হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৩.
“শুনলাম তোর বাবা মা তোর বিয়ে ঠিক করছে। সত্যি?”
ইমনের প্রশ্নে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। মেঘ বিস্মিত চোখে তাকালো সোহিনীর দিকে। সোহিনী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ভাতের লোকমা মুখে তুলে খেতে খেতে বললো,
“হুম সত্যি।”
দোহা কাঁচা মরিচে কামড় বসালো। বললো,
“তুই তাহলে বিয়ে করছিস?”
“উহু আমি করছি না।”
“করছিস না? তবে তোর বিয়ে ঠিক হচ্ছে কেনো?”
হিমির সাথে তাল মেলালো সূর্য। বললো,
“তুই বিয়া না করলে বিয়া ঠিক হয় কেমনে? সত্যি কইরা ক সোহু তুই কি আমাগো মেঘরে ধোঁকা দেয়ার পয়তারা করতেছিস?”
সোহিনী মাথা নাড়লো। ধীর স্থিরে মুখের খাবার শেষ করে পানি খেলো। সোহিনীর উত্তরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মেঘ। সোহিনী উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো। টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“শহরে বখাটে ছেলেদের ওত পাত বেড়ে গেছে। মেয়েরা পরিবারের সাথেই সেইফ না আমি আবার একা থাকি। তাই বাবা মায়ের মনে হলো আমার বিয়ে করিয়ে দেয়া অতি আবশ্যক। একারনেই বিয়ে ঠিক হচ্ছে।”
দোহা পানি গিলে বললো,
“বেশ ভালো কথা। কিন্তু তুই মানা করিস নি আঙ্কেল আন্টিকে?”
“করেছি। শুনেন নি।”
“বিয়ে কবে?”
এতক্ষনে মুখ খোললো মেঘ। নির্লিপ্ত গলায় উক্ত প্রশ্ন করলো সে। সোহিনী এবারও স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
“জেনে লাভ নেই। আমিও জানি নি তাই। বিয়ে করছি না তো!”
হিমি বিরক্ত গলায় বললো,
“আজাইরা কথা সব! বিয়ে করছিস না তবে বিয়ে ঠিক হবে কেনো? এদিকে আবার মেঘকে বিয়ে করার কথা বলেছিস। কিছুই মাথায় ঢোকছে না।”
“সহজ বিষয় বুঝবি না কেনো? আমার বাবা মা চায় আমায় বিয়ে দিতে। তাই বিয়ে ঠিক করছে। আমি তাদের কথায় বিয়ে করতে চাই না তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। এবং ওরা ডাকলেও দেখা করতে যাচ্ছি না। কারন বিয়ে করছি না। এখানে ফেরার পর মনে হলো যার সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হয়েছে তার থেকে ভালো মেঘ। আমার হুট করেই মেঘকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু মেঘ এখনো কিছুই জানায় নি। ব্যাপারটা খুব সহজ।”
হিমি সিঙারার প্লেইট ঠেলে সরিয়ে রেখে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললো,
“মেঘ যদি তোকে বিয়ে করতে না চায়?”
“অন্য কাউকে খুঁজবো। তবুও বাবার পছন্দ করা ওই লোকটাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।”
ইমনের খাওয়াও হয়ে গেছে ততক্ষনে। সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো,
“ওই হারামজাদা তোর কাছে কি চায় সোহু? শুনলাম, তোর ফ্ল্যাটের বাইরে হল্লা করেছে?”
“কোন হারামজাদার কথা কস দোস্ত?”
সূর্যের উদ্বীগ্নতা ছাপিয়ে যায় বাকিদের মধ্যেও। ইমন থমথমে মুখভঙ্গী করে বলে,
“আরাফাত।”
দোহা খাওয়া বন্ধ করলো। মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বললো,
“সোহুর এক্স!”
“হু। জেলে কেমনে পৌঁছালো সেটাও জানি না। বলবি?”
সোহিনী ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলালো। চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে বললো,
“আমার কাছে কি চায় তা তো জানি না। জিজ্ঞেসও করি নি। তবে অনেক হল্লা করেছে। চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়াও আমার দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছে। পরে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছি।”
মেঘ নিচু স্বরে জানতে চাইলো,
“কি বলে ধরিয়েছিস?”
“যা সত্যি তাই বলেছি। হ্যারেজ করছে, রাত বিরাতে এসে ডিস্টার্ব করছে, অসভ্যতামো করার চেষ্টা করছে। আরো কিছু বলেছি। ভেবেছিলাম এবার শান্তি পাবো। তা আর হলো কোথায়! পুলিশি কার্যের পর বিল্ডিংএর মালিক সোজা আমায় বের করে দিয়েছে। মাঝরাতে পরে বহু কষ্টে অন্য একটা ফ্ল্যাট যোগার করেছি। এখনো আছে ও জেলে। থাক কয়েকদিন। শিক্ষা হোক।”
“ব্যাটা লুইচ্চা। ঘরে বউ রাইখা প্রাক্তনরে চায়। শালা ***** সামনে পাইলে খুন কইরা ফেলতাম! তোর উচিত আছিল ওই হারামীটারে ঘরে আটকাই রাইখা আমাগোরে কল দেয়া। এরপর দেখতি, কেমনে তার শয়তানি ঘাড় থাইকা নামাই। বেক্কল!”
সোহিনী শব্দ করে হাসলো। ইমন দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
“এখন সব ঠিক আছে তো?”
সোহিনী মাথা দুলালো শুধু। দোহার খাওয়া শেষ হতেই চায়ের অর্ডার দিলো সূর্য। সবাই মিলে মেতে উঠলো আড্ডায়। মেঘই শুধু ভাবনায় আটকে গেলো। সোহিনীর বাবা মা যদি জোর করে তবে কি সোহিনী বিয়ে করে ফেলবে? মেঘের উত্তর দেয়া হবে না? সোহিনী নিশ্চয় মেঘকে ভালোবাসে না! বাসলে অন্য কাউকে খোঁজার কথা বলতো না। বলতো, মেঘের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। মেঘ বিয়ে না করতে চাইলে সে কুমারী থাকবে। কিন্তু সোহিনী তো পুরো বিপরীত কথা বললো। মেঘকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে সোহিনীন অন্য কোনো কারন আছে কি?
___________________
নিরিবিলি পরিবেশের নিরবতাকে চ্যুত করে বেজে উঠলো মুঠোফোন। মোজাম্মেল সাহেব বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন। হাতে চায়ের কাপ। মাথার উপরে অন্ধকার আকাশ। চাঁদ তারাবিহীন আকাশ দেখতেও বেশ লাগছে ওনার। এর মধ্যেই হিমির ফোন পেয়ে কিছুটা বিচলিত হয়ে পরলেন তিনি। কাপ নিচে নামিয়ে রেখে ফোন উঠালেন। অভিমানী গলায় বলে উঠলো হিমি,
“জ্যাঠুমনি?”
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকালেন। ভাবুক গলায় বললেন,
“কি হয়েছে মা? তুই কাঁদছিস?”
“না। তবে মনে হচ্ছে কেঁদে দেবো।”
“কেনো? কান্নার কি হয়েছে?”
“বাচ্চা ডাক্তার আমার ফোন তুলছেন না।”
মোজাম্মেল সাহেব থমকালেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“ফোন তুলছে না বলে কান্না পাচ্ছে?”
“বুঝতে পারছি না।”
মোজাম্মেল সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন,
“ফোন কেনো করেছিলি তাকে?”
“দেখা করতে ইচ্ছে করলো। ভেবেছিলাম চা খেতে খেতে গল্প করবো।”
মোজাম্মেল সাহেব হাসলেন। বললেন,
“পরশু তার বিয়ে। আজ ও তোর সাথে চা খেতে আসবে ভাবলি কি করে?”
হিমি লজ্জা পেলো কিছুটা। অপ্রতিভ গলায় বললো,
“খুব দরকার হলেও আসবে না?”
“না। আসবে না। বিয়ের পরও যে আসবে তারও কোনো মানে নেই।”
“কেনো কেনো? বিয়ের পর ওনার আমার কথা মনে পরবে না?”
“তুই তো বললি তোরা বন্ধু না।”
“নই তো!”
“যেহেতু তোরা বন্ধু না সেহেতু দেখা করার উত্তেজনাও নেই। বিয়ের পর ব্যস্ততা বাড়বে তার। একে তো ডাক্তার তার উপর স্বামী। স্ত্রীর কথাও ভাবতে হয়। স্ত্রীকেও সময় দিতে হয়। তার বিয়ের পর দেখবি মাসেও তোর সাথে দেখা করার সময় পাবে না সে। কথাও বলবে না হয়তো!”
হিমির গলায় কাঁপুনি ধরলো। আমতা আমতা করে বললো,
“এক্কেবারে ভুলে যাবেন?”
“ভুলতেই পারে। তোর কি কষ্ট হচ্ছে হিমি?”
জবাব দেয় না সে। ফোন কেটে দেয়। মোজাম্মেল সাহেব ফোন নামিয়ে রেখে মৃদু হাসেন। তিনি যা ভাবছেন তাই যদি হয়ে থাকে তবে হিমির জীবন ঘুরে যাবে। কয়েকদিনের মধ্যে এক নতুন হিমিকে দেখবেন তিনি। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের। হিমির অতীত বর্তমান উনি সুন্দর করতে পারেন নি। ভবিষ্যত করবেন। বদলে দেবেন হিমিকে নিয়ে সবার চিন্তাধারা। যা এতগুলো বছর হিমি পায় নি সবই পাবে এখন থেকে। মোজাম্মেল সাহেব ফোন উঠান আবারও। কল লাগান কারো নাম্বারে। পরিকল্পনা করতে হবে। সময় বেশি নেই হাতে।
__________________
মায়মুনা জামান হাতে দুটো বেনারসী শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটার রঙ গাঢ় লাল অন্যটার গাঢ় গোলাপী। কনেকে বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে শাড়ি দিতে হয়। তিনি সামিয়ার জন্য এ দুটো শাড়ি পছন্দ করেছেন। দিতে হবে যেকোনো একটা। কোনটা দেবেন সেটা নিয়েই কনফিউশনে পরে গেছেন তিনি। তাহিরকে ছাদ থেকে নিচে আসতে দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। মুখের সামনে শাড়ি দুটো উঁচু করে ধরতে ঘাবড়ে গেলো তাহির। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালে তিনি বললেন,
“দেখোতো কোনটা সুন্দর লাগছে?”
“দুটোই সুন্দর মা।”
“দুটো সুন্দর বলেই আমার হাতে আছে। এখন এ দুটো থেকে যেকোনো একটা পছন্দ করো। বউয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে। তুমি যে শাড়ি পছন্দ করবে সেটাই বিয়েতে পরবে সামিয়া।”
“কেনো? ওনাকে ওনার পছন্দের শাড়ি পরতে দিলেই হয়। আমার পছন্দ ওনার অপছন্দ হতে পারে!”
“হবে না। আর হলেও বা কি! অভ্যাস করতে হবে। বিয়ের পর তোমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী থাকতে হবে তাকে।”
তাহির শুকনো হাসলো। মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“তুমি তো বাবার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী থাকো নি মা! তাহলে অন্য কাউকে তার বরের পছন্দ অপছন্দে থাকতে বলছো কেনো?”
মায়মুনা জামানের হাসি মিলিয়ে গেলো। চোখ মুখ শক্ত হলো ওনার। তাহিরের খেয়াল হলো এ কথাটা বলা উচিত হয় নি তার। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করতেই মায়মুনা জামান মৃদু গলায় বললেন,
“তুমি তোমার বাবার মতো নও। আর না সামিয়া আমার মতো। যদি তুমি তোমার বাবার মতো হতে তবে অন্য কথা বলতাম। তোমাকে আমি আমার মতো করে বড় করেছি। ভালো ছেলে, ভালো ভাই, ভালো মানুষ হয়ে তৈরী হয়েছো তুমি। এবার ভালো স্বামী হওয়ার পালা। আমি বিশ্বাস করি তুমি সবদিক থেকেই ভালো হবে। তোমার কথায় আমি রাগ করি নি তাহির। ভুল বলো নি বলেই আমার ভালো লাগছে। যাই হোক, শাড়ি দুটো তোমার ঘরে রেখে দিচ্ছি। চাইলে সামিয়াকে শাড়ির ছবি দেখাতে পারো। তার যেটা পছন্দ হবে সেটা পাঠাবো। ঠিক আছে?”
তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়মুনা জামান তাহিরকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠলেন। তাহির বুক ভরে শ্বাস টানলো। দু হাতে চুল মুঠো করে মনে মনে কিছু একটা আওড়ালো। উপলব্ধি করলো বাবার মতোই তার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না। বাবার মতোই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। বাবার মতোই বড় কোনো ভুল করবে না তো তাহির?
চলবে,,,,,,,,,