হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:২৮

0
937

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:২৮

লিকু সরদার এর পুরোনো টিনের চালা দেওয়া ঘড়টা থেকে মাঝে মাঝে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ভেসে আসছে। বৃদ্ধ লিকু ভুলে গেছে তার এহকাল পরকাল। একদিন জবানের জবাবদিহিতা যে করতে হবে তাও বোধহয় বিস্মৃত হয়েছে সে।এমনকি যে সন্তান এখনো চোখের সামনে সুস্থ্য ভাবে ঘুরছে তার মৃত্যু কামনা করছে দাঁত কিড়মিড় করে,,,
ঐ শু**রের বাইচ্চা আমার বাড়িতে যেন আর না আসে।তাইলে অরে শাবল দিয়া কুপায়ে মারুম কইলাম। আমার ভিডায় থাইকা আমার লগে দুশমনি ?

লিকুর স্ত্রী স্বামীকে একসময় ভয় পেতেন আজরাইলের মতো।সেই ভয় বছরের পর বছর ধরে ক্ষয় হতে হতে অবশিষ্ট নেই তেমন। তবুও লিকুকে তিনি বিশ্বাস পান না। লোকটার নিজের তো মানসম্মান বলতে কিছু নেই অন্যেরটাও রাখতে জানে না।ঘড়ভর্তি মানুষের সামনে চুলের মুঠি ধরে মারতেও বাঁধবে না এই বয়সে এসেও। তিনি স্বামীর প্রতি বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ নাকরেই বললেন গলাটা খাদে নামিয়ে,, আমনের আল্লার দোহাই লাগি,এমন কইরা চিল্লাইয়েন না।পোলাডা হুনলে ক্যাচাল হইবো।
তেলে বেগুনে জলে উঠে লিকু সরদার। হাতের কাছে থাকা সরিষার তেলের কাঁচের শিশিটা ছুড়ে মারে স্ত্রীর দিকে।ভাগ্য সহায়,মহিলা দ্রুত সরে গিয়েছিলেন শিশিটা উড়ে গিয়ে লেগেছে বাঁশের খুঁটির সাথে।শিশি ভাঙার উচ্চ শব্দে উঠোন থেকে ছুটে আসে লিকুর মেজ ছেলে।সে এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপের গালিগালাজ শুনছিলো।মাকে টেনে ঘড় থেকে বাহির করে দিয়ে পিতাকে বললো,,আব্বা হুদাই মালামাল ভাইঙ্গো না।পারলে ছোড পোলার সামনে গিয়া কিছু কও।এমনে বাপ ভাইয়ের লগে শত্রুতা করতে না করো তারে।

লিকু সর্দারের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে,,মুখ কাঠিন্যে মুড়িয়ে বলে,,,জানোয়ারডার লাইগা আমার এত বড়ো পরিকল্পনা নষ্ট হইয়া গ্যাছে।না হইলে গত কালই চৌধুরীর পোলার কল্লাটা নিজের হাতে দুইভাগ করতাম লগে ঐ মাষ্টারনীরে।ওরে ছাড়ুম না আমি। দরকার হইলে দুনিয়ার থাইকা নাই কইরা দিমু।খিটখিট করে খানিক হেসে নেয় লিকু সর্দার।হাসি নাকি ইঁটের ভাটার পরিবেশ দূষণ কারী কালো ধোঁয়া বোঝার কায়দা নেই। পিতার মুখে এমন কথা শুনে ভরকে যায় মেজ ছেলে টা।সে তার ডাকাত বাপের কুকর্ম সচোক্ষে দেখেনি কখনো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আঁতকে উঠলেন লিকুর স্ত্রী।ছোট ছেলেটা যে তার বড়ো আদরের।কি করবে ভেবে পায়না।

কালো মসৃন পিচঢালা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে বড়ো সাইজের লোকাল বাসটা।গন্তব্য নড়াইলের কোনো একটা জায়গা।

বাসে উঠে পর পর দু’বার বমি করে নেতিয়ে পরেছে রিতি।প্রায় গোটা রাত জাগ্রত থাকা আর গুমরে কাঁদার ফলে মাথাটা আগে থেকেই ভারী হয়ে উঠেছে।তার উপর খালি পেটে পেট্রোল পোড়ার ঝাঁঝালো গন্ধে নাড়ি ভুড়ি উগরে এসেছিলো। সকালের ব্রেকফাস্ট এর জন্য অর্ডার করা খাবার টুকুও পরে রয়েছে হোটেল রুমে। ছুঁয়ে ও দেখেনি রিতি। বিরূপাক্ষর দিকে ভূলেও তাকায়নি।সেটা কি বুক ভরা অভিমান নাকি প্রচন্ড ঘৃনায় হৃদয়ের গহীনে ক্ষতর জন্য জানিনা।তবে হোটেল রুম থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বিরূপাক্ষের কিছু কথার উত্তর দিয়েছিলো সিক্ত ঝাঁঝালো কন্ঠে।রাতে রিতির প্রত্যাখ্যানে অপমানিত হয়ে বিরূপাক্ষ বেরিয়ে গিয়েছিলো রুম থেকে।একবারো পেছনে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে হয়নি ওর।যদি দেখতো তাহলে দেখতে পেতো প্রত্যাখ্যানের যে তীব্র যাতনা ওর নিজের বুকে বইছে তার চেয়ে অধিক দহনে জলছে মেয়েটা।বাকি রাতটুকু হোটেল লবিতে ঝিম মেরে পরে থেকে যখন সকালের সূর্যের দেখা মিললো তখন নেশার ঘোর অনেকটা কেটেছে বিরূপাক্ষের।বুঝতে পারলো গত রাতে ডিনার সেরে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে কোল্ড ড্রিংস নিয়েছিলো ওতেই হয়তো এলকোহোল ছিল। তারপর ঝিম ঝিম মাথায় রুমে ফিরে রিতির সাথে,,,ওহ নো। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে বিরূপাক্ষ।
রাতের ঘটনা মনে পরতেই পুরো নেশা ছুটলো আর বিরূপাক্ষ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো নিজের রুমের দিকে। নেশার ঘোরে মস্ত বড় ভুল হয়েছে তার।হুরমূর করে দরজা খুলে শান্ত হলো কিছুটা।রিতি মুখ মুচছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বিরূপাক্ষ। আয়নার রিতিকে যেনো খুব মলিন দেখালো।
সংকোচ আর অপরাধ বোধ নিয়ে এগিয়ে গেলো রিতির দিকে।কোনো রকমে উচ্চারণ করলো,সরি,,, আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে রে,,
কান্নাটা দলা পাকিয়ে ওঠে রিতির গলার কাছে।শত শত কেঁচোর কুন্ডলীর মতো ঘিনঘিনে অনুভূতি হয় তার,,,

এখনো আমি তোমার স্ত্রী রূপদা,,

কিন্তু আমি তো তোকে,,

রিতি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে বিরূপাক্ষ কে থামিয়ে দেয়,,
কিন্তু তুমি রিতি ভেবে রিতিকে কাছে টানোনি।

আসলে আমি নেশার ঘোরে এমনটা করেছি বিশ্বাস কর।। আকুলতা ঝরে পরে বিরূপাক্ষের স্বরে।

রাতের আঁধারে নেশায় আসক্ত হয়ে নিজের কৃত কর্মের দ্বায় সারাজীবনের জন্য আমার মাথায় তুলে দিতে তুমি? প্রেমহীন দৈহিক সম্পর্কের মানে জানো তুমি? নিজের স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হতাম আমি। বেঁচে থাকতাম কি করে বলো?

রিতি,,, বাচালতার একটা সীমা আছে। মুখে যা আসে তাই বলবি?গলা চড়িয়ে ধমক দেয় বিরূপাক্ষ। নিজের দিকে টেনে ঘুরিয়ে নেয় রিতিকে।রিতির অশ্রু বিহীন দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। বিরূপাক্ষ হতাশ হয়ে নিজের উত্তেজনাকে সামলে নেয়,,,

একবার আমার দিকে তাকা না বুড়ি,,,,, আকুল আবেদন বিরূপাক্ষের।

রিতির বুকটা ব্যাথায় টনটন করে ওঠে এমন স্নেহের সম্ভাষণে।

আমি তোমাকে ঘৃনা করতে চাই না রূপদা।অমন পাপ করার আগে যেনো মরণ হয় আমার। কিন্তু ছুঁতে এসো না আর আমাকে।নিজেই বেহায়া হয়ে যাই।রেডি হয়ে নাও।বেড়োবো আমরা।

বিরূপাক্ষ ছেড়ে দেয় রিতিকে।ধীরলয়ে ওয়াশ রুমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
সকালের নাস্তা রুমে দিয়ে গেলে বিরূপাক্ষ একবার বলেছিলো রিতিকে খেয়ে নিতে। কিন্তু রিতি খায়নি এমনকি কোনো প্রকার উচ্যবাচ্য ও করেনি।
কিন্তু কি আশ্চর্য যাকে ছুঁতে মানা করেছিলো,যার উপর ক্রোধ,আত্মাভিমান কিংবা ঘৃনায় সকালের খাবারটা পর্যন্ত খায়নি।একটু দুর্বল হতেই চলন্ত বাসে ক্যামন পরম নির্ভরতায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সেই মানুষটির বুকের পাশে মাথা রেখে। একবার বুঝতেও পারছে না সদ্য ব্যান্ডেজ মুক্ত হাতটা একভাবে থাকার ফলে ব্যথায় টনটন করছে বিরূপাক্ষের। কিন্তু ও সরাবে না হাতটা তাহলে যে রিতির ঘুমে ব্যঘাত ঘটবে কিংবা গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে জানালার কাঁচে আঘাত পাবে।

*****
সকালে পূজা সেরে মন্দির থেকে সবে ঘড়ে ঢুকলো জয়া। আবার ছুটতে হবে রন্ধনশালায়। কাজের মাসি আটা মেখে সবজি কেটে রেখেছেন।ওকে নিজের হাতেই বানাতে হবে জলখাবার।শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছেনা জয়ার।মাথাটা থেকে থেকে ঝিম ঝিম করে ওঠে।কিছু খেলেও বমি বমি ভাব হয়। কিন্তু জয়া কাউকে বলে নি কথাটা।চাপা স্বভাবের মেয়ে গুলো এমনি হয় তায় আবার অভিমান ভর করেছে বুকের মাঝে।যাকে আপন মনে করে নিজের সকল খুঁটিনাটি বলতো সময় পেলেই তার সাথেও আজকাল কথা বলে না জয়া।মনে মনে ভাবে কঠিন অসুখ হয়তো হোক, আত্মঘাতী হয়ে মহাপাতকী হওয়ার চেয়ে এভাবে রোগে শোকে মরে যাওয়াই ভালো তাহলে অন্তত শ্রাদ্ধ শান্তি টুকু কপালে জুটবে।তাও বা জুটবে কি করে নিজে যে নিস্ফলা বৃক্ষ। জয়ার এমন মূর্খের মতো বোকা সোকা ভাবনা দেখে হয়তো সৃষ্টিকর্তা হেসে লুটোপুটি খান।মনে মনে বলেন,,এত সাদাসিধে হতে নেই মেয়েটা?
রঘুনাথ হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়েছে ওয়াশ রুম থেকে।ইতোমধ্যে পটু হাতে স্বামীর পরনের পোশাক সাজিয়ে রেখেছে বিছানায়। রঘুনাথ তোয়ালে খানা সোফায় ফেলে বললো জয়াকে,,,

তোমার কি শরীর খারাপ?দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছো যে?
এতদিনে নজর পরলো?বলবো না, মরে গেলেও না। অভিমান ভারী হয় জয়ার তবে কথাগুলো স্বরতন্ত্রীর গহ্বরেই বিলীন হয়ে যায়।

কি হলো জয়া কথা বলো?
কথা বলে না জয়া বেশ কয়েকদিন কথা বলে না রঘুর সাথে। সেই রাতের পর জয়ার মুখে তালা লেগেছে।চোখ ছাপিয়ে অশ্রু আসে জয়ার। দরজার দিকে হাটা দিতেই রঘুনাথ হাত টেনে ধরে জয়ার।একদম বুকের সাথে মিশে দাঁড়িয়েছে জয়া। নিজের দু-বাহু প্রসারিত করে পেছন থেকেই বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে জয়াকে।কানের কাছে মুখ নিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে,,এমন করছো ক্যানো তুমি?আমি তো বলেছি আমার ভুল হয়েছে,ক্ষমা করো না!এভাবে কথা বলা বন্ধ করতে আছে?

কথা ফোটেই না জয়ার ঠোঁটে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে সে।
যে রাতে বিরূপাক্ষ চিলেকোঠার ছাদে বসে রঘুনাথ কে ব্লাকমেইল করেছিলো সেই রাতে ভাইকে কিছু বলতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ঘড়ে এসে নিজের ক্রোধটুকু শান্ত শিষ্ট পতিব্রতা স্ত্রীর উপর প্রয়োগ করেছিলো।জীবনে প্রথম বারের মতো ভালোবেসে নয় আঘাত দেওয়ার জন্য ছুঁয়েছিলো জয়াকে।পর পর দুটো চড় মেরেছিলো জয়ার দুই গালে।পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে কিন্তু ধনুক থেকে তীর আর মুখ থেকে থুথু বেরিয়ে গেলে যেমন ফেরানো যায় না,তেমনি কাউকে আঘাত করা হয়ে গেলে শত চেষ্টা করেও সে দাগ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায় না মন থেকে।

কাঁদছে জয়া। রঘুনাথের বুকে তোলপাড় শুরু হয়েছে।জয়াকে এইটুকু ছুঁলেও যে অনাবিল প্রশান্তি বুক ছুঁয়ে যায়, অর্পিতাকে দেহের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে নিলেও তো সে প্রশান্তি আসেনি কোনো দিন তার।তবে সত্যিই কি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে অজানা অপরিচিত দুটি মানুষের দুটি হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যায় কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে?

*****
সকাল সকাল অফিসে ছুটেছে অখিলেশ।অন্যদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে যায় বুটিক হাউসে। সেখানে সুমির সাথে ভাব হয়েছে বেশ।সুমিই সবকিছু বুঝিয়ে শিখিয়ে দেয়।রিতির বান্ধবী কি না,রিতির মতো বুদ্ধিমতি না হলেও আন্তরিকতার প্রতিযোগীতায় দু বন্ধুর প্রতিযোগিতা সমানে সমান।এর চেয়ে ও ভালো,ওর চেয়ে এ ভালো। অন্যদিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে যায়নি অখিলেশ। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে স্কুলের সামনে।কি এক দূর্নিবার টানে জানেনা সে।স্কুলের চারিধারে দেয়াল না থাকায় তাকালে দেখা যায় সবকিছু। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে অকারণে। তারপর আশাহত হয়ে ফিরে যায় নিজের গন্তব্যে। দোতলার টিচার্স রুমের রাস্তা মুখী জানালা থেকে বিমর্ষ মুখে সরে যায় নিরুপমা।তাকে ছাড়তে হবে এ গন্তব্য নইলে আবার অপমানিত হবে চরম ভাবে।যে দায়িত্ব নিতে ভয় পায় তাকে দায়িত্বে আবদ্ধ করতে গিয়ে নিজেকে হেনস্থার সর্বো নিচে নামাতে আর পারবে না নিরুপমা।

এতদিন শহরে থেকে থেকে যে স্মৃতির দহনে দগ্ধ হয়েছে প্রতিনিয়ত। দুঃখের দিনে সুখের স্মৃতিগুলো একটা মানুষকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে বারে বারে।সেইসব সুখস্মৃতির তাড়না থেকে বাঁচতে চির পরিচিত,জন্ম থেকে অভ্যস্ত শহুরে পরিবেশ ছেড়ে একপ্রকার পালিয়েই এসেছে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা পাড়াগাঁয়ে।এখানে বদলি নিতে কম সময় বা কম জবাবদিহি করতে হয়নি নিরুপমাকে।এমনকি একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতটাও অনিশ্চিত করে ফেলেছে সে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক।কথায় আছে,,যেখানে গেলে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়।

****
মাঝে কেটে গেছে আরো একসপ্তাহ। গতকাল লক্ষীপূজাও মিটলো ভালোয় ভালোয়।রিতি সেদিন বাড়িতে ফিরেই বিরূপাক্ষের ঘড় থেকে নিজের সবকিছু নিয়ে আগে ঘড়ে ফিরে গিয়েছিলো। অন্নপূর্ণা দেবীর আকুতি মিনতি পারেনি তাকে বিরূপাক্ষের ঘড়ে রাখতে। অবশেষে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো তাঁর কাছে।ছেলের ঘড়ে না থাকুক একই বাড়িতে তার চোখের সামনে যে আছে সেই ঢের আনন্দের বিষয় অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে।রিতি বিরূপাক্ষের সাথে আগে তাও দু চারটে যা কথা বলতো এখন আর তাও বলে না। রাতের গভীরে কফি নিয়ে যায়না আর।ঔষধ কিংবা খাবারের জন্য তাগাদা দেয় না।তবে একটা কাজ সে রিতিমত করে চলেছে ক’দিন যাবত।ভোরে সবার অলক্ষ্যে বিরূপাক্ষের ঘড়ে ঢুকে ওর আঘাত পাওয়া হাতটায় কি একটা উদ্ভট গন্ধ যুক্ত তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে ম্যাসাজ করে অতি সন্তর্পণে। সজাগ বিরূপাক্ষ অনুভব করে রিতির এই আদরমাখা সেবা যত্ন। কিন্তু মুখে বলে না কিছুই। আজকাল রিতির সাথে সেধে কথা বলতেও তার জিভ ভারী হয়ে নড়া চড়া বন্ধ করে দেয়।তাইতো রিতি আসার আগেই ঘুম থেকে উঠে দরজাটা খুলে,কান খাড়া করে অপেক্ষা করে কখন শুনবে সেই কাঙ্খিত পদধ্বনি।

অন্যান্য দিনের মতো সন্ধ্যার একটু আগেই ফিরলো রিতি।আজ সাথে অখিলেশ ও আছে।সবে বসার ঘড়ে পা দিয়েই একটা ঝটকা খায় অখিলেশ।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দরজাতেই। এতক্ষণ দুজনে কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো হেসে হেসে।রিতি অখিলেশের সাড়া না পেয়ে পিছনে পাশে তাকিয়ে দেখলো অখিলেশের দৃষ্টি বসার ঘরে এটে আছে। মৃদু ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিতি সেদিকে,,,
নিরুপমা দি,,অখিল দা আপনি চেনেন নাকি ওনাকে?

হ্যা না মানে চলো?

কি হ্যা না?কোনটা ধরবো আমি?
ততক্ষণে ছোট্ট অদ্রিকা দৌড়ে এসে অখিলেশের পা জড়িয়ে ধরেছে,,

আঙ্কেল তুমি আর যাওনি ক্যানো আমাদের বাসায়? তোমাকে কত খুঁজেছি আমি! অভিযোগের শেষ নেই অদ্রিকার।

রিতি তো অবাক।এই ফুটফুটে বাবুটা নিরুপমা দিদির? আওড়ায় মনে মনে।
অখিলেশ ততক্ষনে কোলে তুলে নিয়েছে অদ্রিকাকে। কিন্তু রিতি অন্য হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। মেয়েটার মুখায়বয়বের সাথে অখিলদার মুখের আদল টা যেনো ভীষণ মেলে।

*****
অখিলদা সত্য কথাটা কি তুমি বলবে নাকি আমি খুঁজে বের করবো?কড়া সুরে বললো রিতি। ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে।অখিল পরেছে মহা বিপাকে।এই মেয়ে যেভাবে ধরেছে বিশ্বাস জনক কিছু একটা বলতে হবে।নইলে ছাড়বে না।

দ্যাখো বোনটি,,,,

থাক,,আমি দেখে নিয়েছি অখিলদা।এখন শুনতে চাই। আপনার এই দেবদাসের মতো উদাস হয়ে চলাফেরার মূল কারনটা কি নিরু দি?

আসলে হয়েছে কি রিতি,,,,

হ্যা হ্যা,,,আমি তো আসলটাই শুনতে চাই।গলা চড়িয়ে বলে রিতি।

এত কিছু জেনে কি লাভ আছে বলো?

রিতির গলা খাদে নামে,,,

লাভ,লস এত হিসাব পরে করবো।আগে যা জানতে চাইছি বলেন?

মা তোমাকে কতবার বলেছি ও কথা আর মুখে আনবে না। নিরুপায় নিরু।

কিন্তু মা এভাবে তোকে রেখে আমি কিভাবে চোখ বুজবো বল? একবার তো কথা বলি ছেলেটার সাথে! মেয়েকে বোঝান অনিতা দেবী।

না মা,, তুমি ই তো বললে ওর ঘড় সংসার হয়েছে।সে এখন অন্যের ভালোবাসার মানুষ। এখন আর সময় নেই মা।যখন সময় ছিলো তখন আমি ভিক্ষুকের মতো তাড়িত হয়েছি।দূর দূর করে তারিয়ে দিয়েছে নিজের জীবন থেকে।আর পারবো না মা।পারবো না। কোন মুখে ওকে আবার চাইবো বলো? কাঁদে নিরু। অসহায় মায়ের চোখেও জল।

ওকে পাওয়ার কথা চিন্তায় আনাও যে ঘোর পাপ মা।

কিন্তু মা তুই একা একটা মেয়ে কিভাবে পার করবি এত বড়ো জীবনটা বল?যাকে ভালোবেসে জীবনের সকল সুখ,মোহ ত্যাগ করেছিস, তাকে তুই চাইতেই পারিস এতে পাপ নেই।মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন অনিতা দেবী।

নিরু ঘুমন্ত অদ্রিকাকে বুকে চেপে গুমরে কাঁদে।মুখের বুলি ফুরায়। এতদিন যে বাসনা ছাইচাপা হয়েছিলো বুকের ভেতর। মানুষটাকে দেখার পরে তা ধিকি ধিকি জলছে শুধু।পোড়া বুকটা তার আর কত পুড়বে কে জানে?

অনিতা দেবী নিজে কাঁদেন কিন্তু মেয়েকে কোনো শান্তনা বানী শুনান না।গত কয়েকবছর যাবত দেখছেন একমাত্র আদরের কন্যা রাতের আঁধারে ঘুমায় কম, কাঁদে বেশী।যে মেয়ের চোখে কখনো অশ্রু আসার সুযোগ দেয়নি সে মেয়ে এখন অশ্রু সমুদ্রে হাবুডুবু খায়।

বুনু সমুদ্রের বুকে জলের অভাব নেই কিন্তু তৃষ্ণা মেটাতে কি সক্ষম বলো? আমার বুকেও তেমনি নিরুর নামে ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র বইছে কিন্তু তার এক কণাও তাকে দিতে পারিনি আমি। যতটুকু দিয়েছি তাতেই সে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলো।আর পোড়াতে চাই না।

সে স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালো আছে,ভালো থাকুক।একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অখিলেশ।রিতি বিভোর হয়ে শুনছিলো এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া অখিলেশ এবং উচ্চ বিত্ত পরিবারের মেয়ে নিরুর প্রেমকাহিনী।কি পাগলের মতো ভালোবেসে মেয়েটা নিজেকে সঁপে দিয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটির হাতে।যে হাতটি শেষ অবধি তার হাতটি আঁকড়ে ধরতে পারেনি।

চলবে,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here