হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৫
মিশু মনি
.
৭৯
দ্রুত গাড়ি টেনে শহর থেকে দূরে একটা বৃক্ষঘেরা দোকানে নিয়ে এলো মেঘালয়। গাড়ি থেকে নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিলো মিশু। শহরের শব্দদূষণে ঘেরা গরম পরিবেশ থেকে কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি। এখানে তেমন কোনো শব্দ নেই, আলো নেই, মাঝেমাঝে দূরের রাস্তায় হুশ করে একটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ কানে আসে। বেশ ভালোই লাগছে।
মেঘালয় মিশু’কে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলো। একজন মধ্যবয়সী মহিলা দোকানদারি করছেন। মেঘালয় কাছে যেতেই উনি হেসে বললেন, ‘কেমন আছেন সাহেব?’
– ‘ভালো আছি খালা। তুমি ভালো আছো?’
– ‘এইতো আছি। বহুদিন পর এসেছো। প্রেমিকা?’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘বউ। বিয়ে করেছি খালা।’
– ‘ওমা! মেয়েটা মিষ্টি আছে।’
– ‘থ্যাংকস খালা। আইসক্রিম হবে না?’
– ‘হবে। শুধু ভ্যানিলা হবে, চকোলেট শেষ হয়ে গেছে।’
– ‘ওটাই দিও। আমাকে সুজির রসবড়া আর কফি দিও। আর ওকে আইসক্রিম।’
– ‘দিচ্ছি, বসো গিয়ে। আইসক্রিম কাপে দেবো না কোণে?’
– ‘কাপেও না, কোণেও না। একটা বালতি কিংবা গামলা থাকলে গামলা বালতি ভরতি করে দাও। আমার বউয়ের আইসক্রিমের সাধ মেটাবো আজ।’
হো হো করে হেসে উঠলেন দোকানি মহিলা। মিশু হা করে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বললো, ‘ইস এমনভাবে বলছে যেন আমি রাক্ষস। আইসক্রিম ভালো লাগে বলে এমন নয় যে এক গামলা আইসক্রিম খাবো।’
মেঘালয় মিশু’র দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এক বালতি দিতে বলেছি। এটা তো বলিনি যে ইয়া বড় বালতি হবে। বালতির সাইজ হবে ছোট্ট একটু। চার ইঞ্চি।’
মিশু ক্ষেপে গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করলো। দোকানি মহিলা হেসে বললেন, ‘তুমিও যা দুষ্টু বাবা। বৌ মনি তুমি মন খারাপ কইরো না। আমি তোমাকে কোণেই দিচ্ছি। একবার শেষ হয়ে গেলে আবার নিও। গামলায় দিলে তো গলে যাবে। তুমি অল্প অল্প করে এক গামলা খেও।’
মিশু বললো, ‘আমি কি রাক্ষস? আর মেঘমনি সবার সামনে আমাকে এভাবে বলেন কেন? সবাই মনেমনে বলবে মেয়েটা রাক্ষসী। ওর স্বামীর টাকা পয়সা সব বুঝি খেয়েই শেষ করে দেবে।’
হো হো করে হেসে উঠলো মেঘালয়। তারপর কাছে এসে মিশুর কাঁধে হাত রেখে ওকে টেনে নিয়ে বললো, ‘তোমার বর অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে প্রচুর পরিশ্রম করেছে বুঝলে? যাতে করে তার লক্ষী বউটার সব আবদার পূরণ করতে পারে। আমার লক্ষী বউটার তো তেমন কোনো আবদার ই নেই, শুধু খাওয়া ছাড়া। আমার পরিশ্রম টাকে সার্থক করতে হবে না?’
মিশু মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘তাছাড়া আর কি আবদার করবো শুনি?’
– ‘বউদের কতরকম আবদার থাকে..’
– ‘যেমন?’
মেঘালয় মিশুকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা। দূর থেকে আলোর ঝলকানি এসে পড়ছে কোলের উপর। বসতে বসতে মেঘালয় বললো, ‘রূপচর্চা, অর্নামেন্টস, আজকে এইখানে ঘুরতে যাবো, কালকে ওইখানে ঘুরতে যাবো, শপিংয়ের অভ্যাস তো আছে ই। এগুলোর বাইরেও কত কি..’
মিশু বললো, ‘এগুলোতে কি আর এমন খরচ হয়?’
– ‘হা হা হা। বাবু তুমি তো ঢাকায় থাকো না, তাই জানো ও না। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের রূপচর্চা করতে দেখে পুরো হা হয়ে গিয়েছিলাম।’
– ‘কেন?’
মেঘালয় বললো, ‘একদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। দুপুর আমাকে কল দিয়ে বললো মিনা বাজারের সামনে থেকে আমাকে একটু বাসায় রেখে আসবি? আমি রীতিমত মিনা বাজারে এসে তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। পরে সে বেড়িয়ে এসে বললো, আমিতো ফারজানা শাকিলে ছিলাম। আমি হা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কি? সে বললো, মেইকওভার। ফেসিয়াল ট্রিটমেন্ট করতে এসেছিলাম।’
কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম, তোদের এই রূপচর্চায় খরচ কেমন রে?
সে হেসে হেসে বললো, ‘আজকে শুধু ফেসিয়াল করেছি, তিন হাজার লেগেছে। মেনিকিউর, পেডিকিউর, হেয়ার ট্রিটমেন্ট, বডি ওয়াশ, ম্যাসাজ এইগুলোতে আলাদা আলাদা খরচ। এগুলোর বাইরেও কন্সিলার, প্রাইমার, ফেস পাউডার সব বিদেশি প্রোডাক্ট লাগে। একটা সানস্ক্রিনের দাম দুই হাজার টাকা। ভাবা যায়?’
মিশু হা হয়ে শুনছিলো এতক্ষণ। মেঘালয় ভ্রু নাচাতেই ও বললো, ‘আমার এসব ভালো লাগে না। কিন্তু বডি ম্যাসাজ টা কিভাবে করায়? সুড়সুড়ি লাগে না?’
– ‘আমি সুড়সুড়ি ভেঙে দিয়েছি না?’
ক্ষেপে গিয়ে মেঘালয়কে মাইর শুরু করে দিলো মিশু। আর মেঘালয় হো হো করে হেসেই চলেছে। দোকানি খালা এসে ট্রে সামনে রেখে বললেন, মারামারি করছো কেন?
মিশু মাইর বন্ধ করে বললো, ‘জানেন খালা, এই লোকটা এত দুষ্টু! ওনার হাড়ে হাড়ে শয়তানি কিলবিল করে।’
– ‘জানি জানি। এইগুলা সহ্য করো। ছেলেরা একটু দুষ্টু না হলে হয় না।’
মেঘালয় সুজির রসবড়া নিয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে বললো, ‘ইয়াম্মি! খালা বহুদিন পর খেলাম। তুমি এটা যা বানাও না..’
মিশু বললো, ‘এমা! এগুলো তো মিষ্টি। আমিও খাবো।’
– ‘হা করো। খাইয়ে দিচ্ছি।’
মিশুকে মিষ্টি তুলে খাওয়ালো মেঘালয়। খালা দোকানে ফিরে এলেন। মিষ্টি শেষ করে মেঘালয় কফিতে চুমুক দিলো আর মিশু আইসক্রিম। আইসক্রিম দেখে সে কি আনন্দ মেয়েটার। ছোট ছোট আনন্দগুলোই জীবন টাকে কত উপভোগ্য করে তোলে।
মেঘালয় বললো, ‘জায়গাটা কেমন লাগছে তোমার?’
– ‘খুব নিরিবিলি। একটা রাত এখানে থাকতে পারলে ভালো হতো। মনে করো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করছি। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে যাবা।’
– ‘নিরিবিলি দেখলেই তোমার খালি কোলে উঠে ঘরে যেতে ইচ্ছে করে তাই না?’
মিশু আবারো ক্ষেপে এগিয়ে এলো। হাসি শুরু করে দিলো মেঘালয়। হাসি থামিয়ে মিশু’কে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘মিশু, তোকে খুব ভালোবাসি রে। এত কাছে থাকার পরও ইচ্ছে করে তোকে আমার বুকে পিষে ফেলি। কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে রে। তুই আমাকে রেখে ইন্ডিয়ায় গেলে আমি থাকবো কি করে?’
গলা ধরে এলো মেঘালয়ের। আমি থাকবো কি করে- কথাটা শুনেই বুকের ভেতর কেমন উথাল পাথাল শুরু হয়ে গেলো মিশুর। সত্যিই তো, এই মেঘালয়কে ছাড়া সে নিজেও কি থাকতে পারবে? এই মুহুর্তগুলো সবসময় হৃদয়ে কাঁপন ধরাবে। ইচ্ছে করবে ছুটে চলে যাই মানুষটার কাছে। কিন্তু চাইলেও আসা সম্ভব হবে না। মাঝখানে একটা সীমান্ত দুজনকে দুভাগ করে রাখবে। মিশু মেঘালয়ের শার্ট খামচে ধরলো। বুকের উপর জোরে খামচে ধরতে ধরতে অনেক খানি জায়গা একেবারে দাগ করে দিলো। ব্যথা পেলেও কোনো শব্দ করলো না মেঘ। ভালোবাসার এই আচঁড় গুলোও অনেক শান্তি দেয়। যন্ত্রণাগুলো কমিয়ে দেয়।
মিশু বিড়বিড় করে বললো, ‘আমি কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে। আমার কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে তোমাকে আপন করে পেয়েছি। আমি দূরে সরে গেলে তুমি মরেই যাবে।’
মিশুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো মেঘালয়। চোখে পানি এসে গেছে ওর। একইসাথে প্রিয় মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে হারানোর ভয়ের যন্ত্রণা। ভালোবাসারা এমন ই, খুব আপন করে পেলে হারানোর ভয়টা মনে চেপে বসে।
মিশু বললো, ‘আজকাল কয়েক বছর সংসার করার পর মানুষটাকে আর ভালো লাগে না, বিরক্তি এসে যায়। আমার ক্ষেত্রে আপনার এমন হবে না তো?’
– ‘তুমি এমনই একটা মেয়ে, যাকে শত শত বছর সামনে বসিয়ে রাখলেও বিরক্তি আসবে না মিশু।’
– ‘সত্যি?’
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘নাহ। ঢপ মারলাম। তোকে আমার এত বিরক্ত লাগেএএএ, ন্যাকা একটা মেয়ে। শাবনূরের মাসি, শাহতাজের চাচী, সাফা কবিরের নানী।’
মিশু আবারো ক্ষেপে তেড়ে এলো মেঘালয়ের দিকে। ভয়ানক রাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজকে মেঘালয়ের রক্ষে নেই। ধরতে পেলেই খবর আছে। মেঘালয় উঠে একটা ভো দৌড় দিলো। বেঞ্চের চারিদিকে দুজন মিলে দৌড় প্রতিযোগিতা চলতে লাগলো। মেঘালয় চাইলেই বেঞ্চের উপর দিয়ে লাফ পারে কিন্তু মিশু পারে না। ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো মিশু। মেঘালয় পিছনে ওর কানের কাছে এসে বললো, ‘ম্যাও!’
মিশু চমকে উঠলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে আবারো দৌড়। মিশু নিজেও হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ পর মেঘালয় এসে মিশুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপরেই। মিশু মেঘালয়ের নাক টেনে ধরে বললো, ‘এখন মারি?’
– ‘মিউ মিউ মিউ।’
মিশু হেসে মেঘালয়ের কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলো। মেঘালয় আঙুল তুলে আকাশে ঝুলতে থাকা পূর্ণিমার চাঁদ টা দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘দেখেছো কি অপরূপ?’
– ‘হুম। কি সুন্দর আলো ছড়িয়েছে!’
– ‘তার চেয়েও সুন্দর আলো কোনটা জানো?’
– ‘কোনটা?’
– ‘তুমি। আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছো।’
মিশু মুচকি হেসে বললো, ‘উহু। তুমি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ আলো।’
মিশুর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখলো মেঘালয়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে যেতে লাগলো মিশুকে। দুজনে গল্প করতে করতে কোনো এক কল্পলোকে হারিয়ে গেলো। চারিদিকের মুগ্ধকর পরিবেশ সবাই ওদেরকে সাহায্য করছিলো জীবনটাকে নতুনভাবে উপভোগ করতে।
চলবে..