হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৭
মিশু মনি
.
৮৩
মেঘালয় অনেক রাত করে বাসায় ফিরলো। মিশু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মেঘের পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো ওর। মেঘালয়ের চেহারায় এখনো দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কোনো কথা না বাড়িয়ে খাবার নিয়ে এলো মিশু। মেঘালয় গোসল সেরে খালি গায়ে রুমে এসে বসেছে। মিশু এসে ওর মুখের সামনে ভাত তুলে দিলো।
খেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মুখে তুলে দেয়া ভাত সরাতে পারলো না মেঘালয়। খাবার মুখে নিয়ে বললো, ‘তুমি খেয়েছো?’
– ‘না।’
– ‘কেঁদে চোখ ফুলিয়েছো কেন?’
– ‘কে বললো আপনাকে?’
– ‘আমি কি কানা?’
– ‘আপনি মেঘালয়।’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘টেনশন কোরো না। আসলে আমার ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। ছয় লাখ টাকার হিসেব মেলাতে পারছি না। একার প্রচেষ্টায় ব্যবসাটাকে এতদূর নিয়ে এসেছি। ছয় লাখ টাকা গরমিল হওয়া মানে কতটা লস বুঝতে পারছো তুমি?’
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হুম। কি করে হলো এমন?’
– ‘গত দু’মাস আমি ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারিনি। নিজে অফিসে যাইও নি, খোঁজ ও নেইনি। আমার উদাসীনতার কারণেই এই অবস্থা।’
– ‘ইস! আমি আপনার জীবনে এসেই যত ঝামেলা পাকিয়েছি তাই না?’
– ‘এরকম ভেবো না। আমার উচিৎ ছিলো বিজনেসে সময় দেয়া। কিন্তু তোমাকে পেয়ে পুরো দুনিয়া ভূলে গিয়েছিলাম আমি।’
মিশু মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকালো। বিয়ের পর থেকে প্রত্যেকটা কাজের জন্য ওর নিজেকে অপরাধী মনে হতো। এমনকি বিয়েটাও ওর ভূলের জন্যই হয়েছে। সবসময় ওর জন্য এত ঝামেলা লেগে থাকে যে ওর নিজেকে শনি মনেহয়। মেঘালয় বলেই এতকিছু সামলে নিয়েও ওকে ভালোবাসে। অন্য কেউ হলে তো রাগে কবেই ছেড়ে চলে যেতো।
মিশু’র কাচুমাচু করা মুখটা দেখে মেঘালয় বললো, ‘অমনি গাল ফোলানো শুরু করলে? বলেছি তো তোমার মন খারাপ করার মত কিছু হয়নি। আমাকে সময় দাও, আমি সবকিছু গুছিয়ে ফেলবো।’
মিশু মেঘালয়ের মুখে ভাত তুলে দিয়ে বললো, ‘খেয়ে নিন।’
মেঘালয় মিশুকেও খেতে বললে মিশু দু’বার খাবার মুখে দিলো। হাত ধুয়ে এসে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো মিশু। মেঘালয় ভেজা চুল হাত দিয়ে আঁচড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ ও ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। ওকে এই মুহুর্তে বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। নিঃশব্দে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো মিশু।
মাথায় নানান আজগুবি চিন্তাভাবনা আসছে। মেঘালয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই একদিন ভালো সময় কাটালে পরেরদিন একটা বিপদ ঘটবেই। একদিন দুজনে রোমান্স করলে পরেরদিন একটা ঝামেলা এসে দুজনের মাঝে বাগড়া দিবেই। কেন এই অসংগতি? মিশুর নিজেকে তুচ্ছ ও নর্দমার মত লাগছে। এই মানুষটা ওর জন্য অনেক ছাড় দিয়েছে। দুজনকে পাশাপাশি দাঁড়ালে মোটেও মানাতো না। সবকিছুকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরেই রেখেছে। আকর্ষণ করার মত সৌন্দর্য মিশুর চেহারায় ছিলো না। কেবল কথা বলে একটা মানুষকে এতটা আপন করে নেয়াটা মেঘালয়ের দ্বারাই সম্ভব। ভালোবাসা না থাকা স্বত্ত্বেও ওই মানুষটা বাসর ঘরের প্লান করেছে, এতগুলো মানসিক চাপ সামলে নিয়েও মিশু’র মন ভালো করে দেয়ার চেষ্টা করেছে।
মেঘালয় ই একমাত্র মানুষ যে কিনা মানসিক অবস্থা যত খারাপই হোক, কখনো মিশুকে তুচ্ছ করেনি। অবহেলাটা মিশু’র দিক থেকেই এসেছিলো। ডিভোর্সের প্রস্তাব মিশু ই দিয়েছিলো, তখনো মেঘালয় মিশুকে ভালোবাসতো না। ও কেবল ভেবেছিল মিশুকে ছেড়ে দিলে মানসিক ডিপ্রেশনে মেয়েটা সুইসাইড করবে। একের পর এক ধাক্কা সামলে নিতে পারবে না। তারচেয়ে আমি বরং ওর পাশে থেকে ওকে উৎসাহ দেই। একটা নতুন জীবন শুরু করি। এই মেঘালয় ই তো বুকে আগলে রেখে প্রত্যেকটা রাত মিশুকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসার নতুন সব রাজ্য ঘুরিয়ে এনেছে। কেয়ারনেসের দিক থেকেও বিন্দুমাত্র কমতি ছিলো না। সত্যিকার ভালোবাসা তো এটাই, যে ভালোবাসায় নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়।
ভাবতে ভাবতে চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। মেঘালয়ের এই কঠিন সময়ে ওর পাশে থাকা উচিৎ। ওকে ফেলে বিদেশে যাওয়াটা চরম স্বার্থপরতা হয়ে যাবে। তাছাড়া মেঘালয় নিজেও মিশুকে ছাড়তে চায় না। এ অবস্থায় কি করা উচিৎ ওর? স্কলারশিপের চিন্তাটা বাদ দিয়ে দেয়াই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দূরে সরে গেলে মানুষটা অনেক কষ্ট পাবে।
এমন সময় কাঁধে কেউ হাত রাখলো। মুখ ঘুরিয়ে মেঘালয়কে দেখে কান্না বেড়ে গেলো মিশু’র। মেঘালয় বললো, ‘কি হয়েছে?’
– ‘আমার জন্য আপনার এত সমস্যা হয়। আমার কি করা উচিৎ বুঝতে পারছি না।’
– ‘তোমার এখন ঘুমানো উচিৎ। রাত হয়েছে অনেক, ঘুমিয়ে পড়ো।’
আপনাকে একটা কথা বলবো রাখবেন?’
– ‘কি?’
– ‘আমি আপনার সেবা করতে চাই। সেই সুযোগটুকু আমাকে দেবেন?’
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কিরকম?’
– ‘এই ধরুন আপনার মাথায় তেল মালিশ করে আপনাকে ঘুম পারিয়ে দিই? আপনার হাত পা টিপে দেই?’
– ‘হা হা হা। তোমার যা ছোট ছোট হাত।’
– ‘ছোট ছোট হাত তো কি হয়েছে? আমি আপনার অল্প একটু সেবা করি?’
– ‘হা হা হা। করলে একটু বেশি করেই করো। অল্প একটু কেন?’
– ‘না। আমি অল্প একটু ই করবো। দিই?’
– ‘আচ্ছা আসো।’
মেঘালয় বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। মিশু তেল নিয়ে এসে ওর মাথায় মালিশ করতে করতে বললো, ‘আপনার অনেক টেনশন তাই না?’
মেঘালয় সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘আরে নাহ। তোমার মত ছোট্ট একটু টেনশন।’
– ‘আমার এখন কি করা উচিৎ বলুন তো। আমি না বুঝতে পারছি না।’
– ‘তোমার যা ইচ্ছে হবে সেটাই করবে।’
মিশু বললো, ‘সবসময় যা ইচ্ছে হবে তাই করা যায় না। যা করা উচিৎ তাই করতে হয়।’
মেঘালয় মাথা তুলে মিশুর দিকে তাকালো। বাব্বাহ! মিশু দেখছি বড় হয়ে গেছে। যা করা উচিৎ এমনভাবে বললো যেন কত দায়িত্বশীল হয়ে গেছে। ওর মুখ দেখে মায়া লাগছে মেঘালয়ের।
মিশু বললো, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো মানছি। আপনাকে রেখে যেতে হবে এমন জানলে আমি এরকম ইচ্ছে করতাম না।’
মেঘালয় মিশু’র হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো, ‘আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ো। চিন্তাটা স্কিপ করে দাও।’
– ‘কতক্ষণ চলবে এভাবে? একটা সিদ্ধান্তে তো আসতে হবে।’
– ‘তুমি কি চাও?’
মিশু মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে বললো, ‘বুঝতে পারছি না।’
মেঘালয়ের নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। দুশ্চিন্তা করে কোনো ফল হবে না। যা করার ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে। এখন ঘুম দরকার।
মেঘালয় মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, ‘তাহলে চিন্তাটা আপাতত স্কিপ করে রাখো। ওটা পাঠকের উপর ছেড়ে দাও। তারা তোমাকে বিদেশ যেতে বললে যাও। আমার সাথে থাকতে বলে থাকো। এখন আপাতত আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোও তো পাগলী।’
চলবে..