হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:১৮

0
986

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:১৮

সদ্য বালু দিয়ে ভরাট করা বিশাল ফাঁকা মাঠের একপ্রান্তে ইটের গাঁদা।তার উপর পা মেলে বসে আছে রাহুল এবং বিরূপাক্ষ।সূর্যমামা ডুবু ডুবু করেও ভাগ্নেদের মায়ায় হয়তো কিছুক্ষণ বেশীই সার্ভিস দিতে ব্যস্ত। বিকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলো দুজনে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে মেলার মাঠ থেকে দুশো গ্রাম চিনে বাদাম কিনে নিয়ে বসেছে নিরিবিলিতে।অন্যদিন গ্রামের ছেলেরা দলবেঁধে বিভিন্ন ধরনের খেলা করতে দেখেছে এখানে কিন্তু আজ কাউকেই দেখলো না বিরূপাক্ষ।হয়তো পূজায় ব্যস্ত যে যার মতো।দুজনের মাঝখানে যে ব্যবধান টুকু রয়েছে সেখানে বাদামের প্যাকেটটা হা করে বসে আছে।প্রায় বিশ_পচিশ বিঘা জমির উপর চিকচিকে বালুর আস্তরণ।একপাশে কুলু কুলু রবে বয়ে চলেছে নদী।সেখান থেকে ধেয়ে আসা বিশুদ্ধ নির্মল বাতাসে মন খারাপেরা দল বেঁধে পালিয়ে যায় নিমিষেই। অপর পাশে পিচ ঢালা রাস্তা এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে ধানি জমির মাঝ বরাবর ‌। আর দুই পাশে ধানি জমি।নিরবতা ভেঙে প্রথমেই কথা বললো রাহুল,,,
আঙ্কেল কিন্তু এই উদ্যোগটা নিয়েছেন খুব ভালো।কারো একটু বেশি পরিমাণে সর্দি কাশি হলেও ছুটতে হয় উপজেলায়। এখানে দাতব্য চিকিৎসালয় হলে গ্রামের মানুষের অনেক উপকার হবে।বিনে পয়সায় উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা।

কি বলছো, এখানে দাতব্য চিকিৎসালয় হবে?এটা তো আমাদের জমি তাইনা?আমি তো ভেবেছি এখানে বোধহয় অন্য কোনো প্রজেক্ট করবে দাদাভাই।

স্মিত হাসে রাহুল,,
না না আঙ্কেলের স্বপ্ন ছিলো তিনি গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করবেন। এখানে শুধু দাতব্য চিকিৎসাই দেওয়া হবে না। উন্নত মানের ক্লিনিক তৈরীর পরিকল্পনা ও হবে রূপ দা।

বিরূপাক্ষ অবাক হয়ে যায় , এতকিছু পরিকল্পনা করে রেখেছে বাবা অথচ তাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না?তবে তাকে ডাক্তার বানানোর খুব ইচ্ছে ছিলো বাবার। কিন্তু জেদের বশে বাবার ইচ্ছে মাটি চাপা দিয়েছে সে নিজেই।

তাহলে তো ভালোই হয়।আসলে আমি তো এতবছর বাড়িতে যোগাযোগ তেমন ভাবে রাখিনি তাই জানিনা এত কিছু। কিন্তু এসব গ্রামগঞ্জে ডিগ্রিধারী ডাক্তারদেরইতো বড়ো অভাব। শহুরে চাকচিক্য মাখা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছেড়ে কোনো ডাক্তার পাড়াগাঁয়ে আসতে চাইবে?

সে ব্যবস্থাও চলছে। শহুরে ড:যদিও না আসে এখানে গ্রামের কেউ ড:হলে তো অবশ্যই থাকবে।আবার সে যদি আর্ত মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে তাহলে তো কথাই নেই।

গ্রামের কেউ মানে?তেমন কেউ আছে নাকি?উডবি ড:?

থাকতেও পারে আবার নাও পারে।মিটি মিটি হাসছে রাহুল।বিরূপাক্ষ ব্যাপারটায় আর এগোয় না,,

আচ্ছা বাদ দাও। তুমি তো আমেরিকাতে ভালো পজিশনে আছো। সেদিন আঙ্কেল বললেন,সেখাকার পাঠ নাকি চুকিয়ে দিতে চাও?

বাবা ঠিকই বলেছেন।সবাই যদি পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে পরে থাকে তাহলে দেশের উন্নয়ন করবে কারা? তাছাড়া আয় রোজগার যথেষ্ট হয়েছে।এখন দেশেই কিছু একটা করবো আর পরিজন প্রিয়জনের সাথে সময় কাটাবো।
বিরূপাক্ষের মনের মধ্যে গতরাতের সেই তোলপাড় শুরু হয় রাহুলের মুখে প্রিয়জন কথাটা শুনে।তাহলে কি রিতির সাথে সবকিছু ফাইনাল করে ফেলেছে।হুট করে শিশুসুলভ প্রশ্ন করে বসে বিরূপাক্ষ,,
আচ্ছা রাহুল তুমি যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেশে ব্যাক করছো রিতি মত দিয়েছে তাতে?
রাহুল বুঝতে পারে বিরূপাক্ষের অভিপ্রায়।মনে মনে ভীষণ হাসে।একটু ঘোরালে ক্ষতি কি?
হ্যা হ্যা রূপ দা।রিতিই তো আমাকে দেশে ফিরে কিছু একটা করতে বললো।সত্যি বলতে কি তা না হলে আমার ফেরার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।

ওহ্।তাহলে দুজনে এগোচ্ছো না ক্যানো?বয়স তো তোমার নেহায়েৎ কম নয়।তার বয়েসটাও সংসার করার জন্য উপযুক্ত।

রাহুল ভেবে পায়না একটা মানুষ কতটা নিচে নামলে তার বর্তমান স্ত্রীর সাথে অন্য একজনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করে। এতক্ষণে বুঝতে পারলো বিরূপাক্ষ ক্যানো তাকে সবার মধ্যে থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাঁটতে বেরোলো। কিন্তু রিতি এবং অন্যান্য সবার মুখে যে ব্যক্তিত্ববান বিরূপাক্ষের গল্প শুনেছে তার সাথে এই বিরূপাক্ষের কোনোভাবেই মিল করতে পারছে না।তবে কি বিরূপাক্ষ তাকেই বাজিয়ে দেখছে?

সে তোমার স্ত্রী রূপ দা।আর অন্য একজনের স্ত্রীকে নিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এগোনো কি কোন বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে?একটু যেনো তাচ্ছিল্য ভরে কথাগুলো বলে রাহুল।

তুমি যেখানকার মানুষ সেখানে এইসব বিবাহিত-অবিবাহিত কি কিছু ম্যাটার করে রাহুল? তাছাড়া ডিভোর্সি মহিলাদের কি পুনরায় বিয়ে,সংসার হচ্ছে না?

সেটা তো এ সমাজেও হচ্ছে দাদা।সবদেশেই হচ্ছে। কিন্তু যে মেয়ে আপনার নামের সিঁদুরে সিঁথি রাঙায়,হাতে শাঁখা পলা পরে তার সম্মন্ধে এহেনো আলাপ আলোচনা কি যথাযথ লাগছে আপনার মুখে?নাকি আপনার এমন ব্যাবহার শোভা পাচ্ছে?আমার ভারতীয় সংস্কার তো এটা সায় দেয় না।আমি যতই আমেরিকা প্রবাসী হই না কেন,মনে প্রাণে ভারতীয় আমি। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর আশায় হয়তো অন্য দেশের গোলামী করছি কিন্তু নিজের দেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি কে গোলাম করিনি এখনো।
এমন ভাবে কথা গুলো বললো রাহুল তার এই নীরব অপমান একটুও বুঝতে দেরী হলোনা বিরূপাক্ষের।আবার একেবারে ফেলেও দিতে পারেনা রাহুলের কথা।সে নিজেই ক্যমন হিংসুটে আর অশালীন ধরনের কথা বার্তা বলছে।একটা বাদাম হাতে নিয়ে খোসাটা আলাদা করতেই খয়েরী আবরণের দুটো কোয়া দৃশ্যমান হলো।হাতের তালুতে নিয়ে বললো,,এ দুটোকে দেখেছো রাহুল? রাহুল দেখছিলো বিরূপাক্ষের কর্মকান্ড সায় দিল মাথা নেড়ে।

কোয়া দুটো একটা খোলসের মধ্যে সারাজীবন থাকে কিন্তু দেখো কেউ কাউকে ছুতে পারে না,কারো সাথে কেউ মিশতে পারে না।থাকে কিন্তু খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে একজায়গায়। ওদের ভাগ্যে এটা আছে তাই হয়েছে।আলাদা করে জমিতে রোপণ করো ফুলে ফলে ঠিকই ভরিয়ে দেবে কিন্তু দুজনের যে দুজনকে হারাতেই হবে।
করুন শোনায় বিরূপাক্ষের সুর। রাহুল কথা বাড়ায় না আর।অন্যান্য কথার ছন্দ তুলে ছন্দহীন কথা গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে অন্ধকার নামা অব্দি।একসময় বাড়ির পথে পা বাড়ায় দুজনে বন্ধুর মতো হাত ধরে।যা দেখে হয়তো উপরে বসে অন্তর্যামী হাসেন আমুদে হাসি কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এরা দুজন উপর থেকে যতটা কাছে ভেতরে ভেতরে তার বহুগুণ দূরের।

****
মন্দিরে ঢাকের তালে মায়ের আরতি চলছে।একটা বিশেষ নিয়ম প্রচলিত আছে গ্রাম এলাকায়, যে মন্দিরে সন্ধ্যায় আরতি বা নাচ গান বেশী হয় সে মন্দিরে মানুষের আনাগোনা বেশী হয়।এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।দূর দূরান্ত থেকে ছেলে, মেয়ে,নারী, পুরুষ এসেছে চৌধুরী বাড়ির মন্দিরে।এ যেনো মানুষের ঢল। বাড়ির সকলে মন্দিরে উপস্থিত হলেও বিরূপাক্ষ এবং রাহুলের দেখা পেলো না রিতি।বার বার শুধু চোখ চলে যাচ্ছে বসে, দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ সারির দিকে। কিন্তু চোখ দুটো তার প্রশান্তি খুঁজেই পায়না।এভাবে চললো পালাক্রমে বেশ কয়েকজনের আরতি।এবার যুবক ছেলেরা করবে গণ-ডান্স মানে সবাই নাচবে উরাধুরা একসাথে।শুরু হলো কান, কপাল ফাটানো সাউন্ড বক্সের বিকট আওয়াজ।রিতি দেখলো কয়েকটা ছেলে মিলে বিরূপাক্ষ এবং রাহুলকে টেনে নিয়ে আসলো সবার মধ্য থেকে। রাহুল তো ভালোই নাচে কিন্তু বিরূপাক্ষ পরলো মহা ফ্যাসাদে কিন্তু ছুটে যাওয়ারও কায়দা নেই।গ্রাম সম্পর্কীয় বৌদি,ঠাকুরমা যারা ছিলেন তাঁরা জেকে ধরলো।অগত্যা নাচতেই হলো এতাল বেতাল।তিতলি,অহনা ,অভি সবাই নাচলো। কিন্তু রিতি এবং জয়া শুধু হাসলো।
নাচ শেষে সবাই যখন একে একে চলে যাচ্ছে তখন এক বুড়ি ঠাকুমা রসিকতা করে বললো রিতিকে,,,হ্যা গো নাতনী সোয়ামীরে খালি একাই নাচাইবা?আইজকা আমরাও নাচাইলাম।গতর ব্যাথা কইরা দিছি বুঝবা রাইতে!হাসতে লাগলো ঠকুরমা সহ ওনার সহচরী কজন।রিতি তাকিয়ে দেখে বিরূপাক্ষও কথাটা শুনছে কাছে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় রিতির কান গরম হয়ে আসে।
আরেক বুড়ি টিপ্পনী কাটে,,আ্য্য,শরম দ্যাহো?এত শরমাইও না দিদি।পাইলা,পুইষা বড়ো করলাম আর নাচোন খালি একাই দেখবা?

আরেকজন বলেন,,আহ্ কও কি তোমরা ,এমন সোনার গতর দেখলে আমাগো ঘোচানো চামড়ার দিকে তাকাইবো ক্যানে ও নাগর?

এমন টিকা টিপ্পনী শুনে কান ঝা ঝা করে ওঠে রিতির কিন্তু কি করবে গ্রামের সাদা সিধা বয়স্কা মহিলারা এর চেয়ে আরো বেশী লজ্জায় ফেলা কথা বলে।রিতি সরতেও পারছে না তাতে অভদ্রতা হবে।সামনে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলো বিরূপাক্ষ তার দিকেই জলন্ত চুল্লী জ্বালিয়ে তাকিয়ে আছে।ভাগ্যিস,,আশে পাশের মানুষ গুলো এই বুড়ি গুলোর কথায় খেয়াল করছে না। শিকদার বাড়ির দিদা বললেন রিতির গায়ে হাত দিয়ে,,,
গোসা কইরো না দিদি,,তোমারে এমন কথা কওয়ার সুযোগ পাইনাই কোনো দিন।তাই আইজকা লোভটা সামলাইতে পারলাম না।এমন চাঁন্দের লাহান সোন্দোর নাতবউ তুমি আর নাতী কি না পক্ষীর লাহান উড়তে থাহে? এবার আর পালাইতে পারবো না, এমন রূপ যৌবনের পাগল পুরুষেরা বুঝলা?শুধু একটু রং ঢং করবা বুঝলা?

আর কেউ কিছু বলার সুযোগ পায়না।তিতলি এসে রিতিকে ছো মেরে টেনে নিয়ে যায়।
হাফ ছেড়ে বাঁচে রিতি, মহিলাদের মুখে কোনো লাগাম নাই।আশে পাশের পরিবেশ ও বোঝেনা তাঁরা। লজ্জা দিতে পারলে বাঁচে।

এতক্ষণ কি করছিলে ওখানে?যতসব ন্যাকেড কথাবার্তা!রাগে গজগজ করছিলো তিতলি।

তিতলি দি তুমি কখন শুনলে উনাদের কথা?

আমি ক্যানো শুনবো?আমি ওখানে থাকলে রসিকতা বের করতাম বুড়িদের।বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিতে দিতে চিতায় উঠতে চলেছে কিন্তু রস কমে না।শুনেছে তোমার বর,দ্যাখো গিয়ে সাহেবের রাগ।
লজ্জার আর অন্ত নেই রিতির।এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পারে এই ঠাকুমা,দিদিমা সম্পর্কীয় মহিলাগুলো।

****
ড্রইং রুমে গল্পগুজব চলছে।অভির মা বিরূপাক্ষ কে বললো,এবার কিন্তু বৌমাকে নিয়ে যেতেই হবে মামার বাড়িতে।রিতিকে কবে থেকে নিতে চাইছি যেতেই চায়না। এবার আর না শুনবো না বলে দিলাম!

শ্যালোক পত্নীর কথায় সায় দেন প্রভাকর রায় চৌধুরী,,,

সে তো অবশ্যই,,এত করে বলার কিছু নেই।পূজোটা মিটুক তারপর যাবে। দুই ছেলে দুই বৌকে নিয়ে ঘুরে আসবে।কি বলো রূপ?
বিরূপাক্ষ হালকা জবাব দেয়,,

দেখি চেষ্টা করবো।

ওসব চেষ্টা ফেষ্টা বাহানা চলবে না ভাগিনা।কাজে কর্মে ঢুকে যাওয়ার আগে বেরিয়ে নাও ইচ্ছা মতো। বলেন অভির বাবা।

এত কথা বলিসনে ভাই।সময় হোক ওরা যাবে।বড়ো খোকাটা হয়েছে একদম কাজ পাগল মামার মতো, বৌমাকে নিয়ে কবে শেষ বেরিয়েছে মনে নেই তার।বলেন অন্নপূর্ণা দেবী।

এই দ্যাখো মামিমা, আবার আমাকে নিয়ে পরলে ক্যানো?কাজ না করলে চলবে?অত ঘুরে ফিরে পয়সা,সময় দুটোই নষ্ট।

অত জ্ঞান আমাকে দিওনা বাবা,,শুধু টাকা পয়সা জীবনের সবকিছু নয়।সংসারের লক্ষীর দিকে খেয়াল না দিলে ধনলক্ষী যে পালাই পালাই করে বাবা।লক্ষী যে বড়োই চঞ্চল।বুঝবে যখন মামার মতো বুড়োটি হবে।কথার খোটা দেন অন্নপূর্ণা দেবী।

এই দ্যাখো মা ছেলে মেয়েদের ভেতর আবার আমাকে ক্যানো টানছো?আমি কি তোমাকে নিয়ে কম ঘুরেছি?কম সময় দিয়েছি? অসহায় বোধ করেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।

থাক আর নিজের সাফাই গাইতে হবে না।আমি যদি মুখ খুলি থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে।হাটে হাঁড়ি ভাঙতে চাইনা। অন্নপূর্ণা দেবী তার অভিযোগের ঝুলি খুলতে চলেছেন।প্রভাকর রায় চৌধুরীর মুখে কথা জোগায় না।

বড়ো মা কি শুরু করেছো বলোতো?কোথার থেকে কোথায় চলে গেলে? অন্নপূর্ণা দেবীর পাশে বসে বললো রিতি।

তাহলে ঐ কথাই থাকলো ভাগিনা,,খুব শীঘ্রই আসছো মামা বাড়িতে।তাও বৌ সহ?স্বতস্ফুর্তভাবে বলেন মামা।

বিরূপাক্ষের ভেতরে বিরক্তি বাসা বাঁধছে। কিন্তু উত্তর না দেওয়া অভদ্রতা।
আমি তো যাবোই মামা সে গ্যারান্টি দিচ্ছি কিন্তু অন্যকারো কথা আমি বলতে পারবো না।আর কাউকে সাথে নিতেও চাই না।
রিতি বুঝতে পারে কথাটা তার উদ্দেশ্যে বলা।আস্তে উঠে চলে গেলো রান্না ঘরের দিকে। বিরূপাক্ষ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো একবার।
রূপ দা তোমরা একবার আমাদের ইন্ডিয়াতে ঘুরতে আসো বরং অনুচ্চ স্বরে বললো রাহুল বিরূপাক্ষের পাশ থেকে।

হ্যা হ্যা রাহুল তুমি বরং সেইটাই করো।ভালো করে আগ্রার তাজমহল টা দেখিয়ে দাও,ও বুঝুক স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাটা কি?তবেই না বুঝবে স্ত্রীর মর্ম।পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো অখিলেশ।হাসছে নিঃশব্দে। রাহুল যোগ দেয় সে হাসিতে।
অখিলেশের রসিকতায় অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে বিরূপাক্ষ,,,এই বেশী প্রেম ভালোবাসা বুঝাতে আসবি না বুঝলি?ভাই রাহুল আমার কথা বাদ দাও।যে যাওয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে তাকেই ক্যানো নিচ্ছো না বলো?

রাহুল বুঝতে পারে না এই কথার কি প্রতিউত্তর করা যেতে পারে তথাপি এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বললো, তিনি তো এখনো তোমার দায়িত্বেই আছে।কাজটা নিজে ক্যানো করছো না বলো?বড়ো ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের এইটুকু উপকার করো দাদা।রিতিকে বেঁধে ছেধে পাঠিয়ে দাও আমার সাথে। বিশ্বাস করো বড়ো ভাইয়ের আমানত সারাক্ষণ মাথায় করে রাখবো।ফিস ফিস করে কথাগুলো বললো রাহুল। কুঁচকে যাওয়া ভ্রু চুলকে শঙ্কিত হলো বিরূপাক্ষ,এ ছেলে যে এমন জবাব দিতে পারে কখনো ভাবেই নি সে। তবুও একটু হাসলো,,

ঠিক আছে রাহুল আমি চেষ্টার ত্রুটি করবো না। খুশি তো?

বহুত খুশ হুয়া ব্রো।হাসছে রাহুল, বিরূপাক্ষ সে হাসিতে শরীক হয় কিন্তু অন্য পাশে অখিলেশের হাসি মুখটাতে যে অন্ধকার নেমে এলো সেটা দৃষ্টি গোচর হলোনা কারোই।সে একয়দিনে বন্ধুর চোখে যে আগ্রহ দেখেছে রিতির জন্য রাহুলের চোখে দেখেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। রাহুলের রসিকতা মেশানো কথাগুলো বিরূপাক্ষ বুঝলো কি না জানে না অখিলেশ কিন্তু ও জানে নিজের অব্যক্ত বাক্যই মজার ছলে ব্যক্ত করেছে রাহুল।

****
ছল চাতুরী কইরো না মা, কতদিন দেহি নাই তোমারে। একবার আইসো রূপ বাপরে নিয়া।ফোন কানে গুজে কথা গুলো বললেন সুমিতা দেবী।এ প্রান্তে রিতি,,

পিসি মা তোমার রূপ বাপে যদি না যায় তো আমি কি তার ঠ্যাং দুটো টেনে নিয়ে যাবো? দাদুকে বলো তার সাথে ফোনে কথা বলতে।

তোমার দাদু তো কইলো হেয় আইবো।অহন তুমি একটু বুঝাও পরাও।বুড়ো মানুষডা আশা কইরা আছে।নিরাশ কইরো না মা।

আচ্ছা পিসি বলবো আমি।দাদু কি ঘুমায়?

হ মা একটু আগে শুইলো।

ঔষধ দিচ্ছো ঠিকমতো?

সেইডা কি তোমার কইয়া দেওয়া লাগবো?

তুমি আছো বলেইতো আমি এতটা নিশ্চিন্ত পিসি।তোমরা ছাড়া কে আর আছে আমার বলো?

অমন কথা কইও না মা।ওবাড়ির সবাই তোমারে কত ভালো বাসে। বাবাজি তো আছেই, এতকাল দূরে দূরে থাকছে তাই কিছু হয় নাই মা।কাছে কাছে থাকবা ,যত্ন নিবা তার দেইখো মায়া বাড়বো। ছোট্ট কালে তোমারে কত্ত ভালো বাসতো,,

ও পিসি সবকিছু শেখাতে হবে আমাকে?আমি এখন আর কচি খুকিটি নেই সব বুঝি বুঝলে।অত বুঝাতে হবে না আমাকে।কি করলে বরের মন পাওয়া যায়, তার পায়ের তলায় ঠাঁই হয়,,সব জানি আমি সব,,রিতির গলাটা কেঁপে ওঠে।নিজেকে সামলে বিদায় নেয়,,ঠিক আছে পিসি এখন রাখছি।সকালে আবার কল করবো। ভালো থেকো।

ভালো থাইকো মা।

আশায় বুক ভরে শ্বাস নেন সুমিতা দেবী।কেউ না জানুক তিনি তো জানেন মেয়েটা মুখে যাই বলুক, বিরূপাক্ষ ছাড়া আর কাউকেই কোনোদিন স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে না সে।তাই যদি হতো তবে চার বছর আগেই রাহুলের মতো ভালো ছেলেটার দিকে ঝুঁকে যেতো।প্রয়োজনে একাই থাকবে তবুও আর কাউকে মন দেবে না।এই নিয়ে যত অশান্তি সুমিতা দেবীর। মেয়েটার নীরব কান্না তিনি দেখতে পান অহরহ। সন্তানের বুকের ক্ষতর জালা পোড়া মা ছাড়া আর কেই বা বুঝবে।তিনি তো রিতির মা ই। শুধু গর্ভে ধারণ করেননি বলে কি রিতির মায়ের উপাধি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যায়?

আকাশের তাঁরা গুলো নাকি মৃত মানুষের আত্মা। কিন্তু রিতি কখনো ভাবে না তার মা,বাবা তাঁরা হয়ে জ্বলছে।আধার রাতে নিজের দুঃখ ভাগ করে তাঁরা গুলোর সাথে।তাইতো ও চায়না মা,বাবা তাঁরা হয়ে তাঁদের একমাত্র বুকের মানিকের দুঃখের আহাজারি শুনে কষ্ট পাক।মেয়ের কষ্টে অসহায়ের মতো বুক চাপড়াক।

কতটা বোকা তুমি পিসি, তোমার রিতির রূপদা যে আর রিতির নেই গো।রিতির কান্নায় তার প্রাণ কাঁদে না পিসি।সে এখন বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী,কত মেয়ের আরাধ্য পুরুষ সে জানো?জানো না তো। কিন্তু এতটুকু তো জানো রিতি কখনো কারো সাথে প্রতিযোগীর লাইনে দাঁড়াতে চায় না।রূপদার জন্যে তো নয়ই।প্রাণ গেলে যাবে কিন্তু কখনো মুখ ফুটে চাইতে পারবো না তাঁকে,কখনোই না।

বোনটি,, এখানে একা একা?

পেছনে কারো গলার আওয়াজ শুনে হাতের চেটোয় চোখের জল মুছে নেয়। কৃত্রিম হাসি টেনে বলে,,অখিল দা আপনি?

হ্যা আমি তো এখানে আসি প্রায়ই।এই রাতে ছাদে একা একা ক্যানো?রিতির পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে অখিলেশ।

দোকা কোথায় পাবো বলুন? আপনার তো তবু সঙ্গি হিসেবে সিগারেট আছে।

কিন্তু,আমি যে কথা বলতে শুনলাম তোমাকে?

পিসি ফোন করেছিলো।তাই ছাদে উঠে এসেছি।নিচে নেটওয়ার্ক খুব দূর্বল।

তা অবশ্য ঠিক তবে এখানে আরেকটা সুবিধাও আছে। মিট মিটিয়ে হাসছে অখিলেশ।রিতি তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

কাঁদলে কেউ দেখে না তাই না? সুবিশাল আকাশের সাথে মনের ব্যাথা ভাগ করা যায়, ইচ্ছে মতো কাঁদা যায়?আবার হুট করে নিজের কষ্ট লুকোতো মুখে নকল হাসির ফোয়ারা ছোটানো যায়?

রিতি খানিকটা চমকে ওঠে। মুখের নকল হাসিটা অন্ধকারে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলোর মতো ঐ দূর বহুদূর চলে যায় নিমেষেই।

একটা অনধিকার চর্চা করবো বোনটি?যদি অনুমতি দাও তো?

হুম,, বিভ্রান্তি কাটিয়ে বলে রিতি।

রাহুল বাবু কিন্তু খুবই অমায়িক এবং ভালো একটা ছেলে। কতদিন ধরে চেনো তুমি তাকে?

ছয় বছর ধরে চিনি। খুব ভালো ভাবেই জানি উনাকে। নিজের চেয়েও বেশি।

তুমি কি জানো তিনি তোমাকে,,,

প্রচন্ড ভালোবাসে,,

আর তুমি?

ভালো বাসি।বন্ধু সে আমার।আর সব ভালো বাসার মানে কি এক হয় দাদা?আমি তাকে বন্ধু হিসেবে সাথে চাই সারা জীবন ,পাশে না থাকলেও ক্ষতি নেই।

আর যদি সাথে এবং পাশে থাকতে চায় তাহলে?
সেটা সম্ভব নয়। সারাজীবন পাশে থাকতে হলে ভালোবাসার ধরনটা পাল্টাতে হবে যা এ জীবন ক্যানো আগামী সাত জনমেও আমাকে দিয়ে হবে না অখিল দা।

রিতির কথার দৃঢ়তায় অখিলেশের চোখে বেদনা ঘনিয়ে আসে। মেয়েটির প্রতি বেশ মায়া জন্মে গেছে তার।তাই হয়তো তার হাসি খুশি চোখে মুখের অন্তরালে বেদনার ছায়াটা দেখতে পেয়েছে?
কি এতো ভাবছেন অখিল দা?গল্প বলি শুনুন,,
ছয় বছর আগে যখন রাহুল বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছিলো,আমি তখন প্রায় অন্ধকার বন্দী। কিন্তু হাসতাম প্রাণখুলে নকল হাসি। বিয়ের মানেটা বুঝে ওঠার আগেই স্বামী পরিত্যক্তা তকমাটা জুটে গেলো বছরখানেক আগেই।সবাই ভাবলো ছেলে মানুষ,তাই মনের মধ্যে কোনো কষ্ট দুঃখ বোধ নেই।সেটাও অপরাধ ছিলো আমার।গ্রামের মানুষের চরিত্র পাল্টানোর অপূর্ব সব ক্ষমতা আছে।যারা আমাকে চোখে হারাতো তারাও আড়ে আবডালে কটু কথা বলতে ছাড়তো না।পিসি আর দাদুভাই বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। একদিন দাদাভাই রাহুল বাবুকে নিয়ে গেলেন আমাদের বাড়িতে। অনেক দিন পর বাইরের কারো কথা শুনলাম আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন?ঐ মানুষটি মাত্র একঘন্টা সময়ের মধ্যে পড়ে নিলেন আমার হাসি খুশি ভরা চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা বিরহ,বেদনায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া রিতিকে। আমার মধ্যে উপরে ওঠার,বড়ো হওয়ার একটা চাঁপা জেদ ছিলো কিন্তু কাউকে সে কথা জানাতে সংকোচ হতো। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আমিও ক্যামন যেনো রাহুল বাবুর প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করলাম, নিজের মনের ভেতরের জেদটাও জানলো রাহুল।আমাকে অনেক উৎসাহ দিলেন,পরামর্শ দিলেন। অবশেষে দাদাভাইকে বলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন উপজেলার একটা এনজিও ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে।তারপর একদিন চলে গেলেন নিজের গন্তব্যে। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে সেটেল হয়েও কখনো আমাকে বিস্মৃত হয়নি।এখোনো সাথ দিয়ে চলেছে পরম আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে।এমন বন্ধুকে কি অশ্রদ্ধা, অবহেলার পাত্র করা যায়?তার কথা মানতে কাজের মাঝেও পড়াশোনায় গাফিলতি করিনি কখনো।

হ্যা তারই ফলশ্রুতিতে আজ ডাক্তার হতে চলেছো। নিজের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে দেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশেও স্থান নিতে চলেছে। কিন্তু যার উপর অভিমান করে আজ এতো কিছু করছো সে এসবের কিছুই জানে না।অখিলেশ রহস্যময় হাসি হাসে।সে জানে এখন কতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে।

প্রচন্ড বিস্ময়ে হতবাক রিতি, ধরা পরে অস্বস্তি বাসা বাঁধে মনের মধ্যে,,

আপনি জানেন সব? কিন্তু কিভাবে?

হ্যা জানতে পেরেছি। নিজের গরজেই জেনেছি। সে কথা অন্য সময়ে হবে।কিন্তু এই দাদাকে বলতো বোনটি,,যার জন্য এতকিছু তার কাছে ক্যানো এত লুকোচুরি?

সে তো আমাকে চায় না দাদা।

আমি যাহারও লাগিয়া,এ ঘড়ও বাধিনু
সে তো আমার নয়,,

শুধু সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বশে কি কেউ কাউকে পায়, অন্তরে,বাহিরে?আমি যার জন্য উন্মত্ত, সে যে অন্যতে প্রমত্ত।

ভোলানাথ অনেকবার মাতা পার্বতীর সাথে অভিমান করে ভুল বুঝে কৈলাশ ত্যাগ করেছেন অন্য নারীর টানে। কিন্তু কোনো অপ্সরা কি পেরেছে হর পার্বতীর নিখাদ, শুদ্ধ প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে?পার্বতীর একনিষ্ঠ পতি ভক্তি আর অবিচল তপস্যায় রূদ্রমূর্তী ভঙ্গ হয়েছে।মাতা পার্বতীর তপস্যা আমি দেখিনি তবে তোর তপস্যা আমি দেখেছি।এ যে কখনো বিফলে যাবে না বোনটি।তুই ত্ররিতি,মা দূর্গার এক নাম ত্ররিতি,বিরূপাক্ষ নাম ধারনকারী শিব তোর জীবনে এসেছে। সময়ের ব্যাবধান শুধু,ত্ররিতি আর বিরচপাক্ষের মিলনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে, খুব শিগগিরই আসবে।

অখিলেশের গলাটা ধরে আসে। বিচ্ছেদের বিরহ যাতনা যে কতটা ভয়বহ সে জানে।রিতির গন্ডোদেশ বেয়ে জল গড়ায় উত্তপ্ত নোনা জল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।সামনে মূর্তিমান মানুষটির কিছুই সে জানে না কিন্তু ভীষণ ভাবে বুঝতে পারে এই ভীষণ ভালো মানুষটার ভেঙেচুরে যাওয়ার পেছনে এক নিগূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে।যা শুধু অর্থের অভাব নয়, কিছু কিছু অনর্থও আছে এর ভেতরে।

চলবে,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here