হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৩
মিশু মনি
.
৭৬
ঠিক যেন স্বপ্নের মত একটা রাত কাটলো। এতটা প্রশান্তি, ভালোবাসা, স্বপ্নে ঘেরা একটা রাত্রি ছিলো, যা প্রতিটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা জুরে থাকে। কিন্তু সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বাঁধলো বিপত্তি।
বর্ষা আহমেদ বললেন, ‘মিশু আজ আমার সাথে হাইকমিশনার অফিসে সাক্ষাতের জন্য যাবে। তোমাকে কোন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন দেয় দেখো।’
চমকে উঠলো সবাই। মেঘালয় মিশু’র দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ‘মানে! মিশু যখন বাইরে যাবেই না তাহলে ভাইভায় যেতে হবে কেন?’
মা বললেন, ‘বাইরে না যাওয়ার কথা তুলছো কেন? স্কলারশিপ পেয়েছে, অবশ্যই যাবে। আমার ঘরে প্রতিটা ছেলে মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছেনুযায়ী ক্যারিয়ার বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আছে।’
মেঘালয় ও মিশু একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। মেঘ বললো, ‘কিন্তু মিশুর এই স্কলারশিপ নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না।’
মা বললেন, ‘তুমি যা মনে করছো তোমার স্ত্রী’র সেটা নাও মনে হতে পারে। অনেকের স্বপ্ন থাকে বিদেশে আন্ডারগ্রাড করার। একটা সুযোগ পেয়েছে, সেটাকে ফেলে দিতে হবে কেন? ভালো ভার্সিটি হলে গবেষণার একটা ভালো সুযোগ পাবে। বিভিন্ন দেশের বন্ধুবান্ধব হবে, বাইরের দেশের ডরমিটরিতে থাকার এক্সপেরিয়েন্স হবে, আরো অনেক দেশ ঘুরে দেখার সুযোগ পাবে।’
কেউ কোনো কথা বললো না। আকাশ আহমেদ মাথা নিচু করে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করছেন। এদিকে কারো মুখে কোনো কথা নেই দেখে কিছুক্ষণপর উনি বললেন, ‘আমরা সবকিছুর আগে মিশু’র ইচ্ছেটা শুনি। ওর এমবিশন কি? আর ও ঠিক কোথায় পড়াশোনা করতে চাচ্ছে?’
মিশু গম্ভীর হয়ে গেলো। সবসময় তো ভেবে এসেছে জীবনে বড় হতে হবে। কিন্তু সঠিক কোনো লক্ষ্য কখনো স্থির করা হয়েছিলো কি? লক্ষ্য থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ করা হয়নি। ছোটবেলায় সবারই স্বপ্ন থাকে ডাক্তার হওয়ার। স্যার যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, বড় হয়ে কি হতে চাও? একবাক্যে বলবে ডাক্তার। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হওয়ার সাথে সাথে স্বপ্ন বদলায়, জীবনের লক্ষ্য বদলায়। ছোটবেলায় যেটা ড্রিম ছিলো, বড় হওয়ার সাথে সাথে সেটা শুধুমাত্র কল্পনা হয়ে দূরে সরে যায়। এখন কি লক্ষ্য আছে সেটা নিজেই জানেনা মিশু।
মেঘালয় মিশু’র দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি ভাবছো এত? আমার কথা ভাবতে হবে না। তোমার ইচ্ছের কথা বলো। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
– ‘আমি কিছুই ভাবছি না। সত্যি বলতে আমি আমার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারছি না।’
মা বললেন, ‘তুমি আজকে সাক্ষাত করে আসো। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। এরপর ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিও। লাইফে এমবিশন, হাইয়ার স্টাডি, সাবজেক্ট চয়েস এসব খুবই ইম্পরট্যান্ট।’
– ‘আমার বাইরে পড়তে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো। ইচ্ছে ছিলো বলেই তো পাসপোর্ট বানিয়েছি, এপ্লাই করেছি, প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি।’
বাবা হেসে বললেন, ‘তাহলে তোমার ইচ্ছেই সই। তোমার যা ভালো হবে, সেটাই করো। আমাদের কোনোকিছুতেই আপত্তি নেই। যেকোনো ভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করতে চাইলে করো। পড়াশোনা না করলেও আশাকরি সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার মেয়ে হয়েছো যখন, পড়াশোনার সর্বোচ্চ জায়গায় তোমাকে যেতে বলবো। এক্ষেত্রে যত টাকা লাগুক, খরচ করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মানুষ হতে হবে।’
মিশু উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আপনি সত্যিই আমার বাবা। আমার মাঝেমাঝে মনেহয় কোনো স্বপ্নের জগতে আছি। যেখানে আমাদের মা বাবা ই অনেক সময় আমাদের ইচ্ছেটা বোঝেন না, নিজের স্বপ্ন তো দূরের কথা বরং তাদের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দেন। সেখানে আপনারা যেভাবে পুত্রবধূ’র ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, দেশের সব বাবা মা যদি আপনাদের মত হতেন!’
আকাশ আহমেদ হেসে বললেন, ‘হয়েছে বাবা। কৃতজ্ঞতা আর সম্মানের জায়গাটা ভূলে যেওনা। তাহলে আর কোনো প্রশংসা লাগবে না। তুমি সকাল সকাল বর্ষার সাথে গিয়ে ভাইভা দিয়ে আসো।’
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
এমন সময় মেঘালয় খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমার কাজ আছে, রুমে যাচ্ছি।’
সবাই তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ও কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। মিশু করুণ মুখ করে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়ের কষ্টটা বুঝতে পারছে ও। কিন্তু ওরও যে খুব ইচ্ছে ছিলো দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার। এখন বাবা মায়ের উৎসাহে ইচ্ছেটা আরো বেশি পেয়ে বসেছে। চলে গেলে মেঘ কি খুব বেশি কষ্ট পাবে?
মৌনি বললো, ‘আব্বু, ভাইয়া বোধহয় মিশুকে ছাড়তে চাইছে না। দেখেছো কেমন রেগে গেছে?’
বাবা বললেন, ‘রাগুক। প্রত্যেকের নিজস্ব স্বপ্ন আছে, লক্ষ্য আছে। আমার কাছে বিয়েটা লাইফের সবকিছু নয়। বরং এটা ছোট্ট একটা অংশ। প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এসব নিয়ে পড়ে থাকলে জীবনের অর্থটাই থাকলো কোথায়? মেঘালয়ের উচিৎ ছিলো একজন প্রতিষ্ঠিত গ্রাজুয়েট মেয়েকে বিয়ে করা। যেহেতু বিয়েটা দূর্ঘটনাবশত হয়ে গেছে, এখন এই মেয়েটার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে হবে না? সংসারের মত জটিল সমীকরণে এত তাড়াতাড়ি ওকে না বাঁধলেও হয়।’
মৌনি আর কোনো কথা বললো না। বাবা মায়ের চিন্তা ভাবনা অনেক উন্নত। কোনো যুক্তি সেখানে খাটবে না, কোনো উত্তর ও দেয়া যাবে না।
বাবা মিশুকে বললেন, ‘বিল গেটসকে তার মা কি উপদেশ দিয়েছিলেন জানো? এমন স্বপ্ন দেখবি যেটা মানুষকে বলতেও ভয় লাগবে। এমন কাজ করবি, যা অন্য কেউ করছে না। বেশিরভাগ মানুষ ঘুরেফিরে একই পথে ক্যারিয়ার গড়ে তোলে। কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। তুই সবার চেয়ে ভিন্ন পথে হাঁটবি, ভিন্ন কাজ করবি। তুই নিজেই পথ তৈরি করবি, মানুষকে স্বপ্ন দেখাবি। মায়ের এই উপদেশ বিল গেটসের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। পৃথিবীজুরে বিপ্লব এনেছে, স্রোতের বাইরে গিয়ে কোটি কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখায় তিনি। এজন্য আমি বলবো, সবসময় স্রোতের হাল ধরে চলার চিন্তা বাদ দাও। স্রোতের বাইরে গিয়ে কঠিন কিছু করবে।’
মিশু মুগ্ধ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে! চোখের পলক পড়ছে না ওর। প্রত্যেকটা কথা শিরা উপশিরায় প্রতিটা রক্তবিন্দুতে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। সত্যিই তো, জীবনটাকে এভাবে ভেবে দেখা হয়না কখনো। জীবনকে নিয়ে উচ্চ আশা করার কথাও অনেকেই ভাবে না।
বাবা বললেন, ‘মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলে শুনবে ওর পড়াশোনা করতে কত কষ্ট করতে হয়েছে। ওর পড়াশোনায় আর্থিক সাপোর্ট খুব কম করেছি। ওকে স্কলারশিপে গ্রাজুয়েশন করতে হয়েছে। এতে করে লাভটা কি হয়েছে জানো? সিজিপিএ চারের মধ্যে তিন পয়েন্ট থাকতেই হবে। প্রত্যেক ইয়ারে সিজিপিএ থ্রি পয়েন্ট না থাকলে স্কলারশিপ বাতিল। স্কলারশিপ বাতিল হলে আমরাও ওকে সাপোর্ট দিচ্ছি না। এই চাপে পড়ে মেঘালয় ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে প্রতি সেমিস্টারে রেজাল্ট ভালো ছিলো আর ফুল ফান্ড স্কলারশিপে ওর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট।’
মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘আপনারা অনেক অদ্ভুত! এজন্যই বলি লোকটা এমন কেন? আজকে বুঝলাম বাবা মা ওনাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। স্যালুট তোমাকে আব্বু।’
মিশু কপালে হাত তুলে স্যালুট জানালো। বাবা মা দুজনেই হাসলেন। মা মিশু’র গাল টেনে দিয়ে বললেন, ‘তোকে সাংঘাতিক কিউট লাগছে। দেখলেই ইচ্ছে করে গাল টেনে আদর করে দেই।’
মিশু বললো, ‘গাল টেনে কিভাবে আদর করে মা? এত জোরে গাল টানলে তো ব্যথা লাগে।’
– ‘ওলে বাবালে ব্যথা লাগে? আচ্ছা বাবুতাহ এখন থেকে আলতো কলে গাল তানবো।’
কথাটা বলেই মা আরো জোরে গাল টেনে ধরলেন। মিশু চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, ‘আম্মু গোওওও, ব্যথা পাচ্ছি।’
– ‘যা ছেড়ে দিলাম। তোর আব্বু আম্মু কালকে আসবেন। ফোন করেছিস?’
মিশু উৎফুল্ল হয়ে বললো, ‘সত্যি! আমি এখনো ফোন করিনি।’
– ‘নতুন বাপ মা পেয়ে পুরনোদেরকে ভূলে গেছিস। কালকে তোর মায়ের কেমন কানমলা খাস দেখবো।’
মিশু হেসে বললো, ‘আমার মনেই হচ্ছে না আব্বু আম্মুকে ছেড়ে এসেছি। আপনারা সে অভাবটা বুঝতে দিলেন কখন?’
বলেই মিশু শ্বাশুরি মাকে জাপটে ধরলো। হঠাৎ ই কান্না পেয়ে গেলো ওর। মাথা তুলে বললো, ‘আমি রুমে যাই এখন।’
ঘরে এসে দেখলো মেঘালয় গালে দিয়ে বসে আছে। মিশু গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে খপ করে মেঘালয়ের গলাটা চেপে ধরে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দিলো ওকে। তারপর মেঘালয়ের বুকের উপর বসে দুই পাশে দুই পা রেখে দুইহাতে গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই সুন্দর মানুষটা, আপনার মন খারাপ?’
মেঘালয় মিশু’র আচমকা এমন আক্রমণে থ হয়ে গেছে। মিশু’র চোখে চোখ রেখে মেঘালয় বললো, ‘আমাকে তুই ভালোবাসিস?’
মিশু মেঘালয়ের নাক টেনে ধরে বললো, ‘হ্যা বাসি তো। জানেন না?’
– ‘সত্যি বাসিস?’
– ‘হ্যা রে বাবা সত্যি বাসি।’
মিশু মেঘালয়ের কানদুটো দুহাতে টেনে ধরে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সুরে বললো, ‘ভুম ভুমমমম.. গাড়ি চালাচ্ছি। পিপ পিপ পিপ..’
মেঘালয় এক ঝটকায় মিশুকে নিচে ফেলে এমন জোরে ওর কোমরটা চেপে ধরলো সে চেঁচিয়ে উঠলো মিশু। মেঘালয় ওর চোখে গভীরভাবে তাকালো। মিশু চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘সমস্যাটা কি হ্যা?’
– ‘তুই আমাকে রেখে বিদেশে পড়তে যাবি?’
– ‘ভালো কোনো ইউনিভার্সিটি হলে ভেবে দেখবো। আব্বু আম্মু’র কথা শুনে মনে হচ্ছে ওরা আমাকে পাঠিয়েই ছাড়বে। আপনি কি চাইছেন?’
মেঘালয় বলল, ‘আমাকে সবসময় ভালোবাসবি। যখন তখন আমার বুকের উপর উঠে এরকম গাড়ি চালাবি। তোকে কোলে বসিয়ে আদর করবো। কিন্তু আমি জানি বাবা কি বলেছে। সে শিক্ষাটা আমিও পেয়েছি। জীবনে এসবের বাইরেও অনেক কিছু আছে। আমি কিচ্ছু জানিনা, শুধু জানি ভালোবাসি রে মিশু।’
মিশু মেঘালয়কে শক্ত করে চেপে ধরতে ধরতে বললো, ‘আমিও ভালোবাসি মেঘমনি। খুব খুব খুব ভালোবাসি।’
– ‘তুই চলে গেলে তোকে ছাড়া থাকবো কিভাবে বল তো?’
মিশু কোনো কথা বললো না। মেঘালয়ের গরম নিশ্বাস গলায় পড়তেই কেঁপে উঠতে লাগলো ও। দুহাতের বন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করে রইলো ওকে। মেঘালয়ের বুকের ভেতরটা কেঁপে যাচ্ছে। একইসাথে দু ধরণের অনুভূতি। একদিকে আপন করে পাওয়ার সুখ, অন্যদিকে দূরে যেতে দেয়ার যন্ত্রণা।
চলবে..