উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:৩৭(অন্তিম পর্ব)
****
ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা দুইয়ের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে সবে।যাকে বলে ভরদুপুর।ভ্যান গাড়ি থেকে নেমে স্কুল গেটের ভেতর দিয়ে প্রাণপনে পা চালিয়ে হাঁটছে অখিলেশ। শুক্রবার সরকারী ছুটি বিধায় মাঠটা পুরো ফাঁকা। বুকের ভেতরটা অসহনীয় অব্যক্ত ব্যাথায় টনটন করছে।গন্তব্যে পৌঁছাতে আর বেশি দেরী নেই। নিরুপমার শয়ন কক্ষের দরজাটা হাট করে খোলা রয়েছে।এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা গিয়ে সেখানে ঢুকলো অখিলেশ। নতুন ভাঁজ ভাঙা শাড়ির কুঁচি পরিপাটিতে ব্যস্ত নিরু।তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অখিলেশ। আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত নিরুর হাত থেকে বেরিয়ে যায় নতুন শাড়ির কুঁচি গুলো।
পেছনে ব্যাক্তিটিকে সনাক্ত করতে এক মুহুর্ত লাগে না তার।
কি করছো অখিলেশ?এ কি ব্যবহার তোমার? সামান্য বিরক্ত বোধ হয় নিরুপমার।
প্লিজ নিরু,,এমনটা করো না তুমি।অদ্রিকাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।গলা কাঁপছে অখিলেশ এর।নিরু বুঝতে পারে না হলো টা কি? অখিলেশ কে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসে। মানুষটার চোখের জল ভাবনায় ফেলে দেয় মুহূর্তেই,,
তা কি করে হয় অখিল?অদ্রিকা আমার সন্তান, তাকে তুমি কিভাবে কাছে রাখবে?আর আমিই বা কেন দেবো? উদ্বেগ হীন কন্ঠে বললো নিরু,,
অখিলেশ খাট থেকে নেমে নিচে হাঁটু গেড়ে বসে নিরুপমার কোলে মাথা রাখে। নিরুপমার ভেতরটা শিউরে ওঠে।ভয় হয় মনে মনে,,এমন কেন করছে মানুষটা?তার স্বভাবের সাথে কিছুতেই মিলছে না।
নিরু আমি এভাবে বাকীটা জীবন কাটাতে চাই। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মুখে আঙ্কেল নয়,বাবা ডাকটা শুনতে চাই।বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?
মনে জমে থাকা আশঙ্কা ই সত্য হয় নিরুপমার। অখিলেশ কি তবে বুঝে ফেলেছে অদ্রিকা তারই সন্তান?যদি কেড়ে নেয়?বুকটাতে ভোঁতা যন্ত্রণা চাপা দিয়ে বললো নির্লিপ্ত গলায়,,,
এসব কথা এখন বলার সময় নয় অখিলেশ।আমি একটু ব্যস্ত আছি। তাছাড়া এতদিন তো এতসব চাহিদা তোমার ছিল না। এখন বলে কি হবে বলো? আমাকে যেতে হবে এক্ষুনি। প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায় নিরুপমা।
অখিলেশ আরো জোরে আঁকড়ে ধরে নিরুপমাকে। মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি লাগছে তার উন্মুক্ত পেটে। ভালো লাগা, মন্দ লাগা, অসহনীয় শিহরণ খেলে যায় নিরুপমার দেহে। অনেক দিনের স্পর্শ হীন উপসী শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে মৃদু কাঁপন।
এভাবে বলো না নিরু।আমি তোমার গর্ভে আমার সন্তানের বেড়ে ওঠা বুঝতে চাই। যে সুযোগ টা একবার হারিয়েছি সেটা আবার ফিরে পেতে চাই।আমি আমার সন্তানের প্রথম উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাই।তার আঁতুড়ে গায়ের গন্ধ নিতে চাই। বেলা শেষে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পরম শান্তিতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে চাই।চলে যেওনা নিরু। তুমি প্রতিশোধ নিও না প্লিজ তাহলে পৃথিবীর শ্বাস টুকুও আর নিতে পারবো না আমি। অখিলেশ শব্দ করে কাঁদছে। দরজায় নিজের মা এবং মেয়ের উপস্থিতি অপ্রস্তুত করে তোলে নিরুকে। মায়ের চোখে চোখ পরে। সেখানেও স্নেহ,করুনায় ছলছল করছে।নিরু জানে মায়ের চোখের ঐ ছলছলানি নিজের মেয়ের জন্য নয়, বরং যে ছেলেটা তাঁর মেয়েকে একদিন নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেছিলো সো কলড্ লো ক্লাস মেন্টালিটির জন্য, সেই গা বাঁচানো ছেলেটার জন্য।
চোখে বিরক্তি ফুটিয়ে মাকে ইশারা করতেই তিনি সরে যান অদ্রিকাকে নিয়ে।নিরুর সত্যিই এখন বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।মা যেমন তেমন, মেয়েটার মনে কোনো প্রকার প্রশ্নের জন্ম দিতে চায়না সে।কিন্তু অখিলেশ এমন পাগলামী কেন করছে বুঝলো না।
অখিলেশ ওঠো প্লিজ।সবাই দেখছে তো।
অখিলেশ উপর দিকে মুখ তোলে।চার চোখের মিলন ঘটে মুহূর্তেই। ভালোবাসার মানুষটির বেদনায় মুহ্যমান মুখাবয়ব সহ্য হয়না নিরুপমার।
কি হয়েছে বলো আমাকে?ওঠো তো।
অখিলের হাতে মৃদু কর্ষন করে মোলায়েম স্বরে বলে নিরুপমা।
না আমি উঠবো না।যতক্ষন না তুমি আমাকে ক্ষমা করে যাওয়া স্থগিত করছো ততক্ষন উঠবো না।জেদ ধরে অখিলেশ।
আশ্চর্য অখিল!এমন জেদ করছো কেনো?আর আমি যাবো না কেন?
গলার স্বর চড়া হয় নিরুর।
প্রবল বেগে ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে অখিলেশ,,
না না,অত কেনো’র উত্তর আমি দিতে পারবো না। তোমার যাওয়া হবে না। কিছুতেই না।তোমাকে আমার লাগবেই লাগবে। আমার মেয়েকে আমার চাই।
অখিলেশ এর এমন শিশুসুলভ আচরণ নিরুপমাকে হতবিহ্বল করে দেয়। সেই সংযমী,আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটির সাথে এর কোন মিল নেই।
চাকরী তুমি ছেড়ে দাও ঠিকাছে কিন্তু আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না তোমার।
নিরু আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।ও দিকে বেলা বসে নেই।অতদূরের পথ যাবে সে।সময় হাতে রেখে না গেলে হয়?
এই আমি যে চাকরি ছাড়ছি সেটা তোমাকে কে বললো?অবাক নিরু। অখিলেশ অতীতে ফিরে তাকায়,,
সকাল আটটা,,,বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসেছে রিতি। আজ বেশ ঝরঝরে লাগল দেখে। অন্নপূর্ণা দেবী জলখাবার খাইয়ে দিচ্ছেন তাকে। অখিলেশ একটা আপেল নিয়ে সবে এক কামড় বসিয়েছে,,
অখিলদা,,, আপনি তো এখানে পরে আছেন দেখছি, ওদিকের খবর কিছু জানেন?আপন মনে মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে বললো রিতি।
অখিলেশ প্রশ্নভর্তি দৃষ্টিতে তাকালো।
কি খবর বোনটি? তোমার বুটিকের? সেখানে কোনো সমস্যা নেই তো, সবকিছু ঠিক আছে।
ওহো অখিল দা,, আমাদের স্কুলের নিরু দিদিমনি যে আজ চলে যাচ্ছেন ইস্তফা দিয়ে, সেটা জানেন কি?একটু আগে ফোনে কথা হলো।কত আশির্বাণী ছুঁড়লেন,,,
আয়েস করে খাবার চিবোচ্ছে রিতি। ওদিকে
অখিলেশ এর হাত থেকে আপেলটি খসে পরে। চোখ মুখের ভাব মুহূর্তে ই পাল্টে গেছে।একটু আগে সে নিজেই দেখেছে নিরুপমার সাথে রিতিকে কথা বলতে। সুতরাং অবিশ্বাসের কিছুই নেই।
বিরূপাক্ষ পাশে বসে রিতির মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করলো এবং এটা বুঝলো যে , এইমাত্র প্রাপ্ত সংবাদ টি একদমই সত্য নয়। কিন্তু অখিলেশ বেচারা,,,তার তো শ্বাস নেওয়া ই কষ্টকর হয়ে পরলো,,, কিছু না বলে বেরিয়ে পরে কেবিন থেকে।
বর্তমান,,,
অখিলেশ এর মুখে সবটা শুনে বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো নিরুর।উঠে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় বলল,
এজন্যই তুমি মরতে মরতে ছুটে এলে??
রিতি তোমাকে নাচালো আর তুমি নাচলে?প্রেম সব উতলে উঠলো?
মেয়েটা পারেও বটে! নিজের শরীরের ঠিক নেই সে আছে অন্যের সম্পর্ক ঠিক করার তালে।
শেষের কথায় গলাটা নেমে আসে।
নাচানাচি? এসব কি বলছো নিরু?
আমি চাকরি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। তুমি শুধু শুধু গলে খসে পরলে। আহারে অখিলেশ বাবু,,মাথাটা পুরোটাই গেছে?
মুখ দিয়ে আফসোস ঝরে পড়ে নিরুপমার। অখিলেশ একটা শুকনো ঢোক গিলে নেয়।
কিন্তু কোথায় যাচ্ছো তাহলে ব্যাগ গুছিয়ে? দেওয়ালের পাশে থাকা বড়ো কালো ব্যাগটায় চোখ যায় অখিলেশ এর।
নিরু সেদিকে তাকিয়ে বলে,,ওটাতে আমাদের শীতবস্ত্র। বাসাতেই ছিলো।সকালে নারান দা এসে দিয়ে গিয়েছে।
অখিলেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এতক্ষণ এই ব্যাগটাকে তার মহাশত্রু মনে হয়েছিল। এবার কি করবে? লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। কিন্তু আজ তো লজ্জা পেলে চলবে না।
আচ্ছা তাহলে থাকো তুমি,আমি যাই?রিতিকে দেখতে যাবো।
কুচিগুলো পুনরায় ঠিক করতে করতে বললো নিরুপমা।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলো অখিলেশ। কিন্তু যেটা একবার হয়ে গেল সেটা ফাইনাল করেই তবে যাবে। এগিয়ে গিয়ে দুহাতের আঁজলা তে নিরুপমার মুখটি তুলে নিয়ে বলে নিচুস্বরে,, কিন্তু নিরু আমার চাহিদা গুলোর কি হবে?জীবন্ত লাশ হয়ে আর থাকতে পারবো না। তোমাদেরকে যে আমার চাইই।
সেটা কি এখনো সম্ভব অখিল?অদ্রিকাকে মানাবে কি করে?
কিছুই অসম্ভব নয় নিরু! আমাদের রিতি দিদিমনি আছে তো।সব ঠিক করে দেবে।
চোখের জল গড়িয়ে পড়লো নিরুপমার কিন্তু বহুদিন বাদে ঠোঁটের কোনে ফুটলো একচিলতে সব পেয়েছির হাসি।
*******
দেখতে দেখতে কেটে গেল দুটো মাস। বৈশাখের চারটা দিন অতিক্রম করেছে ইতিমধ্যে। নতুন বছরের আগমনে ঘরে ঘরে খুশির আমেজ।রিতির সাথে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার পরে গ্রামের মধ্যে সময়ে অসময়ে যে পরিমাণ পুলিশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তিবর্গের আনোগোনা বেড়েছিল তাতে গ্রাম্য নিরীহ মানুষ গুলো ভয়ে,আতঙ্কে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। এখন আর সেই ভয় নেই আসামীরা ধরা পড়েছে।কোর্টে মামলা চলছে। এখন সব শীতল।মানুষজন আবার নিজেদের মতো যে যার কর্মে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। এলাকার লোকজন এর আগে কখনো এমন উৎসব মুখর বৈশাখ পায়নি।এ বৈশাখ শুধু পুরোনো জরাজীর্ণ ধুয়ে দেয়নি।মুছে দিয়েছে অনেক দিন ধরে জমে থাকা কলুষ ও। চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী ত্ররিতি হালদার কে পুনরায় বিবাহ করছে মহা ধুমধাম করে।সে নাকি আগেরবার বিয়ের আনন্দ পায়নি।তাই এই ব্যবস্থা।
নিরু অখিলেশ ভালো আছে। কিন্তু রিতি এবং বিরূপাক্ষের একটা হ্যাপি এন্ডিং না দেখে ওরা সামাজিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে না।সেই প্রতিজ্ঞা করেছে।রিতি তো একদিন সরাসরি বলেই ফেলল,,
তোমাদের ছুকছুকানি বুঝি না ভেবেছো?
বিয়ে এখন না করলেও অন্য কিছুই বাদ পরবে না।
অখিলেশ তো লজ্জায় উঠে সরে পরেছিলো।
নিজের উদ্যোগে দুজনের কোর্ট ম্যারেজ টা ঠিকই করিয়ে দেয় রিতি।
হাসপাতাল থেকে রিতি চলে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে।বিরূপাক্ষের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে,শশুর শাশুড়ি সহ সকলের ইচ্ছে গুলো এড়িয়ে উঠেছিলো বাপের বাড়ি।সে রাগটা বিরূপাক্ষ পুষে রেখেছে কি না জানে না রিতি তবে এটুকু বেশ বুঝেছে রূপ দা এখন শুধুই তার। কিন্তু বনলতার ব্যাপারটা নিয়েও একেবারে নিশ্চিত হতে পারছে না।কারন চাপা স্বভাবের বিরূপাক্ষ কাউকে কিছু না বললেও মনের মধ্যে কিছু রেখেছে কি না কে জানে?
বিরূপাক্ষ মাঝে মধ্যে গিয়েছে হালদার বাড়িতে। কিন্তু হাসপাতালে থাকতে রিতির সাথে যতটা সহজ হয়েছিল তার ধারে কাছেও ঘেঁষে নি।রিতি বোঝে রূপদা তার উপর অভিমান করে আছে। ভীষণ অভিমান।দোলের দিন ফোন করে ডেকেছিলো রিতি।
দুপুর গড়াতেই হাজির হলো বিরূপাক্ষ। সারা গ্রামের মানুষ যখন রঙের সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে রঙে চুবানো রাঙা মাসি হয়েছে বিরূপাক্ষ সেখানে সাদা টিশার্ট পরে দিব্যি ঘুরছে।কার সাধ্যি তাকে আবির ছোঁয়ায়? একফোঁটা রঙের ছোঁয়া নেই তার কোথাও।
দুপায়ে আবির দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে রিতি। বিরূপাক্ষও দিয়ছিলো দু-গালে। সিঁথি পর্যন্ত আর ওঠেনি।রিতি জানে এটা গভীর অভিমান।ও শুধু বলেছিলো,,
তুমি কিন্তু আজো আমায় ভেজা চুমুটা দিলে না রূপদা।
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বিরূপাক্ষ উত্তর দিয়েছিলো,,
ইচ্ছে আছে তোর ভেজা চুমু নেওয়ার?? তাহলে এখানে উঠতি না।
রিতি মনে প্রশান্তির হাসি ফোটে।
একটা ভেজা চুমু হয়তো দাওনি কিন্তু কত শত চুমুর বর্ষন করেছো ঘুমন্ত আমাকে সেটা কি আমি জানি না ভেবেছো?অতটাও মরার ঘুম আমি ঘুমোই না রূপ দা।
অন্দরের কথাগুলো আর বাইরে আসেনি রিতির।
****
গতকাল কালরাত্রি ছিলো।আজ রিসিপশন, বৌভাত হয়ে গেলো জোর কদমে। আত্মীয় অনাত্মী বহু অতিথি তাদের পদধূলি দিয়ে প্রাণভরে আশির্বাদ করে গিয়েছেন নবদম্পতিকে। অনেকে আবার আড়ালে আবডালে বড়লোকের যতসব অনাসৃষ্টি কান্ডকারখানা বলতেও ভোলেনি।
গুরুদেব নিভৃতে ডেকে নিলেন রিতি, বিরূপাক্ষ কে।
সস্নেহে বললেন তিনি,,
বিরূপাক্ষ দাদু ভাই,,এই বুড়োর দেখানো পথে তবে হাঁটলে,হা হা হা।
রিতির মুখেও মৃদু হাসি। লজ্জিত হয়ে বললো বিরূপাক্ষ,,,
ক্ষমা করো দাদুভাই।কি দুর্বুদ্ধিতে পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম জানি না।তবে কথা দিচ্ছি,যে রত্ন পেলাম তা অবহেলা করার দুঃসাহস আর দেখাবো না। অনেক হয়েছে প্রায়শ্চিত্ত।
গুরুদেব বিরূপাক্ষের মাথায় হাত রেখে বলেন সহাস্যে,,,
নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন করো না দাদুভাই। পুরুষের অর্থের দরকার আছে।উৎসাহ দেওয়ার জন্যেও সর্বদা একজন নিজস্ব মানুষ দরকার। এতটুকু ভোগান্তি, হয়তো কোন ভালো কিছুর ইঙ্গিত ছিলো তাই হলো। একজন পুরুষের পৌরুষের সাথে সুস্থ দেহ আর অর্থের প্রয়োজন আছে। অর্থ তুমি যথেষ্ট সংগ্রহ করেছো,আরো করো আমি সেই আশির্বাদ করি। এবার তা যোগ্য মানুষটির জন্য ব্যয় করো।সুখী হও।
মাথা নুইয়ে প্রণাম করে বিরূপাক্ষ।রিতির ভেতর বাহির প্রশান্তি আর প্রাপ্তির সুখে ভরে ওঠে। চোখ দুটো ছলছল করছে তার,, মা বাবা, দাদুভাই সবাই থাকলে আজ কত খুশিই না হতো। তাঁরা নিশ্চয়ই উপর থেকে দেখছে আর আশির্বাদ করছে প্রাণভরে।
ত্ররিতি দিদিভাই,,
রিতি তাকায় গুরুদেব এর মুখপানে।
যা হয়েছে ভুলে যা দিদি।তোর ভক্তি,সাধনা যে মিথ্যা ছিলো না প্রমাণ পেয়েছিস তার?
ভোলানাথের আরেক নাম বিরূপাক্ষ।ত্ররিতি বিরূপাক্ষের পার্বতী। তোদের মিলন যে হওয়ার ছিলো দিদি। এবার বেঁধে রাখি অদৃশ্য শক্ত বাঁধনে ।
রিতির নয়নের টলমল জল এবার গড়িয়ে পড়লো।সেও প্রণাম করলো ভক্তিভরে।
*******
বেলী, রজনীগন্ধা,গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণে ম ম করছে বিরূপাক্ষের বিশালাকার শয়ন গৃহটি।গোলাপ, রজনীগন্ধা ও অন্যান্য ফুলের মিশ্রনে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে বন্ধুরা।এ যেন এক স্বর্গপুরী।রিতিকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে তিতলি,সুমি, নিরুপমা সহ আরো কয়েকজন মহিলা।সারা ঘড়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো রিতি।ভাবলো মনে মনে,,এমনটাও ভাগ্যে ছিলো?
কে গো তুমি খুলিয়াছো
স্বর্গের দুয়ার
ঢালিতেছ এত সুখ,
ভেঙে গেল__গেল বুক
যেন এত সুখ
হৃদে ধরে না গো আর।
এই রিতি কি ভাবছিস রে এত?বললো সুমি।
লজ্জায় মুখ নামিয়ে আনলো রিতি।
কিছু না। সংক্ষিপ্ত উত্তর।
অত ভয় পাসনে রিতি আমরা আছি তো তোর সাথে।ফোড়ন কাটল নিরুপমা।
দরজা থেকে হাক দেয় অখিলেশ,,
মানে কি নিরু? ওদের ফুলশয্যায় তুমি থেকে কি করবে?
কি আর করবে কাবাবে হাড্ডি হবে।ফোড়ন কাটলো প্রদীপ।নিরু চোখ পাকায়,,মিথ্যে শাসায়,,
একদম পেছনে লাগার চেষ্টা করো না প্রদীপ! তোমার দিন কিন্তু সামনে আছে। সুমিকে বাসরঘরে ঢুকতেও দেবো না।
প্রদীপ দমে যায়। এমনিতেই অনেক অপেক্ষা করেছে আর পারবে না।নিরু যা মেয়ে করেও বসতে পারে এমনটা।
নিরু,,, তুমি একটু বেশি বেশি করে ফেলছো মনে হয়,,, আমাদের হাতেও কিছু একটা আছে।কি রে অখিলেশ তোদের বিয়েটাও তো এমাসেই তাই না রে? জয়া ভ্রু নাচায়। অখিলেশ মনে হলো ভয় পেলো,,
কি যে বলো বৌদিদি?এই নিরু,, বেচারা আর কত অপেক্ষা করবে বলো?এবার তো ছাড়ো।বললো অখিলেশ।
রিতি চোখ পাকায়। ভুলে যায় সে নতুন বৌ,,
অখিল দা,,, খবরদার একদম বরের বন্ধুর মতো আলাপ করবেন না। আপনি কিন্তু দাদা হন আমার।
জিভ কাটে অখিলেশ,, ছিঃ ছিঃ বোনটি কি যে বলো তুমি?এই প্রদীপ চলোতো।রূপ কোথায় যেন গেলো?
পালিয়ে বাঁচে অখিলেশ।
*****
মানুষ কখনো চতুর্দিকে পরিপূর্ণ হয় না।কিছু একটা না পাওয়া, কিছু একটা খামতি থেকেই যায়। জীবনে একটি মাত্র পুরুষকেই মন থেকে চেয়েছিলো তিতলি। কিন্তু সে আর নিজের হলো কই।গেলো মাসে বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছে।সেকি শুধু বাবা মায়ের মানসিক অশান্তি দূর করতে নাকি আরো একজন মানুষের মনকে অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি দিতে?সে কথা নাই বললাম আজ।রিতি বিরূপাক্ষের বিবাহ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে। এইতো সারাদিন কত কষ্ট করে বাসর ঘড় সাজিয়ে আসলো।কখনো কি নিজেকে ঐ পুষ্পশয্যিত পালঙ্কে কল্পনা করেনি?হ্যা করেছে কিন্তু মুহূর্তে নিজের মনকে শাসন ও করেছে কড়া ভাবে। ভালো বাসলেই যে পেতে হবে এমন কোন কথা নেই।না পেয়েও কাউকে মনের মতো করে ভালোবাসা যায় সেটা বুঝেছে তিতলি।এ ভালোবাসায় পাপ নেই।এ ভালোবাসায় কোনো বাঁধা নেই।
আর কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি তিতলি?রাত অনেক হলো? ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিতলি।বিরূপাক্ষের কন্ঠে ভাবনার সুতো কাটে। জোছনার আলোয় থইথই করছেই পুরো ছাদটা।সন্তোর্পণে দু গালের জল মুছে ফিরে তাকায়,,
হ্যা রে,,,,যা ধকল গেলো। ঘুম দরকার।তুই এখনো বাইরে কেন রূপ? অপেক্ষা করছে তো! মিষ্টি হাসি দিচ্ছে তিতলি।
বিরূপাক্ষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখে যা বোঝার বুঝে নেয়।
এইতো যাই।নিচে চল তুইও।
কি হৃদয় শীতল করা বাতাস এখানে দেখেছিস রূপ?মনেই নেই এত রাত হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা চল চল।
মুখ লুকিয়ে পা বাড়ায় তিতলি।পেছনে বিরূপাক্ষ ডাকে,,
তিতলি???
হ্যা বল না? দাঁড়িয়ে পরেছে তিতলি।
বিয়েটা নিয়ে সুখী আছিস তো দোস্ত?
বুক ভেঙে আসে তিতলির।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,,ওকে দেখেছিস তুই? খুব ভালো ছেলেরে!স্বামী হিসেবেও খুব ভালো হবে আমার বিশ্বাস।আমি সুখী হবো দেখিস। শুধু সময়কে একটু সময় দিতে হবে নিজেকে ওর জন্য গড়ে তুলে নিতে।
ক্ষমা করেছিস তো আমাকে?
তুই তো কোনো দোষ করিসনি।আর আমিও কোনো পাপ করিনি। একনিষ্ঠ ভাবে চেয়ছিলাম তোকে। কিন্তু তুই তো আমার ভাগ্যেই নেই।রিতি তোকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালো বাসে। তুইও তাই।
তুই,তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো আর সারাজীবন অবাধে, নির্বিবাদে তোকে ভালোবাসবো রে।প্রকাশ্যে আনবো না কখনো। তাহলে স্বামীকে ঠকানো হবে।ওর মতো ভালো মানুষ টাকে আমি ঠকাতে পারবো না। কিন্তু তোকেও মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।সামলে নিয়েছি অনেক টাই আরো নেবো।
*******
এতক্ষণ ভালোই ছিলো রিতি। এখন কেমন জানি ভেতরটা কাঁপছে তার।জয়া সবকটি কে একপ্রকার টেনে তবে বের করেছে ঘর থেকে।চেনা ঘর,চেনা বর কিন্তু কিছুতেই যেন ভয় কমছে না তার। বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে সারা ঘরময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বড়ো সাইজের বিভিন্ন রঙের মোমবাতি। মোমবাতির রঙ বেরঙের মোলায়েম আলোর রশ্মি ফুলের উপর পরে এক মোহময় পরিবেশ এর সৃষ্টি হয়েছে।পরনে নীল বেনারসী, মাথায় ওড়নার লম্বা ঘোমটা,হাতে কানে গলায় কেয়েক ভরি স্বর্ণালঙ্কার,সাথে অজানা ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।খুট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে চমকে তাকালো রিতি।দরজা বন্ধ করছে। ঘোমটার নিচে থেকে একপলক দেখলো রিতি। মুহুর্তেই ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো মনটা।এত এত দামী ধুতি পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে বিরূপাক্ষ রিতির দেওয়া সেই পাঞ্জাবি টাই পরেছে।
সামনে হেঁটে গিয়ে খুলে দিল দক্ষিণের জানালা।বাহিরে পুর্নিমার পূর্ন শশী।সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল নবদম্পতির বিশেষ রাত্রি যাপন এর জন্য বিশেষ কক্ষটি।
কত ভাবনা যে ভাবছে রিতি তার ঠিক নেই।মনে পরে যায় কয়েক বছর আগেও এমন একটি রাতে এমনি পূর্ণিমা চাঁদ ছিলো।সেই চাঁদ,সেই কক্ষ এবং সেই মানুষ দুজন ও একই আছে কিন্তু তখনকার সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে কত তফাৎ।সেই রাতের কথা মনে পরলে অপমানে যন্ত্রনায় আজো রিতির বুকে কাঁটা ফোঁটে। কিন্তু সে কাঁটার আঘাতের যন্ত্রণা আজ কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে।
এত লজ্জা কোথা থেকে আসলো তোর? একেবারে একহাত ঘোমটা তাও আমার সামনে?
রিতি বাস্তবে ফিরলো।সত্যিইতো রূপদার সামনে এত লজ্জা কেন পাচ্ছে সে?
ঘোমটা খুলে উঠে দাঁড়াতো রিতি।দেখি তোকে কেমন লাগছে?
অভিমান হয় রিতির,,নিজ হাতে ঘোমটাটা খুললে কি এমন অশুদ্ধি হতো?
নিজের হাতেই ঘোমটা উঠিয়ে দেয় মাথার উপর।
একহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিরূপাক্ষ যেন আচ্ছন্ন হয়ে পরে পলকেই। মোমবাতির হালকা লালচে আলো পরেছে রিতির মুখে।
নিষ্পলক তাকিয়ে আছে বিরূপাক্ষ।এমন রূপ সে এর আগে কখনো দেখেনি।
টুপ করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে রিতি।বিরূপাক্ষের ঘোর কাটে তাতে। দুহাত বাড়িয়ে উঠিয়ে দাঁড় করায় রিতিকে,,নত মুখে দাঁড়িয়ে আছে রিতি। লজ্জায় তাকাতে পারছে না সে।এত লজ্জা কোথা থেকে আসলো তার নিজেই ভেবে পাচ্ছে না। তবুও একটা কথা তার মনের ভেতর খুব খুচছে।আজ জিজ্ঞেস করবেই রূপদাকে।সেই ঘটনার পর থেকে রূপদা একবারও বনলতার নামটি মুখে নেয়নি সেটাই যেন বড়ো শোক রিতির। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা রিতি।তার রূপ দা কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখবে না এমনটা মেনে নিতে কষ্ট হবে তার।রূপদা দায়িত্ব এড়াতে পারে না।তেমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন ছেলে নিশ্চয় নয়?রিতির
নিজের মনের প্রশ্ন এগুলো।
একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো তোমাকে।আমতা আমতা করে বললো রিতি।
করতেই হবে? এখন? আচ্ছা করিস।আগে এই ভারী অলঙ্কার গুলো খুলে নে তো। একফোঁটা মেয়ে, তার এত গহনা পরার শখ কেন?
রিতির অভিমান ভারী হয়।রূপদা কি তাকে অপমান করছে? কিন্তু কথার ধরনে তো তা মনে হচ্ছে না।
আগে আমার প্রশ্নের উত্তর তারপর গহনা খুলবো।
ওকে!বসে কথা বলি? ঠোঁটের কোনে ফিচেল হাসি ফুটে উঠল বিরূপাক্ষের।রিতি বসতেই গা ঘেঁষে বসলো বিরূপাক্ষ। আবার সেই কাঁপাকাপি অনুভূতিটা ফিরে আসছে।
বল বল?
আগ্রহ নিয়ে তাকায় বিরূপাক্ষ।
বনলতা কোথায়?তার কথা তোমার মুখে একবারো শুনি না কেন? ছেড়ে দিয়েছো ওকে? কোথায় আছে জানো তুমি?কথা হয় তার সাথে?
এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন গুলো করে রিতি।বিরূপাক্ষের ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই পাশের টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয়,,
নে গলাটা ভিজিয়ে নে।রিতি কয়েক ঢোক জল গিলে নিয়ে,, মরিয়া হয়ে ওঠে,,
বলো?
বিরূপাক্ষ জলসহ গ্লাসটা রিতির হাত থেকে নিয়ে বাকী জলটুকু নিজের গলাধঃকরণ করে।
ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিতি,,
মানুষটার কি ঘেন্নাপিত্তি নেই নাকি? বৌয়ের এঁটো খেতে হবে?
বলে মনে মনে।
বনলতা আছে তার যোগ্য স্থানেই।একদম আমার বুকের মধ্যে, বুকের বাহিরে।আর মনের মধ্যে যাকে ভালোবাসা দিয়ে পুষে রাখছি তার নাম মুখে না নিলেই বা কি?ছাড়ার কথা বলছিস? আগামী সাত কেন চৌদ্দ জন্মেও ওকে ছাড়তে পারবো না রে রিতি।আর কথা তো হয়েই থাকে।ওর সাথে কথা না হলে আমি বেঁচে থাকি বল?
রিতির কান্না পাচ্ছে খুব। এতদিন মিথ্যা ভেবেছে সে?রূপদা শুধু দায়িত্ব পালন করছে?রিতিকে ভালোবাসে না?
কিন্তু ওতো মানবে না এগুলো? বুকের মধ্যে একজনকে লালন করে বুকের উপর আরেকজনকে শোয়াবে তা হবে না।
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে রিতির। এতকিছুর পরেও সে বেঁচে আছে কোন আশায়।চরম অসুস্থতায় রূপদার সেই ব্যাকুল চাহুনি কি তবে মিথ্যে ছিল? ঘুমের ভান করে যখন বেডে পরে থাকতো রূপদা গিয়ে শত শত চুম্বন করে নিজের চোখের জলে রিতির মুখ সিক্ত করতো সেটা কি তবে ফেক ছিলো?
নাহ আর ভাবতে পারছে না রিতি। বিরূপাক্ষ রিতির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নীরবে বসে থাকে কিছুক্ষণ।রিতি বসে আছে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে। অনুভূতি গুলো ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পরছে।
এভাবে কান্নাকাটি করলে বাবা মা আমাকে খারাপ ভাববে।অশান্তি হবে।তুই শুনতে চাইলি বলেই বললাম।না হলে বলতাম না।ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পর আমি বাইরে যাচ্ছি।
রিতি যেন বুঝতে পারে না কথা গুলো।সে কি দুঃস্বপ্ন দেখছে?
না না অতটাও বেঘোরে ঘুমায় না ও।তাহলে?? আবারো ঠকেছে?রূপদা তাকে আবার ঠকিয়েছে?
বিরূপাক্ষ ধীরপায়ে বেড়িয়ে যায় ঘড় থেকে।
রিতি বসে থাকে পাথরের মতো।একটানে খুলে ফেলে মাথার ওড়না। ছিঁড়ে ফেলে গলায় পরিহিত হার।দশ মিনিট অতিক্রম হয়নি,, বিছানায় ফোনে রিং বাজছে।রিতি তাকায় সেদিকে।একটা ছোট্ট বাটন ফোন।কার ফোন বুঝতে পারে না।স্কিনের উপর ভাসছে”রূপ কুমার”এক চিলতে রক্ত ছলকে উঠে রিতির ফ্যাকাসে মুখটাকে রক্তিম করে দেয়।নামটা সে চেনে।এমন ইমুজি,স্টিকার দিয়ে সাজানো নামটা।
রিসিভ করে কানের কাছে ধরে কাঁপা হাতে।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে মোলায়েম কন্ঠ,,
বনলতা,,,,,
********
আরো অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় আধঘন্টা।রিতি শুয়ে আছে নরম ফোমের উপর। পিঠের তলায় আরো কিছু একটা আছে যেটা বুঝতে পারছে না।চোখ দুটো পিট পিট করে তাকায়।উপরে রূপোর থালার মতো চাঁদটা।আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।বুঝতে পারে না কোথায় আছে। শুধু মনে পরলো ফোনের ওপাশে বনলতা নামটা শুনে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠেছিলো।
পাশে বিরূপাক্ষ ঝুঁকে বসে আছে। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে বুঝলো রিতি,রূপদা হাসছে।
ঘুম ভাঙলো?উঠে বসো। তোমার ফুলশয্যার উপহার নাও।
রিতি গোলক ধাঁধায় আঁটকে থেকে উঠার চেষ্টা করতেই পেছনে হাত দিয়ে উঠিয়ে বসায় বিরূপাক্ষ।তারা এখন চিলেকোঠার ছাদে আছে।জ্যোছনার আলোয় সবকিছুই স্পষ্ট।হার ছিঁড়েছো ভালো কথা,,কাল কিন্তু ঠিক করে এনে দিতে বলবে না।
রিতির মুখে কথা নেই।
স্বপ্ন দেখছে আবার?হাতে চিমটি কাটতেই ভাবনাটা ভুল প্রমাণিত হয়।যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে সে স্থানে।
হাতটা দাও দেখি,,
নিজের গরজে রিতির ডান হাতটা টেনে নিয়ে অনামিকায় জ্বলতে থাকা আশির্বাদ এর হিরের আংটি খুলে সেখানে অন্য আরেকটি আংটি গলিয়ে দেয় বিরূপাক্ষ।রিতি অভিভূতের মতো চেয়ে আছে বিরূপাক্ষের মুখ পানে। অনামিকায় আংটির দিকে চোখ পরতেই বুকটা ধড়ফড় করে উঠে। চেনা আংটি কিন্তু আঙুলে লাগলো কি করে? একটুও ঢিলে হয়নি তো?কত কথাই গলায় এসে আঁটকে আছে কিন্তু কিছুই বলার ক্ষমতা নেই তার।
একই রকম দেখতে একটা আংটি তোমাকে দিলাম।এবার আমার টা ফেরত দাও তো দেখি।ওটা তো পরতেই পারবে না কখনো।দিয়ে দাও।
******
বোঝাপড়া শেষ হয়েছে দুজনের,,রাত যখন শেষ ভাগে, চন্দ্র দেব পশ্চিমে হেলে পরেছে তখনি রিতিকে নিয়ে চিলেকোঠার ছাদ থেকে নেমে আসে বিরূপাক্ষ ফুলে ফুলে সজ্জিত বাসর ঘরে।
সে দুর্ঘটনার রাতে,,
রিতিকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরাতে কেউ লক্ষ্যই করেনি তাদের পায়ের তলে পিষ্ট হয়েছে কারো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রহস্যের চাবিকাঠি।
রিতির হাতের মুঠোফোনটা কয়েক টুকরো হয়ে মিশেছিল ধুলোর মধ্যে। ইনভেস্টিগেশন অফিসার সেটা পেয়েছিলো পরের দিন সকালে।ভাগ্যক্রমে সিমটা ছিল অক্ষত।আর সেই অক্ষত সিমকার্ড থেকেই মিললো বিরূপাক্ষের সকল প্রশ্নের উত্তর যেটা আজ রিতিকে বললো।
রিতি অবাকের চরম সীমায় বসে শুধু একটা কথাই ভাবলো,, এতদিন আমাকে বুঝতেও দেয়নি?
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিতি।
পেছন থেকে জড়িয়ে আছে বিরূপাক্ষ।আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়ায় রিতির উন্মুক্ত কাঁধে। মেরুদণ্ড বেয়ে এক শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পরে সমগ্র দেহে।রিতির ভয় লাগে, লজ্জা পায়। ভালো লাগা তো আছেই,, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন যে জানতে বাকি!
ঘোর লাগা চোখে আয়নার রিতিকে দেখতে পায় বিরূপাক্ষ। নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে,গালে, ঠোঁট ছোঁয়ায়। ওষ্ঠদ্বয় এর সাথে যখন নিজের ওষ্ঠদ্বয় মেলাতে যাবে তখনি বাঁধ সাধলো রিতি,,
রূপ দা,,,,,
চরম বিরক্তি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে বিরূপাক্ষ,,
দিলি তো আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে?দাদা ডাকার আয় টাইম পাসনি?একটু তো ভাববি আমার কথা? কত্ত আদরের বোন তুই আমা,,,,,
মুখের কথা আর বেরোয় না।রিতি হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে।
নিজের এতাল বেতাল বাক্য প্রয়োগের জন্য রাগে দুঃখে বিরক্তিতে পালঙ্কে বসে পরে বিরূপাক্ষ।রিতি তখনো হাসছে মুখ টিপে। বিরূপাক্ষ ও ধীরে ধীরে ঠোঁট প্রসারিত করে বললো, ভালোই তো তোর কৃপায় নিজের সন্তানের মুখে মামা ডাক শুনবো নাহয়।রিতিকে নিজের দিকে টেনে নেয় বিরূপাক্ষ।
রাত বেড়ে চলেছে মধুময় সে রাত। ভালোবাসা তো এমনই। অনেক সময়,সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটিকে তার প্রাপ্যটুকু দিতে পারে না কিন্তু দিতেই যে হবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।বেডের লাগোয়া বড়ো জানালাটা খুলে দিয়েছে বিরূপাক্ষ।ভরা চাঁদের ভরা জ্যোছনার আলোতে প্লাবিত হয়েছে দুজনের দেহ মন।ফুলের পাপড়ি ছড়ানো বিছানায় চাঁদের আলোয় মাখামাখি ।জানালা দিয়ে চাঁদের আলোর সঙ্গে দখিনা বাতাস প্রবেশ করছে অবাধে।সে আলোয় দেখছে দুজন দুজনকে।অবাধে চলছে একের মনে অন্যের বিচরণ। রেকোর্ডারে তখনো মৃদু ভলিউমে গান বেজে চলেছে,,,
আমার হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,
দেখতে আমি পাইনি তোমায়,,
দেখতে আমি পাইনি,,,,,,
বাহির পানে চোখ মেলেছি,,
আমার হৃদয় পানে চাইনি,,,,,
** ****সমাপ্ত********
প্রিয় পাঠক পাঠিকাবৃন্দ,
শেষ হলো রিতি বিরূপাক্ষের বিচ্ছিন্ন জীবন। এবার থেকে তারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাটাবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।হাসি, আনন্দ, দুঃখ বেদনা হয়তো থাকবে। কিন্তু সেটা ক্ষনিকের জন্য।
দেরীতে পর্ব গুলো দেওয়ার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আসলে উৎসাহের অভাব হলে অনেক কিছুই মন থেকে আসতে চায় না।দুটো গল্প শেষ করলাম অথচ পড়ুয়া এত কম?আমি হয়তো ভালো লিখতে পারিনি তাই এমন অবস্থা। যাইহোক যারা আমার লেখাটা অপেক্ষা করে ধৈর্য সহকারে পড়েছেন, আমার সাথে থেকেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।লেখাটা কেমন হলো। ভালো লাগলো নাকি খারাপ সেটা নিসংকোচে জানিয়ে যাবেন। তাহলে আমার ভালো লাগবে।
ভালো থাকবেন সবাই।