হৃদমোহিনী পর্ব ৩০

0
2775

হৃদমোহিনী
পর্ব ৩০
মিশু মনি
.
৪১
আকাশ আহমেদ ব্যক্তিগত ভাবে মিশুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। কথাটা শুনেই হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে মিশুর। শ্বশুরমশাইয়ের সাথে এখনো একবারও কথা হয়নি ওর। কি যে বলবেন ধারণা করা যাচ্ছেনা।

মানুষটা অনেক গম্ভীর হয়ে আছেন। সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে মিশু ওনার বেডের কাছাকাছি এগিয়ে আসলো। মেঘালয়ও মিশুর পাশে এসে দাঁড়ালো। আকাশ আহমেদ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোকে কি আলাদা করে যেতে বলবো?’

মেঘালয় মিশুর আরো কাছাকাছি এসে বললো, ‘আমি সবসময় এই মেয়েটার পাশে থাকতে চাই। তুমি কি বলবে জানিনা, কিন্তু যাই বলবে দুজনকেই বলো। কারণ আমরা অপরাধী হলে দুজনেরই সমান অপরাধ।’

বাবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুদিনেই এত প্রেম?’
– ‘প্রেম তো বটেই। প্রেমের চেয়েও বড় আমার দায়িত্ববোধ। মেয়েটার এখানে কেউ নেই আমি ছাড়া। আমি ওকে এনেছি, আমিই ওর সবকিছুতে থাকবো।’

বাবা হেসে ফেলে বললেন, ‘যাক। ছেলেটা মানুষ হলো তবে? যেখানে আজকালকার ছেলেরা মাইয়া রে মাইয়া রে তুই অপরাধী গান গায়। হা হা হা।’

বাবাকে হাসতে দেখে চমকে উঠলো মিশু। মিশু ও মেঘালয় একে অপরের দিকে তাকালো অবাক হয়ে। বাবা হেসেছে! তারমানে কাম হোয়াগা। মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তাকালো।

মেঘালয় বললো, ‘কি বলতে চাও আব্বু?’
– ‘যা বলার তুই তো বলেই দিলি। আমি আর কি বলবো?’
– ‘তোমার কি নেগেটিভ কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো?’
– ‘তা নয়। আমি জানতে চাই এই বাচ্চার এইম কি? এখনি কি সংসার শুরু করতে চায়?’

মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তাকালো। প্রশ্নের অর্থ বুঝতে না পেরে অবাক হয়েই চেয়ে রইলো। আকাশ আহমেদ বললেন, ‘ব্যাপারটা যেহেতু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে কাজেই বিয়েটা ধুমধাম করেই আয়োজন করা উচিৎ। কিন্তু ওর তো এখনো কৈশোরই কাটেনি, এত তাড়াতাড়ি কি সংসারে মন বসবে? যেকোনো মেয়ের জন্যই অন্তত বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে নিজের মত থাকতে দেয়া উচিৎ। জগতের বড় বড় বিস্ময়গুলো দেখে ফেলা উচিৎ। তারপর না সংসার। সুখী হওয়ার গোপন রহস্য হচ্ছে জগতের সব বড় বড় বিস্ময় দেখে ফেলা।’

মিশুর চোখেমুখে মুগ্ধতা। শ্বশুরমশাই দারুণ কথা বলেছেন তো!
আকাশ আহমেদ বললেন, ‘কি রে মেয়ে, অবাক হচ্ছিস?’

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হুম।’

আকাশ আহমেদ এবার শব্দ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার কাছে জীবন একটা উপভোগ্যকর জিনিস। একটা ছেলে জেনারালি সাতাশ আটাশ বছর বয়স পর্যন্ত লাইফটাকে নিজের মত এনজয় করতে পারে। সেখানে একটা মেয়ে ষোল বছরে পা দিলেই আমরা ভাবি মেয়ে বড় হয়ে গেছে। সতের হতেই বিয়ের চিন্তা করি, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে করতেই বিয়ে দিই। একটা মেয়ে ইন্টার পাশ করার পর মাত্র জীবনকে বুঝতে শেখে। তাকে অন্তত কয়েকটা দিন নিজের জীবনটাকে উপভোগ করতে দেয়া উচিৎ তাইনা? বিয়ে তো একদিন দিতেই হবে। দু এক বছর সে থাকুক না তার মত। বই পড়ুক, ট্রাভেল করুক, গ্রাজুয়েট হোক, চাকরি নিক, দুটো দিন আয়েশ করে নিজের টাকায় শপিং টপিং করুক। ঘোরাফেরা করুক, তারপর বিয়ে দিলে ক্ষতি কি?’

মেঘালয় বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে বললো, ‘স্যালুট ইউ আব্বু।সব বাবারা যদি তোমার মত ভাবতো।’
– ‘আহা, সব বাবাকে আমার সাথে কম্পেয়ার করছিস কেন? সব বাবারা বলবে, মেয়েকে ঘরে বন্দি করে রাখো। এত কিসের ঘোরাঘুরি? বিয়ে হলে জামাইয়ের সাথে ঘুরবে। আমি তো সবার থেকে আলাদা। হা হা হা।’

মেঘালয় ও মিশুও হেসে উঠলো বাবার কথা শুনে। মিশু নিঃসংকোচে বললো, ‘সত্যিই আপনি আলাদা।’
– ‘আমি কি তোর আংকেল?’

মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো। আকাশ আহমেদ বললেন, ‘বাক্যের শেষে বাবা শব্দটা যোগ করিস না কেন?’

মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘আমি তো আপনাকে বাবা বলবো না, আমিও আব্বু বলে ডাকবো।’
– ‘তোর আম্মু আবার মাইন্ড করবে না তো? হা হা হা।’

মেঘালয় ও মিশু মুখ টিপে হাসলো। হাসপাতালের বেডে শুয়েও মানুষটা কি সুন্দর করে হাসছে! এরকম হাসি দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে করে মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতেই থাকি।

মিশু বললো, ‘আপনি অনেক ভালো বাবা।’
– ‘বাবারা সবসময় ভালোই হয় রে মা। প্রত্যেক মেয়ের কাছেই তার বাবা রাজকন্যা। সরি ভূল বললাম। প্রত্যেক বাবার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা। হা হা হা।’

দুজনেই হেসে উঠলো। বাবা হাসি থামিয়ে বললেন, ‘হাসি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ। এজন্য বেশি বেশি হাসবা। হাসতে হাসতে আজকে হার্টের বাপের নামও ভূলিয়ে দিবো। সে যে এটাক হয়েছিলো সেটাও ভূলে যাবে।’

মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘আমি প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম। এখন অনেক হালকা লাগছে।’
– ‘তুই তো এমনিতেও হালকা। নয়ত কি আর মেঘালয় কোলে নিয়ে ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটতে পারে? হা হা হা, হো হো হো।’

মিশু লজ্জা পেয়ে হাসলো। সাংঘাতিক রকমের রসিক মানুষ তো! অথচ কি ভয় টাই না পেয়েছিলো মিশু। মেঘালয় আরেকবার মিশুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো। আকাশ আহমেদ মিশুকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাসায় কে কে আছে?’
– ‘আব্বু আম্মু আর ছোটবোন।’
– ‘তোর কয়টা আব্বু? ও হো হো হো।’

মিশুও না হেসে পারলো না। হাসি থামিয়ে বললো, ‘আপনি অনেক দুষ্টু।’
– ‘আরে মা হার্টের বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছি হেসেহেসে। হাসলে হার্ট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। তুই কি একটা গল্প শুনিস নি?’
– ‘কি গল্প আব্বু?’

আকাশ আহমেদ বললেন, ‘এক লোক মৃত্যুশয্যায় চলে গিয়েছিলো। সবাই ধরে নিয়েছিলো সে আর বাঁচবে না। কিন্তু তার মনোবল ছিলো অনেক বেশি। সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে একটা বাড়িতে চলে গেলো। জগতের সবচেয়ে হাসির হাসির গল্প, কমেডি মুভি দেখে প্রচুর হাসতে লাগলো। দিনের অধিকাংশ সময়েই সে হাসতে হাসতে এক সময় সুস্থ হয়ে গেলো। মনোবলের সাথে হাস্যরস খুব কাজে দেয় বুঝলি?’

মিশু মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘সত্যি! তারপর সে বেঁচে গেলো?’
– ‘তাহলে কি সুস্থ হয়ে মরে গেলো নাকি? হা হা হা।’

মিশু ও মেঘালয় দুজনেই হেসে উঠলো। হাসি থামার পর বাবা বললেন, ‘তো ইয়াং ম্যান, হানিমুন কেমন হলো?’

মিশু লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। মেঘালয় বললো, ‘একদমই ভালো না। আরেকবার হানিমুনে যাবো।’
– ‘টাকা কি তোর বাপে দেবে?’
– ‘বাপ ছাড়া আর কে দেবে?’
– ‘বাপের টাকায় হানিমুন করতে লজ্জা করেনা? কাল থেকে অফিসে বসবি।’
– ‘ঠিকাছে। তাহলে আজকেই হানিমুন সেরে আসি?’
– ‘হা হা হা। বাপের সাথে ইয়ার্কি করো ব্যাটা?’
– ‘বাপকা ব্যাটা বলে একটা কথা আছে না?’

আকাশ আহমেদ হেসে বললেন, ‘আমি আজকেই বাসায় যেতে চাই। আর মিশুর বাপকেও আজকে চলে আসতে বলো। সবকিছু ফাইনাল কথা বলতে চাই। উনি এসে মিশুকে নিয়ে যাবেন।’

মেঘালয় ও মিশু একে অপরের দিকে তাকালো। বুকটা ধক করে উঠলো মিশুর। নিয়ে যাবেন মানে! হঠাৎ এই কথা কেন বললেন বাবা? মুখটা করুণ করে তাকিয়ে রইলো মিশু।

বাবা বললেন, ‘আরে তোমরা এমন প্যাঁচার মত মুখ করে আছো কেন? মিশুর বাবা এসে বিয়ের তারিখ ফাইনাল করে যাবেন। আর আমরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে রংপুর থেকে আয়োজন করে নতুন বউ নিয়ে আসবো।’

হাসি ফুটে উঠলো মেঘালয় ও মিশুর মুখে। মেঘালয় মুচকি হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি একটা ভালোবাসা। তাড়াতাড়ি বাসায় চলো তো।’
– ‘ওকে যাচ্ছি এবার বলতো অয়ন্তিকা মেয়েটার কি হবে?’
– ‘ও নাহয় অপরাধী গান গাইবে।’

বাবা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন রে? গোপনে কিছু করেছিস নাকি?’
– ‘আব্বুউউউ…’

হেসে উঠলেন বাবা। মিশুও হাসলো। বাবা ওঠার চেষ্টা করে বললেন, ‘একটু ওয়াশরুমে যাবো।’

মেঘালয় বাবাকে ধরে উঠিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু কেন? পুরোটাই যাও।’
– ‘হা হা, আমি একাই পারবো।’

তবুও মেঘালয় হাত দিয়ে ধরে বাবাকে উঠতে সাহায্য করলো। বেড থেকে নামিয়ে বাথরুমের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাবা বলে দিলেন উনি একাই যেতে পারবেন। বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মেঘালয় মিশুর কাছে এসে বললো, ‘দারুণ একটা বাবা না আমার?’

বাবা বাথরুমে যেতে যেতে বললেন, ‘দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিস বাবা।’

বলেই হেসে উঠলেন। মিশু লজ্জা পেয়ে মেঘালয়কে বললো, ‘এত দুষ্টু কেন উনি?’
– ‘আমার বাবা তো। কিংবা আমিই বাবার জিন পেয়ে এতটা দুষ্টু হয়েছি।’

কথাটা বলতে বলতে মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘কি পরিমাণ টেনশনে কাটিয়েছি এই দুটো দিন। আজকে রাতে কিন্তু রেডি থেকো মিস ফুল্টুসি।’
– ‘আব্বু এলে তো আমাকে নিয়ে যাবে। কতদিন লাগবে বিয়ের প্রোগ্রাম এরেঞ্জমেন্ট করতে?’
– ‘দশদিন তো লাগবেই। দশটা দিন দূরে থাকবো! ফোনে ফোনে প্রেম করতে হবে। এতদূর তো হুট করে চলে যেতেও পারবো না।’
– ‘এই ছাড়ো, আব্বু চলে আসবে।’
– ‘ঠিকাছে, এখন ছাড়ছি। কিন্তু কি বলেছি মনে থাকে যেন। আজকে তোমার খবর ই আছে।’

মিশু শিউরে উঠে বললো, ‘ছাড়ো তো।’

মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্র ছেলের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বড্ড সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। এত এত দুশ্চিন্তার পর সুখের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েটার জীবনে একটার পর একটা দূর্ভোগ, এখন যদি একটু সুখের মুখ দেখে। মিশুকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হিসেবে দেখতে চায় মেঘালয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here