হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
সপ্তম_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন
প্রভাতের নতুন ভোরের সাথে আশার দীপকের নতুন সঞ্চার হলো যেন। নৈরাশ্যের রাজ্যে তারিন এক বিন্দু আশার আলোর খোঁজে নেমেছে। অধরার এত দ্রুত রেসপন্স করা যেন অভাবনীয়! তারিন তা দেখামাত্রই ডাক্তারকে ডেকে আনলো।
ডাক্তার অধরার চেক-আপ করলেন। তারিন জিজ্ঞাসা করলো,
– ‘অধরা এখন কেমন আছে, ডক্টর?’
ডাক্তার স্মিত হেসে বললেন,
– ‘চিন্তার কোন কারণ নেই। পেশেন্টের কন্ডিশন ভালো রয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই অধরা সুস্থ হয়ে উঠবে।’
তারিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অধরা পাশে থাকলে তারিনের পক্ষে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া আরো সহজ হয়ে উঠবে। তারিনকে নিঃশ্চুপ দেখে ডাক্তার বললেন,
– ‘মনোবল শক্ত রাখো। আমি জানি বিগত বছর ধরে তুমি কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছো এবং যাচ্ছো। সত্যিই তোমাদের সাথে যা ঘটেছে সবই আশাতীত ছিলো, যা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। মিস্টার সাইফ চৌধুরীর হঠাৎ মৃত্যু, অতঃপর মিসেস. রিমির এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া।
মেডিকেলের সবচেয়ে ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলো অধরা। সবাই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলো। কিন্তু সব যেন এক নিমেষে বদলে গেলো! শুধু একটাই দোয়া করি অধরা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।’
তারিন ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনার্থে বললো,
– ‘বাবা গত হবার পর যেকোন পরিস্থিতিতে আপনি পাশে ছিলেন এবং এখনো আছেন। সত্যিই আপনি এভাবে পাশে না থাকলে হয়তো সবকিছু সামলানো আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে যেতো।’
তারিন অধরার হাত ধরে বললো, ‘এই সময়ে আমার তোকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো, আর তুই এভাবে ঘুমিয়ে আছিস! প্লিজ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠ। অন্তত অপ্সরার জন্যে হলেও! তোকে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না।’
তারিন ডাক্তারের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে তাঁকে এগিয়ে দিয়ে আসে। ডাক্তারকে বিদায় জানিয়ে তারিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সোহান কারাগারের ভেতরে বসে নিরব দর্শকের মতো চারপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। একদল পিপিলিকা সারিবদ্ধ হয়ে আপন মনে চলেছে নিজেদের খাদ্য যোগাড়ের প্রয়াসে। তাদের কাজের প্রতি কোন অলসতা নেই, নেই কোন আলসেমি। পিঁপড়েরাই একমাত্র প্রাণী যারা কিনা রাতে ঘুমোয় না। দিনের সকল প্রহর-ই তারা পরিশ্রম করে থাকে।
আজ দুদিন হলো প্রভাতের গগনে প্রতীয়মান সূর্যের সহিত তার দেখা মেলেনি। মিয়াজ অবশ্য এর মাঝে এসেছিলো একবার। তারিনের পাহাড় থেকে ফিরে যাবার খবর মিয়াজের কাছ থেকেই জানা। তবে মিয়াজ আর তেমন কিছুই বলেনি। তারিন ফিরে গিয়েছে এতটুকু খোঁজ নিতেই যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
তারিন চলে গেছে জানা সত্ত্বেও সোহান হাল ছাড়েনি। এখনো নিজের জেদ বজায় রেখেছে। তার বিশ্বাস তারিন আসবে। মিয়াজের অনেক বলার পরেও সোহান শুনলোনা। অবশ্য একরোখা মানুষেরা এমনি হয়! নিজের জেদ বজায় রাখে সর্বদা। এতে তার প্রাণনাশ হলেও তাতে তাদের যায় আসবে না।
প্রতিদিনের মতোই মিনিট দুয়েক বাদে আগমন ঘটে মিয়াজের। সোহান স্মিত হেসে বললো,
– ‘আরে বাহ্! আজ তুই দুই মিনিট একত্রিশ সেকেন্ড আগে এসেছিস!’
মিয়াজ বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে সোহানকে বললো,
– ‘এখানে থেকেও তুই সময়ের এতো নিখুঁত হিসেব রাখছিস কী করে!’
সোহান সচারচরের মতো আবারো মুচকি হাসলো। স্মিত হেসে বললো,
– ‘চিরায়িত অভ্যেস! দিন দুয়েকে ভুলি কী করে?’
মিয়াজ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,
– ‘তোর জন্য আজ আমায় মিথ্যে বলতে হচ্ছে!’
খানিক সময় বাদে মিয়াজ পুনরায় বললো,
– ‘আংকেল ফোন করেছিলেন? জানতে চেয়েছিলেন কেমন আছিস? আমরা এখনো ফিরে যাচ্ছি না কেন? তোর কথা রাখতে অগত্যা আমায় মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো!’
সোহানকে নিরব থাকতে দেখে মিয়াজ বললো,
– ‘যতদূর জানতে পেরেছি, তারিন এখান থেকে ফিরে গতকালেই বাড়ি চলে গেছে। মিথ্যে আশায় দিনযাপন করে তুই বোকামো করছিস। তারিন কখনোই তোকে এখান থেকে মুক্ত করতে আসবে না। বিগত বছর কয়েকে তোদের মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্ট হয়েছে তা অমোচনীয়।’
সোহান দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে বললো,
– ‘তারিন আসবে। তার মনে সৃষ্ট ভুল-ধারণা ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথেই সে নিজেই আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। নির্দোষ হয়েও এভাবে অপরাধীর মতো পলায়ন করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।’
– ‘আর এখানে যে তোকে এদের অমায়িক অত্যাচার সহ্য করতে হয়? আমি জানি, তারিন-ই ওদের এমনটি করতে বলেছে।’
– ‘তারিন ওদের এমন নির্দেশ কখনোই দেয়নি।’
– ‘তাহলে?’
– ‘ষড়যন্ত্র চলছে। গভীর ষড়যন্ত্র! এই ষড়যন্ত্রের রহস্যই আমাকে ভেদ করতে হবে। মুখোশ উন্মোচন করতে হবে কিছু মুখোশধারীর।’
একটি ধারালো ছুরি নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ধরেই উপরে ছুড়ে নিচে পড়ার পূর্বেই ধরে নিচ্ছে। হঠাৎ ছুরিটি অত্যন্ত হিংস্রভাবে ছুড়ে মারলো সামনের দিকে। সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভীতগ্রস্থ অনুচরের মাথার উপরে রাখা আপেলটাকে নিশানা করেই ছুরি তাক করেছিলো ব্ল্যাক হ্যাট পড়া লোকটি। ভীতগ্রস্থ অনুচরের উদ্দেশ্যে বললো,
– ‘আমার নিশানা কখনো ভুল হয় না। তবে নিশানা ভেদের মাঝে কখনো কখনো এক-দুজন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সেসব বাঁধাকে পথ থেকে সরাতে কী করতে হয় জানো?’
অপর মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বললো,
– ‘কী বস?’
– ‘তার গলার স্বর কেড়ে নিতে হয়।’
– ‘কীভাবে বস?’
– ‘এভাবে!’
বলেই একমুহূর্তও ব্যয় না করে লোকটির গলায় নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করলো। সাথে সাথেই অনুচরটি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে!
কালো হ্যাট পরিহিত লোকটি হিংস্রভাবে হেসে উঠলো।
– ‘আমি আমার পথে কোন কাঁটা রাখিনা। আমার রাজ্যে ভয়ের কেবল একটাই দন্ড। তা হলো মৃত্যু!’
সবেমাত্র-ই বাড়ি ফিরলো তারিন। তারিনকে দেখামাত্র-ই আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে অপ্সরা। দৌড়ে এসে তারিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘আন্টি, কারা যেন আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করেছিলো। ভয় পেয়ে আমি সিক্রেট প্লেসে লুকিয়ে পড়ি। যেভাবে আমি তোমার সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে লুকিয়ে যেতাম।’
অপ্সরার কথা শুনে তারিনের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। আরেকটু হলেই অপ্সরার বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো! কিন্তু অপ্সরা পরবর্তীতে যা বললো, তাতে যেন তারিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
– ‘আন্টি তারা মায়ের ঘরে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর লোকগুলো চলে গেলে আমি মায়ের কাছে যাই। মা কেমন যেন ছটফট করছিলো। কিছুতেই আমার কথা শুনে শান্ত মেয়েদের মতো ঘুমোচ্ছিলো না।’
তারিন দ্রুত ছুটে অধরার কাছে গেলো। অধরা ছটফট করতে করতে হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অস্পষ্ট স্বরে বললো, – ‘রায়হান…!’
রায়হানের নাম শুনে তারিনের মনে সন্দেহ জাগে। তবুও সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তারিন দ্রুত ডক্টরকে কল করে। বাড়ি ফিরে নার্সটিকেও খুঁজে পায়নি তারিন।
কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে রায়হানের আগমন ঘটে। রায়হানকে এমন রূপে দেখে তারিনের বেশ অবাক হয়। রায়হানের পোষাক রক্তাক্ত। হাতে-পায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে তারিন হতবাক হয়ে পড়ে। রায়হান বললো,
– ‘আমি বাড়িতেই ফিরছিলাম। তখনি বাড়ির বাইরে কিছু দূরে তাদের দেখতে পেয়ে অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু তারা তা টের পেয়ে যায়। আর তারপর…!
তারিনের বুঝতে বাকি থাকে না এরপর কী হয়েছিলো। ডাক্তার কিছু সময় বাদেই চলে আসে। অধরাকে চেক-আপ করার পাশাপাশি রায়হানের-ও চিকিৎসা করানো হয়।
কিছুক্ষণ বাদে অধরার জ্ঞান ফেরে। অধরাকে চোখ মেলতে দেখে তারিনের মনে যেন নতুন আশার সঞ্চার ঘটে। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে মুহূর্তেই যেন তা মিলিয়ে গেলো।
ডাক্তার তারিনকে জানালো অধরা বাকশক্তি হারিয়েছে। মূলত অধরার শরীরে এমন একটি মেডিসিন পুষ করা হয়েছে যার ফলে অধরা আর কথা বলতে পারবে না।
রায়হানকে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ডাক্তার চলে যায়। পুরো দিন এভাবেই কেটে গেলো। সন্ধ্যা নেমে আসে। তারিন বেলকনিতে বসেছিলো। নিজের উপরি বেশ রাগ হচ্ছে তার। রায়হানকে সন্দেহ করেছিলো তারিন! যে কিনা নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও তার পাশে থেকেছে? তারিন যখন ভাবনায় মগ্ন
হঠাৎ সেখানে অপ্সরা এসে বললো,
– ‘আন্টি তুমি কী এখন রেগে আছো?’
(তারিন বেশি রেগে থাকলে বেলকনিতে এসে চুপচাপ সময় কাটায়। বর্তমানে মন খারাপ থাকায় তারিন বেলকনিতে বসে একাকী সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু অপ্সরা ভেবেছিলো, তারিন রেগে আছে।)
তারিন বললো,
– ‘না আমি রেগে নেই! তুমি কী আমায় কিছু বলবে?’
– ‘হ্যাঁ, আজকের ঐ লোকগুলোই আমাকে সেদিন আটকে রেখেছিলো।’
তারিন বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘তুমি তা আমায় আগে বলোনি কেন অপ্সরা? তারমানে এই সবকিছুর পেছনে সোহান রয়েছে! সোহান এতটা নিচে নেমে গেছে। অপ্সরা এমনকি অধরার ক্ষতি করতেও সে একবারো ভাবেনি। সোহানকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।’
অপ্সরা বললো,
– ‘বন্ধু খুব ভালো লোক। বন্ধু আমার কোন ক্ষতি করেনি। বরং আমাকে সেদিন দুষ্ট লোকগুলোর থেকে বন্ধুই বাঁচিয়ে ছিলো।’
অপ্সরা তারিনকে সব খুলে বলে। সব শুনে তারিন কপালে হাত রেখে নিচে বসে পড়ে। অনুতাপের স্বরে বললো,
– ‘এটা কী হয়ে গেলো! নিজের অজান্তেই আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। অপ্সরা তুমি আমাকে এগুলো আগে বলোনি কেন?’
চলবে…
স্কুল কলেজ খোলায় পড়াশুনো, এসাইনমেন্টস্ সহ অন্যান্য কাজের চাপ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। গল্প লিখার কিংবা ভাবার সময়-সুযোগ কোনোটিই হয়ে উঠছে না। তবে এত দেরি হয়ে যাবে ভাবিনি।
কেউ হয়তো আমার গল্পের অপেক্ষায় থাকেনা। কিংবা আমি হয়তোবা তেমন ভালোও লিখিনা। তবুও যেসকল সম্মানিত পাঠকেরা আমার ভুলে পূর্ণ কাঁচা হাতের লেখাগুলোই তাদের অতি মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়ে থাকেন তাদের জন্যেই বলা।
এরূপ ত্রুটির জন্য আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
কষ্ট করে ধৈর্য নিয়ে এতটুকু পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আসসালামু আলাইকুম।