হৃদমোহিনী
পর্ব ১২
মিশু মনি
.
১৫.
সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে মেঘালয় মিশুর কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ সত্যিই ডিভোর্স চাইছো তুমি?’
মিশু মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যা চাইছি।’
– ‘ডিভোর্স ছাড়া আর কোনো সমাধানের কথা ভাবতে পারবে না?’
মিশু একটু নিশ্চুপ থেকে বললো, ‘আপনি কি চাইছেন মন থেকে? সত্যি করে বলুন তো?’
– ‘আচ্ছা আমরা দুটো দিন সময় নিই। তারপর ডিসিশানে আসা যাবে। যদি ডিভোর্স নেয়াটা জরুরি হয়,তাহলে ডিভোর্স। আর যদি একে অপরকে…’
– ‘সেটা কখনোই সম্ভব না। সকাল থেকে না খেয়ে আছেন, আসুন খেয়ে নিবেন।’
কথাটা বলেই মিশু মুখটা খেমটা মেরে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। মেঘালয় মুগ্ধ ওর এমন তেজ দেখে। মিশু যতবার ডিভোর্সের কথা বলছিলো, ততবার ই মেঘালয়ের বুকটা কেমন যেন করছিলো। এত দ্রুত সেরকম কোনো সিদ্ধান্তে আসার দরকার নেই। কয়টা দিন যাক, তারপর দেখা যাবে। এখন আপাতত কিছু খেয়ে নেয়া দরকার, সত্যিই বড্ড খিদে পেয়েছে।
হাত মুখ ধুয়ে রুমে এসে বসলো মেঘালয়। মিতু খাবার টেবিলে ডেকে নিয়ে গেলো। বাবা মা, মিশু, মিতু ও মেঘালয় এক টেবিলে খেতে বসেছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পরিবারের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা। তাদের সম্পর্কে বলো না শুনি?’
মেঘালয় বললো, ‘আমার বাসায় আব্বু আম্মু আর ছোটবোন। আমি বড়, বোনটা ছোট। বাবার বিজনেস আছে, আম্মু ডক্টর।’
মিশু মাথা নিচু করে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। খাবার ভেতরে যাচ্ছেনা ওর। বাবা মা অবাক হয়ে মেঘালয়ের দিকে চেয়ে আছেন আর ওর কথা শুনছেন। ছেলেটার কথা বলার ধরণটা অনেক সুন্দর। বেশ গুছিয়ে আর স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে।
মেঘালয় বললো, ‘আমি কিছুদিন আগে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার ছিলাম। মা অসুস্থ হওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছি। আপাতত ফ্রি আছি, ভাবছি দ্রুত বিজনেসের দায়িত্ব নিবো। আমি ছাড়া বাবাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই।’
মিশুর বাবা প্রসন্ন হেসে বললেন, ‘পরিবার যদি জানতে পারে বিয়ের কথা, তাহলে তোমার সমস্যা হবে তাইনা? অযথা তোমাকে বিপদে ঠেলে দিলাম।’
মেঘালয় বললো, ‘আরে না না। সেরকম কিছু হবেনা। বাবা মায়ের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে। ঘটনাটা বুঝিয়ে বললেই আশা করি ওনারা বুঝবেন। কিন্তু আপনারা কি আসলেই চাইছেন সবকিছু মিটিয়ে নিতে?’
– ‘তোমাদের দুজনের উপর নির্ভর করছে সবকিছু। রাগের মাথায় হয়ত খারাপ আচরণ করেছি। সেটা মনে রেখো না। তোমরা দুজন কথা বলে যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই হবে।’
– ‘বিয়েটা হঠাৎ হয়েছে বলে সিদ্ধান্তও হঠাৎ নিতে হবে সেটা নয়। দুটো দিন যাক, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পছন্দ করিনা।’
– ‘তোমার দায়িত্ববোধকে সম্মান জানাই বাবা। কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারছি তুমি কেমন পরিবারের ছেলে। তবে তোমার পরিবার মেনে না নিলে এ ব্যাপারটাকে কিভাবে সমাধা করবে বলো?’
– ‘আমার উপর ভরসা রাখুন। আর একটু সময় দিন। দেখা যাক কি হয়।’
কথাটা বলেই মিশুর দিকে তাকালো মেঘালয়। মিশু একবার চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। চোখাচোখি হতেই মেঘালয় বুঝতে পারলো মেয়েটার মাঝে এখন কোনো আবেগ কাজ করছে না। চোখ দুটো পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিথর দেখাচ্ছে ওকে।
মিশু খাচ্ছেনা দেখে মেঘালয় বললো, ‘যত রাগ সব তোমার নিজের প্রতি। খাবারের সাথে রেগে লাভ কি বলো? খেয়ে নাও।’
মিশু কিছু বললো না। মেঘালয়ের কথাগুলো শুনতে অসহ্য লাগছে ওর। ছেলেটা কতক্ষণে চলে যাবে সেটাই ভাবছে মনেমনে। উটকো ঝামেলাটা বিদায় হলেই ভালো। বিয়ের ঝামেলাটা চুকে যাক, অতীতের সমস্তকিছু ভূলে যাওয়ার চেষ্টা করবে ও।
আনমনে ভাবতে ভাবতে খেয়ে নিলো মিশু। মেঘালয় ও খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। অনেক ধকল গেছে শরীরের উপর দিয়ে। ফ্রেশ একটা ঘুম দেয়া দরকার। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই সবকিছু ভূলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুম এসে গেলো সহজেই।
মিশু একবার কথা বলার জন্য মেঘালয়ের রুমে এসে দেখলো সে ঘুমাচ্ছে। কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। এরকম পরিস্থিতিতেও চোখেমুখে একটুও চিন্তার ছাপ পড়েনি। বরং নিশ্চিন্ত মনে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। অদ্ভুত একটা মানুষ বটে!
মিশুর শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে। জ্বর এসেছে প্রচণ্ড। নিজের রুমে এসে অনেক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুমাতে পারলো না। ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা গুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মগজে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। চিন্তা করতে করতে একসময় ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লো।
১৬.
চোখ মেলে দেখলো মেঘালয় বিছানার পাশে বসে আছে। মিশু কয়েকবার চোখ পিটপিট করে কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে এমন সময় মেঘালয় একটা থার্মোমিটার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। মিশু একেবারে হতভম্ব!
মেঘালয় জ্বর মেপে বললো, ‘শরীর অনেক খারাপ করেছে তোমার। চুপচাপ শুয়ে থাকো। বাবা ওষুধ আনতে গেছে, পেট ভরে ভাত খেয়ে ওষুধ খাবে।’
মিশু বেশ চমকালো। মেঘালয় কত সহজভাবে কথা বলছে যেন দুজনের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। কোনো সংকোচ নেই, কোনো চিন্তার রেখা নেই চেহারায়। কত সহজ, সাবলীল!
মেঘালয় একটু নিচু হয়ে বললো, ‘ব্লাড কি খুব বেশি আসছে?’
মিশু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। কি নির্লজ্জ লোকটা! এমনভাবে কথা বলার কি আছে? যেন মিশু ওর অনেক বছরের বউ। মিশুর গা জ্বালা করছে রীতিমত। অন্যদিকে অবাক ও লাগছে।
মেঘালয় বললো, ‘তুমি নাকি অনেক বড় হবে? বড় হওয়ার জন্য আগে তো সুস্থ থাকাটা জরুরি। যদি চিন্তাই করতে না পারো, তাহলে সামনে এগোবে কি করে?’
– ‘আপনি খুব উল্লাসী মুডে আছেন মনেহচ্ছে?’
– ‘আমিতো সবসময় ই এমন।’
– ‘বাসার জন্য মোটেও চিন্তা হচ্ছেনা? এত বড় একটা দূর্ঘটনার জন্য খারাপ ও লাগছে না?’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘খারাপ লাগলেও সেটা কেউ বুঝতে পারেনা। আর যত বাজে পরিস্থিতি ই তৈরি হোকনা কেন, আমার মনের শান্তি কোনোভাবেই নষ্ট করতে পারেনা।’
– ‘তাই নাকি?’
– ‘হ্যা। মানসিক অবস্থাকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছি, যেখানে দুঃখ কষ্ট পৌঁছাতে পারেনা। দুশ্চিন্তা কখনোই আমাকে কাবু করতে পারেনা।’
মিশু মুগ্ধ স্বরে বললো, ‘আপনি সত্যিই অন্যরকম একজন মানুষ। আমার ও ইচ্ছে করে আপনার মত হতে।’
– ‘সেজন্যই তো সবসময় আমার সাথে সাথে থাকা উচিৎ। যাতে আমার মত হতে পারো।’
মিশু মুখটা বিকৃত করে বললো, ‘কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাথে যাবো না।’
– ‘ওকে ফাইন। যেওনা। কিন্তু ডিভোর্স দিয়ে দেয়ার পর আমার মত হয়েও বা তোমার লাভ কি?’
– ‘চুপ করুন। আমি আপনার মত মানসিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত নই, আমার একটা ইমোশনাল মন আছে। আমার আবেগ নামে একটা খারাপ বস্তু আছে।’
– ‘সেটা আমার ও আছে। তবে আমার আবেগ, আমার মন, আমার সমস্তকিছু সবসময় আমার কথা শুনে চলে। সবকিছুকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করি। মানুষগুলো কতভাবে অপমান করলো, কিন্তু আমার মুখে চিন্তার ছাপ দেখেছিলে?’
– ‘আপনি বাসায় চলে যান তো প্লিজ। আপনার কথা, আপনার সমস্তকিছু আমাকে দ্রুত আকর্ষণ করে। চুম্বকের মত টানে আপনার দিকে।’
– ‘স্বামীর জন্য আকর্ষণ অনুভব করাটা তো ভালো দিক।’
– ‘আপনি হাসছেন কেন? খুব মজা লাগছে তাইনা? যান তো এই রুম থেকে, এক্ষুনি বেড়িয়ে যান।’
– ‘নাহ, আজকে থেকে আমি এই রুমেই থাকবো।’
-‘তাহলে আমিই ওই রুমে যাচ্ছি।’
– ‘আমিও ওই রুমে যাবো।’
মিশু রেগে বললো, ‘প্রচণ্ড বাজে লোক আপনি। আমাকে জব্দ করে মজা নিচ্ছেন না? দূর হোন তো আমার সামনে থেকে। আপনাকে একদমই দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।’
মেঘালয় হাসলো। উঠে পাশের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মিশু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও মেঘালয় উঠে যাওয়ার পর মনটা কেমন কেমন করতে লাগলো। ইচ্ছে করছিলো ও পাশেই বসে থাকুক। পরক্ষণেই মনটাকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলো। সম্পর্কটা আর এগোতে দিতে চায়না ও।
মেঘালয় রুমে গিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসছে। মিশুর ইনোসেন্ট স্বভাবটাকে অনেক ভালো লাগে ওর। আর যখন একটু তেজি ভাব দেখায়, ইচ্ছে করে গালটা আলতো করে টেনে দিতে। মেয়েটা বেশ কিউট আছে, আর অনেক দুরন্তপনাও আছে ওর মাঝে। ভার্সিটির মেয়েদেরকে পড়ানোর পর আজকে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করায় খুব হাসি পাচ্ছে মেঘালয়ের। মেঘালয় ভালো করেই জানে মিশুর মাঝে অনেক তেজ আছে, মেয়েটার সাথেই থাকতে ইচ্ছে করছে ওর। কিশোরী বউয়ের খুনসুটি গুলো উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মিশুর জেদ কবে কমবে কে জানে!
মেঘালয় মিতুকে ডেকে নিয়ে এসে বললো, ‘আচ্ছা শালীকা, বাসর ঘর সাজাবে না?’
মিতু অবাক হয়ে বললো, ‘সিরিয়াসলি!’
– ‘হুম। ভয় পাচ্ছো? যে মেয়েটার লাইফ নষ্ট করে দিয়ে ছেড়ে দিবো? আমি ওরকম নই।’
– ‘সেটা আমি জানি ভাইয়া। কিন্তু আপু তো বুঝতে চাইছে না।’
– ‘আমি তো আছিই, এত টেনশন করোনা। তুমি শুধু আজকে রাতে আমাদের দুজনকে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আমি সারাজীবনের জন্যই ওকে গ্রহণ করছি, তাহলে একটা সেকেন্ডও দূরে রেখে লাভ কি বলো?’
মিতু হেসে বললো, ‘ভাইয়া, আপনি যেমন ভালোমানুষ, তেমনি দুষ্টুও। টেনশন করবেন না, কাউকে বুঝতে না দিয়েই আমি বাসর ঘর রেডি করে ফেলবো।’
– ‘আমার মিষ্টি শালীকা রে। তোমার জন্য গিফট আছে।’
মিতু মুখ বেঁকিয়ে বললো, ‘আপনার কাছে এখন এই শার্ট প্যান্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। গিফট দেবেন কোথ থেকে? আপনি এখন ফতুর।’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘তা ঠিক বলেছো। আচ্ছা আমি চেঞ্জ করে কি পড়বো?’
– ‘নাহ। কিচ্ছু পড়তে হবেনা, বাসর রাত বলে কথা।’
মেঘালয় হা হয়ে বললো, ‘শালীকা রে,তুমিও তো কম না। দারুণ পাজি আছো।’
মিতু হেসে জবাব দিলো, ‘তা তো আছি ই। শুনলাম আপনার একগাদা হ্যান্ডসাম ফ্রেন্ড আছে? ওনাদেরকে আসতে বলুন না। আমাকে যতটা বাচ্চা ভাবছেন, আমি কিন্তু ততটা বাচ্চা নই। দ্রুত এসএমএস লিখতে পারি। হা হা হা।’
মেঘালয়ও হো হো করে হেসে উঠলো। মিতু ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘যাই, ফুল কিনে নিয়ে আসি।’
মেঘালয় হেসে ফেললো। তারপর পাশের রুমে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো মিশু কি করছে?
চলবে..