হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০৩.
হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকেই বাবাকে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতে দেখলো হিমি। চোখ মুখ সব সময়ের মতো গম্ভীর। হিমি কিছু না বলে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মুহিব রহমান টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন। দুপুরের নিউজ দেখতে পারেন নি বলেই এখন নিউজ খুঁজছেন তিনি। সবগুলো চ্যানেলেই বাংলা ছবি নাটক চলছে। এসবের মাঝে হঠাৎই চোখ গেলো মেয়ে হিমির দিকে। তিনি রিমোট নামিয়ে রাখলেন সোফায়। উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে দু হাত বাধলেন। দৃষ্টি টিভির দিকে রেখেই কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
“অথৈকে দেখতে আসছে। তোমার ওখানে না থাকাই ভালো।”
হিমি মাথা নেড়ে সায় জানালো। মুহিব রহমান ছোট ছোট পা ফেলে নিজের ঘরে চললেন। হিমি লম্বা শ্বাস টানলো। উল্টো ঘুরে বসার ঘরের টিভি বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘরে উকি দিলো। বড়মা খুন্তি অনবরত নাড়াচাড়া করছেন। ছোটমা চায়ের যোগার করছেন। বিকেলে এক কাপ চা না খেলে তার মাথা ধরে যায়। হিমি শার্টের কলার ঠিক করে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। কেডস খোলে ছুড়ে দিলো আলনার দিকে। দুটো কেডস দুদিকে গিয়ে পরলো। প্যান্টের পকেট থেকে চুইঙ্গাম বের করে মুখে পুরলো হিমি। চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। আচ্ছা, সে কি বাজে? খুউব বাজে? বাবা কেনো তার সাথে ঠিক করে কথা বলে না? বড় মামা যেমন অথৈকে ভালোবাসে, ছোট চাচামনি যেমন নিহানকে ভালোবাসে অমনি করে বাবা তাকে ভালোবাসে না কেনো? আজ হিমির মা বেঁচে থাকলে হয়তো বাবাও তাকে ভালোবাসতো! আদর করে কথা বলতো নিশ্চয়! না কি এখনের মতোই রাগি চোখে থমথমে গলায় দু এক শব্দ বলতো শুধু? হিমি ভাবে। তার ভাবনার অন্ত নেই। ভাবতে ভাবতেই লম্বা কোঁকড়ানো চুলে চিরুনি চালায় হিমি। জটে আটকে যায় চিরুনি। টেনে টুনে চিরুনি খোলে জট থেকে। চুলে তেল দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু হিমি দেবে না। তেল দিলে মাথা ব্যাথা করে তার। লম্বা চুল কখনোই পছন্দনীয় নয় হিমির। ছোটবেলায় ছেলেদের মতোই চুল ছিলো। চুল বেরে গেলে ছেলেদের মতোই কেটে ছোট করা হতো। একদিন বাবা আটকে দেয় হিমিকে। মুহিব রহমান মেয়ের কোঁকড়ানো চুল কাটতে দেখে ছোট্ট করে বলেছিলেন, ‘থাকুক না। কাটার কি দরকার?’ হিমি চুল কাটে নি আর। যত্নও করে নি কখনো। তবুও চুল বাড়ে। ঝরে পরে না, ছিড়ে যায় না। কোঁকড়ানো চুল কোমর অব্দি পৌঁছে গেছে। তীব্র বিরক্তি নিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে রেখে দেয় সে। চুল বাধতেও রাগ লাগে তার। অথৈদের বরাবরই দেখে চুল ঝুটি করতে, বিনুনি গাঁথতে, খোপায় ফুল লাগাতে। হিমি তার করে না। কোনোরকম চুল গুলো খোপা করে রেখে দেয় নয়তো পিঠেই ছড়িয়ে রাখে। চুলগুলো উস্কখুস্ক হয়ে উড়তে থাকে। হিমি পাত্তা দেয় না তাতে। উল্টো হেটে জানালার গ্রিলে হাত রাখলো হিমি। গরম লাগছে ভীষন। অস্বস্তিও হচ্ছে। খিদে পেয়েছে হিমির। কিছু খেতে পারলে ভালো হতো। কাউকে বলবে? না থাক, ছোটমা মুখ ঝামটাবে। বড়মা দিবে হয়তো! সন্তানহীন জননীর যে সবার প্রতি মায়া থাকে। ঘরের দরজায় টোকা পরায় ঘাড় ঘুরায় হিমি। বড় চাচা মতিউর রহমানের স্ত্রী আমিনা বেগম খাবারের প্ল্যাট নিয়ে হাজির। হিমি মৃদু গলায় বললো,
“কি ব্যাপার বড়মা?”
“তোর জন্য খাবার নিয়ে এলাম। ওবাড়িতে কিছু খেয়েছিলি দুপুরে?”
হিমি মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“না।”
দুপুরে অথৈকে ওবাড়িতে ড্রপ করে দিলেও কেউ তাকে খেতে বলেনি। সেও আগ বাড়িয়ে খেতে চায় নি।আমিনা বেগম গোল গোল চোখে দেখেন তাকে। তাড়াহুড়া করে প্ল্যাট নামিয়ে রাখেন টি টেবিলে। হিমিকে টেনে বসান খাটে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন,
“সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে কখন খাবি তুই? হা কর! আমি খাইয়ে দি।”
হিমি মুখের চুইঙ্গাম ট্যিসুতে নিয়ে জানালার বাইরে ছুড়ে ফেলে। হা করে মুখ বারিয়ে দেয়। আমিনা বেগম খুশি মনে খাইয়ে দিতে থাকেন তাকে। এই একমাত্র মহিলা যিনি হিমিকে খাইয়ে দেন। কখনো কখনো জোর করে চুলে তেল দিয়েও দেন তিনি। গল্পও করেন কখনো তার সাথে। হিমিকে খাইয়ে দিতে গিয়ে আমিনা বেগমের চোখে মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তি।
অথৈকে নীল রঙা শাড়ি পরিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে বসানো হয়েছে। অথৈ এখনই বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু মাকে যমের মতো ভয় পায় সে। সারাদিন বক বক করতে পারা অথৈয়ের মুখ খোলে না মায়ের সামনে। এখনো তাই মুখ বোজে অপরিচিত লোকজনদের সামনে বসে সে। বুক দুরু দুরু করছে। হাতপাও মৃদু কাঁপছে তার। চোখ তুলে সামনে বসে থাকা পাত্রকে দেখছে না অব্দি। পাত্র সরকারি কলেজের প্রফেসর। কথাটা শুনা মাত্রই অথৈয়ের বুকে চাপা আর্তনাদ বয়ে গেলো। প্রফেসররা সাধারনত বুড়ো হয়ে থাকে। তবে কি তার বরও বুড়ো! আবার ভাবে বিয়েটা নাও তো হতে পারে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে অথৈয়ের মা অনাহিতা নাহার বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দেন। ছেলে মেয়েকে আলাদা কথা বলার সুযোগটুকুও দিলেন না তিনি। অথৈয়ের কান্না পাচ্ছে। প্রথমবার দেখেই কেউ বিয়ে করে ফেলে না কি? মা কি তাকে একটুও বুঝবে না? অথৈয়ের হাতে আঙটি পরান ছেলের মা। সবাই খুশিতে ঝুমছে। শুধু চোখ ভিজে উঠছে পর্দার আড়ালে থাকা অথৈয়ের চাচাতো বোন মিশ্মির! যা কারো চোখেই পরে নি।
__________________
রাত এগারোটা বাজে। ঢাকায় নিজ বাসভবনে তাহির ঢুকেছে সবে। ক্লান্ত লাগছে তাকে। শার্টের বুকের উপরের দুটো বোতাম খোলে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো তাহির। সিড়ি ভেঙে শোবার ঘরে ঢুকলো এসে। দরজার পাশেই সুইচ বোর্ড। হাত বাড়িয়ে রুমের লাইট জ্বালালো তাহির। হাতের এপ্রোন চেয়ারের হাতলে রেখে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গোসল সেরে বেরুলো সে। ছাই রঙের ট্রাউজাড়, সাদা রঙের ঢোলা টি শার্ট গায়ে তার। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছচে সে। খেয়াল হলো ডিম লাইট জ্বলছে। অথচ ওয়াশরুমে ঢোকার আগে বড় বাতিটাই জ্বলছিলো। নিশ্চয় তার মা এসেছিলো ঘরে। মৃদু হেসে তোয়ালে র্যাকের উপর রেখে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো তাহির। স্টাডি ল্যাম্প জালিয়ে খানিক বসে রইলো। মাথার পেছনে হাত রেখে ঘাড় অব্দি টানলো। ব্যাগ খোলে কোনো এক পেশেন্টের ফাইল ঘাটলো সে। বাচ্চাটার মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। রোজ রোজ এক স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠে। কি স্বপ্ন দেখে তাও ঠিকঠাক বলতে পারে না। এখন তো ঘুমাতেও চায় না। তাহিরের কাজের মাঝেই দরজা ঠেলে ভেতরে আসেন মায়মুনা জামান। ঘরে ঢোকেই দুধ ভর্তি গ্লাস টেবিলের উপর রাখেন তিনি। তাহির চমকায় নি মোটে। এই সময় মা যদি তার হরলিক্সের গ্লাস দিয়ে যেতেন তবুও চমকাতো না সে। কিন্তু সমস্যা একটাই। তাহিরের দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্তি দূর করার মূখ্য ঔষধ চায়ের প্রয়োজন খুব। সেটা মাকে বলা দুষ্কর। মায়ের বাধ্যগত সন্তানরা মাকে কোনো কিছুতে মানা করতে পারে না। তাহিরও তাই। মা ভক্ত বা ‘মামা’স বয়’ হিসেবে ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত বন্ধুদের কাছে পরিচিত সে। বাস্তবেও তাই। মায়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ না তে না। এখন কি করে বলে, ‘মা আমি দুধ খাবো না। চা খাবো। শুনেছি চা খেলে ক্লান্তি দূর হয়। এক কাপ চা হবে। পুরো এক কাপ না দিলেও চলবে আধা কাপ দিও!’ হাসপাতালে একবার খেয়েছিলো মিটিংএ। বেশ লেগেছিলো তার। আর খাওয়া হয় নি। অখাদ্য পানীয় চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফিই খায় সে রোজ। বাসায় ফিরে দুধ। সে বাচ্চা নয়। মা কি বুঝে না? সব মাই কি একরকম?
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? খেয়ে নে। ভালো লাগবে।”
মায়ের কথায় মাথা নাড়লো তাহির। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু ঢোক গিললো। সাথে সাথে বেজে উঠলো মুঠোফোন। তাহির ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলো। মায়ের সামনে কখনোই ফোন কানে ঠেকায় না তাহির। তার ধারনা এতে বেয়াদবি করা হয়। তাই প্রতিবারের মতো এবারও নম্র গলায় সালাম দিলো তাহির। ওপাশ থেকে রূঢ় গলায় মেয়েলি গলায় জবাব এলো,
“কই আপনি? কি চাইছেন টা কি? মেয়েটা মরে যাক? আরে ভাই, বিয়েই যখন করবি না তবে প্রেম করেছিস কেনো? আগে পরিবার ছিলো না তোর? এখন দুম করে উদয় হয়ে গেলো! লিসেন, আমারে তো চিনিস না তুই! একবার কাছে পাইলে শরীর থেকে ঘাড় আলাদা করে দিবো। কই আছিস সেটা বল।”
তাহির ভড়কে গেলো এতে। মায়মুনা জামানের ঘাম ছুটছে। কি বলছে এই মেয়ে? ছেলে তার প্রেম করছে? এমন শিক্ষা তো তাকে দেন নি মায়মুনা। তাহির কিছু বলবে তার আগেই মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে বিচ্ছিরি কিছু গালি শোনা গেলো। তাহির ফোনের স্পিকার অফ করে দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“কে আপনি? এসব কি কথা বলছেন?”
“কি বলছি বুঝিস না তুই? সোহিনীরে ধোকা দেয়ার সাহস হইলো কেমনে তোর? শালা, মেয়েদেরকে হাতের পুতুল ভাবো? তোর ওই হাতই ভেঙে দিবো। কই তুই? আইজ যদি সোহিনীর কিছু হয় তাইলে তুই শেষ। এই হিমি তোরে জ্যান্ত পুতে দিবে। বুজছিস? কাজ ফাজ ফেলে চটপট সরকারি হাসপাতালে আয়। দশমিনিট। দশমিনিটের মধ্যে এইখানে তোরে না পাইলে তোর অবস্থা কি করবো আমি নিজেও শিওরিটি দিতে পারছি না।”
কথাটা বলেই ফোন কাটলো হিমি। প্রেমিকের ধোকা সহ্য করতে না পেরে হাত কেটে বিদিগিস্তা অবস্থা করেছে সোহিনী। শহরে সে একাই থাকে। রুম মেইট মেয়েটা সোহিনীকে সুইসাইড এটেম্প্ট করতে দেখে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো। সফল হয় নি তাতে। বাধ্য হয়ে হিমিদের ফোন লাগায় সে। প্রাণের বান্ধবীর এমন হাল মেনে নিতে পারছে না বন্ধুরা। রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে তাদের। সোহিনীর ডায়েরি থেকে বয়ফ্রেন্ড নামক চিটারের নাম্বার বের করে কল লাগিয়েছে হিমি। এদিকে তাহির ভেবে পাচ্ছে না কে এই সোহিনী। তার জানা মতে আজ অব্দি সে কারোর প্রেমে পরে নি , প্রেম করা তো দূরের কথা। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে মনে হলো ভয়ানক কিছুই হয়েছে। একবার যাওয়া উচিত। এট লিস্ট আসল ঘটনা তো জানবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন পকেটে পুরে ঘরের পোশাক নিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো তাহির। দরজায় ঠেস দিয়ে মায়মুনা জামান ছেলেকে দেখছেন। মাকে না বলে কখনোই কোথাও যায় না তাহির। অথচ আজ এই মাঝরাতে এক মেয়ের ফোন পেয়ে কিছু না বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো। ছেলে কি তবে সত্যি প্রেমে টেমে জড়িয়েছে! মায়মুনা জামান অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পরেন। সেজদায় গিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন তিনি। ছেলেকে যেনো ফিরিয়ে আনতে পারেন সেই দোয়া। প্রেমের মতো পাপ থেকে ছেলে যেনো বেঁচে ফিরতে পারে সেই দোয়া।
চলবে,,,,,,,,