হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
ষষ্ঠ_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন
– ‘আমার আর রায়হানের বিয়ের কার্ড। এখান থেকে বাড়ি ফেরার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের বিয়ে।’
সোহানের উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাটি বললো তারিন। কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয়ে তারিনের বলা উক্ত কথাটি সোহানের বিশ্বাসকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
প্রতিউত্তরে সোহানকে কিছু বলতে না দেখে তারিন পুনরায় বলে উঠলো,
-‘কার্ডটি দেখতে খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়, তাইনা? আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। খুব ধুমধাম করেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। আমাদবিয়েতে সবাইকেই আমন্ত্রণ করতে চলেছি, ভাবলাম তুমিও তাহলে বাদ যাবে কেন? তাইতো চলে এলাম তোমায় আমন্ত্রণ করতে!’
কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে তারিন বললো,
-‘ওপস্ সরি। তুমি তো এখন জেলে বন্দি! বেচারা। ইচ্ছে হলেও কিছুতেই আমার বিয়ে এটেন্ড করতে পারবে না।’
এবারো সোহানকে নিরব থাকতে দেখে তারিন বেশ অবাক হলো। তারিন সোহানের দিকে ফিরে দাঁড়ালো। তাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে দেখতে। তবুও নিজের জেদ বজায় রেখে ঠিকি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারিন বেশিক্ষণ সোহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বললো,
– ‘তোমার কি কিছুই বলার নেই?’
সোহান মুচকি হেসে বললো,
– ‘আপনার বিয়ের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।’
বরাবরের মতোই সোহান তার জবাবে তারিনকে পুনরায় বিস্মিত করে তুললো। তারিনের নিরবতা দেখে সোহান নিজেই পুনরায় বললো,
– ‘ভেবে অবাক হচ্ছি মিস. তারিন তার অতি মূল্যবান সময় ব্যয় করে তারঘৃণারো যোগ্য নয় এমন কাউকে তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করতে এসেছে! ধন্যবাদ মিস. তারিন। আমাকে আপনার বিয়েতে আমন্ত্রণ করার জন্যে। সরি, একটু ভুল হয়ে গেলো। মিসেস. তারিন বলাটাই এখন ভালো হবে বোধ হয়। সমস্যা নেই, এটাও মানিয়ে নেবো।’
সোহান পুনরায় বললো,
– ‘মিসেস. তারিন এভাবে বিয়ের আগে এভাবে একজন অপরিচিত কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন আপনার হবু স্বামী কি তা জানেন?’
তারিন মুচকি হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ, আমার স্বামী জানেন। আমি আমার সবকিছু আমার স্বামীকে জানিয়েই করি। আমি চাইনা তৃতীয় কেউ আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করুক।’
তারিন থেমে পুনরায় বললো,
– ‘আজ তাহলে আসছি। বিয়ের সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হবে! বুঝতেই পারছেন, বিয়ে নিয়ে আমি খুবি এক্সাইটেড! আমার এখন অন্য কারো সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বিদায়।’
সোহান আবারো হাসলো। কখনো কখনো হাসা যে নিজের কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যম হয়ে উঠে, সোহান তা উপলব্ধি করতে পারলো। তারিন দ্রুত কদমে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তারিন চলে যেতেই মিয়াজ প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললো,
– ‘কী লাভ হলো মিথ্যে আশা নিয়ে স্বপ্ন বেঁধে? তোর ভালোবাসাই আজ তোর বিশ্বাস ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো। এখনো তুই পাগলামি করবি?’
বরাবরের মতোই সোহানের জবাব ছিলো,
– ‘তারিন আমায় ভুল বুঝেছে মিয়াজ। তাই আমাকে কষ্ট দেবার জন্যেই তারিন এমন করছে। অন্যথায় তারিন এমন আচরণ করার মেয়েই নয়।’
মিয়াজ এবার প্রচন্ড রেগে গেলো। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সোহান জেদ ছাড়ার পাত্র নয়। কিন্তু সোহানের সাথে মিয়াজ কিছুতেই অন্যায় হতে দিতে পারে না। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন সোহানের কথাটা মানাই তার উচিত হয়নি। সোহানের কোন কথা না শুনে ওইদিনেই এখান থেকে ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো তার। মিয়াজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললো,
– ‘আমি আর তোর কোন কথাই শুনছিনা। তুই চাইলেই এই বন্দিশালার অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে পারছি। কিন্তু তুই তা না করে জেদ ধরে বসে আছিস। আমি এখনি আংকেলকে ফোন করে সব জানাচ্ছি। সব জানতে পেরে এবার আংকেলই যা করার করবেন।’
মিয়াজের কথায় সোহান বিচলিত হয়ে বললো,
– ‘না, না! বাবাকে এসব জানাস না। বাবার ব্লাড প্রেসার খুব হাই। সবকিছু জানিয়ে বাবার জীবনকে আমি ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারবো না।’
মিয়াজ বললো,
– ‘তুই এভাবে জেদ ধরে অত্যাচার সহ্য করলে বাধ্য হয়ে আমাকে এটাই করতে হবে। তুই কী ভেবেছিস? তুই বা আমি আংকেলকে কিছু না জানালে আংকেল কিছুই জানতে পারবে না? দেশের নাম করা বিজনেস ম্যান এর ছেলে জেলে বন্দি! এই খবরটা কতদিন চাপা থাকবে তুই বলতো?’
সোহান বললো,
– ‘মিয়াজ, তুই প্লিজ সবটা সামলে নে। দেখ, এখানে কেউই আমার পরিচয় কিংবা আমি কার ছেলে তা জানে না। তুই প্লিজ এদিকটা এবারের মতো ম্যানেজ কর।’
সোহানের অনুরোধ মানতে মিয়াজ বাধ্য হয়ে রাজি হলো। হাজার হোক, সোহান তার বেস্টফ্রেন্ড। আরো কিছু টুকটাক কথা বলে সোহানকে বিদায় জানিয়ে মিয়াজ চলে গেলো।
গহীন বনের মধ্যবর্তীতে একটি কাঠের তৈরি কারুকার্য পূর্ণ কুঠুরিতে বিরাজ করছে ঘোর অন্ধকার। আলোহীন নিস্তব্ধ ঘরটির নিরবতা যেন শরীরে ভীত অনুভূত এক আলাদা শিহরণ জাগে। নিরবতার অবসানে ঘটিয়ে অন্ধকারে ভেসে আসে এক মিনতির কন্ঠ।
– ‘মহাশয়, এবারের মতোন আমাদের ভুল মার্জনা করুন। পরবর্তী হতে আমরা আরো দ্বিগুণ সচেতন থাকবো।’
একটি ভয়ংকর দ্যর্থহীন কন্ঠে কক্ষে উপস্থিত অপর একজন ব্যাক্তি বললো।
– ‘সংঘটিত ভুল কখনো সংশোধন করা যায় না। পরবর্তী কালে সচেতন হবার পরিবর্তে যদি তোমরা পূর্বেই সচেতন থাকতে তবে কখনোই তোমাদের দ্বারা ভুলটি হতো না। তোমাদের জন্য আজ প্রথমবার আমি কোন পরিকল্পনায় অসফল হয়েছি। আমার রাজ্যে ভুলের কেবল একটিই প্রায়শ্চিত্ত, তা হলো মৃত্যু।’
মহাশয় তার বক্তব্যে বিরতি টানতেই কক্ষে উপস্থিত অপর ব্যাক্তিযুগল তৎক্ষণাত মহাশয়ের পদস্থলে অবস্থান নিয়ে ভীতগ্রস্থ কন্ঠে অনুনয়ের স্বরে বললো,
– ‘এবারের মতো মার্জনা করুন, মহাশয়। আমরা আর কখনো এমন ভুল করবোনা।’
– ‘যদি আর কখনো তোমাদের দ্বারা একি ভুল পুনঘটিত হয়, তবে তোমরা আমার নিকট মার্জনার আকুতি করার সুযোগটুকুও পাবে না।’
মহাশয়ের কথায় দুজনে যেন পুনরায় প্রাণ ফিরে পেলো। উভয়কে আনন্দিত হতে দেখে ক্ষমতাশালী লোকটি পুনরায় বলে উঠলো,
– ‘এটি তোমাদের জন্য কোন আনন্দ সংবাদ নয় বরং এটি তোমাদের জন্য একটি সতর্কবাণী। আজ কোন এক কারণে আমি বেশ পুলকিত। এবং সেজন্যই তোমাদের শাস্তিমুক্ত করে দিলাম। কিন্তু সবসময় এমনটি হবার আশা মনে পোষণ করোনা। আজকের জন্য তোমরা এসো।’
ব্যাক্তিযুগল কুঠুরি হতে প্রস্থান করতেই কালো হ্যাট পরিহিত ব্যাক্তিটি বিকট শব্দে অট্টহাসিতে মেতে উঠে। তার ভয়ংকর কুৎসিত হাসিতে যেন পুরো ঘর জুড়ে এক কম্পন বয়ে গেলো। হাসির অবসান ঘটিয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে দাম্ভিক ব্যাক্তিটি বললো,
– ‘আমি তোমাদের কখনো এক হতে দেবো না। তোমাদের বিনাস আমার হাতেই লিখা। ওয়েট ফর মাই নেক্সট প্ল্যান ডিয়ার।’
পাশে রাখা ইন্জেকশান সিরিজটি হাতে নিয়ে সে বললো,
– ‘নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সর্বদা নিজের সহিত অস্ত্র রাখা উচিত। আজ কেবলমাত্র এই অস্ত্রের জন্যেই বেঁচে গিয়েছি। আর একটু হলেই আমার সমস্ত পরিকল্পনাকে অধরা নস্যাৎ করে দিতো।’
বলেই লোকটি পুনরায় হেসে উঠলো।
তারিন সবেমাত্র বাড়িতে এসে পৌঁছিয়েছে। তারিনের অগোচরে তারিনের পূর্বেই রায়হান ঘরে প্রবেশ করলো। কিন্তু অনেক সতর্কতা অবলম্বনের পরেও রায়হান তারিনের চোখ এড়াতে পারেনি।
– ‘কোথায় গিয়েছিলে, রায়হান?’
– ‘সোহানের কাছে যাচ্ছো জানলেও আমি তোমায় বাঁধা দিতাম না, তারিন।’
– ‘তুমি আমাকে অনুসরণ করছিলে! তোমার কাছ থেকে আমি কখনোই তা আশা করিনি।’
– ‘তারিন তুমি হয়তো জানো তুমি কখন কোথায় অবস্থান করছো এবং কী করছো তা জানা আমার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। এর জন্যে আমায় তোমাকে ফলো করতে হয়না।’
– ‘বাহ্! তাহলে নিজেই খোঁজ লাগিয়ে নিতে আমি কোথায় যাচ্ছি! তখন আমায় অযথা জিজ্ঞাসা করতে গেলে কেন?’
– ‘আমি কেবল তা তোমার মুখে শুনতে চেয়েছিলাম তারিন।’
অনেক কিছু বলতে চেয়েও তারিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ দ্রুতপদে নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজা তালাবদ্ধ করে বিছানার পার্শ্বে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো।
তারিনের মনে ক্রমাগত যুদ্ধ চলছে। ভালোবাসা এবং কর্তব্যবোধের মধ্যবর্তীকার যুদ্ধ! মনের অগোচরেই ক্রমাগত অতীত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তারিন অতীত হতে পলায়ন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে শতবার। দ্বন্দের যুদ্ধে সন্দেহের তীর ক্রমশ সোহানের দিকেই যাচ্ছে। পাঁচবছর পর তার জীবনে সোহানের আগমন, আবারো পুনরায় সবকিছু পাঁচবছর আগের মতোই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া নেহাত কাকতালীয় হতে পারেনা। তারিন ক্রমশ এসবের পেছনকার যোগসূত্র খুঁজে চলেছে।
অপ্সরার হঠাৎ অপহরণ, অধরার এই করুণ পরিণতি এসবের পেছনে সোহানের হাত নেই তো? বারংবার সন্দেহের তীর সোহানের দিকেই নিক্ষিপ্ত হলেও তারিনের মনের কাছে হেরে যাচ্ছে সবি। চোখের আড়ালে সবকিছুর পেছনে বড় কোন রহস্য নিজেকে অদৃশ্যের চাদরে লুকায়িত রেখেছে। তারিনের কেন বার বার এমন অনুভূত হচ্ছে?
হতাশায় পরিপূর্ণ আরো একটি নৈরাশ্য রজনী অতিবাহিত হলো। নিরাশার প্রহর শেষে ভোরের সূর্য যেন এক নতুন আশার দীপক নিয়ে প্রজ্জ্বলিত হলো!
চলবে…