উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে:চন্দ্রা।
পর্ব:২৪
আমি বা কে?
আমার মনটা বা কে?
আজো পারলাম না আমার মনকে চিনিতে,,,
পাগল মন রে,,মন ক্যানো এতো কথা বলে,
উত্তরের আমবাগান থেকে ধেয়ে আসা শীতল বাতাসের সাথে অখিলেশের মুখ থেকে নির্গত ধোঁয়ার কুণ্ডলী মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে একের পর এক সিগারেটের মুখে আগুন দিয়ে নিজের কলিজাটা পোড়াতে ব্যস্ত সে।মনটা ছেয়ে আছে বিষন্নতার মেঘে। অনেক দিন হলো মন তার এমন বিক্ষিপ্ত রূপ ধারন করে না।আজ খুব মনে পরছে ফেলে আসা সেই একান্ত ব্যক্তিগত অতীত স্মৃতি গুলো।মনে পরছে তার নিরুপমার কথা।আজ বিকেলে বুটিক হাউস থেকে ফেরার পথে একজনের পেছন দিক দিয়ে দেখলো একদম নিরুপমার মতো চলন ভঙ্গি তার। কিন্তু নিরুপমা শাড়ি পরতো না সেই রমনীর পরনে একটা হালকা রঙের ক্যাটালগ শাড়ি ছিলো। ভীষণ ভীষণ ভাবে মনে পরছে।এ যেনো সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছে,,,
হোটেলের ধূসর শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে দুজনেই।কারো শরীরে পরিধেয় বস্ত্র হয়তো অবশিষ্ট নেই। কিন্তু গায়ের উপর গাঢ়ো নীল রঙের পাতলা চাদর চাপানো।নিরুর নগ্ন কাঁধে মুখ ডোবাতেই কিছু একটা বুঝে আঁতকে ওঠে অখিলেশ।তার নিরুপমা কাঁদছে?ব্যতিব্যস্ত হয়ে শায়িত অবস্থায় নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়, বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করছে তার।কি এমন হলো তার নিরুর?
এই নিরু কাঁদছো ক্যানো?কি হয়েছে আমায় বলো? কয়েকবার বলতেই নিরু মুখ খোলে কিন্তু কান্নার প্রবল স্রোতে বাক্য স্রোত তিরোহিত হয়।
কি হলো বলো?এভাবে কাঁদছো কেন? অসহনীয় গলা অখিলেশের।
অখিল কাল আমার বিয়ে,,, বাকরুদ্ধ স্বরে বলে নিরুপমা।
অখিলেশ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় নিরুর দিকে,,
কি বললে,, আবার বলো নিরু,,
এমন আদুরে ডাকে নিরুর সকল সংযমের বাঁধ ভেঙে যায় নিমিষেই।প্রবল বেগে জাপটে ধরে সামনের মানুষটাকে।এমন ভাব যেনো কখনোই আর ছাড়বে না প্রিয় ভালোবাসার মানুষটাকে।অতি কষ্টে অখিলেশ নিজের শক্তিহীন হাত দুটো উঠিয়ে দেয় নিরুপমার নগ্ন পিঠে।মিথ্যে শান্তনার আভাস শুধু,,এ হাত নিরুর হাতের মতো আকড়ে ধরে রাখার জন্য নয়।
ভালোবাসলে তাকে আগলে রাখতে হয় যেকোনো প্রতিকূল, অনুকূল পরিবেশে।কখনোই ছাড়তে হয় না প্রিয় মানুষটার সাথ। কিন্তু সবাই তো আর ভালোবাসায় বেঁধে রাখতে জানে না,, বাঁধা পরতে জানে না। অবশেষে কলঙ্ক রটে প্রেমের নামে,,প্রেমিক প্রেমিকা থাকে ধোঁয়া তুলসী পাতা।যত দোষ,নন্দঘোষ।ছ্যাকা খেয়ে এবং ছ্যাকা দিয়ে অবশেষে নীতিবাক্য ঝাড়বে,,,প্রেম করোনা,প্রেমে পড়োনা, প্রেম বড্ড খারাপ জিনিস।
অখিল নিজের বুকের মধ্য থেকে নিরুর মুখটা তুলে ধরে। ততক্ষণে নিরু অনেকটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। অখিল নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলে,,,কাল বিয়ে আর আজ এভাবে আমার সাথে সময় কাটানো ঠিক হয়নি তোমার নিরু।
নিরু যেনো খানিকটা থমকায়,,,
কিন্তু অখিল আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না বিশ্বাস করো।আমি একেবারে ই চলে এসেছি আর ফিরবো না ওখানে।
এসব কি বলছো তুমি?অবাক অখিলেশ।
হ্যা,,আমি তো জানি,, তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। আমিও পারবো না।এই দ্যাখো তুমি আমাকে যেখানে যেভাবে রাখো সেখানেই মানিয়ে নেবো।এতটুকুও অভিযোগ করবো না দেখো। শুধু তোমার পাশে একটু জায়গা দাও আমায় প্লিজ,,
অখিলেশ এর বুকটা ফেটে যেতে চায়।নিরুর কান্না তাঁর বুকে হাজারোধিক ক্রুশ বিদ্ধ করে। কিন্তু কি করে সে নিজের, আশ্রয়হীন জীবনে ভালোবাসার মানুষটির আশ্রয় দেবে। নিজের দুমুঠো অন্নের সংস্থান সে করতে পারে না।মা,ভাই,বোনেদের একমুঠো ভাতের জোগাড় করতে কিভাবে হন্যে হয়ে ঘুরছে। না না নিরুকে এমন কষ্টের জীবন দেখাতে পারবে না কিছুতেই।তাতে যদি বুকে পাথর বাঁধতে হয় তাও রাজী।
কি হলো কি এত ভাবছো?কোথায় রাখবে আমাকে সেটাই ভাবছো তো?আমি বেশকিছু টাকা নিয়ে এসেছি। তুমি শুধু ম্যারেজ রেজিস্টার এর অফিসে গিয়ে আমাকে বিয়ে করে নাও।তুমি থাকো এইখানে,,,আমাকে গ্রামে মায়ের কাছে রেখে আসো শুধু।
বিশ্বাস করো।এক বছরের মধ্যে বাড়িতে না গেলেও আমি কিছু বলবো না।আমি শুধু তোমার জন্য পাগল, তোমায় পাশে চাই।সঙ্গ না দিলেও চলবে শুধু সাথ দিও।
ভাবা ভাবির সময় নেই এখনি নিরুকে নিরস্ত করতে হবে,নইলে যে ঘোর বিপদ।
তুমি ফিরে যাও নিরু,,,
নিরুর বিশ্বাস হলো না কথাটা,,
আবার বলো?ফ্যাসফেসে গলা নিরুর।
তুমি ফিরে যাও তোমার উপযুক্ত ঠিকানায়। আমাদের একসাথে চলা আজ থেকেই ফুরোলো নিরু।কন্টকাকীর্ণ পথে তোমার প্রতি পদে পদে যে রক্তক্ষরণ হবে আমার বুকে যে তা সইবে না নিরু। আমার পথ যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ঝলসানো, কাঁটায় ভরা,সে পথে হাঁটতে হাঁটতে তুমি ক্ষত বিক্ষত হবে তা আমি কোন প্রাণে সইবো বলো? তুমি মুক্ত প্রান্তরে, অন্তহীন সুখের মাঝে ডানা মেলে উড়ে বেড়াও মুক্ত বিহঙ্গের মতো, তোমার সে পাখনার ছায়াটুকু আমার ঊষঢ় মরু বুকে জাগাবে প্রশান্তির স্পন্দন।সেই তো আমার বড্ড সুখ গো।বড়ো শান্তি।
প্রতিক্রিয়া হীন নিরুপমা ক্ষণকাল হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ভালোবাসার অখিলেশের দিকে।আচ্ছন্নের মতো বিবস্ত্র দেহে বস্ত্র জড়ায়। অবশেষে অখিলেশের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে নিজের কম্পনরত ঠোঁট ছোঁয়ায়।পাথর দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে বলে আপন গতিতে,,, তুমি সত্যিই আমাকে ভালো বাসতে পেরেছো কিনা জানিনা তবে এতদিন যে আমাকে ভালোবাসার অধিকারটুকু দিয়েছো তাতেই পরিতৃপ্ত আমি।ঐ টুকুই হবে আমার চলার পথের পাথেয়,হোক না সে এ পাড়ে কিংবা ঐ পাড়ে।
সেই নিরুর সাথে অখিলেশের আর দেখা হয়েছিলো গতবছর।একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা হয়েছে নিরু। ফুসকা খেতে এসেছিলো মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু একাই ।অমন কন্যার ভাগ্যবান পিতাকে দেখার ইচ্ছা জেগেছিলো অখিলেশের কারণ কোথাও না কোথাও মেয়েটির পিতার জায়গায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলো।
বুকের ভেতর কুট কুট করছে অখিলেশের।ঠিক যেনো এক ঝাঁক লাল বিষাক্ত পিঁপড়ের কামড়। নিকোটিনের ধোঁয়া হয়তো তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।ডান হাতে নিজের বুকের বাঁ পাশটা খামছে ধরে সে, পিঁপড়ের কামড় এর জন্য নয় এক নামহীন অসহনীয় যন্ত্রণার জন্য।
******
এই রিতি তুই তো গতদিন স্কুলে এলি না। আমাদের নতুন টিচার জয়েন করেছে কালই।সে কি সুন্দর চেহারা মেয়ের না দেখলে বিশ্বাস করবি না। কিন্তু শহরের স্কুল ছেড়ে এই গ্রাম্য এলাকায় বদলী হলো ক্যানো কে জানে?টিচার্স রুমে ঢোকার মুখে কথাগুলো বললেন মনিকা ম্যাডাম।প্রথম ক্লাস শেষে ফিরছিলেন তিনি।
রিতি প্রতিউত্তরে এক ঝলক হাসলো শুধু।
হাসছিস যে?এখনি আসবে মিলিয়ে নিস।
আমি কি অবিশ্বাস করছি আপনাকে?এমনিই হাসি পেলো।
সত্যি করে বলতো হাসলি ক্যানো? মনিকা ম্যাডাম নাছোড়বান্দা।
আপনার চেয়ে বেশী বর্ণণা আমাকে পুনিত স্যার ইতিমধ্যেই দিয়েছেন।তাই হাসছি।
ওহ্ তাই বল?মন্দ হয় না আমাদের পুনিতের সাথে একটা কিছু হলে বল?
চোখ সরু করে তাকায় রিতি,,,
খারাপ কি বললাম বল?
বর্তমান মেয়েদের পেছনে আগে থেকেই ইট পাতানো থাকে আর আপনি ঘটকালি শুরু করলেন ম্যাডাম?হাসছে রিতি।কথাটা
মনিকা ম্যাডামর মনঃপুত হলো না বোধহয় মুখের হাসিতে ভাটা পরল খানিক। পুনরায় সে হাসি উজ্জীবিত হলো দরজা দিয়ে ঢুকছেন নতুন ম্যাডাম।রিতি মনিকার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো ,, আসলেই প্রশংসা পাওয়ার মতোই সৌন্দর্যমন্ডিত নতুন ম্যাডাম।অবাক হলো রিতি, সে ভেবেছিলো ম্যাডামের বয়স হয়তো একটু বেশিই হবে কিন্তু না অনেক টেনেটুনে বেশী হলেও ত্রিশের উর্দ্ধে হয়তো একচুল ও নড়ানো যাবে না।
উস্ ্্করে শব্দ করে রিতি, মনিকা ম্যাডাম উৎফুল্ল হয়ে নিজের কনুই চালিয়ে দিয়েছেন রিতির বাহুর নরম মাংস পেশিতে।
দুঃখিত সোনা,,বেশি ব্যাথা পেয়েছিস? অনুতাপে ঢলে পরা দেখে রিতির মায়া হয়, নিজের ব্যাথা চেপে মুখে হাসি এনে বলে,,না না ঠিক আছে ম্যাডাম।
অতঃপর রিতির সাথে নতুন ম্যাডামের আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক।।এতে অবশ্য পুনিত স্যারের আগ্রহের সীমা বিপদ সংকেত অতিক্রম করেছে।
রিতির ভালোই লাগলো নতুন ম্যাডাম নিরুপমা সেন কে।বেশ সদালাপী মেয়েটা।
নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ সে হিসেবে জড়তা নেই একদমই।
*****
দিনের শেষ ভাগ প্রায়। বুটিক হাউস থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মী হেঁটে চলেছে নিজেদের গৃহাভিমুখে। পুরুষ যে কজন আছে তাদের হাঁটতে হয় না।বাই সাইকেল ই ভরসা।রিতি স্কুল শেষে এসেছিলো বুটিক হাউসে।ফিরতি পথে পেলো রাহুলকে। দুজনেই কথায় কথায় এগোলো তাঁত কলের ঐ দিকে।বেশ কয়েকদিন যায় না রিতি। শুধু কর্মচারীদের দিয়ে কি আর এসব কাজ সম্পূর্ণ হয়?
কাল তাহলে চলেই যাচ্ছেন? রাহুলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোঁড়ে রিতি।
হুম,,যেতেই হবে।না গিয়ে উপায় কি বলো?প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করে রাহুল।রিতির কান এড়ায় না।
আপনি থাকলে ভীষণ ভরসা পাই রাহুল বাবু।যা অন্য কোথাও পাই না।
শুনে শান্তি পেলাম রিতি।
আপনার শান্তি পাওয়ার জন্য কিন্তু বলিনি কথাটা ।
জানি,,কারো মন রাখতে কখনো নিজের মনের বিরুদ্ধে তুমি যাওনা সেকথা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না বোধহয়।
এবার সময় দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত আমি।
বাব্বাহ যে ঝক্কি ঝামেলা তোমার। নিজেকে দেওয়ার মতো সময়ইতো পাওনা। তবুও একটু দিও।সব জায়গায় দিয়ে থুয়ে নিজের কাছে নিজেই যদি কিছু না পাও তাহলে আর জবাব দিতে পারবে না আয়নার ওপারের প্রতিবিম্ব কে।
রাহুলের কথায় জবাব দিলো না রিতি শুধু এক টুকরো ম্লান হাসি উপহার দিলো।
যাক সে কথা,, আমার কাজ তো এগিয়ে নিয়েছি অনেক টা। এখন সরকারী অনুমোদনের ব্যবস্থা বাকী শুধু। এবার কিন্তু তোমার পার্টনারের সাক্ষর গুলো নিয়ে নিও সময় করে।
দেখি!অত গুলো সই সাবুদ চাইলে আবার কি বলে বসবে কে জানে?আমি তো আবার তার অর্থ সম্পদ লুটে নেওয়ার ধান্দায় আছি।
শশব্দে হেসে ওঠে রাহুল।কি ধারালো সেই হাসি। মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে যাবে সে হাসিতে।এই লোকটার হাসিটাই বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর সকল বৈশিষ্ট্য এর মাঝে। সেদিকে তাকিয়ে ভাবে রিতি।
যত যাই বলো রিতি। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।রূপদাকে দেখে আমার কিন্তু একটুও অমন মনে হয়নি।পারলে তুমি যে কি তার একটু আধটু উপমা তাঁকে দিও।নইলে যে একেবারে অবিচার করা হয়।
আমার নিজের কানে শুনেছি।জোর দিয়ে বলে রিতি।
কি আশ্চর্য!কেউ কি অন্যের কানে শোনে নাকি হ্যা?
ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকায় রিতি,,,
সব সময় মজা,মশকরা কিন্তু ভালো লাগে না!
আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে?
মানে ?
আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে শ্রীমতী ত্ররিতি হালদার রায় চৌধুরীর সাথে তামাশা করবো?
এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে রাহুল বাবু?
রাহুল খুব উপভোগ করে রিতির এই ছেলেমানুষি গুলো। একমাত্র রাহুলের কাছেই রিতি উন্মুক্ত খাতার মতো, তা জানে রাহুল।রিতির এই প্রাণখোলা উচ্ছলতার ঢেউ রাহুলের বুকে তুফান আনে ভীষণ ভাবে।সে যে বাঁধ ভাঙা ঢেউ।আত্মসংযমী রাহুল তা সামলে নেয় নিজের মতো করে।সামলে নিতে হয়।
আর এইটুকু সময়ইতো। চলেই তো যাচ্ছি। রাহুলের চেহারার গভীর বেদনার ছাপ রিতিকে ভাবায় ভীষণ ভাবে।
******
কি ব্যাপার রিতি,, তুমি নাকি তোমার বড়মাকে বলেছো বাড়িতে যেতে চাও?
জেঠু এখানে আমার পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না। তাছাড়া আঙ্কেল উনারা কাল তো চলেই যাবেন। পূজাও শেষ। আমতা আমতা করে বলল রিতি। জেঠুকে সে ভীষণ ভয় পায় তাইতো বাড়িতে ফিরে যাবার কথা বড়মাকে বলেছিল সন্ধ্যায়।এরই মধ্যে হেড অফিসে কথাটা বলে দিয়েছে বড়োমা।
অন্নপূর্ণা দেবী ঘড়ে ঢুকতেই রিতি তাকায় তীক্ষ্ণ চোখে। অন্নপূর্ণা দেবী দেখলেন সবই,,মনে মনে হেসে ছদ্ম উষ্মার সাথে বললেন,,,
খবরদার চোখ রাঙাবি না আমাকে।তোর চোখ রাঙানির ভয় পাই না আমি।যা বলার জেঠুকে বল।
রিতি থতমত খায়,,এই মহিলা তাকে ডুবাবে। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
আহ্ অনু,কথা বলছি তো আমি থামো। তুই কি সত্যিই বাড়িতে চলে যেতে চাস ?
রিতি আস্কারা পায়। প্রভাকর রায় চৌধুরী তাকে তুই বলছে মানে লক্ষণ অতীব উত্তম।
হ্যা জেঠু।
আচ্ছা,,, প্রভাকর রায় চৌধুরী কথা শেষ করে পারে না।
কি আচ্ছা হ্যা?কোথাও যাচ্ছো না তুমি। দুদিন বাদে লক্ষী পূজা।কোথায় শুনেছিস লক্ষীপূজায় ঘড়ের লক্ষী বাপের বাড়িতে থাকে? তুমি এখানেই থাকছো।অন্য কোথাও নয়।
আমি সত্যিই কি তোমার ঘড়ের লক্ষী বড়মা? ক্যানো একটা মিথ্যে সম্পর্ক নিয়ে ওনাকে কষ্ট দিচ্ছো বলোতো? তোমাদের একমাত্র ছেলে সে ,পরের মেয়ের জন্য পেটের ছেলের দুঃখ ডেকো না আর।মায়ের চোখ ভিজে আসে।রিতির মুখটা দুহাতের তালুর মধ্যে নিয়ে বলে,,,ও আমার পেটের ছেলে,তুই বুঝি কিছুই না?ওকে ভালোবাসি তোকে বাসিনা?বল?বেশ তো জ্ঞান দেওয়া শিখেছিস তোরা। ভুলে যাস না।মা আমি ,তোরা না।নিজেদের বিদ্যা, বুদ্ধির দৌড় আমাকে দেখাতে আসবি না।যে পুত্র মা, বাবার মনের ব্যাথা বোঝেনা সে কুপুত্র।আর কুপুত্রের জন্য আমার এই লক্ষী প্রতিমার অসম্মান আমি করতে পারবো না।তুই থাকবি আমার বুকে।তোকে নিয়ে বাঁচবো আমারা,সে আসলে ভালো,না আসলে থাকুক ওর মনের মতো করে। কিন্তু তোকে আমি কাছছাড়া করতে পারবো না রে।পারবি না আমাদের ভরসা হয়ে থাকতে?তোর সহায় আমরা আর আমাদের সম্বল তুই।গলাটা কান্নায় ভেঙে আসে অন্নপূর্ণা দেবীর।রিতি আর সইতে পারে না।ব্যাথার ব্যাথী না হলে কিসের আপন জন সে।রিতি জড়িয়ে ধরে বড়োমাকে।সে জানে যতই যা বলুক ছেলের নামে, দূরে গেলে আর সইতে পারবেননা তিনি। কিন্তু রিতি তা হতে দেবে কি করে?যাকে মা জ্ঞান করে এসেছে এত বছর ধরে। তাঁর স্নেহের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতেই হবে যে।
****
অধিক চিন্তায় সারা ঘড়ময় পায়চারী করছে বিরূপাক্ষ।ভাবনা চিন্তার প্রেসারে মাথাটা দপদপ করছে তার। একটু আগে মায়ের শয়নগৃহের দরজা থেকে ফিরে এসেছে সে। গতকাল রাত থেকে রিতির ব্যবহারে রিতিমত পরিবর্তন টের পেলেও ঘটনা আমলে নেয়নি সে কিন্তু এখন তো আর না ভাবলে চলছে না। বিরূপাক্ষ ভেবেই পাচ্ছে না।কি এমন ঘটলো যে,রিতি সরাসরি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বললো। আবার মা এবং সে কাঁদছে?
আর ভাবতে পারছে না বিরূপাক্ষ। হেঁটে গিয়ে সটান শুয়ে পরে বিছানায়।বাহাতটা কপালে বিচরণ করছে নিরলস ভাবে।মাথাটা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে ব্যাথায়।
আস্তে দরজা ঠেলে রিতি ঢুকলো ঘড়ে।একপলক আড় চোখে দেখেই বুঝতে অসুবিধা হলো না বিরূপাক্ষের,,, ভালো মতোই কেঁদেছে।নাকটা লাল হয়ে আছে পাকা টমেটোর মতো।চোখ দুটো ফোলা ফোলা। বিরূপাক্ষ কোনো শব্দ করলো না।পরে রইলো যন্ত্রণায় কুঁচকানো কপালে ভাঁজ ফেলে।চোখ বুজেই টের পেলো রিতি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে নিজের বিছানা পাতছে।বিরূপাক্ষের খুব ইচ্ছে হলো বলতে,,এই ঠান্ডায় নিচে না শুয়ে খাটে শো। শরীর খারাপ করবে।
কিন্তু কথাটা মনের গহীনেই মিশে গেলো।রিতি শোয়ার জন্য বসেছে সবে বিরূপাক্ষ মৃদু কাতর স্বরে বলল,, তোর কাছে জামবাক আছে?
আর বেশি কিছু বলার ইচ্ছা বা সাহস হলো না কারণ কাল থেকে সে যাই বলছে রিতি কোনো কথার ঠিক ঠাক উত্তর দিচ্ছে না।টের পেলো রিতির দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়া।আশাহত হলো বিরূপাক্ষ ,,হয়তো আর ফিরবে না।
মিনিট তিনেক অতিবাহিত হয়েছে কি হয়নি। বিরূপাক্ষ যন্ত্রণা ক্লিষ্ট কপালে একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেলো সাথে জামবাকের ঝাঁঝালো গন্ধ গিয়ে ঠেকলো নাকে।রিতি দাঁড়িয়ে ই ছিলো বিরূপাক্ষ ভেতর দিকে সরে পাশে বসার জায়গা করে দিলো।
কোনো উচ্চবাচ্য না করেই বসলো রিতি পা তুলে।সে কখনো কর্তব্যে পিছুপা হয় না। কষ্ট সে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু অসুস্থ মানুষটা যন্ত্রণায় ছটফট করবে আর ও ঘুমাবে শান্তিতে সেটা এ জীবনেও হবে না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো এভাবেই একজনের শুধু হাত চলছে অবিরাম ভাবে আরেকজনের সমস্ত শরীরে যত রকমের অনুভূতি আছে সব চলছে খুব দ্রুত গতিতে।রিতির হাতের কব্জিটা আলতো হাতে ধরে নিতেই খানিকটা কেঁপে ওঠে সে। করুন চোখে তাকায় বিরূপাক্ষ।রিতি না চাইতেও বিরূপাক্ষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট লালচে চোখে চোখ পরে। দৃষ্টি নত করে ঠায় বসে থাকে রিতি। বিরূপাক্ষের হাতের মুঠোয় তির তির করে কাঁপছে রিতির হাতটা।
কি হয়েছে রে তোর বুড়ি?বল আমাকে।
বিরূপাক্ষের এমন রেশম কোমল পেলব স্বরে রিতির ভেতর ভেঙে কান্না আসে।সব অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু নিজের নামের অভিযোগ কেউ অন্যের মুখে শুনতে পছন্দ করে কি?সে কিভাবে যার নামের নালিশ তাকেই শুনাবে?
অনেক কসরত করে কান্না আটকে বলে,,,
কিছু হয়নি তো।
সত্যি করে বলনা?হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে বিরূপাক্ষ।
এত জেদ ক্যানো করছো রূপদা? আমার কিছু হয়নি। আমার কিছু হতে নেই।
বলবি না তাহলে? বিরূপাক্ষের কন্ঠে হতাশা টের পায় রিতি। নিজের গরজেই বলে,,
মনটা একটু খারাপ আছে।আর কিছু নয়। নীহার আঙ্কেল,আন্টি উনারা কাল চলে যাবেন তো তাই?
রাহুলের জন্যই তাহলে মনটা খারাপ তোর?বিরূপাক্ষের স্বরে সেই কোমল ভাব আর নেই।রিতি মনে মনে খানিক হাসে,তাচ্ছিল্যের হাসি।
সে তুমি যেটা ভাবো।হতেও পারে।
বিরূপাক্ষ রিতির হাতটা ছেড়ে দেয়।তার এখন আর ভালো লাগা বলে কোনো বস্তুতে বিশ্বাসই নেই যেনো,,
রিতি পুনরায় বিরূপাক্ষের কপালে হাত দিতেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো সে।
রিতি কুটিল হেসে বলে ওঠে,,
রাগ ক্যানো করো তুমি? রাহুল বাবুর অনেক টাকা পয়সা। তোমার চেয়ে হয়তো বেশী।সুযোগটা কি হাতছাড়া করা ঠিক হবে বলো?
বিরূপাক্ষ হতভম্ব হয়ে তাকায় রিতির দিকে। মাথা ব্যাথাটাও যেনো লাঘব হয়েছে খানিকটা।কি বলে এই মেয়ে?
এতই যখন রাহুলকে প্রয়োজন তাহলে পরে আছিস ক্যানো এখানে?যা না তার কাছে? বেঁধে তো কেউ রাখেনি।
ঐ যে বললাম না,টাকা পয়সার লোভ বেশি আমার। তারউপর ছেলে ভোলানো মেয়ে কি না! গাছের ও খাবো তলারও কুড়োবো।
বিরূপাক্ষ স্পষ্ট বুঝতে পারে গতরাতে দাদা ভাইকে বলা কথা গুলো রিতি শুনে নিয়েছে।পায়ের শব্দটা তাহলে রিতির ছিল?
কিন্তু রিতির মুখে এই কথাগুলো বিরূপাক্ষের কানে বিষের জ্বালা ছড়ায়,অত্যন্ত কঠিন কন্ঠে বলল,,তুই এক্ষুনি সর আমার পাশ থেকে নইলে লাত্থি খাবি।কি হলো যা!অসভ্য মেয়ে কোথাকার!
রিতিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয় বিরূপাক্ষ।মনটা তার বিষাদের শেষ সীমানায়।
নিজের পাতানো বিছানায় শুয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো রিতি।আজও একটা নির্ঘুম যাতনাময় নিশি নিঃশেষ করবে সে।
বিরূপাক্ষ রিতির পেছনে তাকিয়ে থাকে অপলকে।অন্তর্দহনে জলছে সে।ক্যানো যে মাথাটা হুট হাট গরম হয়ে উঠছে আজকাল ভেবে পায়না।
*****
পুনিত স্যার আছেন মহা বিরক্ত হয়ে।কত আশা করেছিল নিরুপমা ম্যাডামকে দিয়ে নিজের পঁয়ত্রিশটা রঙহীন বসন্তের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে স্কুলের দপ্তরি শরিফুল নামের ছেলেটা।নিরুপমা যখন গেট দিয়ে ঢুকলো তখন টিচার্স রুমের জানালা ভেদ করে নিজের চোখ দুটো তার উপর ফেলে রাখলো পুনিত।
শরিফুল খাতা পত্র গোছগাছ করতে করতে মুচকি হেসে সাবধান বাণী দিলো,,,স্যার লাড্ডু কমায় খান।ও দিদিমনির ঘড়ে কিন্তু মেয়ে আছে একটা।
পুনিত বিষম খেলো যেনো।রিতি, মনিকা সহ আরো যে টিচার্স রা ওখানে উপস্থিত ছিলেন সবাই হাসলো একদফা।
স্যার আপনার জন্য মনিকা ম্যাডাম এর ঘটক হওয়ার স্বপ্ন টা জলাঞ্জলি দিতে হলো?ভেরী স্যাড। রসিকতা করে রিতি।
পুনিত মালহোত্রা নিজের জন্য নয় মনিকার জন্য যেনো দুঃখে ভেঙে পরলো।রিতি তা দেখে হাসি চাপালো কোন মতে মাথাটা নিচু করে।
মনিকা মুখটা চুন করে আধোমুখে বসে নিজের নির্বোধ ভাবনার জন্য নিজেকেই গালমন্দ করলো।এক দিনের দেখায় কত কি ই না ভেবে ফেলেছিল।
নিরুপমা ঢুকলো রুমে।সবার সাথেই সৌজন্য আলাপ আলোচনা করে বসলো নিজের জায়গায় কিন্তু পুনিত মালহোত্রার গতকালের সেই আন্তরিকতাটুকু যেনো আর পেলো না।
ব্যপারটা ঠিক বুঝলো না নিরুপমা।
চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।