবে,,,,,,,,,,