হৃদমোহিনী
পর্ব ৩২
মিশু মনি
.
৪৪
হঠাৎ করেই বাবা মায়ের মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারছে না তন্ময়। মিশুকে যেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলো, সেদিন রাতেই বাবা মা ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে রোড এক্সিডেন্টে দুজনের মৃত্যু। তিন/চারদিন প্রচণ্ড মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো তন্ময়। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিলো ওর। মিশুর সাথে প্রতারণা করার ফলশ্রুতিতে বাবা মাকে হারিয়েছে সেটাই ভেবে ভেবে অনুশোচনায়নায় দগ্ধ হচ্ছে। এর জন্য মিশুর পায়ে ধরে হলেও মাফ চাইতে হবে। বাবা মা ছাড়া পুরো জগতটাই অন্ধকার হয়ে গেছে, এখন মিশুকে খুব প্রয়োজন। এই কয়েকদিন মিশুকে ভেতর থেকে অনুভব করেছে তন্ময়। অনুতপ্ত হতে হতে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। মিশুর সাথে দেখা করতেই হবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিশুর নিষ্পাপ মুখটা মনে করার চেষ্টা করছে ও। মেয়েটার ছোট্ট একটা মুখ, খাড়া নাক, শীতল একটা ভাব আছে চেহারায়। অনেক মায়া মিশে আছে সেই ছোট্ট মুখে। চোখের দিকে তাকালে অন্যরকম মায়া অনুভূত হয়। সেই মেয়েটাকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলো ও? নিজের কাছে নিজেকেই আজ ছোট ছোট লাগছে। মিশুকে দেখার জন্য প্রচণ্ড ছটফট লাগছে ওর। মিশুর নাম্বার বন্ধ, মিশুর মায়ের নাম্বারে কল দিলে ব্যস্ত বলে। নাম্বার ব্লাকলিস্টে রাখা। মেসেজ পাঠিয়েও কোনো লাভ হচ্ছেনা। মিশুর বাবার নাম্বারে কল দিলে কেউ রিসিভ করেনা। এখন একমাত্র উপায় সরাসরি মিশুর বাসায় চলে যাওয়া। ফেসবুকে অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে কিন্তু সিন হচ্ছেনা। অনেক দিন যাবত মিশু অনলাইনে আসেনা। মেয়েটা ঠিক আছে তো? ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তন্ময়ের। নিজের প্রতারণার জন্য নিজেকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর। মনেমনে ভেবে রাখলো যেভাবেই পারে আগামীকাল মিশুর বাসায় গিয়ে হাজির হবে ও। সকালের বাসেই রওনা দেবে। মিশুর সাথে দেখা করতেই হবে। মেয়েটা যেন ঠিক থাকে সেটাই মনেমনে প্রার্থনা করতে লাগলো।
৪৫
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে মিশু ও মেঘালয়। মাঝখানে একহাত দূরত্ব। দুজনে দুদিকে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে। বিয়ের পর থেকে প্রত্যেকটা রাত এই সময়ে মেঘালয়ের স্পর্শে পাগল হয়ে যেতো মিশু। একটা সময় মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। আর আজ দুজনে দুদিকে! কোনো ঝগড়া হয়নি, তর্ক হয়নি অথচ কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলতে পারছে না। দুজনেরই নিজেকে ছোট ছোট লাগছে।
মেঘালয় কখনো মুখে না বললেও মনেমনে চাইতো ওর জীবনসঙ্গিনী ওর সমান সমান হবে। মিশুর বয়সও নিন্তান্তই কম। মনেপ্রাণে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও কেন যেন ভালোবাসাটা ঠিকমত হয়ে উঠছে না। মন থেকে ভালোবাসতে পারছে না ওকে। দশদিন পর কি আদৌ সম্ভব হুট করে ভালোবাসা হয়ে যাওয়া? না হলেও মিশুকে গ্রহণ করতে হবে। নয়তো অন্যায় করা হবে ওর সাথে। আবার গ্রহণ না করলেও অন্যায় হয়ে যাবে। দুটো ব্যাপার ভেবেই মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মেঘালয়ের। ভালোবাসা আকস্মিক ভাবে জন্ম নেয়। ইচ্ছেকৃত ভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়? সেটা তো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত। উলটা পালটা অনেক কিছু ভেবে মেঘালয় নির্ঘুম রাত পার করছে।
মিশু নিরবে চোখের জল ফেলছে। শীত লাগছে খুব। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠাণ্ডাও বাড়ছে। কিন্তু উঠে কম্বল টেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছেই করছে না ওর। ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপতে লাগলো। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, ‘এত শীত লাগছে কেন!’
মেঘালয় চমকে উঠে পাশ ফিরলো। মিশু অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। মেঘালয় নিজেই কম্বল টেনে নিয়ে মিশুর গায়ের উপর দিয়ে দিলো। নিজেও ঢুকে পড়লো কম্বলের ভেতর। মাঝখানে এখনও এক হাত দূরত্ব। দুজনে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। অনেক রাত অব্দি শুধু একে অপরকে অনুভব করেই গেছে সেটা কেউই জানেনা। নানান আজগুবি চিন্তা ভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।
সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর মিশু উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারলো মেঘালয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। একহাতে জাপটে ধরে আছে মেঘালয়কে আর সে নিজেও দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মিশুকে। দুজনে তো মাঝখানে একহাত দূরত্ব রেখে ঘুমিয়েছিলো তাহলে এভাবে জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়লো কখন? নাকি মেঘালয় টেনে নিয়েছে কাছে? প্রশ্নটা মাথায় রেখেই ওঠার চেষ্টা করলো মিশু। মেঘালয় ওর বাহুতে টেনে ধরে বললো, ‘উহু নড়াচড়া করছো কেন? কতবার বলেছি আমাকে বিছানায় একা ফেলে উঠবা না?’
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেঘালয়ের ঘুম জড়ানো মুখটার দিকে। দেখলেই বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। এটাকে কি মায়া বলে? কোনো এক অচেনা মায়ায় জড়িয়ে আছে দুজনে। এই মায়া থেকেই কি ভালোবাসা হয়? আজকে কেন যেন মেঘালয়কে ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। বাসায় যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মিশু মনেমনে ভাবলো, ‘আমি যে মেঘালয়কে ভালোবাসতে শুরু করেছি সেটা কি ও বুঝতে পারছে?’
চোখ মেলে তাকালো মেঘালয়। মিশুকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘উঠবে না?’
– ‘না ছাড়লে উঠবো কিভাবে?’
– ‘যদি না ছাড়ি?’
– ‘রংপুর যাবো না।’
হেসে ফেললো মেঘালয়। মিশুকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললো, ‘ঘুম থেকে ওঠার পর আমার বউটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে।’
– ‘চোখে সরষে ফুল ফুঠেছে বোধহয়। আমাদের জুটিটাকে একদমই মানায় না।’
– ‘হুম মানায় ই না তো। চলে যাও, ছেড়ে দিলাম।’
মিশু বিছানার উপর বসতে বসতে বললো, ‘আমি গাইয়া ক্ষ্যাত।’
– ‘গাইয়া মেয়েদের একটা ন্যাচারাল লুক থাকে।’
– ‘আমি হাইটে শর্ট।’
– ‘খাটো মেয়েদের জড়িয়ে ধরতে আরাম লাগে। খাটো মেয়েদের মাথাটা বুকে এসে ঠেকে।’
– ‘শুনেছি অয়ন্তিকা অনেক লম্বা।’
– ‘ফেরাউনের মত লাগে।’
– ‘একটা লম্বা মেয়ে দরকার।’
– ‘লম্বা মেয়েরা তাড়াতাড়ি কুঁজো হয়ে যায়।’
– ‘একটা ধবধবে ফর্সা মেয়ে দরকার।’
– ‘সাদা তো ব্রয়লার মুরগিও হয়।’
মিশু মুখ টিপে হেসে পিছনে ফিরে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। মেঘালয় শুয়ে আছে আর ও বসে আছে। মেঘালয়ের ঠোঁটের কোণেও বাকা হাসির আভাস।
দুজনেই হাসছে মুখ টিপে। মিশু বললো, ‘আমি এখনো বয়সে বাচ্চা।’
– ‘বাচ্চাদের খুব কিউট লাগে। কোলে বসিয়ে আদর করা যায়।’
মিশু আবারো হাসলো মুখ টিপে। বললো, ‘আমি কেবল ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম। একটা গ্রাজুয়েট মেয়ে দরকার।’
– ‘গ্রাজুয়েট মেয়েরা অত্যধিক ম্যাচিউর হয়। পিচ্চি বউয়ের পাগলামি গুলা ভালোলাগে।’
মিশু নিচু হয়ে এসে মেঘালয়ের শার্টের কলার ধরতে গিয়ে দেখলো শার্ট ই নেই গায়ে। খালি গায়ে শুয়েছে। মিশু চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আমিই আপনার জন্য পারফেক্ট। হয়েছে?’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘আমি সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ে নিবো না। আমার জন্য এমন মেয়ে লাগবে যে কখনো কারো প্রেমে পড়েনি।’
মিশু রেগে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মেঘালয় বাহু চেপে ধরে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললো, ‘দুষ্টুমি করলাম তো।’
– ‘ছাড়ুন আমাকে। আমি চলে যাবো।’
– ‘যদি যেতে না দিই?’
– ‘আমি তো সেকেন্ড হ্যান্ড।’
– ‘সেকি! কুমারীত্ব তো আমিই হরণ করেছি। তাহলে?’
লজ্জায় মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিলো মিশু। মেঘালয় দুহাতে জাপটে ধরে বললো, ‘পাগলী। একটা রাত দুজন দুজনের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে কি বুঝলে? অজান্তেই যে একজন আরেকজনের প্রতি কতটা দূর্বল হয়ে পড়েছি সেটা কি বোঝো?’
মিশু লাজুক স্বরে বললো, ‘আপনি একটা খুব খারাপ।’
– ‘এই খারাপ টাকে ছেড়ে থাকতে পারবা?’
– ‘পারবো।’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘যত বড় মুখ নয় ততবড় কথা। তবে কালকে তোমার কথাগুলো ভালো ছিলো।’
– ‘অপ্রিয় সত্য কথাই বলেছি। আমাকে পাগলের মত ভালো না বাসলে আমি থাকবো না।’
– ‘পাগল হলে ভালোবাসবো কিভাবে? ভালোবাসার জন্য তো আমাকে সুস্থ থাকতে হবে। হা হা হা।’
– ‘আপনি সিরিয়াসলি একটা খুব খারাপ।’
মেঘালয় শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসি থামার পর বললো, ‘দশদিন যোগাযোগ থাকবে না কিন্তু। ফোন দিলে খবর আছে বলে দিলাম।’
– ‘ঠিকাছে। পনেরো দিন পর সব উসুল করে নিবো।’
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই শান্ত হয়ে রইলো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করছে শুধু। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মিশু বললো, ‘যদি এর মাঝে খুব করে আত্মার জন্য আত্মা ছটফট করে?’
– ‘বুঝতে পারবে।’
– ‘যদি দেখার জন্য অস্থির লাগে?’
– ‘ফ্লাইটে রংপুর যেতে মাত্র ঊনষাট মিনিট লাগে।’
মিশু চুপ করে গেলো। কে বলেছে মেঘালয় ভালোবাসে না? একটা রাত কথা বন্ধ রাখতেই একে অপরকে খুব করে অনুভব করছে। মেঘালয়কে ছাড়া মিশুরও যে চলবে না। একটা মুহুর্তও চলবে না।
৪৬
বাসার সবার কাছে থেকে বিদায় বেড়িয়ে পড়লো বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। মেঘালয় এয়ারপোর্টে এসেছে ওদের সাথে। বাবার পাশে বসে দুজনেই শান্ত হয়ে বসে ছিলো। কিন্তু বুকের ভেতরটা ঠিকই ফাটছিলো। দুজনই দুজনকে অনুভব করছে। মেঘালয়ের কষ্ট হচ্ছে মিশুকে ছাড়তে আর মিশুরও কষ্ট হচ্ছে মেঘালয়কে রেখে যেতে। বারবার শুধু চোখাচোখি হচ্ছিলো। শেষ চোখাচোখির সময়ে মেঘালয়ের চোখে অন্যরকম মায়া খুঁজে পেয়েছিলো মিশু।
খুব উৎফুল্ল মনে বাসায় ফিরলো মিশু। সন্ধায় কলিং বেল বেজে উঠলে দরজা খুলে বড় ধরণের ধাক্কা খেয়ে গেলো। তন্ময় কেন এসেছে! আবার কোন বিপদ ঘটাতে এসেছে সে?
চলবে..
গত পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=317376862220668&id=310794352878919