হিমি পর্ব-৪২

0
802

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৪২.

হানিফ শরীফের বাড়িতে হিমির বাবার বাড়ির সবার নিমন্ত্রণ আজ। কয়েকদিন পর‌ই নিহান মিশ্মির বিয়ে। এর মধ্যে আত্মীয়তা আরো খানিক গাঢ় করার তাগিদ চলছে। মিশ্মিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে অথৈ। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে গতকাল। বোনের বিয়ের জন্য এখানেই থাকবে কদিন।

“কি মিষ্টি লাগছে দেখতে! এতো তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে আমার তো বিশ্বাস‌ই হচ্ছে না মিশু।”

মিশ্মি প্রত্যুত্তর করলো না। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইলো। অথৈ উচ্ছাস নিয়ে মিশ্মির গা ঘেষে বসলো। কৌতুক মাখা গলায় বললো,

“কবে থেকে এসব প্রেম ভালোবাসা চলছিলো? আমায় বললিও না! তোর দুলাভাই না বললে আমি মানতাম‌ই না।”

মিশ্মি শুকনো গলায় বললো,

“তোর বর কি বলেছে?”

“ওই ই তো আমাকে বললো নিহান আর তোর ব্যাপারে।”

“আমার আর নিহান ভাইয়ার ব্যাপার! কি ব্যাপার?”

“ন্যাকা! প্রেমের ব্যাপারে।”

মিশ্মি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। অথৈ হাসি হাসি মুখে বললো,

“ক্যান্টিনে নিহান যে তোকে শাসন করছিলো, খাওয়াচ্ছিলো, তোকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো সব‌ই খেয়াল করেছে ও। নিহানকে দেখেই বুঝে গেছিলো কিছু একটা চলছে তোদের মধ্যে। আর পরে তো বিয়ের কথা বার্তা উঠতে একেবারে শিউর হয়ে গেলো। প্রফেসর বলে কথা! চোখ মুখ দেখেই বুঝে গেছে কার মনে কে আছে!”

মিশ্মি বিরবির করে বললো,

“শুধু বুঝলো না আমার মনে কে আছে! ‌প্রতিটা দিন তার চোখের সামনেই ঘুর ঘুর করেছি আমি। অথচ আমাকে দেখে বুঝলো না। কিছুই বুঝলো না।”

“কে, কি বুঝলো না?”

অথৈর কথায় মাথা নাড়লো মিশ্মি। কথা ঘুরাতে গিয়ে বললো,

“তোরা সবাই ভুল জানিস অথৈ। নিহান ভাইয়ার সাথে আমার প্রেমের কেনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক‌ও ছিলো না। উনি হয়তো আমায় ভালোবেসেছেন তবে আমি বাসি নি।”

অথৈ মৃদু হেসে বললো,

“বাসিস নি তাতে কি হয়েছে? বাসবি! আমিও তো ওকে আগে ভালোবাসি নি। বিয়ের পর বেসেছি। তোর ক্ষেত্রেও এমনটা হবে।”

“হবে না। তুই আর আমি এক ন‌ই।”

“পরিস্থিতি তো এক।”

“আংশিক। তুই বিয়ে করার শখ নিয়ে বড় হয়েছিস আর আমি কোনো প্রকার শখ ছাড়াই বড় হয়েছি। তুই বিয়ে করতে চাইছিলি আমি চাইছি না।”

“কেনো চাইছিস না? নিহান তোকে কতো ভালোবাসে।”

“তোরা সবাই এই এক কথায় পরে আছিস কেনো বলতে পারিস? নিহান ভাইয়া আমায় ভালোবাসে বলেই আমায় তাকে বিয়ে করতে হবে? আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই? আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না? না কি কেউ একজন আমায় ভালোবেসেছে বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে আমায় বিয়ে করতে হবে! আমি বুঝতে পারছি না অথৈ। তোকে বুঝতে পারছি না। আজীবন তুই আমায় বুঝেছিস। হিমি আপু বুঝেছে। বুঝিয়েওছে। কিন্তু আজ তোমরা দুজনেই আমাকে বুঝছো না, বুঝাতেও পারছো না। মনে হচ্ছে যেনো আমি তোমাদের গলার কাটা! কোনোরকম উগরে দিলেই বাঁচো।”

অথৈ থম মেরে গেলো মিশ্মির কথায়। ঘরে ঢোকেন রোশন আরা। মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,

“বাইরে আয়। কখন থেকে বসে আছেন ওনারা।”

“আমি গিয়ে কি করবো মা? দাওয়াত তোমরা দিয়েছো গল্পগুজব করার হলে তোমরা করো। খাওয়াও তাদের। আমায় কেনো রেডি করিয়েছো আর যেতেই বা কেনো বলছো?”

ঝাঁঝালো গলায় বললো মিশ্মি। রোশন আরা গম্ভীর গলায় বললেন,

“ওরা তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মিশ্মি। বিয়ে সংক্রান্ত কারনেই আজ তাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তোকে বেশি কিছু করতে হবে না, বড়দের সালাম করবি, হেসে হেসে দুটো কথা বলবি। ওরা খেতে বসবে তুই সার্ভ করবি। চল।”

মিশ্মি নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ালো। অথৈ বাইরে চলে গেছে ততক্ষনে। রোশন আরা মিশ্মির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলেন। থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বললেন,

“শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে তোকে। এবার একটু হাস! ‌সবাই ভাববে জোর করে বিয়ে দিচ্ছি।”

“দিচ্ছোই তো।”

“তোর ভালোর কথা ভেবেই দিচ্ছি।”

“আমার তো তা মনে হয় না।”

“তোর মনে না হলে আমার কিছু করার নেই। আমি তো তোর মা, কখনোই তোর খারাপ হোক সেটা চাইবো না। আমি জানি কোনটায় তোর ভালো, কোনটায় খারাপ।”

মিশ্মি বাঁকা হেসে বললো,

“জ্যাঠিমাকে দেখে শিখেছো?”

“কি শিখবো?”

“কি করে নিজের মন মতো সন্তানদের চালনা করতে হয়! ‌অন্বেষাপুকে তো ফাইনাল এক্সামটাই দিতে দিলো না জ্যাঠিমা। বিয়ে করিয়ে এক মাসের মধ্যে বিদেশ পাঠিয়ে দিলো। অথৈর মতামত না জেনেই বিয়ে ঠিক করে দিলো। হিরনকে ছোট্টবেলা থেকে হোস্টেলে থাকতে বাধ্য করে গেছে। এমনকি নিজের বোনদের বিয়েতেও আসতে পারে নি সে। তুমিও এর ব্যতিক্রম কিছু করছো না মা। আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো। জোর করেই দিচ্ছো।”

“বেশ করছি। বিয়ে করতে অমত করলে তোমার হাত পা ভেঙে দেবো আমি। একের পর এক আকাম ঘটাচ্ছে আর বড় বড় কথা বলছে। তোমার ভাগ্য ভালো মতিউর চাচা বিয়েতে রাজি হয়েছেন। তোমার কুকীর্তি বের হ‌ওয়ার আগে ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে ও বাড়ি গিয়ে উঠো। নয়তো অন্যের সংসার ভাঙতে সময় লাগবে না।”

মিশ্মি রুদ্ধ গলায় বললো,

“আমি কারো সংসার ভাঙতাম না মা!”

“ভাঙতে কি ভাঙতে না সেটা এখন জানা বুঝার সময় নয়। বুঝদার হ‌ওয়ার পর থেকেই তো হিমিপু, হিমিপু করে গেছো। এখন যখন তোমার হিমিপু সত্যি সত্যি তোমার জীবনটা গড়ে দিচ্ছে তখন ভাঙতে চাও কেনো? সব মানিয়ে নিলেই হয়!”

“আমি নিহান ভাইয়াকে ভালোবাসি না। তাই তাকে বিয়েও করবো না। আগেও বলেছি আবার‌ও বলছি। বিয়ের দিন কিন্তু আমার মরা মুখ দেখবে তোমরা!”

তাৎক্ষনিক মিশ্মির গালে সজোরে চড় বসালেন রোশন আরা। বাহু টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“বেয়াদব অসভ্য মেয়ে। মরা মুখ দেখাবেন উনি। চড় মেরে গাল ফাটিয়ে দেবো বলে দিচ্ছি। এতক্ষন ধরে ভালোয় ভালোয় বলছি তা শোনার নয়। ভালোবাসা দিয়ে কি করবি তুই? যাকে ভালোবাসিস সেও তো তোর হবে না। কিসের এতো ঢং? মার খাওয়ার স্বভাব! চোখ মোছ এক্ষুনি। শাড়ি ফারি ঠিক করে চুপচাপ নিচে আয়। খবরদার যদি চেহারা হাসি খুশি না রেখেছিস তবে দেখেনিস!”

কথা শেষ করেই ঝাড়া মেরে হাত ছেড়ে নিচে চলে যান রোশন আরা। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো মিশ্মি। হেঁচকি উঠে গেলো তার। টিস্যু পেপার নিয়ে চোখ মুখ মোছে জোরে জোরে শ্বাস টানলো এবার। অতিরিক্ত রাগ লাগছে মিশ্মির। সবার উপর রাগ লাগছে। বিশেষ করে হিমির উপর। হিমি যদি ওইদিন মিথ্যেটা না বলতো তবে মিশ্মির বিয়েটাও হতো না। সে তার মতোই থাকতো। হিমি নিশ্চয় জেনে বুঝে কাজটা করেছে।

চলবে,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here