হিমি পর্ব-৪

0
1600

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০৪.

হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষার প্রহর গুনছে হিমি আর তার বন্ধুরা। সবার মাথায় আগুন জ্বলছে। একটা ছেলের কথা ভেবে বান্ধবী মরতে বসেছে এতে সোহিনীর উপর‌ও রাগ লাগছে তাদের। সোহিনী অজস্র রোগীর মাঝে একটা বেডে শুয়ে আছে। হাতে রক্তের নল, অন্যহাতে ব্যান্ডেজ। এখনো অজ্ঞান সে। দরজার বাইরে বেঞ্চে বসে আছে দোহা। চোখের জ্বল শুকিয়েছে সেই কখন। এখনো ফুঁপাচ্ছে সে। ইমন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ, হিমি, সূর্য পুরোদমে পায়চারি করছে। পা যেনো থামছেই না তাদের। এই মুহুর্তে ছেলেটাকে হাতে পেলে যাচ্ছে তাই করতে পারে তারা। বয়ফ্রেন্ডের নাম্বার খুঁজতে গিয়ে ডায়েরি ভর্তি সোহিনীর হৃদয়বিদারক গল্প পড়েছে হিমি। মেয়েটা কালো বলে এভাবে অপমান করবে? তাও আবার যে কি না দেড় বছর ধরে তাকে ভালোবেসে পাগল! বিশ্বাস হয় না হিমির। ছেলেটা নিশ্চয় আগে থেকে ছক কষে রেখেছিলো। প্রেমের নাটক করেছিলো, বাস্তবে কখনোই ভালোবাসে নি তাকে। ভাবনার মাঝেই করিডোরে ঢোকে ডাক্তার তাহির। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে হিমিদের দিকে তাকায় সে। আবার‌ও সেই কোঁকড়ানো চুলের মায়াবিনী! তাহির তাড়াতাড়ি চোখ ফেরায়। আবার‌ও তাকায়। মেয়েটার দিকে তাকালে কেমন ঘোর লেগে যায় যেনো! কারো ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে তার। গলা কেশে এগোয় সামনের দিকে। ধীর কন্ঠে বলে,

“এক্সকিউজমি?”

হিমি ভ্রু কুঁচকায়। এই ডাক্তারের এখানে কি কাজ? ‌এখানেও চিকিৎসা টিকিৎসা করে না কি লোকটা? হতে পারে। তাহির আবার‌ও ডেকে উঠে। হিমি বিরক্তি নিয়ে বলে,

“কি চাই?”

“কিছুক্ষন আগে কেউ একজন কল করেছিলো আমাকে।”

তাহিরের কথার মাঝেই বলে উঠে ইমন,

“তো? আপনারে কে কল দিছে না দিছে সেইটা জেনে আমাদের কি কাম?”

তাহির মৃদু গলায় বলে,

“আসলে, কে কল করেছিলেন বলতে পারছি না তাই জিজ্ঞেস করছি আপনাদের মধ্যে কেউ কল করেছিলেন কি না!”

এবার গর্জে উঠলো সূর্য,

“আজিব মানুষ! আপনারে চিনিই না তাইলে কল কেমনে করমু? আর কেনোই বা করমু ভাই? এই তোরা চিনোস লোকটারে?”

মেঘ একপলক দেখে চোখ ফিরিয়ে বেডে শুয়ে থাকা সোহিনীর দিকে তাকালো। ইমন কিছু না বলে আগের মতো দেয়ালে ঠেস দিলো। দোহা উঠে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছু বলতে নিলে ধমকে উঠলো সূর্য,

“ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাইন্দা তুই স্বর্গে যাইবি? বেদ্দপ! বন্ধ কর মরা কান্না। এই কেবিনের সব রোগী তোর কান্না শুইনাই ম‌ইরা যাইবো। দোস্ত, চিনোস এরে?”

শেষের কথাটা হিমির উদ্দেশ্যে ছিলো। হিমি মাথা নাড়লো। সূর্য তটস্থ হলো এবার। হিমি বললো,

“ভুলে গেলি? সেদিনের ডাক্তার। ওই যে মফিজ না কি যেনো নাম লোকটার? ‌হাসপাতালে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন উনিই নার্সকে বকাঝকা করছিলেন।”

তাহিরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

“কিন্তু আপনার নাম্বার তো আমি আনি নি। তাহলে কল করার প্রশ্ন‌ই উঠে না। অন্যকেউ হয়তো কল করেছিলো।”

তাহির মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলে ওয়ার্ড বয়ের সামনা সামনি হয়। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“একটা সুইসাইড কেইস। বন্ধুরা নিয়ে এসেছে মেয়েটাকে। তাদের মধ্যে একজনের নাম মেই বি হিমি! এই রুমেই?”

তাহিরের কথা শেষ হতে দেরি মেঘের তার কলার ধরতে দেরি হয় নি। এক হেঁচকা টানে তাহিরকে নিজের সামনে দাঁড় করালো মেঘ। দু হাতে টি শার্টের গলার দিক টেনে ধরে রক্তলাল চোখে তাকিয়েই বলে উঠলো,

“শালা, ****! তোর সাহস কি করে হলো ওরে ধোকা দেয়ার? কালো? ও কালো? আগে মনে ছিলো না? সোহিনী তোর কাছে গিয়েছিলো ভালোবাসার দাবি নিয়ে? তুই আসছিলি? কেনো? কেনো আসছিলি তখন? বিয়ে করবি না না! দেখি কেমনে বিয়ে না করে থাকিস! ‌একবার, একবার খালি ওরে উঠতে দে এই হাসপাতালেই তোদের বিয়ে দেবো। বাপ মা না মানলে নাই। আর যদি ত্যারাব্যারা করিস তাইলে তুই শেষ!”

হিমিরা মেঘের হাত টেনে ধরে আছে। সূর্য‌ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে টানছে মেঘকে। অথচ তার হাত তাহিরের টি শার্ট থেকে সড়ছে না। তাহির কিছু বলতেও পারছে না। গলায় কথাগুলো আটকে গেছে। আমতা আমতা করে শুধু এতটুকুই বললো,

“আপনি যার কথা বলছেন আমি সে ন‌ই মিস্টার।”

হিমিও জোড় গলায় বললো,

“মেঘ? ‌এই লোকটা সেই লোক নয়। ছার!”

মেঘের হাত হালকা হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে হিমির দিকে তাকালো। হিমি চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলায় তাহিরকে ছেড়ে দিলো সে। হিমি তাড়াহুড়া করে বললো,

“আমি ওই ছেলেটাকে দেখেছি।”

মেঘ গোল গোল চোখ করে তাকালো। বললো,

“কবে? কখন?”

“অনেক আগে একবার দেখা হয়েছিলো আমাদের। সোহিনী আর তার বয়ফ্রেন্ড রিকশায় কোথাও যাচ্ছিলো। তখন‌ই দেখি।”

সূর্য সন্দিহান হয়ে বললো,

“তুই শিওর যাকে দেখেছিলি সে এই লোক নয়!”

“হ্যাঁ। ইনি তো ডাক্তার। আর সোহিনী বলেছিলো ওর বফ ছোট খাট একটা চাকরি করে। সো!”

ইমন শান্ত গলায় বললো,

“তবে ইনি কেনো এসে বললেন কলের কথা? এনাকে কে কল দিলো? আর এসব জানলেন কি করে?”

তাহির টিশার্ট টেনে টুনে ঠিক করে বললো,

“আপনাদের কল রং ডিরেকশনে চলে গেছিলো। আমাকে আপনাদের কাঙ্খিত কেউ ভেবে ধমকে আসতে বলেছিলেন।”

“আর আপনি চলে এলেন?”

দোহার প্রশ্নে ঠোঁট চ‌ওড়া করলো তাহির। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,

“এমন ভাবে বলা হয়েছিলো ভেবেছিলাম ভয়ানক কিছু হয়েছে। আসল ঘটনা জানতে আর মিস‌আন্ডার্স্টেন্ডিং দূর করতেই তাই ছুটে এসেছি। পাশাপাশি একজন ডক্টর। কোনো সাহায্য লাগলে আই ক‌্যান হ্যল্প!”

সবাই মাথা দুলিয়ে যার যার জায়গায় চলে গেলো। অলসভঙ্গীতে বেডের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজোড়া চোখ। দোহা হঠাৎ‌ই বলে উঠলো,

“হিমি? বদমাইশ টাকে জানাবি না সোহিনীর খবর?”

হিমি তাচ্ছিল্য হাসলো। বললো,

“নিজেই তো বলছিস বদমাইশ। বদমাইশকে এসব জানিয়ে কি লাভ? বিশ্বাসঘাতক কোথাকারের! ‌সোহিনী সুস্থ হোক তারপর ভাববো কি করা যায়।”

তাহির হিমির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“‌আপনাদের ফ্রেন্ড, সোহিনী কোথায় এখন?”

হিমি হাতের ইশারায় দেখালো। কয়েক সেকেন্ড পর বললো,

“ভীষন ইমোশনাল। দেড় বছরের সম্পর্কে ইতি টানা সহজ নয় ওর কাছে। তার‌উপর যাকে ভালোবাসে সে অন্যকাউকে বিয়ে করছে। শুধু করছেই না বাজে ভাবে অপমান করেছে মেয়েটাকে। সব সহ্য করা যায় ডাক্তার, অপমান, আর প্রিয়জনের অবহেলা সহ্য করা যায় না। প্রিয়জনের কথার তীর বুকে গিয়ে বিধলে তা শুধুই রক্তক্ষরণ বাড়ায়। সোহিনী ভেতরের রক্তক্ষরণ থামাতে গিয়ে বাইরে রক্তক্ষরণ করলো। হাতের রগ কেটে দিয়েছে। কি সাহস দেখেছেন? ‌ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়! ‌আমরা বাঁচিয়ে নিলাম।”

এতক্ষনের কথায় তাহির কষ্ট অনুভূত করলেও শেষের কথায় চমকালো। চমকে ওঠা কন্ঠেই বললো,

“বাঁচিয়ে নিলেন বলে ভাগ্য খারাপ?”

“অবশ্য‌ই! ও তো মরতে চাইছিলো। পারলো না। এটা কি ভালো হলো? যেহেতু ভালো হলো না তাই ভাগ্য খারাপ বলাটাই শ্রেয়।”

তাহির হিমির বলা কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলো। এর মধ্যেই হিমি ধরফরিয়ে উঠে দৌড় লাগালো সোহিনীর বেডের দিকে। বন্ধুরা সবাই হিমির কাজের পেছনে কারন ঠাহর করতে পারলো না। তবুও তার পিছু নিলো। তাহির কৌতুহল হয়ে ধীর পায়ে এগুলো। সোহিনীর জ্ঞান ফিরেছে। সবে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো। হিমি ওতো দূর থেকেও স্পষ্ট দেখে নিলো তার নড়াচড়া। দৌড়ে এসেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো বাম গালে। সোহিনী সহ বাকিরাও ভড়কালো।

“বেঁচে আছিস।”

হিমির থাপ্পড় খেয়ে সোহিনী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না সে কোথায়! তবে এবার বুঝলো। হিমির কথায় ঢোক গিললো সে। কাঁদো কাঁদো গলায় হিমি নামটা উচ্চারণ করতে গেলে অন্যগালেও চড় পরে তার। এবারের চড়টা মেরেছে মেঘ। বেচারি ফুঁপিয়ে উঠলো। দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো কানের পাশ দিয়ে। দোহা এগিয়ে এসে উঠে বসতে সাহায্য করলো সোহিনীকে।

“আফসোস হচ্ছে দোস্ত? মরতে পারলি না বলে আফসোস হচ্ছ?”

হিমির দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলায় ভয় পেলো সোহিনী। ঢোক গিলে বললো,

“পানি খাবো।”

সূর্য দাঁত কেলিয়ে স্টুলে বসে বললো,

“পানি? না, ঐটা খাওয়া যাবে না। তোরে বরং এক গ্লাস বিষ দেই। খা। খেয়ে চটপট মরে যা। তোরে মাটি দিয়া আমরাও ঘুমামু।”

সোহিনী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সূর্যের দিকে। ইমন সূর্যের কাধে হাত রেখে বললো,

“কি যে বলিস মামা! বিষ খেয়ে মরায় অনেক প্যারা। এক কাজ করা যায় বুঝলি, ওরে ঝুলাই দেই! মাথার উপরে দেখ কি সুন্দর ফ্যান ঘুরতাছে! ওইটাতে ঝুলাই রাখা যাবে। আরামসে বাঁচার চেষ্টা করতে করতে মরে যাবি।”

কথাটা বলেই ভ্রু নাচালো সে। মেঘ হাত টানটান করে বললো,

“এর থেকেও ভালো উপায় আছে। আমি ওর গলা টিপে ধরে মেরে ফেলি। কাতরাতে কাতরাতে মরবো। কি বলিস সোহু। মরবি আমার হাতে?”

সোহিনী দোহার গায়ের সাথে লেগে পরে একদম। মেঘ সোহিনীর দিকে ঝুঁকে বলে,

“ওহ তুমি বন্ধু দোহার হাতে মরতে চাও! দোহা, বালিশ চেপে ধর ওর মুখে। হিমি হাত পা আটকাতো। সবাই মিলে আল্লাহর নাম নিয়া শয়তান মারি চলো। কি রে ভয় পাস কেন? মরবি না? কবরে অনেক শান্তি পাবি দোস্ত। অন্ধকার মাটির ঘর, আহা আরাম! কি রে শুরু কর তোরা!”

সোহিনী কাঁদতে লাগলো। ধীরে ধীরে গলার আওয়াজ বাড়তে লাগলো তার। বন্ধুরা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। শান্ত চোখে সোহিনীকে দেখছে। তাকে থামাচ্ছে না। হিমি লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। সোহিনীকে কাঁদতে দেখে কিছুটা শান্তি পেলো এবার। তারা জানে সোহিনী আবেগী হয়েই কান্ডটা ঘটিয়েছে। তাকে বুঝানো প্রয়োজন ছিলো মৃত্যু এতো সোজা নয়। এতো শান্তির নয়। চাইলেই সব পাওয়া যায় না আর না পাওয়ার জন্য হন্নে যাওয়া উচিত। তাকে বুঝাতে গিয়েও এতো কথা বলতে হয়েছে তাদের। মেয়েটা কাঁদছে। হাউমাউ করে নয় তবে কাঁদছে। চোখের পানির সাথে সাথে বুকের ভেতরের পাথরটা নামছে একটু একটু করে। একজন ডাক্তার হিসেবে তাহিরের উচিত তাকে আটকানো। এভাবে কান্নাকাটি করলে সে আরো অসুস্থ হয়ে পরবে। কিন্তু তাহির তা করছে না। কক্ষে থাকা বাকি রোগীরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন এতে। একজন নার্স এগিয়ে এসেছে। সোহিনীকে শান্ত হতে বলে পাল্স, প্র্যাশার চেইক করলো সে। বন্ধুরা সান্তনা দিলো না সোহিনীকে। কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজ থেকেই শান্ত হলো সোহিনী। দোহা পানির বোতল এগিয়ে দিলো। দু ঢোক পানি খেয়ে বোতলের ছিপি বন্ধ করে দোহার হাত ধরেই বালিশে মাথা রাখলো সোহিনী। তাহির কিছুক্ষনের জন্য আৎকে উঠেছিলো। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ওঠা এক ব্যক্তিকে এভাবে কেউ বলতে পারে তা তার ধারনার বাইরে ছিলো। তাও একসাথে এতোজন! ‌মেরে ফেলার কথা এতো সহজে কি করে বলে ফেললো এই ছেলে মেয়েগুলো? তাহির ভেবে পায় না। বেশি ভাবেও না। হাসপাতালের দেয়াল ঘড়িতে দুটো বেজেছে। ঘড়িটা কি নষ্ট? হতে পারে। জেনে কাজ নেই। তাহিরের এখন বাড়ি ফেরা উচিত। যা জানার ছিলো জানা হয়ে গেছে, যা জানানোর ছিলো জানানোও হয়েছে। শুধু শুধু এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দেয়া উচিত।

চলবে,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here