হৃদমোহিনী পর্ব ৪৩

0
2195

হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৩
মিশু মনি
.
মিশুর মুখটা দুহাতে ধরে মেঘালয় বললো, ‘তুমি যতই বড় সাজার চেষ্টা করো, তোমাকে ততই বাচ্চা বাচ্চা লাগে।’

ভ্রু কুচকে মিশু জবাব দিলো, ‘শাড়ি পড়লেও আমাকে পিচ্চি লাগে?’
– ‘শুধু কি পিচ্চি? আমি ভাবছি বিয়ের দিন না জানি বাল্যবিবাহ ভেবে পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।’

বলেই হেসে উঠলো শব্দ করে। মিশু মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। কত্তদিন পর দেখছে ওকে। মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। মেঘালয় শেভ করেনা কয়েকদিন ধরে। কিন্তু চাপ দাড়ি গুলো ওর আউটলুকের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মিশু খেয়াল করে দেখলো মেঘালয়কে কোট টাই পড়ে ফর্মাল ড্রেসে একেবারে ক্যাপ্টেনের মত লাগছে।

ও এগিয়ে এসে মেঘালয়ের গলা ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেঘ ওর চেয়ে এতটাই লম্বা যে গলা ধরতে পারছে না। মেঘালয় হাসতে হাসতে একটা ছোট্ট টুল নিয়ে এসে সামনে রেখে বললো, ‘ওঠো। উঠে দাঁড়াও আর আমার গলা ধরো।’

হেসে ফেললো মিশু। টুলের উপর উঠতে যাবে তার আগেই মেঘালয় ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার উপর এসে বসলো। পুতুলের মত মেয়েটা যেন পাখির মত হালকা ওর কাছে। বিছানায় বসে মিশুকে কোলে বসিয়ে বললো, ‘এবার আমার গলা ধরবা না কি ধরবা ধরো।’

বলেই দুষ্টুমি হাসি হাসলো। মিশু মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘পরের জন্মে ৫ ফুট ছয় ইঞ্চি হয়ে জন্ম নিবো দেখো।’
– ‘হা হা হা। ৫ ফুট ছয় ইঞ্চি সাইজের মেয়ে দেশে অনেক আছে। অন্তিকা, দুপুর এরা সবাই মোটামুটি লম্বা। কিন্তু ওরা তো মিশু না।’

মিশু চোখের পলক না ফেলে মেঘালয় কে দেখছে। ছেলেটা এমন কেন? কখনো কথা দিয়ে হারানো যায়না ওকে। বললো, ‘আপনি শুকিয়ে গেছেন।’
– ‘হ্যা। কারণ কি জানো? আম্মু প্রতিদিন আমাকে রোদে শুকাতে দেয়। হা হা হা।’
– ‘আমাকেও দিতো। ছোটবেলা শীতকালে গোসলের পর রোদে গা শুকাতাম।’
– ‘তুমি কিন্তু দারুণ সুন্দরী হয়ে গেছো মিশমিশ।’

মিশু হেসে বললো, ‘মোটেও না। আপনার দৃষ্টি সুন্দর বলে আমাকে সুন্দর দেখছেন।’
– ‘আমার দৃষ্টিতে তাহলে ‘গু’ ও সুন্দর। হা হা হা।’

মিশু ক্ষেপে বললো, ‘সারাক্ষণ আপনার শুধু ফাজলামো। খিদা পায়নি? আসুন খেতে দেই।’
– ‘কোলে বসেই খাওয়াও।’
– ‘কাচ্চি রান্না করেছে। নিয়ে আসি?’
– ‘ওহ কাচ্চি খেতে বলেছো? আমি ভাবলাম অন্য কিছু।’

বলেই আবারও শয়তানি হাসি শুরু করে দিলো মেঘালয়। মিশু ক্ষেপে শুকনো লংকার মত লাল হয়ে মাইর শুরু করলো মেঘালয়কে। মেঘ ওর হাত দুটো এক হাতে ধরে অন্যহাতে কাছে টেনে নিয়ে বললো, ‘বাচ্চাটা রাগও করে?’
– ‘হ্যা করে। আমাকে ছাড়ুন, খাবার নিয়ে আসি। এত রাত অব্দি না খেয়ে আছেন।’
– ‘ওরে আমার দায়িত্ববান বউ রে। আমি খেয়ে এসেছি বাইরে থেকে। অনেকদিন পর সায়ান, আরাফের সাথে আড্ডায় গেলাম।’
– ‘ওনাদেরকে আসতে বলুন না। কতদিন কথা হয়নি!’

মেঘালয় মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর গা থেকে টাই ও কোট খুলে ফেললো। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো, ‘ অনেক টায়ার্ড লাগছে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি?’
– ‘আচ্ছা। তারাতাড়ি করবেন কিন্তু।’
– ‘নাহ। এতদিন পর বউ এসেছে সেই খুশিতে সারারাত ধরে গায়ে পানি ঢালবো। হা হা হা।’

মিশু ক্ষেপে বললো, ‘আপনি এত দুষ্টু কেন বলুন তো? কত রকম ইয়ার্কি করেন শুধু। আমি টাওয়েল আর প্যান্ট নিয়ে আসছি, আপনি গোসলে যান।’
– ‘যাচ্ছি তো বাবা।’
– ‘আমি আপনার বাবা নই।’
– ‘ওকে, যাচ্ছি তো বউটা।’
– ‘ধেৎ, শুধু ফাজলামি।’

মিশু উঠে যাচ্ছিলো বিছানা ছেড়ে। মেঘালয় এক হাত চেপে ধরে বুকের উপর টেনে নিলো ওকে। মেঘের বুকে ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মিশু। ইতিমধ্যেই শার্ট খুলে ফেলেছে মেঘ। মিশু বুকের পশমে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললো, ‘এখানে একটা ঘর বানাবো আমি। পুরুষ মানুষের শরীরের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে এই রোমশ বুক।’

বলেই নিচু হয়ে মেঘালয়ের বুকে নাক ডুবিয়ে দিলো। মেঘালয় মিশুকে তুলে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললো, ‘গায়ে ঘামের গন্ধ। শাওয়ার নিয়ে আসি।’
– ‘এই গন্ধটাই তো মাদকতাময়।’
– ‘সেরেছে রে। যতটা বাচ্চা ভাবি ততটা নয়, ত্রিশ পারসেন্ট সেয়ানাও আছে।’

মিশু আবারও মেঘালয়ের বুকে কিল বসাতে বসাতে বললো, ‘যান তো গোসলে যান। আমাকে জ্বালিয়ে মারে এই লোকটা।’
– ‘তুমি নাকি আসবা না আর? আচ্ছা, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? গিভ মি এ চিমটি প্লিজ?’
– ‘সত্যিই এসেছি। মা গিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাকে।’
– ‘মা গিয়েছিলো! সিরিয়াসলি? কিছুই জানিনা।’
– ‘মা অনেক আদর করে নিয়ে এসেছে আমাকে।’
– ‘বাহ! তাই নাকি? কি কি খাইয়েছে শুনি?’

মিশু উৎফুল্ল হয়ে বললো, ‘সকালে পায়েস রান্না করে রেখে গিয়েছিলো। পাটিসাপটা পিঠা, নারিকেলের নাড়ু, আমার জন্য আচার বানিয়েছে, কাচ্চি রেঁধেছে। আসার পর থেকেই শুধু খাচ্ছি আর খাচ্ছি। আইসক্রিম, ছানার সন্দেশ, পুষ্টির মিষ্টি। একটা লুকান্ত জিনিসও খাইয়েছে।’

মেঘালয় কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘লুকান্ত জিনিস?’

লজ্জায় ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মিশু। মাথাটা নিচু করে বললো, ‘বুঝেন না? কক্সবাজারে একদিন আপনিও খাইয়েছিলেন আমাকে।’

গলা খাকাড়ি দিলো মেঘালয়। দুষ্টু হাসি হেসে বললো, ‘শ্বাশুরি তো অনেক খেয়াল রাখে তোমার। এদিকে আচার বানিয়েছে, ওদিকে আবার লুকান্ত জিনিসও খাওয়ায়। ছোটবাচ্চাদের বিয়ে করলে এই এক জ্বালা।’

মিশু মুখটা বাঁকা করে বললো, ‘কে বলেছিলো আপনাকে বিয়ে করতে?’
– ‘তোমার বাপ বলেছিলো। তোমার বাপ মা চোদ্দগুষ্টি ধরে বেঁধে বিয়ে দিলো ভূলে গেছো সে কথা?’
– ‘আহারে। আমি তো বলেছিলাম আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। বলিনি?’

মেঘালয় খপ করে মিশুর কোমরে চেপে ধরে নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো, ‘আরেকবার এই কথা বললে খুন করে ফেলবো একেবারে। আমি ফান করি, তুমিও ফান করো। কিন্তু ভূলেও এইসব অলক্ষুণে কথাবার্তা বলবা না।’

শক্ত করে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো মিশু। তারপর কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। মেঘালয় বললো, ‘কাঁদছো কেন পাগলী?’
– ‘এই কয়েকদিন অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা?’
– ‘হুম। অনেক।’
– ‘সরি। আমি তো চাই তোমার সাথে সম্মান নিয়ে চলাফেরা করতে।’
– ‘এমনিতেও তোমার যথেষ্ট সম্মান আমার কাছে আছে। আর বাহিরের লোকদের কাছে তোমাকে সম্মানিত করাটা আমার আর আমার পরিবারের দায়িত্ব।’
– ‘আমি তোমাদের ক্রেডিট নিতে চাইনি।’
– ‘আমাকে নিজের থেকে আলাদা করে দেখছো কেন? আমি তোমার ই একটা সত্তা।’

কান্নার বেগ বেড়ে গেলো মিশুর। মেঘালয় বাঁধা দিলো না। কিছুক্ষণ কেঁদে মেঘালয়ের বুক ভিজিয়ে দিয়ে মিশু বললো, ‘আর কাঁদবো না।’
– ‘আরেকটু কাঁদো না। ভালোই তো লাগছিলো।’
– ‘আমি কাঁদলে আপনার ভালো লাগে?’
– ‘প্রচুর।’
– ‘কিহ! কি খারাপ একটা লোক!’

হেসে ফেললো মেঘালয়। তারপর বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, ‘টাওয়েল টা নিয়ে এসো।’

মিশু টাওয়েল হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা খোলাই আছে। মেঘালয় হাত বাড়িয়ে টাওয়েল নিতে গিয়ে মিশুর হাতটা ধরেই টেনে ওকে বাথরুমের ভেতরে নিলো। তারপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো খট করে। মিশু চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, ‘শাওয়ার বন্ধ করুন আমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে.. আমার শাড়ি ভিজে আরে এভা..’

মিশুর আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। কিছুক্ষণ নিরবতা। সাড়া শব্দ নেই কোনো। তারপর পরই একটা মিষ্টি লাজুক সুর ভেসে আসলো, ‘আপনি একটা খুব খারাপ।’

৬৪
ভেজা চুল মুছতে মুছতে মিশু বললো, ‘বিজনেস কেমন চলছে?’
– ‘দৌঁড়াচ্ছে। তোমাকে একদিন অফিসে নিয়ে যাবো। তোমার ও কাজ বুঝিয়ে দিবো।’
– ‘আমার কাজ! পড়াশোনা করবে কে?’
– ‘পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি নিতে নিতে জীবনের অর্ধেকটা পার হয়ে যাবে। ততদিনে অনেকের বাবা মা ওপারে চলে যায়। আর চাকরি করে কিইবা করবে? বিজনেসের চেয়ে বড় কোনো প্রফেশন আছে নাকি?’

মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আমি তো কিছুই বুঝিনা ওসবের।’
– ‘বুঝিয়ে দিবো৷ এরপর লোন দিয়ে দিবো, তুমি একা ব্যবসা করবা। তোমার বিজনেস তোমার, আর আমার টা আমার। তুমি লস করলে তার দায় তোমার। কেউ কারো বিজনেসে ইন্টারফেয়ার করবো না। যেকোনো কিছু আমরা আলোচনা করে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নিতে পারি।’

মিশু মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘স্ত্রীকে কেউ এভাবে উৎসাহ দেয় কিনা আমার জানা নেই।’
– ‘আমিও চাই তোমার একটা পরিচয় থাকুক। আগে তুমি মিশু, তারপর মেঘালয়ের স্ত্রী।’
– ‘হুম। বুঝেছি।’
– ‘কচু বুঝেছো। চুলটাও ঠিকমতো আচড়াতে পারো না।’

মেঘালয় এসে টাওয়েল নিয়ে মিশুর চুল মুছে দিতে দিতে বললো, ‘চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে তো।’
– ‘জানেন আমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের কাছে গিয়েছিলাম। সারাদিন ছিলাম। উনি বলেছেন, আমার হাইট আর ফিগার অনুযায়ী, এক রঙা ফ্রক টাইপের জামায় আমাকে বেশি মানাবে। পুতুলের মত লাগবে।’

মেঘালয় মনোযোগ দিয়ে চুল মুছছে। বললো, ‘ভালো বলেছে। এখন থেকে পুতুলের মত জামা কিনে দিবো।’
– ‘ব্রাইট কালারগুলো পড়তে বলেছে। এক রঙা, কোনো ফুল থাকবে না।’
– ‘হুম বুঝেছি। ঠিকই বলেছে।’
– ‘জানেন আমি সারাদিন ওনার সাথে গল্প করেছি। আপুর কথাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। ওনার ডিজাইনার হওয়ার গল্প শুনেছি। আমার ও ছোট থেকে এটা ওটা ডিজাইন করতে ভালো লাগতো। ভাবছি ফ্যাশন ডিজাইনিং সাবজেক্ট নিয়ে পড়বো।’
– ‘তাই! খুবই ভালো হবে। প্রচুর পরিশ্রম হবে শুরুতে, পারবে তো?’
– ‘পারবো না কেন? আপনি তো আছেন ই।’
– ‘হ্যা, চুল মোছার জন্য।’

বলতে বলতে চুলগুলো ভালোমতো মুছে দিলো মেঘালয়। তারপর মিশুকে সোজা করে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘ফাইনালি আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা হচ্ছে?’
– ‘হুম হচ্ছে।’
– ‘রাত অনেক হয়েছে, সারারাত গল্প করেই কাটিয়ে দিই কি বলো?’

মিশু চমকে উঠে বললো, ‘হুম। আমার অনেক গল্প আছে আপনাকে শোনানোর। অনেক গল্প, সব শোনাবো।’

মেঘালয় মিশুকে নিয়ে এসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মিশু ওর সামনে বসে মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকালো। মেঘালয় বললো, ‘তোমার সব কথা শুনবো। বলো কি কি কথা পেটে উঁকিঝুঁকি মারছে?’

মিশু সোজা হয়ে বসলো গল্প বলার জন্য৷

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here