হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৫
মিশু মনি
.
৪৯
সারারাত খুব ভালো ঘুম হলো মিশুর। রাতে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। শেষরাতে হঠাৎ কারো হাতের উষ্ণ স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেলো। কোলবালিশটা কত্ত ভালো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এরকম কোলবালিশ সবসময় দরকার। মিশু দুহাতে শক্ত করে জাপটে ধরলো বালিশটাকে। কোলবালিশও তার একহাতে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অন্যহাতে জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। বাহ, কোলবালিশ জড়িয়ে ধরতে শিখেছে! মিশু দুহাতে জাপটে ধরতে ধরতে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় কপালে আলতো চুমুর স্পর্শ পেয়ে আচমকা ঘুম পালিয়ে গেলো। কোলবালিশ চুমু খেতেও শিখে গেছে! কিভাবে সম্ভব?
চোখ মেলে তাকালো মিশু। মেঘালয়কে দেখে চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো ওর। খুব কাছ থেকে মেঘালয়কে তাকিয়ে থাকতে দেখে রীতিমত হা হয়ে গেলো। মেঘালয় এসেছে! এটা স্বপ্ন নয়তো?
মিশুর নিজের নখে নিজেই কামড় দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। ব্যথা পেয়েছে। তারমানে স্বপ্ন নয়। মিশু চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানার উপর উঠে বসলো। অনেকটা থ মেরে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। কিন্তু মেঘালয়কে গতকাল ই ঢাকায় রেখে এসেছে ও। তবে সে কিভাবে এসে হাজির হলো!
মেঘালয় হাসতে হাসতে ভ্রু দুটো নাচিয়ে বললো, ‘সারপ্রাইজড?’
– ‘আপনি! কোথ থেকে এলেন?’
– ‘ঢাকা থেকে।’
– ‘এত রাতে! আপনি রওনা দিয়েছেন কখন?’
– ‘মিতু ফোন দিয়ে বললো তন্ময় এসেছে। তোমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। আমার বউকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে আর আমি বসে বসে দেখবো?’
মজা পেলো মিশু। মেঘালয়ের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ওকে। চোখ দুটো ফুলে আছে। একদিনেই এই অবস্থা? মনেমনে বললো, ‘এত টান! আমিও ডাকলাম আর তুমিও চলে এলে।’ কিন্তু মুখে বলল, ‘আপনি তো আমাকে এখনও ভালোই বাসতে পারেননি। এত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিলো?’
মেঘালয় বললো, ‘না আসলেই বুঝি খুশি হতে?’
মেঘালয়ের গলার স্বরে এক ধরণের রাগ মিশে আছে। বেশ মজা লাগছে মিশুর। ওকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য বললো, ‘তা জানিনা। কিন্তু কে আমাকে বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে সুবিধা হতো।’
ভ্রু কুঁচকে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে!’
– ‘মানে তন্ময় তো নিজের ভূল বুঝতে পেরেছে। আর ছেলেটা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আপনি যেহেতু এখনো বাসেন না, কাজেই আমার তন্ময়কে নিয়েও একবার ভেবে দেখা উচিৎ।’
মেঘালয় ভয়াবহ রেগে গেলো। কিন্তু মুখে রাগ দেখাতে পারলো না। মিশু তাকিয়ে দেখে মেঘালয়ের চোখে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। মুখ টিপে হেসে ও বললো, ‘আজীবন একসাথে থাকতে হবে। সবকিছুর আগে একবার ভেবেচিন্তে তারপর ডিসিশন…’
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘কিসের ডিসিশন? আমি তোমার হাজব্যান্ড। আমার সামনে এই কথা বলার আগে বুকটা একবার কাঁপলো না?’
– ‘কথা বলার সময় কি কাঁপে তাও জানেন না দেখছি। ঠোঁট কাঁপে ঠোঁট। অন্যকিছু নয়।’
মেঘালয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মিশুর চোখের দিকে। মিশুর চোখে হাসির ঝিলিক। ঠোঁটে দুষ্টুমি হাসি মিশে আছে। মেঘালয় রাগবে নাকি হাসবে বুঝতে পারলো না। মিশুর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখতে রাখতে বললো, ‘মেরে হাড্ডি গুড়া করে দিবো। খুব পাঁজি হয়ে গেছো।’
– ‘সেকি! আপনি আমাকে মারবেন? তন্ময় বলেছিল কোনোদিনো আমার গায়ে হাত তুলবে না।’
– ‘হাত তুলবে কোথ থেকে? হাত থাকলে তো তুলবে। আমার বউকে কেড়ে নিয়ে গেলে আমি হাত রাখবো নাকি?’
মিশু মেঘালয়ের সামনে বসে বললো, ‘খুব তো আমার বউ আমার বউ করছেন। বউয়ের জন্য কি এনেছেন শুনি?’
মেঘালয় আমতা আমতা করে বললো, ‘না মানে এত দ্রুত গাড়ি টেনে এনেছি যে কিছুই আনতে পারিনি।’
– ‘হাহ। আর তন্ময় আমাকে বলতো যতবার বাইরে যাবে ততবারই আমার জন্য চকোলেট, আইসক্রিম, বিস্কুট টিস্কুট নিয়ে তবেই বাসায় ফিরবে। হাউ কিউট!’
মেঘালয় তেলে বেগুনে জ্বলে গেলো। তন্ময়ের নাম নিয়ে বারবার ক্ষেপানো হচ্ছে। কিন্তু মিশুর মনে তন্ময়ের জন্য একটু জায়গা ফাঁকাই ছিলো সেটা মেঘালয় জানে। নয়তো গত রাতে ওভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়তো না। মেঘালয়ের ফোনও রিসিভ করেনি ও। এতটাই হতাশায় পড়ে গিয়েছিলো। তাহলে কি এখনো তন্ময়কে ভালোবাসে ও?
কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসলো মেঘালয়, ‘তুমি কি এখনো তন্ময়কে ভালোবাসো মিশু?’
মিশু দুষ্টুমি করে বললো, জানিনা।’
– ‘জানোনা মানে! সত্যি করে বলোতো তুমি এখনো ওর কাছে যেতে চাও কিনা।’
– ‘যদি বলি চাই?’
থমকে গেলো মেঘালয়। অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না। মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললো, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো।’
বুকটা চিনচিন করে উঠলো মিশুর। এই কথাটা শুনলেই বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। কিছুতেই সহ্য করা যায়না। মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো কত মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে ও! যদি ছেড়েই দেবে তাহলে এত কষ্ট করে কি এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসতো? মিশু একটু হলেও বোঝে। মিশু চোখেচোখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘ভালোবাসেন খুব তাইনা?’
মেঘালয় চোখেচোখে উত্তর দিলো, ‘হুম। আর কখনো এরকম কথা দুঃস্বপ্নেও বলবা না বলে দিলাম।’
আচমকা মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। দুহাতের বন্ধনে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করলো। মেঘালয়ও পাগলের মত মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে রইলো যেন বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইছে। মিশুকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে তবেই বোধহয় সুখ লাগবে। খুব আপন করে নিতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। কতটা আপন হলে যে আর দূরে মনে হবেনা..!
দুজনের কেউই আর কোনো কথা বলতে পারলো না। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই বসে রইলো। একটু পরেই শোনা গেলো পাখির কিচিরমিচির।
৫০
গোসলের পর চুল মুছতে মুছতে মিশু রুমে এসে দেখলো মেঘালয় এখনো ঘুমাচ্ছে। সারারাত জার্নি করে এসেছে, একটু ঘুমানো দরকার। মিনিট দুয়েক মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মিশু এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো। ঘুমানোর সময় মেঘালয়ের শরীরটা অন্যরকম উষ্ণ হয়ে ওঠে। ওর উষ্ণ গলাটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। মিশু নিচু হয়ে এসে মেঘালয়ের গলায় হাত রাখা মাত্রই টের পেয়ে গেলো মেঘ। ও জেগেই ছিলো। তবুও চোখ মেললো না। চুপটি মেরে মিশুর স্পর্শকে অনুভব করার চেষ্টা করলো। মিশু গলায় হাত রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে নিচু হয়ে এসে মেঘের কপালে ঠোঁট স্পর্শ করালো। এমন সময় মেঘালয় দুহাতে জাপটে ধরলো ওকে। মিশু মুখটা তুলে মেঘালয়ের মুখের উপর উপুড় হয়ে এলো। দুপাশের ভেজা চুল মেঘালয়ের গলার উপর হেলে পড়েছে। মেঘালয় বললো, ‘তোমাকে কোন ড্রেসে সবচেয়ে সুন্দর লাগে জানো?’
– ‘না। কিসে?’
– ‘শাড়িতে। শাড়ি পড়বা?’
– ‘নতুন শাড়ি কিনতে হবে।’
– ‘আজকে শপিংয়ে নিয়ে যাবো। নতুন কয়েকটা ড্রেসও কিনতে হবে তোমার। তোমাকে যে ড্রেসে সবচেয়ে বেশি মানায় সেগুলো নিয়ে দিবো।’
– ‘আচ্ছা। আমিতো জানতাম আমাকে সব ড্রেসেই মানায়।’
– ‘উহু। গায়ের রংয়ের সাথে ড্রেসে শুট করার একটা ব্যাপার থাকে। আর হাইট ও ওয়েট অনুযায়ী কোন জামাটা পড়লে বেশি সুন্দর লাগবে সেটাই পড়া উচিৎ তাইনা?’
– ‘উম। আচ্ছা আপনি এতকিছু জানেন কি করে?’
– ‘জানতে হয় রে পাগলী। সাধে কি মেয়েরা তোমার বরের জন্য পাগল হয়?’
– ‘ইইইই খুব খারাপ। ছাড়ুন আমাকে।’
মেঘালয় একহাতে মিশুর চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো, ‘সবসময় যে স্টাইলে চুল বাঁধো, মাঝেমাঝে একটু ভিন্নতা আনাও যায়। এতে একটা আলাদা লুক চলে আসবে।’
– ‘উফফ আপনি ফ্যাশন ডিজাইনার হলেন না কেন বলুন তো?’
– ‘বউয়ের ফ্যাশন ডিজাইনার হবো বলে।’
– ‘হয়েছে। এবার ছাড়ুন, আর উঠে ফ্রেশ হয়ে আসুন দ্রুত।’
মেঘালয় মিশুকে আরো জোরে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, ‘ছাড়বো না। আজকে সারাদিন শুয়ে থাকবো।’
কথাটা বলেই মিশুকে টেনে বিছানায় তুলে নিলো। কম্বলের ভিতরে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। মিশু এই মানুষটার সাথে পারেনা কিছুতেই। শক্ত হাত দুটো দিয়ে মিশুকে এমনভাবে ধরে রইলো যে মিশুর নড়াচড়া করার ও শক্তি রইলো না। খুনসুটি চলতে লাগলো দুজনাতে।
সারাটা দিন শপিং, খাওয়াদাওয়া,দুষ্টুমি আর ঘুরাঘুরি করেই কাটলো। রাত্রিবেলা হঠাৎ খবর এলো তন্ময়কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। যে ছেলেটা মিশুর উপর আক্রমণ করেছিলো তাকে মারতে মারতে মরার মত অবস্থা করে ফেলেছে তন্ময়। আর সেলিমকেও প্রচুর মেরেছে। দুজনের অবস্থা আশংকাজনক। কথাটা শুনেই বুকটা কেমন করে উঠলো মিশুর। তন্ময়কে ছাড়ানোর জন্য ওকেই যেতে হবে। কারণ ওর যে এখন কেউই নেই। আর মিশুকেও সাক্ষী দিতে হবে সত্য ঘটনার। তবে ওদের এই করুণ অবস্থা করার কারণে মেঘালয় তন্ময়ের প্রতি অনেকটা সন্তুষ্ট। বারবার বলছিলো, ‘এতদিনে কাজের কাজ করেছে ছেলেটা। এরকম প্রেমিকই তো দরকার।’
চলবে..
(ব্যস্ততার কারণে দুটো দিন পোস্ট করতে পারিনি। এজন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত)