হৃদমোহিনী
পর্ব ২৩
মিশু মনি
.
২৭
সমুদ্র শান্ত হয়ে আছে, শিরশিরে বাতাসে ঢেউ এসে আচড়ে পড়ছে তীরে৷ চাঁদের মোহময় আলোয় চিকচিক করছে তীরের বালুগুলি। মাঝেমাঝে জোরে হাওয়া এসে বিশাল ঢেউ টেনে এনে তীরে ফেলছে৷ সামনে শুধুই মহাশূন্য! বিশাল শূন্যতায় ভরা আকাশটা নেমে গেছে সাগরে। এই সাগরের রূপের বর্ণনা বলে শেষ করা সম্ভব না। নীল জলে চাঁদের আলো পড়ে অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। আর তার তীরঘেষে দুজন সুখী মানুষ হেঁটে চলেছে।
বাতাসে উড়ছে মিশুর শ্যাম্পু করা চুল, ওড়নার একাংশ উড়ে মেঘালয়ের গায়ের উপর গিয়ে পড়ছে। মেঘালয় একহাতে মিশুর একটা হাত ধরে রেখেছে, পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে। সমুদ্রের নোনা জলে ভিজে যাচ্ছে পা আর ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে দুজনের হৃদয়! মিশু ক্রমশই এই অনিন্দ্য সুন্দর মানুষটার প্রতি দূর্বল হতে শুরু করেছে। আর এই মানুষটাও ভালোবেসে একদম বুকের ভেতর পুষে রাখতে চাইছে এই চঞ্চল পাখিটাকে।
মেঘালয় বললো, ‘সমুদ্র কত শান্ত হয়ে আছে তাইনা?’
মিশু মুগ্ধ হয়ে নানান আঁকিবুঁকি করছিলো আর চেয়েছিলো সমুদ্রের দিকে। এবার চমকে উঠে বললো, ‘সত্যিই অপূর্ব! সমুদ্র এত সুন্দর কেন মেঘ?’
– ‘তোমার কণ্ঠটা এত সুন্দর কেন?’
মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘আমার কণ্ঠ!’
মেঘালয় বললো, ‘তোমার কণ্ঠটা অনেক মিষ্টি, ঠান্ডা আর শীতল। কণ্ঠে অজস্র মায়ার কাব্য ঝরে, আবেগে মাখা গলা। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি। মধুর মত কানে বাজতেই থাকে। সমুদ্রটাও সেরকম শান্ত আর সুন্দর। তোমার কণ্ঠের মত।’
মিশু বিস্ময় লুকাতে না পেরে বললো, ‘সত্যিই! আপনি অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলেন! আমার কণ্ঠ এত সুন্দর?’
– ‘শান্ত সমুদ্রের মত।’
মিশু মুচকি হেসে তাকালো সমুদ্রের দিকে। ঢেউ এসে পায়ের উপর আচড়ে পড়ছে। পা ভিজিয়ে দিয়ে আবারও সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। চারিদিকে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় সমুদ্রকে এতটা লোভনীয় লাগে যে সত্যিই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে৷ আকাশটা একেবারেই ফাঁকা। জোৎস্নার কারণে নক্ষত্রগুলোকে চোখে পড়ছে না। বিশাল আকাশ ও প্রশস্ত সমুদ্র দেখে বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
মিশু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে লাগলো বিড়বিড় করে। মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। মিশু এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউ হাত দিয়ে ছুঁয়ে কয়েক ফোঁটা জল হাতে তুলে ছুঁড়ে মারলো সাগরে। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো, ‘তোমার কি দুঃখ আছে?’
মেঘালয় এগিয়ে গিয়ে মিশুকে ধরে বললো, ‘ঠিক আছো?’
মিশু বললো, ‘সমুদ্রের যেন অজানা একটা ভাষা আছে, কিছু বলতে চায় সে। উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে দেখো?’
মেঘালয় নিজেও তাকালো সমুদ্রের দিকে। মনে হতে লাগলো সত্যিই সমুদ্রের নিজের কোনো ভাষা আছে। কিছু বলতে চাইছে সে। এই ভাষা হয়ত তার বোঝার সাধ্য নেই, মিশু বুঝতে পারবে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, ‘সমুদ্র কি বলছে?’
– ‘বলছে মেঘালয়কে ছাড়িস না।’
– ‘সিরিয়াসলি?’
– ‘হুম। আর এটাও বলছে যে মেঘালয় অনেক বেশি দূর্লভ। এত সহজে ওকে পেয়ে গিয়ে তুচ্ছ করিস না।’
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, ‘ওকে। তুচ্ছ কোরোনা তাহলেই হবে। আকাশটা কিছু বলছে না?’
মিশু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেকবার সমুদ্রের দিকে তাকালো। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো কয়েকবার। বিশাল আকাশটা সমুদ্রে নেমে গেছে কেন? সমুদ্র কোথায় শেষ হয়েছে কেউ জানেনা? এত বিশাল সব শূন্য দেখলে যে বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। অস্থির লাগে, বড্ড অস্থির লাগে। বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যেতে যায়। প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে টানে মানুষকে, এখন ঠিক সেটাই হচ্ছে। সমুদ্রকে ভালোবেসে শুধু স্নান নয়, আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। মিশু নিচু হয়ে জল নিয়ে দুহাতে মুখে ছিটিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললো।
দুজনেই অনেক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে আবারো হাঁটা ধরলো। একজন মধ্যবয়স্ক পুলিশ দূর হতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো এই দুজন পাগল প্রকৃতিপ্রেমীকে!
২৮
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো তীরে। বালির উপরে ধপ করে বসে পড়লো মিশু। মেঘালয় ও পাশেই বসে রইলো। নিরাপত্তার ব্যাপারে কড়া গার্ড আছে। সৈকতে রাত্রিবেলাতেও কোনো সমস্যা হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এলাকাটা অনেক বেশি রিস্কি। পরিচিত পুলিশকে নজরে রাখতে বলায় ভয়হীনভাবে বসে থাকা যাচ্ছে। মিশু হঠাৎ জেদ ধরে বললো, ‘আসুন ওই ঝাউবনের দিকে যাই?’
মেঘালয় একবার বনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখন? আমারও যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু তোমাকে নিয়ে…’
– ‘খুব রিস্কি হয়ে যাবে?’
– ‘তা তো একটু হবেই। আচ্ছা আসো একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।’
মিশু লাফিয়ে উঠলো। মেঘালয়ের প্রতি ক্রমশই ভালোবাসা আর সম্মানটা বেড়েই যাচ্ছে ওর। দুজনে খালি পায়ে বালির উপরে পা ফেলে ফেলে উপরে উঠে এলো৷ পুলিশ আংকেলের কাছে এসে ভালোভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে মেঘালয় মিশুকে নিয়ে বালি ধরে হাঁটা শুরু করলো। মিশু মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে হাঁটছে আর পা দিয়ে বালি ছিটাচ্ছে। মেঘালয় বাঁধা দিচ্ছেনা। মেয়েটার অদ্ভুত পাগলামি গুলোকে ভালো লাগে ওর।
জোৎস্না গায়ে মাখতে মাখতে দুজনে হাঁটছে আর হাসছে। একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করছে আর ভাবছে অপর মানুষটা এত সুন্দর কেন! মিশু হঠাৎ মেঘালয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে সমুদ্রের তীরে চলে গেলো। তারপর শুয়ে পড়লো ধপ করে। মেঘালয় ও ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়লো মিশুর পাশেই।
সমুদ্রের ঢেউ এসে ছুঁয়ে গেলো দুজনকেই। চাঁদের আলোয় মরা মানুষের মত শুয়ে আছে দুজনে। দুজনেই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশের বিশালতা অনুভব করছে আর কানের কাছে বাজছে সমুদ্রের গর্জন। এরকম পাগলামি গুলো করতেও ভালো লাগছে। মিশুর সাথে সাথে আজ যেন মেঘালয়ের বয়সটাও অনেক কমে গেছে। নিজেকে কিশোর মনে হচ্ছে। দুহাতে গ্রহণ করছে এই পরিবেশটাকে।
বারবার সমুদ্রের ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেতে লাগলো। ঢেউ উত্তাল হতে শুরু করেছে, আর ঠান্ডাও লাগছে বেশ। ভেজা শরীরে উঠে পড়লো দুজনে। এক পলক মিশুর দিকে তাকিয়েই শরীরটা কেঁপে উঠলো মেঘালয়ের। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় মিশুকেও স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ভেজা চুল মুখের উপর লেপ্টে আছে, বালি লেগে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না, ঘোর লেগে যায়। ঝাউবনে যাওয়ার ভূতটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো মেঘালয়। একহাতে মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘চলো ফিরে যাই।’
মিশু মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘কেন? আমার খুব ভালো লাগছে। তোমার ভালো লাগছে না?’
মেঘালয় মুখটা এগিয়ে এনে বললো, ‘যখন সমুদ্রের চেয়েও এই সমুদ্রকন্যাকে বেশি ভালো লাগে তখন কি আর সমুদ্রের পাড়ে থাকতে ভালো লাগে?’
– ‘কিহ! তাহলে?’
– ‘কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’
মিশু মেঘালয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘উহু ছাড়ুন লোকজন দেখবে।’
– ‘এটা এমন একটা জায়গা যেখানে কেউ কাউকে দেখেনা। দেখলেও বলার কেউ নেই। তিস্তার পাড়ের গ্রাম এটা নয় মিশু।’
– ‘তো? সেজন্য এভাবে.. ছাড়ুন ছাড়ুন।’
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে একহাত ধরে ঘুরিয়ে অন্যপাশ করিয়ে নিয়ে মিশুকে পিছন দিক থেকে ধরে সমুদ্রের দিকে তাকালো। মিশু মেঘালয়ের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। বিশাল ঢেউ এসে একবার দোলা দিয়ে গেলো দুজনকে। হাঁটু অব্দি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। মেঘালয় মিশুর কানে কানে মুখটা এনে বললো, ‘শুনবে না আমার কথা?’
– ‘বলুন।’
মেঘালয় ফিসফিস করে বললো, ‘উহু, কথা হবে ঠোঁটের ভেতরে ঘুমের আদরে।’
মিশু লাজুক স্বরে বললো, ‘আপনি তীব্র রোমান্টিক একটা মানুষ সেটা কি জানেন?’
– ‘হ্যা জানি। আর আমি প্রচন্ড জেদিও।’
– ‘জানি, আমার চেয়ে ভালো কে জানে?’
– ‘বাব্বাহ! দুদিনেই আমাকে অনেক জেনে গেছো দেখছি।’
– ‘হুম, এই মুহুর্তে আমি আপনাকে সবচেয়ে বেশি জানি।’
– ‘তাই! মিশু দেখো চাঁদটাকে সমুদ্রের জলে কত সুন্দর দেখাচ্ছে?’
মিশু জলের দিকে তাকালো। বালির উপরে মৃদু পানির মাঝে চাঁদটাকে দেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সমুদ্র গর্জন করে তীরে ভেসে আসছে। মেঘালয় মিশুকে জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বিশাল ঢেউ এসে আরেকবার ভিজিয়ে দিলো দুজনকে! হিমশীতল জলের স্পর্শে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। তবুও ভালো লাগছে, একই সাথে জোৎস্না স্নান ও সমুদ্র স্নান। সমুদ্রের জলে জোৎস্নার আলোয় ভিজে যাওয়া, এক অন্যরকম অনুভূতি।
চলবে..
পোস্ট টাইম – ভোর ৫:০৫
৩রা ফেব্রুয়ারি রবিবার