উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে:চন্দ্রা।
পর্ব:৪
মথুরাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রাত্যাহিক প্রার্থনা শেষে শিক্ষার্থীরা শ্রেনীকক্ষে প্রবেশ করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেজিষ্ট্রার খাতাটা হাতে নিয়ে সকল শিক্ষক/ শিক্ষিকা যার যার ক্লাশরুমে ঢুকলেন।পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষিকা রেজিস্ট্রার খুলতে খুলতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় পুরো চার দেয়ালে মাঝে থাকা সবার উপর। এখানে নিয়মনুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আগে থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কে কোথায় বসবে। কিন্তু ফাস্ট বেঞ্চের খালি জায়গায় চোখ যেতেই স্থির দৃষ্টিতে অন্য একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন ম্যাডাম,ফাতেমা স্ট্যান্ড আপ,,
জি দিদিমনি,, দাঁড়িয়ে বললো মেয়েটি।
রাবেয়া অনুপস্থিত ক্যানো?কোমল কন্ঠে প্রশ্ন করেন ম্যাডাম।
দিদিমণি,,ওর মায় আর বাপ,,,
কথাটা শেষ করে পারেনা ফাতেমা, ম্যাডাম থামিয়ে দিয়ে বলল,ভাষা শুদ্ধ করে কথা বলো ফাতেমা,,
দিদিমনি, ওর মা,বাবা আজ আবার ঝগড়া করছে।আর ওর মাকে অনেক মারেছে।তাই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। রাবেয়াকেও নিয়ে গেছে সাথে।আর নাকি আসবে না। আমেনা দাদী বললো।
দিদিমণির ভেতরে রাগে উষ্ণতা বাড়ে। বাচ্চাদের পড়তে বলে আনমনে ভাবে,এই ভাবে স্কুল কামাই করলে মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট হবে।কয়েক মাস পরে সমাপনী পরীক্ষা। টিচার্সদের কত আশা রাবেয়াকে নিয়ে। এবারের বৃত্তিটা হয়তো সেই পাবে।সম্মিলিত মেধা তালিকায় রাবেয়া নামটা সবার অগ্রভাবে। প্রচন্ড মেধাবী একটা মেয়ে মা, বাবার ঝগড়া ঝাটিতে দিনে দিনে উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।না না আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।এভাবে একটা মেয়ের শুরু থেকে অগোছালো হতে দেবেনা সে।ভাবতে ভাবতে উঠৈ দাঁড়ান দিদিমনি।সবার থেকে পড়া নিয়ে নতুন পড়া দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ক্লাস থেকে।পেছন থেকে মনিকা ম্যাডামের ডাক কানে আসে,
এই রিতি দাঁড়া না।
ঘুড়ে দাঁড়ায় ত্ররিতি নামের দিদিমনি টা।
কি ব্যাপার?দাদু ক্যমন আছে তোর?হেসে প্রশ্ন করেন মনিকা ম্যাডাম।
এইতো দিদিমনি, এখন সুস্থ আছেন দাদু।ডক্টর বলেছেন আপাতত চিন্তার কোন কারন নেই।
কোন বিষয়ে কি আপসেট আছিস?বলেন মনিকা।
হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়ার ব্যপারটা খুলে বলে মনিকাকে।মনিকা দিদিমনি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন ঘটনাটা শুনেই।
টিচার্স রুমে প্রবেশ করতেই খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকান হেডস্যার অবিনাশ মুখার্জি। ধীরে ধীরে শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য নির্ধারিত সব আসন গুলো যখন ভরে ওঠে তখন মনিকা ম্যাডাম ই কথাটা তোলেন।এই স্কুল কলেজের সুনাম অনেক।তেমন কোনো খারাপ কিছু শোনা যায়নি কখনো।স্যার, ম্যাডামরা খুবই ভালো।এখানে বেত যে চালায় সে থাকতে পারেনা আবার যার জন্য বেত চালানো হয় তাকেও খেসারত দিতে হয়। রাবেয়া মেয়টা এরকম সমস্যায় বহুবার পরেছে। কিন্তু মেয়েটার ট্যালেন্ট দেখে অবাক হন সবাই । কতটুকুই বা পড়ার সময় পায় মেয়েটা?
তারউপর মা, বাবার ঝগড়ার মাঝে পরে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে মেয়েটা।এর একটা বিধি ব্যবস্থা করতেই হবে বলেন সেকেন্ড স্যার। অবশেষে সবার মতামতের উপর ভিত্তি করে টিফিন পিরিয়ডে রিতি এবং মনিকা বেরিয়ে পরে রাবেয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।হেডস্যার খুব আত্মবিশ্বাস এর সাথে বলেছেন,আমরা সবাই মিলে গেলে যতটুকু কাজ হবে রিতি একা গেলে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ হবে।আর যদি না হয় তাহলে আমাকে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সঙ্গে কথা বলতে হবে।
রিতি একবছর হলো সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে এই স্কুলে।প্রায় কজন স্যার,ম্যাডাম তার শিক্ষাগুরু হওয়ার সুবাদে স্নেহের অভাব হয়না। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় স্কুল ক্যানো পুরো গ্রামেই একটা সুনাম বহাল আছে অনেক আগে থেকেই। হাইস্কুল থেকে যখন বিজ্ঞান বিভাগে এস,এস,সি পাশ করে রিতি তখন তার রেজাল্ট ছিলো তাক লাগানোর মতো।বহু বছর আগেও একজন এমন রেজাল্ট করেছিলেন। তিনি ছিলেন রিতির বাবা।আর বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা।
মথুরাপুর গ্রামের দক্ষিণের শেষ সীমানায় যে খালটা নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে তার ঐ পাড়েই মোল্লার ডাঙ্গা গ্রাম। সেখানে শতভাগই মুসলমান।রাবেয়া মেয়েটির বাড়ি এই গ্রামের মধ্যভাগে।
বছর খানেক আগেও মোল্লার ডাঙ্গায় লোকে লোকারণ্য ছিলো, কিন্তু গেলো বছর কুরবানীর ঈদের পরের দিন ভীষণ রকমে কাইজ্জা(মারামারি) শুরু হয় দুই দলে। ঈদের ছুটিতে যারা বিভিন্ন কর্মস্থল থেকে ছুটি কাটাতে এসেছিলো তারাও মত্ত হয়ে নিজের দলের মারামারিতে লিপ্ত হয়। দুই দলের দুই জন নিহত হয়ছিলো সেই মারামারিতে।ঘড় দুয়ার হয়েছিলো ছিন্ন ভিন্ন ।আট বছরের শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধ অক্ষম ব্যক্তিটিও বাদ পরেনি মার্ডার কেসের আসামী হতে।পলাতক যারা ছিলো বেশ কয়েকজন ফিরেছে কিন্তু অনেকে আবার ফেরেও নি।গ্রামটা এখন যুবক শূন্য বলা যায়। কিন্তু একটা অবাক করা বিষয় হলো এত রক্তারক্তির সূচনা হয়েছিলো সামান্য একটা চার বাচ্চা ওয়ালা মা মুরগীকে নিয়ে। মানুষ কি না পারে?
নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে মোল্লার ডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করলো দুজন। এখানকার বেশ কয়েকজন মহিলাকে চেনে রিতি। চন্ডীনগর গ্রামে যে বুটিকের কারখানাটা আছে সেখানে কাজ করে তারা।চেনা একজন মহিলাকে নিয়ে রাবেয়া র বাড়ির ভেতরে যায় । কপাল ভালো রাবেয়ার বাবা সবে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে বেরোচ্ছিলেন।
প্রায় দশ মিনিট ধরে দুই শিক্ষিকা এবং রাবেয়ার বাবার কথা কাটাকাটি চললো।
ধৈর্য হারা হয়ে রিতি শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে,
মান্নান ভাই আপনার ফালতু বকবক অনেকক্ষণ ধরে হজম করছি আর না।আগামী কাল যদি রাবেয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত না থাকে তাহলে প্রভাকর চৌধুরীর লোক আসবে আপনার কাছে।আর নিয়মিত বউ পেটানোর দায়ে একটা মামলা দায়ের করতে আমাকে দূরে যেতে হবেনা।একটা ফোন করলে থানার ওসি সাহেব নিজে এসে পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন।মনিকা দিদিমনি চলুন বেলা যে গেলো। মান্নান ভাইকে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে দিন।আর ভাই আপনার সময় কিন্তু কাল সকাল পর্যন্ত।
ক্রুর হাসি ফুটে উঠল রিতির মুখে।মনিকা ম্যাডাম মজা পায় ব্যাপারটায়।
পূনরায় সাঁকো পেরিয়ে যখন গ্রামের মধ্যে হাঁটছে ,মনিকা ম্যাডাম কৌতুহল নিয়ে বললো,রিতি তুই কি সত্যিই পুলিশ ডাকবি নাকি?
ধুর,,,,আপনি ও যা বলেন।ভয় দেখাতেই চোখেমুখে র অবস্থা দেখলেন? এতক্ষণে হয়তো শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।হাসছে রিতি।
তারমানে শুধু শুধু ভয় দেখালি লোকটাকে?ওর যা ব্যবহার পুলিশে দেওয়াই উচিত।
কি করবো বলুন ম্যাডাম?সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুটা একটু বাঁকাতে ক্ষতি কি?
তাছাড়া ও চৌধুরী দের খামার বাড়িতে কাজ করে।ওর এসব শুনলে কাজটা থাকবেনা ভালো করেই জানে।
আশ্বিন মাসের শেষ ভাগ প্রায়। দিনের সূর্যের তেজ পরন্ত বিকেল যেন স্তিমিত হয়ে গেলো। দুই পাশে অবারিত সবুজ ধান ক্ষেতে ঢেউ খেলানো মাতাল হাওয়া, মাঝখানে পাহাড় সমান উঁচু পিচঢালা মসৃন রাস্তা ।এই বিকেলে এমন পরিবেশে হাঁটলে দিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমেষেই উধাও হয়ে যায়।
মাঝখানে কেটে গিয়েছে সাতটি বছর। গ্রামের উন্নয়ন আকাশ ছোঁয়া।সবখানে বৈদ্যুতিক লাইনের তার,খুটি।নদী পারাপারের জন্য এখনো আর নৌকার আশায় বসে থাকতে হয়না।বৃহদায়তন চর জেগে নদীর মৃত দশা প্রায়।সাঁকোই এখন পারাপারের মাধ্যম।রিতিও এখন আর পনেরো বছরের ঘাড় অব্দি চুলের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া কিশোরী নয়। বর্ষাকালের ভরা পূর্ণ যৌবনা নদীর মতো বাইশ বছর বয়সের পূর্ণ যুবতী সে।ভেজা চুল গুলো আঁচড়ে যখন পিঠময় ছড়িয়ে দেয় তখন পেছনে হাঁটুর উপর পর্যন্ত দীঘল কালো চুলের মেঘের ঢল নামে। কাঁচা সোনা গায়ের রঙয়ে একটু টোকা দিলেই রক্ত জমাট বাঁধা দেখা যায়।সে এখন অনেককিছুই বোঝে অনেক দায়িত্ব তার কাঁধে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা দিদিমনি বলতে অজ্ঞান। সবকিছুতেই রিতি। এত পূর্ণতার মাঝেও সে একা, অনুভূতি শূন্য।যতক্ষন ব্যস্ত সময় কাটায় ততক্ষন ভালো থাকে। কিন্তু এখনো কোন কোন রাতে রিতির ঘড় থেকে শোনা যায় বিরহের এক বেদনাদায়ক করুন সুর মূর্ছনা।বিবাহ নামক বন্ধন তাকে লোহার উত্তপ্ত শেকলে বন্দী করে প্রতিনিয়ত যন্ত্রনা দেয়। কোন কিছুর বিনিময়ে ভুলতে পারে না জীবনের সেই চরম প্রত্যাখ্যাত অধ্যায়টি।
রিতি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে বাড়িতে যখন পা দিয়েছে তখন সূর্য মামার আলো টুকু পৃথিবী থেকে একেবারে মিলিয়ে যায়নি। নিজের ঘড়ে কাঁধের ব্যাগটা রেখে কলপাড়ে হাতমুখ ধোয়।সুমিতা দেবী সন্ধ্যার যোগাড় করছেন।কাপড় পাল্টে ঠাকুর ঘরে প্রণাম শেষে দাদুর ঘড়ে যায় ধুনোচি হাতে।দাদুকে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজেই পাশে বসে।
দাদু,শরীর কি খারাপ লাগছে?এই ভর সন্ধ্যায় কেউ শুয়ে থাকে?
শশীশেখর হালদার রিতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,না দিদিভাই আমি ঠিক আছি।তোর মুখটা শুকনো লাগছে ক্যানো?কিছু খেয়েছিস?
না দাদু।ফিরতে দেরী হলো । একবারে রাতে খাবো। তুমি বারান্দায় বসো এসো।
রিতি দাদুর হাত ধরে নিয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে আরাম করে বসিয়ে দেয়।শশীশেখর বলেন,দিদি ভাই আগে খেয়ে দেয়ে ঠান্ডা হও।তারপর কথা আছে।
হ্যা না কিছুই না বলে নিজের রুমে ঢুকে ফ্যানটা ছেড়ে বসে স্বস্তির নিশ্বাস নেয় সে।দাদুকে এযাত্রায় তবে ধরে রাখতে সক্ষম হলো।কি বিপদটাই না গেলো।এখনো মনে পরলে উৎকন্ঠায় দম বন্ধ হয়ে আসে রিতির।একটা ছোট খাটো হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল শশীশেখর বাবুর। কদিন যমে মানুষে টানাটানির পরে তিনি সুস্থ হলেন।দাদু মুখে কিছু না বললেও রিতি জানে তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছেন।এক ছেলের জন্ম দিয়ে স্ত্রী গত হলেন। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনে আর সংসার বাঁধলেন না।ছেলে বাবার কষ্টের প্রতিদান ও দিয়েছিলো। শিক্ষা দীক্ষায় হয়ে উঠেছিলো অনন্য অসাধারণ।তাইতো সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার পদে চাকুরী পেয়েও সেটা নাকোচ করে ফিরে এসেছিলেন গ্রামে , শুধুমাত্র বৃদ্ধ বাবার একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য।অজো পাড়াগাঁয়ের এক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকুরী নেন। কিন্তু কি হতে কি হয়ে গেলো।অকালে অবেলায় নিভে গেলো শশীশেখর বাবুর আশার প্রদীপ খানি ।কি একটা কাজে জেলা শহরে যাওয়ার পথে ছেলে, বৌমা বাস দুর্ঘটনায় নিহত হয়ছিলো।রেখে গেলেন একমাত্র সলতে ত্ররিতিকে।নাতনীকে বুকে নিয়ে ছেলে-বৌমার কষ্ট লাঘব না হলেও ছাই চাপা ছিলো এতকাল। কিন্তু সেই নাতনীর জীবনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শশীশেখরের ভেতরের দুঃখ কষ্টের ভারটা যেনো দ্বিগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
রিতি ধীরে ধীরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।দাদু কি জরুরী কথা বলবে সেটা জানে রিতি।আর এটাও জানে, এই মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্তকে মাটি চাপা দিয়ে দাদুর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতে হবে তার।
সারাদিনে কাজের কিছুই হয়নি কিন্তু ধকল গিয়েছে অনেক।পিসি ঘড়ে ঢুকে ডাক দেয়।
একি মনি (আদর করে ডাকে)শুইয়া পরলি যে?আগে খায়া নে।রিতির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন সুমিতা দেবী।
রিতি পিসির হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে তাঁর উরুতে মাথা উঠিয়ে দেয়,
খেতে ইচ্ছে করছে না পিসি।বেশী ক্ষুধা লেগেছিলো তো ।তাই এখন নেই।
এমন কইতে নাই মা।চলো আমি খাওয়ায় দিবো। মাথায় বিলি কেটে বলেন সুমিতা দেবী।
আর একটু শুয়ে থাকি পিসি।তারপর যাবো। অনেকটা পথ হেঁটেছি আজ,, পায়ে ব্যাথা করছে।
একটা কথা কই(বলি)মা?
পিসি তুমি আবার কবে থেকে আমার সাথে কথা বলার পারমিশন নিতে শুরু করলে?
কই কি তেনারা তো মানুষ খারাপ না।এত কইরা তোমারে চায়।একটু কি মনটা নরম করবার পারো না?
তেনারা যে কারা সেটা রিতি ভালোই বুঝতে পারে।উঠে বসে পরে। কিন্তু চেহারায় কোনো পরিবর্তন এলো না।শুধু শান্ত স্বরে বলল,
পিসি কোনো মেয়েই স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে বাবার বাড়িতে পরে থাকতে চায়না।শত অবহেলা সয়ে স্বামীর পা ধরে শশুড়ের ভিটে কামড়ে পরে থাকে। কিন্তু আমার তো স্বামীর পা দুখানি ছুঁয়ে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি। তাহলে কি করা উচিৎ আমার?
সুমিতা দেবী নিজের কথার জন্য নিজেই অনুতপ্ত হলো। খামোখা মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে বসলো।
মাগো আমার কথায় কষ্ট পাইও না। অনুশোচনা ঝরে পরছে সুমিতা দেবীর গলায়।
না না পিসি আমি যে কষ্ট পেতে জানিনা সেটা তোমার চেয়ে কেউ ভালো বোঝে বলো?তবে এবার একটা বোঝাপড়া করতেই হবে। আমার নিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎকে বাঁধা মুক্ত করবো এবার । চলো তো এবার কিন্তু ক্ষুধা পেয়েছে খুব।
****
ভাই আর কতদিন এইভাবে পরবাসে কাটাবে? এবার তো ঘড়ে এসো।মামিমা,মামা বাবু কেউই ভালো নেই।
হ্যা বৌদি।মান অভিমানের পালা অনেক তো হলো। এবার ফেরার পালা।
ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
বৌদি তোমার যে কটা ইচ্ছে জিজ্ঞেস করো।এত সংকোচ ক্যানো করো?
মেয়েটার কথা কি কখনো মনে পরে না তোমার?সে যে এখনো তোমার পথ চেয়ে আছে।
এতক্ষণে বিরূপাক্ষের স্বাভাবিক স্বরে পরিবর্তন টের পায় জয়া।
বৌদি আমি তাকে মুক্তি দিয়ে এসেছিলাম,পথ চেয়ে বসে থাকতে বলিনি। যাইহোক,আর যাতে পথ চাইতে না হয় এসে সেই ব্যবস্থটাই করবো।
এভাবে কিছুক্ষণ ফোনালাপ শেষে নিজের ঘড় থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘড়ে ঢোকে জয়া।এবার এসে কি ব্যবস্থা করবে সেটাই মাথায় গেঁথে গিয়েছে তার। নিঃস্বার্থ মঙ্গলকামনা কারী বা শুভাকাঙ্ক্ষী বলে যদি সত্যিই কেউ থাকে তবে জয়া তার প্রকৃত উদাহরণ।কায়মনে প্রার্থনা তার একটাই এ বাড়ির হারানো সুখ শান্তি ফিরে আসুক।ছেলে মেয়ে দুটোর মাঝের দূরত্বের অবসান হোক।
সেই সাত বছর আগে রূপ ফ্রান্সে পাড়ি জমিয়েছিলো আর ফিরে আসেনি।রিতির খবর সে কখনোই রাখেনি।রিতি এখন কোথায় কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে আছে সেটাও বোধহয় জানেনা রূপ।বাবার সাথে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বার বার। শুধু মাত্র দাদা আর বৌদি ব্যতিত এবাড়ির কারো সাথে তার কথা হয়না।মা কথা বলেছিলেন কয়েকবার ।তবে গ্রামের একজনের সাথে তার সম্পর্কটা আগের মতোই রয়েছে সে হলো প্রাণের বন্ধু প্রদীপ। তিন বছর পড়ার পেছনে ব্যায় করলেও বাকী চার বছরে প্রচুর অর্থ এবং অভিজ্ঞতা সে কামিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে সেই একাকী নিঃসঙ্গতা জাপটে ধরেছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। এবার দেশে ফিরেই তাকে খুঁজে বের করবে রূপ, যার জন্য জীবনের রঙীন বসন্ত গুলো আজো নিষ্কলুষ সাদাটে করে রেখেছে শুধু মাত্র সেই একজনের আলতারঙা পদস্পর্শে রাঙিয়ে দেবে বলে।
মধ্য রাতের রূপোর থালার মতো চাঁদটা ঠিক মাথার উপর অবস্থান করছে।এই যে পূর্ণ চাঁদের উচ্ছল জ্যোছনা রিতির বিরহকে বাড়িয়ে দেয় শতগুণে।আকাশ ভরা চাঁদ তারার মিলন নিজের ব্যর্থতাকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। কাঠের উন্মুক্ত জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিতি। নারকেল সুপারি গাছের পাতার ফাঁক ফোকর গলে যতটুকু আলো আসছে তাতেই চোখ জালা করে উঠছে তার ।সেটা কি নির্ঘুম রাত্রি জাগরণের ফলে নাকি অন্য কোন কারনে?জানেনা রিতি। দাদুর সাথে সন্ধ্যাবেলার সেই জরুরী কথাগুলো হয়ে গিয়েছে। বিরূপাক্ষ দেশে আসছে আর চার দিন বাদে।সামনে দূর্গা পূজা।এত বড়ো গ্রামে একমাত্র পূজা মন্দির সেটা ও চৌধুরী বাড়িতে। মানুষের ঢল নামবে পূজোর কদিন।রিতি এই সাত বছরে মাত্র সাতবার গিয়েছে ওবাড়িতে।বিজয়া দশমীতে গিয়ে প্রণাম করে এসেছে সবাইকে।শত অনুরোধ করেও ওবাড়িতে রাখা যায়নি তাকে। দাদুর একান্ত ইচ্ছা এই পূজোর দিনগুলো রিতি কাটাক ওবাড়িতে।
রিতি জানে দাদু চায় রূপের সাথে তার আধা আধুরা সম্পর্কটা পরিপূর্ণতা পাক। যে সম্পর্ক শুরুই হয়নি সেটা পরিপূর্ণ হবে কিভাবে?
আচ্ছা দাদুর কি আজকাল আমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় বুদ্ধিটা কমে গিয়েছে?না হলে এমন আশা ক্যানো করেন তিনি?দাদু তো জানেন না তার অত্যধিক স্নেহের নাতজামাই যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন।যার প্রতিটি লাইনে ছিলো অন্য একটা মেয়ের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা।এবার তিনি ফিরছেন নিশ্চই তার জন্য।
আনমনে কথা গুলো ভাবছিলো রিতি।
কাঠের পুরোনো আমলের আলমারিটার কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজার একটা পাল্লা খোলে সে। গয়নার একটা খালি বাক্সের মধ্যে থেকে চিঠিটা বের করে।চিঠিটা আগা গোড়া পড়ে শেষ করে সময় নিয়ে।
অনুভূতিটা আজো সেই প্রথম দিনের মতো, বহুবার পড়ার ফলে কাগজটা ময়লাটে হয়েছে,লেখাটুকু এপিঠ ওপিঠ ভেদ করে গিয়েছে কিন্তু অনুভূতি গুলো এখনো তরতাজা।চিঠিটা ভাজ করে একটা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে বলে রিতি,তাকে খুঁজে না পেয়ে যদি ফিরে আসো আমি কিন্তু তোমাকে নেবো না বলে দিলাম।তখন যেনো বলোনা নারী ছলনাময়ী।
চৌধুরী বাড়িতে পূজার তোরজোর চলছে পুরোদমে। একদিন পরে মহালয়া।সাফসাফাই কর্মে নিয়োজিত জনা বিশেক মানুষ।দশ বিঘা জায়গা জুড়ে বিশাল বাস্তুভিটা চৌধুরীদের ।গেট পেরিয়ে ডানদিকে কুলদেবী সিংহ বাহিনীর শ্বেত পাথরের তৈরি মন্দির।যেখানে দূর্গাপূজা হবে। মন্দিরের সামনে অনেকখানি জায়গা ইট সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে পূজার দর্শনার্থীদের বসার জায়গা করা হয়েছে।রোদ বৃষ্টি নিরোধক ব্যবস্থাও রয়েছে উপরে টিনসেডের মাধ্যমে।
মহলের ভেতরে চলছে চাপা উত্তেজনা। রূপের ঘড় সহ অন্য অব্যবহৃত ঘড় গুলো পুনরায় ঝাড়াপোছা চলছে। আত্মীয়-স্বজন তো কম আসে না পূজার সময়।থাকবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।এত কিছুর মাঝে সব চেয়ে বড়ো আনন্দের বিষয় হলো আজ রিতি আসবে , তিনদিন পর রূপ।
ভোরে উঠে রান্নার কাজে পিসিকে সাহায্য করে রিতি।সুমিতা দেবী রিতিকে রাঁধতে দেননা কখনো।এমনিতে মেয়েটার দম ফেলার ফুরসত নেই তারউপর রান্নার ঝামেলা টা তাকে দিতে মন চায়না তাঁর।সকাল সকাল স্নান সেরে ফুল পাতা তুলে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত গোপাল ঠাকুরের ছোট্ট মন্দিরে ঢোকে রিতি।সারা দিনের এই একটি কাজের সময় সে ভীষণ ভাবে মানসিক শান্তি ,স্বস্তি পায়।বেশ খানিকটা সময় নিয়ে পূজা শেষ করে তবেই বের হয় ঠাকুর ঘর থেকে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস।ভক্তির কোনো সীমা পরিসীমা নেই।
কোন রকমে নাকে মুখে দু’টো গুজে দিয়ে বেরিয়ে পরে স্কুলের উদ্দেশ্যে।দেখতে বেশ লাগে তখন। দুহাতে স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো চিকন শাঁখা দুটো গভীর ভাবে লক্ষ্য না করলে শাঁখার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়না।কপালে টিপ না পরলেও সিঁথির সিঁদুর কখনো মিলিয়ে যায় না তার।কালো লম্বা চুলের মোটা বেনীটা হাঁটার তালে যখন এদিক ওদিক দুলতে থাকে তখন চোখ ফেরানো দায় হয়ে পরে।একরঙা পাড় বাঁধানো তাঁতের শাড়ি।বাঁহাতে শাখার সাথে কালো ফিতের সোনালী ডায়ালের ঘড়িটা ফর্সা ত্বকের শোভা বর্ধন করে।ডান কাঁধে ঝুলানো হস্তনির্মিত মাঝারি আকৃতির ব্যগটি।দেখেই বোঝা যায় এই পাটের আঁশ নির্মিত থলেটি বইতে মালকীনের বেশ কষ্ট হয়।
আজ একটু তারাতাড়ি বাড়িতে ফিরেছে রিতি। বেশ অনেকটা বেলা অবশিষ্ট রয়েছে তখনো। নদীর ওপাড়ে বড় রাস্তায় দাঁড়ানো চৌধুরীদের কালো গাড়িটা বাচ্চাদের কৌতুহল বৃদ্ধি করছে।রিতিকে দেখে কেউ কেউ দৌড়ে পালিয়েছে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলো রঘুনাথ দাদা উঠোনে বড় আম গাছটার নিচে চেয়ার পেতে বসে আছে। তাকে দেখেই হেসে এগিয়ে যায়,
কি রে বুড়ি,তোর সাথে দেখা করতে হলে তো আজকাল আগে থেকেই এপয়েনমেন্ট নিতে হয়।
রিতি পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলে, দাদাভাই ,তো কারকাছ থেকে নিলে এপোয়েনমেন্ট?
তোর স্কুলে গিয়েছিলাম। তুই সেখানে ছিলি না।মনিকা ম্যাডাম বললেন,তুই নাকি তোর ঐ মহিলাদের গাঁদায় আছিস তাই আর যাইনি।ভয় করে বুঝলি?শেষে আবার আমার মন্ত্রীর নামে কুৎসা রটতে পারে।রসিকতা করে রঘুনাথ।
রিতি চলতে চলতে চোখ পাকায়,দাদা ভাই তুমি কিন্তু দিন দিন ভীষণ বাজে কথা বলা শিখছো।বৌদিদি কি জানে তোমার এত এত অধঃপতন হয়ে যাচ্ছে?
এই দ্যাখো,,একটু আস্তে বল না বোনটি।ওঘড়ে স্বয়ং বিজয়া দেবী অবস্থান করছেন।শুনতে পেলে মান ইজ্জত সব ভরাডুবি হবে। জিভ কেটে বললো রঘুনাথ।
বৌদিদির কথা শুনে জোরে পা চালিয়ে ঘড়ে ঢোকে রিতি। নিজের রুমে প্রবেশ করতেই থ।
একি বৌদিদি তুমি বস্তা ভরছো ক্যানো?
রিতির কথায় হাতে রাখা শাড়িটা ব্যাগে চালান দিয়ে ফিরে তাকায় জয়া।
এইতো এসে পরেছিস।পিসিমা বললেন আসতে বেলা ডুববে তাই তোর কিছু কাপড়_চোপড় আর বই খাতা ব্যাগে ভরছিলাম। নে এবার ফাইলপত্র যা জরুরী ব্যাগে ভরে নে। তুই তো আবার কাজ ছাড়া চলতে পারিস না।কি হলো ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?রিতি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে আলনাটা, সেখানে দুই বছর আগে বাদ দেওয়া স্যালোয়ার-কামিজ, শাড়ি কিছু্ই অবশিষ্ট নেই সব বড় ট্রলি ব্যাগের মধ্যে গুটি সুটি মেরে এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। টেবিলের দরকারি অদরকারি বই খাতা গুলো বাঁধা শেষ এখন তারাও একটা ব্যাগ পেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাবে।
বৌদিদি তোমাকে এত কিছু কে করতে বললো?
জয়ার হাস্যোজ্জল চেহারাটা নিভলো একটু।
তুই রাগ করেছিস ?আমি তোর ঘড়ে ঢুকে তোর জিনিসে হাত দিয়েছি বলে।তেমন কিছুই ধরিনি বিশ্বাস কর।
রিতি অসহায় বোধ করে ও কি বললো আর বৌদিদি কি বুঝলো।কাছে এগিয়ে গিয়ে জয়ার দুই কাঁধে হাত দিয়ে বললো,বৌদিদি তুমি আমার জিনিস ধরবে আর আমি রাগ করবো?এমনটা ভাবলে কি করে?
পুনরায় হাস্যোজ্জল হয়ে ওঠে জয়ার মুখটা।
এতকিছু নিয়েছো? আমি কয়েকটা দিনে কি এত পরবো বলোতো?শুধু শুধু ব্যাগ ভর্তি করে দাদাভাইকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। দরকার পরলে নিয়ে নেবো। এটুকু আসতে কি পাসপোর্ট ভিসা লাগবে?
কয়েকটা দিন মানে কি হ্যা?যদি আর আসতে না দেই তখন?
বৌদিদি তুমি বরং এগুলো বের করো ব্যাগ থেকে। আলমারিতে রাখা শাড়ি গুলো নাও। ততক্ষনে আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি।যেতেই যখন হবে দেরী করে লাভ কি?
রিতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আলমারীতে হাত লাগায় জয়া। শঙ্কামুক্ত হলো এতক্ষণে।ভেবেছিলো রিতি হয়তো যেতেই চাইবে না।
অবশেষে শশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো রিতি। বিদায় বেলায় যখন দাদুকে প্রণাম করে তখন দাদু সজল নয়নে ধরা গলায় বললেন,দেখে শুনে চলবে দিদিভাই।ঠাকুর যেনো তোর মনের আশা পূরণ করেন।বলেই নিচু হয়ে শুভ্র ধূতির খুঁটে রং হীন তরল পদার্থ টুকু মুছলেন।
পিসিমাকে প্রণাম করতেই তিনি মুখে আঁচল গুঁজে কান্না আটকানোর তারনায় কোন আশীর্বাণী আওড়াতে পারলেন না।
রিতি চোখ তো মুছলো না শুধু মনে মনে বললো,দাদু গোবিন্দ যেনো তোমাদের আশা পূর্ণ করেন।সুমির ক্যানো জানি কান্না পাচ্ছিলো খুব। প্রতিদিনই তো দেখা হবে প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর সাথে আগের মতোই।তবুও ক্যানো জানি মনের দুকূল ছাপিয়ে কান্নার ঢেউ আসছে। হাঁটতে হাঁটতে বংশ নির্মিত সাঁকোর কাছে এসে রিতির হাতটা আঁকড়ে ধরে সুমি।রিতি অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলে,মানে কি সুমি?আমি কি একেবারেই যাচ্ছি?আর ফিরবো না?সবার সাথে তাল মিলিয়ে দল বেঁধে তোকেও কাঁদতে হবে?এই তুই একমাসের জন্যেও যদি কোথাও বেড়াতে যাস আমি কাঁদি?
সুমি আমতা আমতা করে,
না মানে,,তুইতো জানিস কারো কান্না দেখলে আমারো কান্না পায়,,
ওহো,,তুই তাহলে আমার জন্য কাঁদছিস না?তুই তোর ছিঁচকাদুনে স্বভাবের জোরে কাঁদছিস?তেড়ে ওঠে রিতি।সুমি পরে মহাবিপাকে।কান্নার সময় ওর আবার কথা বার্তার ঠিক থাকে না।
এই না না বিশ্বাস কর,,,প্রবল ভাবে মাথা দুদিকে দোলায় সুমি।চল ওনারা দাঁড়িয়ে আছেন।ঐপাড়ে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে সুমি।
চল মানে ? তুই কোথায় যাবি?সোজা বাড়িতে গিয়ে দ্যাখ ,যারা কান্না করছে ওঁদের দল ভারী করগে যা।
সুমি আর আগে যেতে সাহস হয়না।যে মেয়ে, হয়তো সাঁকো থেকে মাঝ নদীতে ফেলে দেবে।হাত,পা,কোমর ভাঙা দেহ নিয়ে সুমির আর প্রদীপের সাথে সংসার বাঁধা হবে না।
কি হলো দাঁড়িয়ে আছিস ক্যানো?যা।
সাঁকোর মধ্যবর্তী স্থানে গিয়ে পুনরায় ধমক দেয় সুমিকে।
গাড়ির কাছে গিয়ে দ্যাখে প্রদীপ দা আগে থেকেই ড্রাইভিং সিটে বসে বসে মুচকি হাসছে।হাসির কারনটা বুঝতে পারলো রিতি লুকিং গ্লাস এ তাকিয়ে।সুমির পেছনটা তখনো দেখা যাচ্ছে, একবার ডানহাত একবার বাঁ হাত দিয়ে অশ্রু মুছতে মুছতে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
কি ব্যাপার প্রদীপ দা তুমি এই সময়ে?আরেকটু এগিয়ে যেতে? ভালো মন্দ আহারের সাথে সুন্দরের ও দেখা মিলতো ।
জয়ার পাশে বসে বললো রিতি।
কি আর করবো বল? ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।যেভাবে জল বাড়ছে তাতে নিম্নচাপটা হয়তো বিপদ সীমা অতিক্রম করবে রাতের কিছুক্ষণের মধ্যেই।
কারো চোখের জল দেখে এভাবে ব্যঙ্গ করোনা তাহলে ঠাকুর পাপ দেবে। বিয়ের দিন কাঁদার জন্য চোখে জল পাবেনা।
রঘুনাথ হাসে হো হো করে।জয়াও ব্যপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে।প্রদীপ গাড়ির এক্সেলেটরে হাত দিয়ে বললো,
আমাদের গ্রামের বৌ বাড়িতে ফিরছে একটু রিসিভ টিসিভ না করলে গ্রামের মান থাকে বল?শেষে কোথায় কোথায় কি না কি বলে বেড়াবি?
রিতি কপাল কুঁচকে বলে,ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না প্রদীপদা তোমরা এভাবে বখে যাচ্ছো ক্যানো সব?কথা বার্তার কোনো লাগাম নেই।
এবার প্রদীপের ভ্রু কুঁচকে আসে। রঘুনাথ আচমকা বিষম খায়।
তোমার আবার কি হলো?কে মনে করছে কে জানে?বললো জয়া।
গুরুজনদের একটু সন্মান দিতে শেখ রিতি।এত লেখাপড়া শিখে এই তোর মুখের ভাষা?বড়ো দাদাদের বলছিস বখে যাচ্ছো?তোর শিক্ষকরা কতদূর লেখাপড়া শিখেছে রে ?কি সব শেখাচ্ছেন ছাত্রীদের।
এই প্রদীপদা কতদূর লেখাপড়া শিখেছে মানে কি? তোমার মতো আন্ডার মেট্রিক পাস করে ওঁরা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের পড়ায়? তোমার চিন্তা ভাবনা গুলো তোমার ফার্মের মুরগীদের মতো পাকস্থলীতে আঁটকে আছে বুঝলে?মস্তক পর্যন্ত পৌঁছোয় নি।জয়া বেশ উপভোগ করছিলো ওদের ঝগড়া ঝাটি। রঘুনাথ আধোমুখে বসে আছে কখন জানি বলে বসে,দাদাভাই মন্ত্রী মিনিষ্টার দের চামচামি আর কতো ?
আচমকা ব্রেক কষায় লাফিয়ে ওঠে রিতি,ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে রায় চৌধুরী বাড়ির বিশাল বড় গেট।
নে এবার ভিতরে পৌঁছে দিচ্ছি ওখানে গিয়ে তোর ঝাড়ফুঁক করিস ।আমাকে ক্ষমা কর। আমার এমন কবিরাজের দরকার নেই ।
জয়া মৃদু হেসে ধমক দেয়,ঠাকুরপো শুধু শুধু ক্যানো লাগছো মেয়েটার পেছনে?
ও মা,,বৌদিদি আমি আপনার ঠাকুরঝির পেছনে লেগেছি? দাদাভাই?
রঘুর দিকে তাকিয়েও কোন সাপোর্ট না পেয়ে বিরবির করে প্রদীপ। কেয়ারটেকার গেট খুলতেই গাড়িটা ঢুকিয়ে দেয় গেটের বিশাল গহ্বরে।
চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।