হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫০.
শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকেই তাহিরের জবাবদিহি চলছে। আর সেই জবাবদিহি করছেন জনাব মতিউর রহমান। সোফায় আয়েস করে বসে তাহিরের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে মতিউর রহমান বলে উঠেন,
‘আমার নাতনিকে কবে থেকে চেনো?’
‘কয়েক মাস হয়েছে হয়তো।’
‘তোমাদের মধ্যে ওসব সম্পর্ক হলো কি করে?’
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। কৌতুহলী গলায় বললো,
‘কোন সম্পর্ক?’
‘ওইযে, প্রেমের সম্পর্ক!’
‘আমাদের মধ্যে এধরনের সম্পর্ক ছিলো না দাদু।’
‘ছিলো না?’
‘জি না।’
‘তাহলে বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো?’
‘মায়ের কথা ভেবে। তখন বিয়ে না করে ফিরে গেলে মা কষ্ট পেতেন, অপমানিত হতেন তাই।’
মতিউর রহমান ভ্রু উচিয়ে পরখ করলেন তাহিরকে। স্মিত গলায় বললেন,
‘মাকে ভালোবাসো?’
‘বাসি।’
‘মায়ের কথাতেই উঠবস করো নিশ্চয়?’
তাহির নিঃশব্দে হেসে উত্তর দিলো,
‘তা করি।’
মতিউর রহমান মাথা দুলালেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘তুমি কি করো?’
‘আমি একজন ডাক্তার।’
‘কিসের ডাক্তার?’
‘সাইকিয়াট্রিস্ট। চাইল্ড স্পেশালিস্ট।’
‘আমি অতো ইংরেজি বুঝি না। বাংলায় বলো।’
‘মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।’
মতিউর রহমান বাঁকা চোখে তাকালেন। বললেন,
‘মানুষের মন বুঝার ক্ষমতা আছে?’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’
‘বলো দেখি আমার মনে কি চলছে?’
কথাটা বলে কিছুটা ঝুঁকলেন তিনি। তাহির মৃদু হেসে মতিউর রহমানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। কয়েক সেকেন্ড মতিউর রহমানের চেহারায় চোখ বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
‘আপনার মনে এখন বিশেষ কিছু চলছে না। একটু আগে অব্দি আমাকে নাতজামাই হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি তাই খানিক লজ্জা পাচ্ছেন।’
‘আমি লজ্জা পাচ্ছি? কেনো?’
‘জি পাচ্ছেন। কারনটা খুব সহজ। আমাকে আপনার মনে ধরেছে। আমার জন্য আপনি গর্ববোধ করছেন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন নি আপনার নাতনির জীবনে এমন কেউ আসবে। এসেছে তাই খুশি খুশি লাগছে। প্রথমে রেগে ছিলেন বলেই এখন লজ্জা পাচ্ছেন।’
মতিউর রহমান মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। ডাট বজায় রেখে বললেন,
‘মিথ্যে কথা। আমি এখনো তোমায় নাতজামাই হিসেবে মেনে নেই নি। রেগে আছি।’
তাহির ফিসফিস করে বললো,
‘নিজের ডাট বজায় রাখতে একথা আপনি বলতেই পারেন। তবে সত্যিটা হলো আপনি আমায় মেনে নিয়েছেন। আপনি রাগ করতে চেয়েও রাগ করতে পারছেন না। খুশি খুশি অনুভব করছেন। অযথা রেগে যাওয়ায় এখন আফসোস করছেন। সেই সাথে আমাকে নিয়ে ভাবছেন। ঠিক বলি নি?’
‘না। ভুল বলছো। তুমি আসলে মানুষের মন বুঝো না। সব ভুয়া। নিশ্চয় ছোটবেলায় পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়েছো। পরীক্ষাতেও নকল করছ পাশ করেছো বোধ হয়। নয়তো এখন আমার মন বুঝতে পারতে। তোমার মা শুধু শুধু এতো টাকা খরচা করে তোমায় লেখাপড়া করালেন। কাজের কাজ হলো না, উল্টো বিগড়ে গেলে।’
তাহির ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো। ভদ্রলোক যে ব্যাপক লজ্জা পেয়ে বিপাকে পরেছেন এবং তিনি সেসব বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না সেটা তাহির বুঝতে পেরেছে। আর পেরেছে বলেই কথা বাড়ালো না সে। চুপ করে রইলো। দেখলো এই বৃদ্ধ ডাটিয়াল লোক কি করে একের পর এক গম্ভীর কথা বলে তাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করছেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। বসার ঘরে টেলিভিশনে খবরের চ্যানেল চলছে। কেউ দেখছে না যদিও। তবুও চলছে। জার্নালিস্ট দেশের খবর পড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক সংবাদ পড়ছেন। তাহির মনোযোগী শ্রোতার মতো টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। টি টেবিলের উপর ফল, সন্দেস, চা, শরবত সহ আরো কিছু নাশতা জমা করেছেন আমিনা বেগম। তাহির বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
‘করেছেন কি? আমি আর কিছু খেতে পারবো না।’
আমিনা বেগম দ্বিগুন বিস্ময় নিয়ে বললেন,
‘পারবে না কেনো? কিছুই তো খাও নি বাবা! দুপুরেও ঠিক করে খেলে না বিকেলেও নাশতা করলে না এখনো খাবে না বলছো যে? শরীর খারাপ করছে?’
‘খাই নি বলছেন? আপনি যে জোর করে খাওয়ালেন! মাছের মাথা, মুরগী ভুনা, সবজি আরো কতো কি তো খেলাম! পেটে আর কতো জায়গা হবে?’
‘হতে হবে। এই বয়সে না খেলে আর খাবে কখন? এই যে আমায় দেখো। তোমার বয়সে খেতে চাইতাম না। এখন চাই। তবে পাই না। এতো বছর বিদেশে থেকেও শান্তি পাই নি। নিজে নিজে রেঁধে খেয়েছি। ভালো কিছু রাঁধতে পারতাম না বলে বিদেশীদের খাবার খেতে হয়েছে। দেশে ফিরে ভাবলাম পেট পুরে খাবো। কিন্তু এই মহিলা আমাকে ঠিকঠাক খেতে দেয় না। একবেলা চা দিলে আরেক বেলা দিবে না। দিলেও চিনি দিবে না। বিস্কুট দিবে না। তুমি যখন আমার বয়সে আসবে তখন পস্তাবে। তোমার বউ তো আবার রান্না বান্না জানে না। ভবিষ্যতে উপোস থাকতেও হতে পারে।’
মোজাম্মেল সাহেবের কথায় হেসে উঠলো তাহির। আমিনা বেগম মুখ ঝামটিয়ে তাহিরের দিকে সন্দেসের প্লেইট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ঠান্ডা হয়ে যাবে। খাও। চা শরবত দুটোই দিয়েছি যা ইচ্ছা খেতে পারো।’
মোজাম্মেল সাহেব সন্দিহান গলায় বললেন,
‘আর আমার নাশতা কোথায়?’
‘তোমার আবার কি নাশতা? ওসব মিষ্টি সন্দেস খেতে হবে না তোমায়। দাঁড়াও চা আনছি।’
রান্নাঘরে চলে গেলেন আমিনা। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘বোরিং লাগছে না তো!’
তাহির মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে নাশতার প্লেইট নিচে নামিয়ে রাখলো। চায়ের কাপ হাতে উঠিয়ে চুমুক বসালো তাতে। চায়ের স্বাদ দারুণ হয়েছে। তাহির তৃপ্তি করে চা খেলো। আমিনা বেগম আরো এক কাপ চা এনে মোজাম্মেল সাহেবকে দিলেন। কিছুক্ষের মধ্যে বাড়ির বাকি সদস্যরাও এসে উপস্থিত হলেন বসার ঘরে। রমরমা পরিবেশ। তাহিরের এমন একটা পরিবার নেই বলে আফসোস হলো। অবাকও হলো সেই সাথে। হিমির এরকম দুটো পরিবার থাকার পরও সে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে না। সুখ অনুভব করে না। আর তাহির এরকম একটা পরিবারের আশায় কাতরায়!
এখানে আসার পর থেকে তাহির এক মুহুর্তের জন্যও একা থাকে নি। কেউ না কেউ ঠিক তার সাথে কথা বলতে, গল্প করতে চলে এসেছে। আমিনা বেগম তো রান্নাঘর থেকে শুধু বেরিয়েছেন তাহিরকে খাবার দিবেন বলে। অন্যথায় সারাটাদিন নতুন জামাইয়ের জন্য একের পর এক নাশতা, খাবারের পদ তৈরি করছেন। এতসবের মধ্যে রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া হিমির দেখা পায়নি তাহির। অজানা কারনে বাপের আসার পর পরই মুখ গোমরা করে রেখেছে হিমি। ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে না। সন্ধ্যার দিকে একবার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতে চেয়েছিলো। দাদু যেতে দেন নি বলে যাওয়া হয় নি তার। আবারও সেই ঘরে ঢোকে বসে আছে। বড়মা, জ্যাঠুমনি, নিহান কারো সাথেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না তাকে। কথা বলছেও না। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। নয়তো প্রিয় মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মানুষ নয় হিমি।
শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে কপালের উপর বাম হাত রেখে কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিলো তাহির। হিমি ডেকে উঠলো তাহিরকে। কপাল থেকে হাত সরিয়ে সচেতন চোখে তাকালো তাহির। হিমি বাথরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে হলদে রঙের কুর্তি পরনে কালো জিন্স। দু হাতে দুটো চুড়ি, কানে সেই পুরনো ইমিটেশনের পাথরের দুলের বদলে সোনার ছোট্ট ঝুমকো। তাহির বিস্ময় নিয়ে উঠে বসলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘কিছু বলবেন?’
‘আপনি দেখছেন না কিছু?’
‘দেখছি। আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেছেন।’
‘কি?’
রাগান্বিত কৌতুহলী গলায় বললো হিমি। তাহির চট করে উঠে দাঁড়ালো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘আই মিন ছেলেদের পোষাক ছেড়ে মেয়েলী পোষাক পরেছেন। কিন্তু কেনো পরেছেন?’
হিমি এগিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কুর্তির ভাজ ঠিক ঠাক করতে করতে বললো,
‘আপনার মায়ের জন্য।’
‘আমার মায়ের জন্য মানে?’
‘আপনার মা কল করেছিলেন। বড়মাকে আমার নামে নালিশ করেছেন। মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ থাকায় ওনার বিরক্ত লাগে। সম্মানে লাগে। কথাগুলো আবার বড়মার সম্মানে লেগেছে। জোর জবরদস্তি করে এসব পরিয়েছেন আমাকে। শাড়ি ফাড়ি পরতে পারবো না। এতে আপনার মায়ের সমস্যা হবে না তো?’
‘আমি কি করে বলবো?’
‘কেনো? আপনি তো আপনার মাকে খুব ভালো করে চেনেন, জানেন, বুঝেন। আপনার মা আমাকে এই পোষাকে দেখলে কি বলবেন না বলবেন সেটা তো আপনার জানার কথা।’
‘হয়তো। কিন্তু বলতে পারছি না। আমি সত্যিই জানি না মা কি বলবেন। তবে এটুকু বলতে পারি মা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’
হিমি গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘কিছুটা! তাতেই হবে। এর থেকে বেশি স্বস্তি আমি আর কাউকে দিতে পারবো না।’
তাহির মৃদু হাসলো। আয়নায় হিমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনাকে এই পোষাকে মানিয়েছে ভালো।’
‘অথচ আমার মনে হচ্ছে এই পোষাকে আমাকে জঘন্য লাগছে। এর পরিবর্তে যদি ঢোলা ঢালা টি শার্ট বা শার্ট পরতে পারতাম তবে আরাম পেতাম। শান্তি পেতাম।’
তাহিরের সহজ জবাব,
‘তবে তাই পরুন। এখন তো ঘুমানোর সময়। নিজের ঘরে আছেন। যা ইচ্ছা পরতে পারেন। বাইরে গেলে বিশেষ করে তখন নাহয় এসব পরবেন!’
হিমি মাথা নেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো। ঝুটি করে রাখা চুল খোলে দিয়ে বললো,
‘বড়মার আদেশ এট লিস্ট আগামী একমাস এই ধরনের পোষাক পরতে হবে আমায়। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা। ঘুমানোর সময়ও। নাহলে না কি আমার অভ্যাস হবে না। বাড়ির বউ যাচ্ছে তাই অবস্থায় চলাফেরা করলে শাশুড়ি মায়ের হৃদয়ে আঘাত লাগতে পারে। স্বামীরও রাগ লাগতে পারে। আমি নতুন বউ, তাই নতুন বউয়ের মতো বিহেইভ করতে হবে। হবেই হবে। বড়মার কথা কখনোই ফেলি না বলে আজও পারছি না। অসহনীয় জ্বালাতন।’
চলবে,,,,,,,,