হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৭.
ব্যালকনিতে কারো ছায়া দেখে এগিয়ে গেলো তাহির। উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে হিমি। চুলগুলো বাঁধনহারা তার। তাহির ধীর পা ফেলে হিমির পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এখানে কি করছেন? ভেতরে চলুন।’
‘ভালো লাগছে না।’
‘মন খারাপ করছে?’
‘উহুম,,,, কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর পুরছে মনে হচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে লাগছে। কান্নাও পাচ্ছে।’
তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ব্যালকনির বাইরে দৃষ্টি দিলো। শান্ত গলায় বললো,
‘বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। না?’
হিমি জবাব দেয় না। তাহির কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। হয়তো হিমির উত্তর জানতে চায়। হিমিকে অপ্রস্তুত দেখে নিজ থেকেই বললো,
‘আই অ্যাম সরি হিমি। আমার উচিত ছিলো বিয়েতে সম্মতি না দেয়া। আসলে, মামা এমন ভাবে বলছিলেন যে মনে হচ্ছিলো বিয়ে না হলে বড় কোনো অঘটন ঘটে যাবে। মায়ের কথা ভেবেই রাজি হয়ে গেছিলাম। আপনার সাথে আলাদা করে কথা বলা উচিত ছিলো আমার।’
হিমি বুকের গভীর থেকে নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘আমার বড়মার কথা খুব মনে পরছে বাচ্চা ডাক্তার। বড়মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমার কথা ভেবে কাঁদছেও হয়তো। রাগ করতেও পারে। মামুও চিন্তা করছে হয়তো। আমিও ভুল করে ফেলেছি জানেন! জ্যাঠুমনির কথা শোনা উচিত হয় নি। এখন খুব আফসোস হচ্ছে।’
‘আমারও আফসোস হচ্ছে। ভীষন আফসোস।’
তারপর দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। নিরবতায় ভেসে এলো ঝিম ঝিম কিছু শব্দ। দুজনের নিঃশ্বাসের আওয়াজ। তাহির হিমির দিকে ফিরলো। হিমি তখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে। তার দৃষ্টি শূণ্যে স্থির হয়ে আছে। তাহির খেয়াল করলো হিমির চোখে পানি। হিমির উদ্দেশ্যে আহত গলায় বললো,
‘আমি বুঝতে পারছি আমার জন্য এসব যতোটা না কঠিন আপনার জন্য তার চেয়েও বেশি কঠিন। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আগে ছিলো। বুঝি নি। চাইলেই বিরোধীতা করে সরে আসতে পারতাম।’
কয়েক মুহুর্ত থেমে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কেনো সরে আসেন নি হিমি।’
‘চেয়েছিলাম বাচ্চা ডাক্তার। জ্যাঠুমনি দেয় নি। এক মুহুর্তে ভেবেছিলাম পালাবো। পরে মনে হলো আমিও যদি পালাই তবে আপনাদের বেঁচে যাওয়া সম্মানটুকুও মাটিতে মিশে যাবে। আমি আপনাকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। আপনাদের ভালো রাখতে, জ্যাঠুমনির কথা রাখতে আর দাদুর পরিকল্পনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সরে আসি নি।’
‘দাদুর পরিকল্পনা মানে?’
‘পরে বলবো। এখন বলুন তো! আপনার মা কেমন আছেন? প্রেশার ঠিকঠাক আছে?’
‘হ্যা। এখন ভালো আছেন।’
‘রেগে আছেন নিশ্চয়?’
‘তা একটু আছেন। তবে রাগের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছেন। ওনার সাথে কথা না বলে বিয়ে করে ফেলায় আঘাত পেয়েছেন মা। মামার উপর রাগ ঝাড়তে পারেন।’
হিমি মাথা দুলিয়ে শুকনো হাসলো। মন বিষিয়ে উঠলো তার। জ্যাঠুমনি বলেছে এখন থেকে হিমির বাড়ি হলো ওর শ্বশুরবাড়ি। এটাই ওর সংসার। পরিবার। অথচ এখানেও কেউ তাকে নিয়ে খুশি নয়। বিশেষত্ব নেই কিছুতেই। কেউই হিমিকে চায় নি। আবারও নতুন কারো সাথে জড়িয়ে গেলো অজান্তে, অনিচ্ছায়। এখানেও উটকো সে। জীবনে কখনোই কি কারো বিশেষ মানুষ হতে পারবে না? জানে না হিমি। জানতেও চায় না। নিজেকে শান্ত করে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে। তাহিরের দিকে ঘুরে বলে,
‘কতক্ষন ধরে এতসব পরে আছেন। ফ্রেশ হোন গিয়ে।’
‘আপনি ফ্রেশ হবেন না?’
‘সাথে তো কিছু আনি নি বাচ্চা ডাক্তার। আপনি যান। আমার কথা ভাবতে হবে না। বাড়ি আপনার, ঘর আপনার। নিজের মতো করেই থাকুন। আমার জন্য আনকোম্ফোর্টেবল ফিল করবেন না। রিলেক্স!’
তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। শোবার ঘরে ঢোকে আলমারি থেকে টাউজার আর টি শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকলো সে। বেশ কিছুক্ষন পর কাপড় পাল্টে ঘরে ফিরলো তাহির। ব্যালকনির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
‘হিমি? ভেতরে আসুন। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।’
হিমি ঘাড় বাঁকিয়ে বললো,
‘খিদে নেই। আপনি খেয়ে নিন।’
‘ফ্রেশ তো হবেন। হৃদির কোনো পোশাক আজকের জন্য পরে নিন। ডাকছি ওকে।’
হিমি মাথা দুলিয়ে ঘরে ঢোকলো। ওয়াশরুমে ঢোকে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে। তাহির সোফায় বসে ছিলো। হিমি বেরুতেই বললো,
‘সরি হিমি। দরজা বাইরে থেকে আটকানো। আমার ফোন মায়ের কাছে দুদিন ধরে। হৃদিকে ডেকেও লাভ হয় নি। নিজের ঘরে আছে হয়তো।’
‘ব্যাপার না। আমি এ কাপড়েই ঘুমাতে পারবো।’
‘একটু তো খাবেন! শরীর খারাপ করবে নাহলে।’
হিমি অসম্মতি জানালো। খাটের কাছে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি নিয়ে বললো,
‘কোথায় ঘুমাবো?’
তাহির চোখ তোলে তাকালো। বোকা বোকা গলায় বললো,
‘আমিতো খাটে ঘুমাই। আপনি কিসে ঘুমান?’
‘খাটেই!’
‘তাহলে জানতে চাইছেন কেনো?’
‘না মানে, খাট তো আপনার। আপনি ঘুমাবেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম আমি কোথায় ঘুমাবো। আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না আর।’
তাহির ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘বিরক্ত হচ্ছি না আমি। হবোও না। শুয়ে পরুন। আমার জন্য একপাশে একটু খানি জায়গা রাখলেই হবে।’
পরোক্ষনেই বললো,
‘তবে আপনার অসুবিধা হলে আমি সোফায় ঘুমাতে পারি।’
মাথা নাড়লো হিমি। বললো,
‘আরে না না। আপনার যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ঘুমান। আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।’
……………………………
‘মেয়ের পরিবার নিয়ে তোমাদের কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও আমার আছে। ছেলে আমার। সংসার আমার। আমার সংসারে কে আসবে, কে থাকবে সেটা আমার ঠিক করার কথা ছিলো। আর তোমরা নিজেদের মনমতো সব করে ফেললে?’
মায়মুনা জামানের কথায় মুখ ছোট করলেন ওনার ভাই। আমতা আমতা করে বললেন,
‘আপা এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।’
গর্জে উঠলেন মায়মুনা,
‘উপায় খুঁজতে বলেছে কে? বাড়ির হবু বউ পালিয়েছে মানেই বিয়ে ক্যান্সেল। তোমাদের উচিত ছিলো ওখান থেকে সোজা বাড়িতে আসা। আমাকে জানানো। তা না করে আমার থেকে সব আড়াল করে অচেনা, অজানা এক মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনলে। কি জানো ওই মেয়ের ব্যাপারে? ওর খানদান, বংশ, পরিবার, বাবা মা, শিক্ষা কিছুই তো জানো না। তাহলে বিয়ে দিলে কেনো আমার ছেলের সাথে? আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলে তোমরা। আমি এটা তোমার থেকে আশা করি নি আফতাব।’
মায়মুনা জামানের ছোট ভাই আফতাব অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘মেয়ের জ্যাঠু মোজাম্মেল রহমান এগিয়ে না এলে আমাদের সম্মান কি আর থাকতো? আর তাছাড়া মেয়েকে তো তাহির আগে থেকেই চিনতো। ও তো অমত করে নি।’
‘কেনো করে নি সেটা জানো? তাহিরকে তুমি বলেছো বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাবো, আমার অসম্মান হবে। একবার আমায় জানাতে পারলে না। তুমি বুঝতে পারছো না আফতাব এই মেয়ের সাথে আমার তাহিরের কিছুতেই যায় না।’
‘যার সাথে তাহিরের যেতো সেই তো পালালো। এখন যাকে ঘরে এনেছি তাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না।’
‘ফেলে দিতে বলছি না। শুধু বলছি খোঁজখবর না নিয়ে থাকলে এখন নাও। আমার সবকিছু জানা জ্বরুরি। আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। আমি বুঝি না বাড়ির মেয়ের বিয়ে এভাবে কেউ কি করে দিতে পারে? কোথায় বিয়ে দিচ্ছে, কার ঘরে পাঠাচ্ছে এসব তো জানবে! আমি যতোটা আমার তাহিরকে নিয়ে চিন্তা করছি মনে হচ্ছে না ওরা ওদের মেয়েকে নিয়ে করছে বলে। আশ্চর্য। বরের মায়ের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তাও মনে করেন নি ওনারা?’
‘আপা? কাল তো রিসেপশন। তখন নাহয় মেয়ের পরিবারের সাথে আলাপ হবে।’
‘কিসের রিসেপশন? যেখানে বিয়েই হলো হুটহাট সেখানে বউভাত, রিসেপশনের কোনো প্রশ্নই উঠে না।’
‘কিন্তু সবাইকে তো ইনভিটেশন করা হয়ে গেছে।’
‘মানা করে দাও।’
‘এখন?’
‘যখন ভালো মনে করো। আগামী কাল আমি আমার বাড়িতে এক্সট্রা কাউকে চাই না। যারা আছে তো আছেই। শুধু মেয়ের পরিবারকে জানিয়ে দিও। ওনাদের সাথে আমার কথা হওয়াটা জ্বরুরি। এখন যাও। মাথা ধরেছে আমার।’
আফতাব উদ্দীন মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই পিছু ডাকলেন মায়মুনা। বললেন,
‘প্যারাসিটামল আছে?’
‘না আপা।’
‘দেখো বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞেস করে। পেলে কাউকে দিয়ে পাঠাও। আমার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে। আনানোর কথা মনে নেই।’
কথা বলতে বলতেই একহাতে কপাল টিপতে লাগলেন মায়মুনা। আফতাব উদ্দীন কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। ভাগ্নের ভালোর কথা ভেবেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। অথচ আপা এমন ভাবে বলছেন যেনো তাহিরের উপর ওনার কোনো অধিকার নেই। মামা হয়ে ভাগ্নের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। অপমানিত বোধ করেন তিনি।
চলবে,,,,,,,