হৃদমোহিনী পর্ব ৩৬

0
2600

হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৬
মিশু মনি
.
৫১
শেষ অব্দি আর কাউকেই যাওয়ার প্রয়োজন হলোনা। তন্ময়ের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন মিশুর বাবা। গত কয়েকদিন আগে উপজেলা চেয়ারম্যান নিজেই সাক্ষী থেকে সরাসরি মন্ত্রনালয়ে অভিযোগ জানানো হলো আসামিদের ব্যাপারে৷ ফলে ওই দুজনকেই পুলিশের তত্ত্বাবধানে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আর তন্ময়ের জামিনের ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।

মাঝখানে কেটে গেছে দুটো দিন। দুদিনে যেন দুজন মানুষ নতুন করে বুঝতে শিখেছে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো কেমন হয়? একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করতেও শিখে গেছে। তন্ময়ের সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করেনি মিশু। পুরনো অধ্যায় শেষ করে দিয়ে নতুন অধ্যায়ে পা ফেলেছে, অতীতের ধূলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জীবনে নতুনভাবে প্রত্যাবর্তন দরকার।

মেঘালয়ের উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য কঠোর শ্রমও দিতে হচ্ছে। মেঘালয়ের এথলেটদের মত বডি, ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। মাসল দেখলেই বুকের হার্টবিট ধরাস করে বেড়ে যায়। মিশুও ব্যায়াম করা শুরু করে দিয়েছে। মিশু আগে চুল বাঁধতে পারতো না, সবসময় অগোছালো হয়ে থাকতো। এখন চেষ্টা করছে চুল সবসময় পরিপাটি করে রাখার৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি থাকলে যেকোনো মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে কথা বলার ক্ষেত্রে। মেঘালয় খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তার মত করে কথা বলাও শিখতে হবে৷ দুজনই যেন অনুধাবন করতে পারে দুজন মিলে একটা পারফেক্ট জুটি।

মিশু গ্রীন টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর চুমুক দিচ্ছে চায়ে। মেঘালয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে কিভাবে বারান্দা সাজাতে হবে। বিয়ের প্রোগ্রামের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। মিশুকে রেখে মোটেও আর ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করছে না। মেঘালয় ভেবে রেখেছে বিয়ের একেবারে দুদিন আগে ফিরলেই হবে। মুহুর্তের জন্যও মিশুকে আড়াল হতে দেয়া যাবেনা।

মিশু চায়ে চুমুক দিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশুর ভেজা গলা দেখে চমকে উঠলো মেঘালয়। ভ্রু কুঁচকে ইশারায় বলল, ‘কি হয়েছে?’

মিশু বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো, ‘একটানা বিশ বার বুকডন ডান।’

মেঘালয় হেসে ইশারায় বললো, ‘বাহ!’

মিশুর ঘর্মাক্ত কাঁধ ও গলা দেখে বুকের চিনচিনিনিটা বেড়ে যাচ্ছে মেঘালয়ের। ওয়েডিং প্লানারকে বাকি কাজটা দ্রুত বুঝিয়ে দিয়ে মিশুর দিকে এগিয়ে এলো। মিশু চুলে বেনী করে সামনে বামপাশে এনে রেখেছে। মুখের দুপাশে বাঁকা চুল ঝুলছে। মুখটাও ঘেমে একাকার। ঘেমে গেলে মেয়েদেরকে কি যে অপূর্ব দেখায়। মিশু জিজ্ঞেস করলো, ‘কি দেখছেন?’

মেঘালয় বললো, ‘তোমার স্বর্ণের লকেট আছে?’
– ‘না। আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে ওসব।’
– ‘তুমি কি জানো তোমার ঘেমে যাওয়া গলায় একটা লকেট ঝুলতে দেখলে কত সুন্দর দেখাবে? আর চুলের নিচে কাঁধের উপর যখন চেইনটা লেপ্টে থাকবে, উফফ! ভাবতেই পারিনা।’

মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘তাই বুঝি? ঠিকাছে একটা বানাতে দিবো।’
– ‘রুমে আসবে একটু?’
– ‘কেন?’
– ‘দরকার ছিলো একটু। আমি যাচ্ছি, তুমি তারাতারি আসো।’

মিশু চায়ের কাপ মেঘালয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনি খান বাকিটা।’
মেঘালয় কাপটা নিয়ে ভালোভাবে খেয়াল করলো মিশু কোন জায়গায় চুমুক দিয়েছিল। সেখানে আলতো করে চুমুক দিলো। তারপর বাঁকা চোখে তাকালো মিশুর দিকে। মিশু কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’

মেঘালয় বললো, ‘তোমার অর্ধেক খেয়ে ফেলে রাখা চায়ে একটা আলাদা গন্ধ মিশে আছে। রিমিক ঝিমিক প্রেম আছে, চিনিক চিনিক ব্যথা আছে, দুটো কবিতার লাইন আছে, ঠোঁট ছোঁয়ানো অনুভূতি আছে, ঘুমের আদর মেশানো ভালোবাসা আছে, আর আছে প্রেমস্বাদ যুক্ত মধু।’

মিশু রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চোখের পলক ও পড়তে চাইছিলো না। একটা চায়ের উপমাও কেউ এত সুন্দর করে দিতে পারে সেটা ওর জানা ছিলোনা। মুচকি হেসে বললো, ‘দারুণ! কবিতা লেখা শুরু করে দিন।’

মেঘালয় চায়ের কাপে আরেক বার চুমুক দিয়ে বললো, ‘আমার গলার স্বরে তোমার জন্য একটা স্বপ্নরাজ্য বুনে ফেলবো। আঙুলের ভাঁজে অজস্র কাব্য রটাবো। শুধু তুমি ‘হৃদমোহিনী’ হয়ে থেকো।’

প্রাণখোলা হাসি শুরু করে দিলো মিশু। মেঘালয় কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছে নাকি? হাসি থামানোর পর বললো, ‘আমি মুখে পানি দিয়ে আসি।’

মেঘালয় বাঁধা দিয়ে বললো, ‘না। ওভাবেই রুমে আসো।’
– ‘কেন? গা ঘেমে গেছে, মুখটা ধুয়ে আসি।’

মেঘালয় কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বললো, ‘তোমার শরীর থেকে সমস্ত লবণাক্ততা দূর করে দিই?’

মিশু লাজুক স্বরে বললো, ‘কিভাবে?’
– ‘আমি বিদ্যা জানি। কামড়ে খেয়ে ফেলবো।’
– ‘আহা, যদি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন?’

মেঘালয় আবারও ফিসফিস করে বললো, ‘তখন তুমি আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নিবা।’

শিউরে উঠলো মিশু। এমনিতেই মেঘালয়ের কণ্ঠটা অসম্ভব মায়াবী আর সুন্দর। তার উপর এভাবে বললে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়না? হার্টবিট বেড়ে গেলো হঠাৎ করেই। এত জোরে বিট হচ্ছে বোধহয় বারান্দায় বসে থাকা ওয়েডিং প্লানারও শুনতে পারবে সেই বিটের শব্দ। ধুকপুক করছে বুকটা। প্রচন্ড অস্থির লাগতে শুরু করেছে মিশুর। এক মুহুর্তও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দ্রুত রুমে এসে দাঁড়াতেই মেঘালয় তাকিয়ে দুষ্টুমি হাসি দিলো। মিশু রাগী রাগী চেহারায় তাকালো ওর দিকে।

মেঘালয় এগিয়ে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিলো মিশুকে। মিশু দুহাতে মেঘালয়কে মারতে মারতে বললো, ‘আপনি একটা খুব খারাপ। তারাতারি ঢাকায় চলে যান তো।’
– ‘আমি যখন থাকবো না, তখন কষ্ট হবেনা?’

মিশু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘অলুক্ষণে কথা বলবেন না। ডাকলেন কেন?’
– ‘একটু আগে যেটা বলেছি সেটা আবার শুনতে ইচ্ছে করছে?’

মিশুর লজ্জায় মরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গেলো। মেঘালয়কে জাপটে ধরে বুকে মুখটা লুকাতে লুকাতে বললো, ‘চুপ একদম চুপ।’

হেসে উঠলো মেঘালয়। মিশুকে বিছানায় জোরে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। মিশু চোখ বুজে রেখেছে। লজ্জায় চোখ মেলতে পারছে না। মেঘালয় দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে বললো, ‘এই হৃদমোহিনী..’

মিশুর চোখে পানি। একই সাথে অনেক ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। ও মৃদু গলায় বললো, ‘আমার না কান্না পাচ্ছে। খুব সুখের মুহুর্তগুলোতে আমার বড্ড কান্না পায়। একটু কান্না করি?’
– ‘কাঁদো। তারপর তোমার চোখের জল…’

মিশু মেঘালয়ের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বললো, ‘আমি জানি। ওষ্ঠে তুলে নেবেন তাই তো?’

মেঘালয় হেসে বিছানার উপর উঠে বসলো। মিশুকে টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপর মিশুর মাথাটা নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘আমি যদি কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাই?’
– ‘মানে! যেখানেই যাবেন আমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।’
– ‘যদি কখনও হারাই?’

মিশু রেগে বললো, ‘একদম রহস্য করবেন না। এরকম ফাজলামি কক্ষনো করবেন না। আমি পাগল হয়ে যাবো আপনাকে হারালে।’
– ‘তোমার না তন্ময় আছে?’

মিশু রেগে দুটো মাইর লাগালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় বুকে হাত রেখে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘উহ এত জোর তোমার গায়ে?’
– ‘তো? এরকম ফালতু কথাবার্তা আরেকবার বললে খুন করে ফেলবো।’

কথাটা বলেই আবার নিজেই মেঘালয়ের বুকে হাত রেখে মালিশ করতে লাগলো। মেঘালয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিশুও নিচু হয়ে চোখ বরাবর তাকিয়ে আছে হা হয়ে। এই চোখ দুটো ভয়ংকর, বড্ড ভয়ংকর। কি যে মিশে আছে চোখে, সেই অর্ধেক ফেলে রাখা চায়ের মত। একসাথে অনেক কিছু। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়। ঘুমের আদর মেশানো ভালোবাসায় মাতাল হতে ইচ্ছে করে।

মিশু মাথাটা নামিয়ে আনতে আনতে মেঘালয়ের মুখের কাছাকাছি চলে আসলো। মেঘের মুখের উপর মিশুর নিশ্বাস পড়ছে। মেঘালয় দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করছে। হঠাৎ…

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here