হৃদমোহিনী
৩য় পর্ব
মিশু মনি
.
৪.
মেঘালয় দূর্দান্ত স্মার্ট একটা ছেলে। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি, ফর্সা প্রশস্ত দেহ। পেশিবহুল বাহু,আকর্ষণীয় ফিগার। ঘন দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে সুক্ষ্ম ভাঁজ আর মসৃণ চুলের নিচে প্রশস্ত সুন্দর কপালটা দেখলেই ভেতরে কাঁপুনি ধরে যায়। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, যথেষ্ট পিংক কালারের গোলাপির পাপড়ির মতন দুটো ঠোঁট। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগেই থাকে। সে হাসি মেয়েদের ভেতরে ঝড় তোলে। ভয়ংকর মায়াবী দুটো চোখ আর প্রাণবন্ত হাসি যেকোনো মেয়েকেই পাগল করার জন্য যথেষ্ট। তার হাঁটাচলা, প্রত্যেকটা শব্দের উচ্চারণ বুঝিয়ে দেয় “আমার কাছে এসো না, কারণ আমি সবার চেয়ে আলাদা।” মেঘালয়কে দেখে মিশুর এই কথাগুলোই মনে পড়ছে। কারণ বিপজ্জনক রকমের হ্যান্ডসাম এই ছেলেটার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে কাউকে গ্রাস করে ফেলতে ওর খুব বেশি সময় লাগবে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে এই কথাগুলোই ভাবছে মিশু। সায়ানের প্রশ্নে চমকে উঠলো।
-“এখন কেমন লাগছে?”
-“পাগল হওয়ার মতন।”
সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। খেয়াল করলো মিশু মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ হয়ে। মিশুর মগজে কি চলছে সেটা বুঝতে সময় লাগলো না ওর। মেয়েটি নিশ্চয়ই ভাবছে এই ছেলেটা “হিরো” হওয়ার সব ধরণের যোগ্যতাই রাখে। ঢালিউডে ওকে টেনে নিলে নিঃসন্দেহে ভালো করবে। কিন্তু ছেলেটির পারসোনালিটি অনুযায়ী তামিল নায়কের সাথে বেশ যায়। “বাহুবলি” টাইপ সিনেমা গুলোর জন্য একদম পারফেক্ট।
মিশু এখনো অপলক ভাবে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। আর মেঘ ও ওর চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না। সায়ান আবারো জিজ্ঞেস করলো, “কেমন ফিল হচ্ছে?”
-“খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
জিহ্বায় কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো সায়ান। সর্বনাশ করেছে। মেঘালয়কে নিয়ে কোথাও গেলে এই এক বিপদ, মেয়েদেরকে টোপ ফেলা বড়শির মত টেনে নেয়। মিশুর মাথাটাও গেছে বোধহয়। সায়ানের বুঝতে অসুবিধা না হলেও বাকিরা বুঝতে পারলো না কিছুই। কারণ সবাই নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে ব্যস্ত। মেঘালয় এখনো মিশুর চোখ থেকে চোখ সরায় নি। আবারো মেয়েটাকে হিপনোটাইজড করতে চাইছে কিনা কে জানে!
সায়ান মিশুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, “এই মেয়ে।”
মিশু চমকে উঠলো। সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “জ্বি।”
মিশুর চোখে ঘোর লেগে গেছে। সায়ান চোখ বড়বড় করে বললো, “এক্ষুনি আরেকটা থাপ্পড় খেতে চলেছিলে।”
মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন? আমি আবার কি করলাম?”
-“মেঘ তোমাকে আবারো সম্মোহন করলে সেটা কাটাতে একটা কষে থাপ্পড় বসাতো তোমার গালে।”
-“ও আচ্ছা। এজন্যই আমার একটু ঘোর ঘোর লাগছিলো।”
মিশু লাজুক ভঙ্গিতে হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। এখন শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ক্লান্তি আর শরীর খারাপ লাগা ভাবটা অনেক টাই কেটে গেছে। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে,নিজের অজান্তেই চোখ বারবার চলে যাচ্ছে এই জেন্টলম্যানের দিকে। কি পরিমাণ হ্যান্ডসাম ভাবলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়! যেমন সুন্দর, তেমনি স্মার্ট। ওর বোনের মত দেখতে মেয়েটাও কম না। দারুণ স্মার্ট আর বেশ সুশ্রী!
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা কি ভাইবোন?”
মেঘালয় উত্তর দেয়ার আগেই সায়ান জবাব দিলো, “হ্যা। এখানে আমরা সবাই ভাইবোনের মতন। তবে ওরা দুজন নিজের ভাইবোন। ওর নাম মৌনি। মৌনতা আহমেদ থেকে শর্ট করে মৌনি।
-“মৌন বললেই হতো। মৌনি কেন?”
-“মৌন একটু মেল মেল লাগে, মৌনিটা ফিমেল। অবশ্য মৌনির মাঝে নারী স্বভাব কমই দেখি। ও একটা ডেঞ্জারাস জিনিস। পাক্কা ছেলে ছেলে লাগে।”
মৌনি হেসে বললো, “থ্যাংকস ফর ইয়োর লেফট হ্যান্ডেড কমপ্লিমেন্ট।”
সায়ান জবাব দিলো, “লেফট হ্যান্ডেড বলো আর রাইট হ্যান্ডেড ই বলো। তুমি যে মেয়েটা সাংঘাতিক সেটা মানতেই হবে। তোমার মত বাঘিনী টাইপের মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি জীবনে।”
-“তা দেখবা কোথ থেকে? তোমার জীবনের দৈর্ঘ্য আর কতই হবে? এইটুকুন জীবনে এরকম বাঘিনী একটাই দেখার কথা।”
-“রানী এলিজাবেথ।”
-“আমাকে নিয়ে কোনো কমপ্লিমেন্ট করার আগে দেরশবার ভেবে তারপর মুখ ফোটাবা মিস্টার সায়ান চৌধুরী।”
-“ওকে ওকে, তোমার সাথে কথা বলতে ভয় লাগে। আর কথাই বলবো না।”
মিশু চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলো। আর ভাবছিলো, মৌনতার কথাবার্তা আর উচ্চারণ শুনলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।ওর স্লিম ফিগারের সাথে হেয়ার স্টাইলটা একদম মানিয়ে গেছে। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? এদের তিনজন মেয়ের মধ্যে রোদ সবচেয়ে সাধারণ ধাচের। আর দুপুর একটু দেমাগি আর স্টাইলিশ। রোদ আর দুপুর চাচাতো বোন, রোদ বয়সে একটু বড় হলেও দুপুরের দাপট রোদের চেয়েও বেশি। রোদ খুব শান্তশিষ্ট আর মিশুক ধরণের। দুপুরকে দেখেই বোঝা যায় মেয়েটা একটু হিংসুটে।
দুপুর, পূর্ব ও আরাফ কিছু একটা নিয়ে গল্প করছে। একটু পরপর হেসে উঠছে শব্দ করে। এখন পূর্ব কথা বলছে হাত নেড়ে নেড়ে। ওর কথা শোনার জন্য কান খাড়া করে সেদিকে তাকালো মিশু।
পূর্ব বললো, “আমি রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখি আমার বিছানাটা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে বিছানার একটা পা টেনে ধরলাম। তারপরও বিছানা থামলো না। সে আমাকে সুদ্ধ জানালা দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেলো।”
দুপুর বললো, “বিছানার কি পাংখা গজিয়েছে? আজাইরা গল্প শোনাইতে আইছো মিয়া?”
পূর্ব বললো, “এতে এত অবাক হওয়ার কিছু নাই। বিছানা আমার বউয়ের নাম ওকে?”
কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো সবাই। মিশুর ও হাসি পেলো। ছেলেগুলো দারুণ পাজি তো। দুপুর ক্ষেপে গেলেও এখন হাসছে।
মাঝখান থেকে মৌনি বলে উঠলো, “আমার গল্পটা শোন। একবার আমার বাসায় একটা মাস্তান ছেলে এলো। তো ছেলেটা এসেই আমার হাতে পায়ে ধরে বললো, বইন রাতটা একটু থাকতে দিবেন? আমারে পুলিশ তাড়া করছে। তো ওর কথামত আমি থাকতে দিলাম ওরে। আমার ঘরে একটা মাত্র বিছানা। ওরে শর্ত দিলাম, এক বিছানায় দুজনে ঘুমাবো। মাঝখানে একটা কোলবালিশ থাকবে। কোলবালিশ টপকানো যাবেনা। মাস্তান এই শর্তে রাজি হয়ে এক বিছানায় ঘুমালাম। সে একচুলও বালিশ টপকায় নাই, ভদ্রমতন ঘুমিয়ে সকালে চলে যাওয়ার সময় বলল,বইন অনেক ধন্যবাদ তোমারে। কখনো কোনো বিপদে পড়লে ডাইকো। আমি বললাম, তুমি কি বিপদ থেকে রক্ষা করবা? সারারাতে একটা কোলবালিশ ই টপকাইতে পারলা না।”
সবাই আবারো হেসে উঠলো। পূর্ব বললো, “তুই চাইছিলি মাস্তান কোলবালিশ টপকাক তাই তো?”
-“মাস্তান কোলবালিশ টপকাইতে পারেনাই তাহলে ওর পাওয়ার কেমন বোঝাই যায়।”
সায়ান বললো, “আমি হলে শুধু কোলবালিশ? ইন্ডিয়া বাংলাদেশ বর্ডার ও টপকাইতে পারতাম। আসলে মাস্তান ভালো ছিলো, সে শুধু মাস্তানিই করে আর কিছুতে মন দেয়না। ভদ্র লক্ষী মাস্তান।”
মৌনি বললো, “বললেই হলো? লক্ষী মাস্তান সে, যে সবক্ষেত্রে মাস্তানি খাটাতে পারে। যে একটা কোলবালিশ টপকাইতে পারেনা সে আবার কেমন মাস্তান?”
-“মাস্তান কোলবালিশ টপকালে বুঝি খুব ভালো হতো? তুই তো সাংঘাতিক মেয়ে মাইরি।”
-“দ্যাখ,এটা একটা জোক্স।”
আরাফ এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। এবার সে বললো, “কপি ক্যাট। এটা আমি মিরাক্কেলে শুনছিলাম। কপি করা জোকস বলিস ক্যান? তোর মাথায় কিছু নাই?”
মৌনি ক্ষেপে বললো, “আমার মাথায় তোদের মাথার চেয়েও অনেক মূল্যবান জিনিস আছে।”
-“তাই নাকি? কি আছে তোর মাথায়?”
-“কি আবার? গোবর।”
সবাই আবারো হাসি শুরু করে দিলো। মিশু হা করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। সবাই খুব পাজি, সেই তখন থেকেই এরকম ইয়ার্কি করেই যাচ্ছে। হাসি থামছে না কিছুতেই। মেঘালয় ওর সামনের সিটে বসেছে, দুজনে মুখোমুখি হয়ে বসার কারণে না চাইলেও মাঝেমাঝে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই ছেলেটা ইশারায় মিশুকে বোঝাচ্ছে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে। মিশুও মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে সহজ হতে।
সায়ান মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি একটা গল্প শোনাও না কেন? এবার তোমার পালা।”
মিশু চমকে উঠে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। মেঘালয় ইশারায় বললো, “শোনাও।”
মিশু লাজুক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বললো, “আমি হাসির গল্প বলতে পারিনা।”
সায়ান আফসোস করে বললো, “আহারে! এত সুন্দর বাচ্চাটা হাসির গল্প বলতে পারেনা! কি দুক্ষ গো।”
মিশু কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এ অবস্থায় মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হতে চাইছে না। বারবার গতকাল দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আর কেবলই মনেহচ্ছে মনের উপর কেউ পর্দা টেনে দিয়েছে। মাথার ভেতর একটা ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। মনেহয় মস্তিষ্কের একটা নিউরনের কাজ হচ্ছে সর্বক্ষণ তন্ময়কে নিয়ে ভাবা। সহজ হওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারছে না। মেঘালয় মেয়েটার সমস্যাটা বুঝতে পেরে বললো, “আচ্ছা আমরা সবাই মিলে একটা গান ধরতে পারিনা?”
পূর্ব লাফ দিয়ে নেমে একটু এগিয়ে এসে বললো, “আমি মিউজিকে থাকবো। আমি ঢোল আর মিশু ঝুনঝুনি।”
ঝুনঝুনি শব্দটা শুনেই হাসি পেলো মিশুর। ঝুনঝুনি! ইস কত মিষ্টি একটা শব্দ। এত সুন্দর একটা শব্দে কারো নাম হতে পারেনা? স্ত্রী আদর করে স্বামীকে ডাকবে, এই ঝুনঝুনির আব্বু শুনছো? কত মধুর লাগবে শুনতে! টুনটুনি অনেকের ই নাম হয়,তাহলে ঝুনঝুনিও হওয়া উচিৎ। এবার কারো বাচ্চা হতে দেখলে মিশু তার নাম রাখবে ঝুনঝুনি।
মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা গান শুরু করে দিয়েছে। অনেক্ষণভরা গান ও হাততালি চললো। গান শুনতে শুনতে আর ওদের সাথে যোগ দিয়ে মিশুর মনটা একদম ভালো হয়ে গেছে। মেঘালয় হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব স্টেশন”। মিশু ব্রীজ দেখবে নাকি?”
সবাই একবার তাকালো ওদের দিকে। দুপুর ভ্রু কুচকালো। মেয়েটির সাথে খুব দ্রুত মেঘের ভাব হয়ে গেছে দেখছি। মেঘালয় এমনিতেও সবার সাথে অনেক মিশুক। কিন্তু এখন একটু বেশিই ক্লোজ হয়ে গেছে মনেহচ্ছে। মেয়েটিকে কোলে নিয়ে হাঁটলো, তুলে খাওয়ালো, সিএনজিতেও বুকে চেপে ধরে ছিলো, আবার ট্রেনেও। দারুণ মাখামাখি চলছে তবে, মেঘ কি ইমপ্রেসড এই বাচ্চা মেয়েটির প্রতি? ওর ইমপ্রেসড করানোর মত আছেটা কি? আজব তোহ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরে মিশুর দিকে চেয়ে আছে দুপুর। এমনটা নাও হতে পারে। একবার এক মৃতুশয্যাশায়ী মেয়েকে কোলে নিয়ে ঢাবির গণতন্ত্র তোরণের সামনে থেকে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি নিয়ে গিয়েছিলো। মেঘকে এত সহজে সন্দেহ করাও ঠিকনা। মাথাটা ঝেড়ে ফেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দুপুর।
মিশু নামের মেয়েটি মেঘালয়ের সাথে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
বাইরে এসে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কিসে পড়ছো তুমি?”
-“এইতো সবেমাত্র ইন্টার মিডিয়েট পাশ করলাম।”
-“এ বছরেই?”
-“হ্যা। এখন ভার্সিটির প্রস্তুতি নিচ্ছি। ”
-“বেশ ভালো। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে?”
-“সমস্যা হলে কি কোলে তুলে নেবেন?”
চমকে মিশুর চোখের দিকে তাকালো মেঘালয়। মেঘের মুখটা গোল হয়ে ‘০’ এর মত হয়ে আছে। ভ্রু দুটো উপরে উঠে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে। মেঘালয়ের কপালের এই ভাঁজটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে!
মেঘালয় হেসে বললো, “চলতে পারলে নেবো না। হাঁটার শক্তি না থাকলে সেটা প্রয়োজন । কিন্তু শক্তি থাকার পরও করতে চাইলে সেটা বিলাসিতা।”
মিশু হেসে বললো, “আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।”
-“ধন্যবাদ”
মেঘালয় আর কিছু বললো না। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে মিশুর হাত ধরলো। মিশু ওর হাত শক্ত করে ধরে দরজায় এসে দাঁড়ালো। একটা অন্যরকম শক্তি আর ভরসা পাচ্ছে ভেতরে। কেবলই মনেহচ্ছে কতটা নিরাপদ এই হাত! একটা মেয়ে বাবার বুকে যতটা নিরাপদ, এখনো ঠিক সেরকমই অনুভূত হচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে লাগলো ওরা। জোরে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে গায়ে। মিশুর চুল এলোমেলো ভাবে উড়তে শুরু করেছে। চুল উড়ে মেঘালয়ের মুখের উপর গিয়ে পড়ছে। মেঘালয় সরালো না,ওর চুলের স্মেলটাকে দারুণ ভাবে ফিল করতে লাগলো। এত সুন্দর ঘ্রাণ কেন চুলের! কোনো শ্যাম্পু কিংবা তেলের নয়, এ ঘ্রাণ যেন প্রকৃতির পরম আদরে গড়ে দেয়া। গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে করছে একদম। মেঘালয় চোখ বন্ধ করে চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। মিশু ওর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলো। চোখের পাপড়ি গুলো কত ঘন আর সুন্দর, ঠোঁট আর থুতনির উপর চুল গিয়ে পড়েছে। এমন চোখ বুজে আছে কেন সে?
মেঘালয় চোখ মেলতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলো মিশু। এত কাছ থেকে কারো চোখ কখনো দেখেনি ও। হ্যা, একবার দেখেছিলো কিন্তু সেটা এই মেঘালয়ের ই। গতরাতে ওকে সম্মোহন করার আগে মেঘালয় এরকম প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো! ভয়ংকর সুন্দর সে দৃষ্টি। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, ঘোর লেগে যায়। মিশু তাকালো বাইরের দিকে।
ট্রেন যমুনা ব্রীজের উপর উঠেছে। ট্রেন থেকে নিচের দিকে তাকালে মনেহয় বুঝি শূন্যে ভেসে চলেছি পানির উপর দিয়ে। কত প্রবল ঢেউ, মাঝেমাঝে শান্ত হয়ে পানির স্রোত বইছে। কাঁদার মত ঘোলাটে জল গুলো দেখলে বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এই দিকটায় রেলিং বলতে গেলে নেই। চিকন একটা লোহার রেলিং দেয়া। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠছে শুধু। নিচের দিকে তাকালেই মনেহয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে নিয়ে এসে ব্রীজের রাস্তার দিকের দরজায় দাঁড়ালো। কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। সব কেবিনের দরজা লাগানো। ফাঁকা ট্রেনের কোথাও কেউ নেই, শুধুই মেঘ মিশু। মনেহচ্ছে পুরো ট্রেন জুড়ে বুঝি কেউ নেই,শুধুই ওরা দুজন। ট্রেনে অনেক সিট থাকবে, অনেক যাত্রী থাকবে তবেই না ট্রেন মনেহয়। এখানে শুধু ছোট ছোট রুমের মত খুপরি সাইজের কেবিন, প্রত্যেকটা দরজা লাগানো। বাইরে কেউ নেই। শীতল বাতাসে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে মিশু।
মেঘালয় ওর হাত ধরে রেখেছে। পরস্পর হাত ধরাধরি করে দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ট্রেন চলছে খুবই ধীরগতিতে। রাস্তায় পা ফেলা যাবে এরকম মনেহচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে সেতুটাকে। ট্রেনের কাছ দিয়েই রাস্তায় বাস ট্রাক চলে যাচ্ছে হুশ করে। বাসের জানালা দিয়ে অনেক যাত্রী তাকিয়ে থেকে সেতু দেখছে। মিশু উৎফুল্ল হয়ে উঠছে ক্রমশই। পুরো ব্রিজ পার হতে অনেক সময় লেগে গেলো। কেউ কোনো কথা বললো না। ব্রিজ পার হওয়ার পরও একে অপরের হাত ধরেই রইলো দরজায়। মিশু কিছুক্ষণের জন্য ভূলে গিয়েছিলো তন্ময়ের কথা। আবারো হুট করেই মনে পড়ে গেলো। অসহ্য একটা যন্ত্রণা দিয়ে গেছে ছেলেটা,প্রতি মুহুর্তে দহন করতেই থাকে।
মিশু একটু পিছিয়ে আসতেই হাতে টান পড়লো। মেঘালয় ওর দিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দিলো। ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
মিশু “কিছু না” বলে মাথা নাড়লো। মেঘালয় বুঝতে পেরেছে ওর সমস্যাটা। নিশ্চয়ই কিছু একটা নিয়ে খুব ডিপ্রেশনে ভুগছে। এটা কাটিয়ে দিতে পারতো যদি! একটু নিশ্চুপ থেকে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। এরকম ফুটফুটে একটা মেয়ে এমন মনমরা হয়ে থাকবে সেটা কেমন দেখায়। ওর ডিপ্রেশন কাটানোর একটা উপায় বের করতে হবে। বাঁকা চোখে মেঘালয় তাকালো মিশুর দিকে। ট্রেন “বঙ্গবন্ধু সেতু”র পর যে স্টেশন সেখানে এসে দাঁড়ালো। মিশু মেঘালয়কে বললো, “একটা চিপস এনে দেবেন?”
-“এখানে এতরাতে দোকানপাট…. আচ্ছা যাচ্ছি। তুমি দরজা থেকে একটু ভিতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি দৌড়ে গিয়ে চিপস নিয়েই আসছি।”
-“আচ্ছা। মিস্টার টুইস্ট আনবেন।”
মেঘালয় লাফ দিয়ে নেমে স্টেশনের দিকে যেতে লাগলো। ট্রেনের পিছনের দিকের বগিতে থাকার কারণে স্টেশনের অনেক পিছনে পড়ে গেছে ট্রেনের বগিটা। মেঘালয় দ্রুত ছুটছে প্লাটফর্মের দিকে। মিশু দরজায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে সেদিকে।
অনেক্ষণ কেটে গেলো মেঘালয়কে দেখা যাচ্ছেনা। মিশু মাথা বাড়িয়ে উৎসুক চোখে চেয়ে আছে প্লাটফির্মের দিকে। মেঘালয় কই? অনেক্ষণ তো হয়েই গেলো। ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে। এখনো তো এলোনা মেঘ। মিশু নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। ট্রেন তো প্রায় জোরেই চলতে আরম্ভ করেছে উনি তো এখনো এলোনা। কি হলো ওনার! টেনশন হচ্ছে।
ওদের বগিটা প্লাটফর্ম বরাবর আসার পরও মিশু মেঘালয়কে দেখতে পেলোনা। প্লাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন প্রায় বেড়িয়ে যাচ্ছে,অথচ লোকটা এলোনা। নাকি ভূলেই অন্য বগিতে উঠে পড়েছে? কিন্তু ছেলেটাকে মিশু দেখতেই পায়নি আর। কোনো বিপদ হলো না তো? বুকটা ছ্যাত করে উঠলো মিশুর।
এমন সময় দেখলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেড়িয়ে আসছে মেঘালয়। এখনো অনেক দূরে। পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে কিন্তু এভাবে হাঁটলে তো আর ট্রেন ধরতেই পারবে না। এই অবস্থায় ট্রেনে উঠতেও পারবে না। পায়ে কিছু একটা হয়েছে বোধহয়। এদিকে ট্রেন তো স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে প্রায়। ওনাকে ফেলেই চলে যাবো!
বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠলো মিশুর। পিছনে তাকিয়ে ট্রেনের শিকল খুঁজতে লাগলো। দেখতেও পাচ্ছেনা। দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো ও। আরে ট্রেন চলে গেলে ছেলেটা একা একা কি করবে এখানে? তার উপর পায়ে আঘাত পেয়েছে। যে মানুষটা ওর এত সেবা করে অনেকটা সুস্থ করে তুললো,রক্তমাখা অবস্থায় কোলে নিয়ে রাস্তায় হাঁটলো, তাকে এভাবে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা কি ঠিক?
আর কোনোকিছু না ভেবেই মিশু লাফিয়ে পড়লো ট্রেন থেকে। স্টেশনের পাকা শানের উপর পড়ে জোরে আঘাত পেয়ে ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো। দূর থেকে মেঘালয় দেখতে পেয়ে একদম থ! এটা কি করলে মিশু? যদি লাইনে পড়ে যেতো তাহলে কি হতো? এভাবে কেউ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দেয়! নিজেও হাঁটতে পারছে না, খুবই কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে মিশুর দিকে এগোতে লাগলো।
একদিকে মাঝরাত, আরেকদিকে ট্রেন ওদেরকে যমুনার পাশে ফেলেই চলে গেলো।
চলবে..