হৃদমোহিনী পর্ব ৫৯

0
2486

হৃদমোহিনী
পর্ব ৫৯
মিশু মনি
.
ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে মেঘালয়। মিশু’র মুখ গম্ভীর। কি জানি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কি ভাবছে। মেঘালয়ের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করার সাধ্য অন্তত ওর হবে না। তবুও বুক ঢিপঢিপ করছে মেঘালয়ের। ও ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ভাবছো মহারানী?’
– ‘আই লাভ ইউ টু।’

কথাটা বলেই দুষ্টুমি হাসি ফুটে উঠলো মিশুর মুখে। মেঘালয় উঠে এসে ওকে জাপটে ধরলো। মিশু মেঘালয়কে দুহাতে আকড়ে ধরে বললো, ‘আমার খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করছে। চলুন না একটু একটু প্রেম করি।’
– ‘হা হা হা। আই লাভ ইউ সুইটহার্ট।’

মেঘালয় মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিলো। মিশু বললো, ‘আমি কাল থেকে আপনার সাথে অফিসে যাবো। আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিবেন। প্রতিদিন দুপুরে দুজনে একসাথে খাবো, একসাথে বাসায় ফিরবো। আর মাঝেমাঝে আপনার চেম্বারে ঢুকে টুক করে একটা চুমু খেয়ে দৌড়ে পালাবো।’
মেঘালয় মিশুর মুখের কাছাকাছি এগিয়ে এসে বললো, ‘আর?’
– ‘মাঝেমাঝে অফিস থেকে ফেরার সময় আমাকে ফুচকা খেতে নিয়ে যাবেন। বৃষ্টি হলে রিক্সায় করে ঘুরবো।’
– ‘আর?’
– ‘রাত্রিবেলা আপনি মশারি টাঙাবেন।’
– ‘আর?’
– ‘আর চুম্বনকালে দয়া করে চোখটা বন্ধ রাখবেন।’

মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। মিশুও হাসছে কিন্তু ওর হাসির শব্দ হিহিহি হিহিহি টাইপের। দুজনে হাসতে হাসতে মেঝের উপর বসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। কেন যে এভাবে পাগলের মত হাসছে কেউই জানে না।

হাসি থামিয়ে মিশু বললো, ‘আমাদের মেয়ে বাচ্চা হবে না ছেলে বাচ্চা?’
– ‘এই বাচ্চাটা আগে বড় হোক, তারপর।’

কথাটা বলেই মিশুকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এলো মেঘ। ওকে শুইয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে এসে চোখে চোখ রাখলো। মিশু লজ্জায় নীল হতে হতে বললো, ‘আপনার দৃষ্টি অনেক ভয়ংকর। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না।’
– ‘আজ অফিসে তন্ময় এসেছিলো।’

মেঘালয়কে সরিয়ে দিয়ে বিছানার উপর সোজা হয়ে বসলো মিশু। মুখটা নিমেষেই গম্ভীর হয়ে গেছে। এই সময়ে তন্ময়ের নামটা না নিলে কি হতো না? লোকটা খুব খারাপ।

মিশু রেগে বললো, ‘ওকে আমাদের মাঝে টেনে আনার কি দরকার ছিলো?’
– ‘না চাইলেও এসে যায়। আমি তো ওকে ডাকিনি।’
– ‘কেন এসেছিলো? যখন আমার সাথেই ওর কোনো যোগাযোগ নেই, সেখানে আপনার সাথে কেন রেখেছে?’
– ‘ক্ষমা চাইতে এসেছিলো।’

মিশু অবাক হয়ে বললো, ‘ক্ষমা! কিসের জন্য?’
– ‘সেদিন রাতে বগুড়ার যে ঘটনাটা তুমি আমার কাছে লুকিয়েছিলে, সেটার জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছিলো।’

মিশু চমকে উঠে মেঘালয়ের দিকে তাকালো। মেঘালয় হেসে বললো, ‘এতদিন পর ওর বিবেকবোধ জাগ্রত হয়েছে তাও ভালো।’

মিশু নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।

মেঘালয় বললো, ‘ও আমার বিশ্বাস ভাঙবে সেটা আমি কখনোই আশা করিনি। কিন্তু তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমি টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। এরপর তুমি যখন ফোন দিলে, তখনই তোমার কণ্ঠ শুনে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে তন্ময় তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। তুমি নিরাপদ ছিলে সেটাতেই শোকরিয়া জানিয়েছি।’

মিশু মেঘালয়ের বাহুতে মাথা রেখে বললো, ‘আমিও সেদিন তন্ময়ের কাছে ওরকম আচরণ আশা করিনি। আপনাকে সেদিন বলতে পারিনি আপনি কষ্ট পাবেন বলে। আপনি মানুষকে অনেক বিশ্বাস করেন। তন্ময় আপনার বিশ্বাসের যোগ্য ছিলো না।’
– ‘তুমি অনেক ভালো আর লক্ষী একটা মেয়ে মিশু। তন্ময় তোমারও যোগ্য ছিলো না। তন্ময় ওর সমস্ত অপরাধের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে আর বলেছে আর কখনো আমাদের সামনে আসবে না।’
– ‘আপনি কি বলেছেন?’

মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, ‘আমার কথার ধরণ তোমার জানা আছে। যা বলা দরকার তাই বলেছি।’
– ‘আমাকে বলা যাবে না?’

মেঘালয় মিশুর মুখটা ধরে বললো, ‘প্রেমিকাকে আমার পাশে কেমন দেখাচ্ছে সেটা ইম্পরট্যান্ট নয়। ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে, প্রেমিকা আমাকে কেমন রেখেছে। তার সাথে আমি কেমন থাকি, সে আমাকে কেমন বোঝে, কতটা খেয়াল রাখে, কতটা ভালোবাসে এসবই সবার আগে। মেয়েটাকে আমার পাশে সেলফিতে কতটা মানাচ্ছে তার থেকেও ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে, সেলফি তোলার সময় আমরা এই মুহুর্তটাকে কতটা এনজয় করছি। দুজনের খুনসুটি, হাসি, আনন্দ এসবই প্রধান। হাইহিল পড়ে সে হাঁটতে পারলো কি না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার সাথে হাঁটতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কিনা আমি সেটা ভাবি। দুজন মানুষ যখন দুজনের সামনে অনায়াসে, নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারবে না, সেটা কোনো রিলেশনশিপ হতে পারে না। দেখা করতে যাওয়ার সময় সাজগোজ করে, রঙিন জামাকাপড় পরে আসতে হবে কেন? সে সবসময় যেমন, আমি তাকে সেভাবেই ভালোবাসি। সে গাইয়া, সে ক্ষ্যাত আর যাই হোক না কেন, তাকে ভালোবেসেই আমি সন্তুষ্ট। আমার কাছে শো অফ এর থেকে হাজারগুণ ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে আমরা একসাথে কতটা ভালো আছি।’

মিশুর চোখে পানি এসে গেলো। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে হাতের বাঁধন আলগা করে দিলো। মেঘালয় ওর বুকে মিশুর মাথাটা চেপে ধরে বললো, ‘আজকে হাউমাউ করে কাঁদো। আজকেই যেন তোমার জীবনের শেষ কান্না হয়।’
– ‘মেঘমনি, ভালোবাসি।’
– ‘আমিও ভালোবাসি। তবে আজকের মত ঝগড়াটা আর কখনো লাগাবা না। আগেই বলেছিলাম একজনের রাগ হলে আরেকজনকে চুপ থাকতে হয়, এটাই নিয়ম।’
– ‘ভূল হয়ে গেছে, আর কক্ষনো এমন হবে না।’
– ‘আমার বুকে সবসময় এভাবে থাকবা।’
– ‘একটু নড়াচড়াও করবো না?’
– ‘হা হা হা, পাগলী একটা। শোনো, আগামীকাল আমাদেরকে কোর্টে যেতে হবে। যারা তোমাকে রেপ করার চেষ্টা করেছিলো, সেই মামলার শুনানি হবে। আর একটা ছেলে মাকে ফলো করেছিল, ওর নামে জিডি করেছি। সেটার ব্যাপারে উকিলের সাথে কথা বলতে হবে।’
– ‘আপনি সবসময় আমার হাত ধরে রাখবেন ঠিকাছে?’
মেঘালয় মিশুর মাথাটা আরো জোরে চেপে ধরে বললো, ‘বুকে আগলে রাখবো, হবে?’

মিশু শক্ত করে মেঘালয়কে জাপটে ধরলো। একইসাথে হাসছে আবার কাঁদছে। এই কান্নাই জীবনের শেষ কান্না হোক।

৮৬

এক বছর পর

দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেছে। এই এক বছরে মিশু হয়ে গেছে পাক্কা গৃহিণী। মেঘালয়ের ব্যবসায় এখন মিশু’র অবদান সবচেয়ে বেশি। দিনরাত এক করে মেয়েটা পরিশ্রম করে, সমস্ত কাজ দেখাশোনা করে। কখনো উপদেষ্টাদের সাথে কথা বলা, কখনো নিজেই শ্রমিকদের সাথে কাজ করা। মেঘালয় ওর কাজের গতি দেখে পুরোপুরি মুগ্ধ! এতটুকু বয়সের একটা মেয়ে অথচ নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে পরিশ্রম করছে। ও মনেপ্রাণে চাইছে আকাশ আহমেদের বিজনেসকে ছাড়িয়ে যেতে। মেঘালয়ের ব্যবসায় যে লোকসান হয়েছে সেটা পূরণ করে আরো দ্রুত উন্নতির জন্য প্রবলভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। একটা মেয়ে এতটা পরিশ্রমী কি করে হতে পারে সেটা মেঘালয়ের অজানা। সে নিজেও এত পরিশ্রম করেনি।

মিশু মাঝেমাঝে বলে, ‘আমি দিনের বারো ঘন্টা কাজ করতে চাই, বাকি বারো ঘন্টা খাওয়াদাওয়া ঘুম আর আদর।’
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, ‘আর গোসল?’
– ‘বারে, আদর করতে করতে গোসল করিয়ে দিবা। হা হা হা।’

মিশু ব্যবসায়ের গতি বিধি বেশ ভালো রপ্ত করে ফেলেছে। শ্রমিক যত দক্ষ হবে, পণ্য তত মানসম্মত হবে আর এভাবেই বিজনেসকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কারণে শ্রমিকের প্রশিক্ষণের জন্য তিনমাস মেয়াদে কয়েকটা ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। বেকার যুবক যুবতীদের জন্য ফ্রি তে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তারা মাস শেষে নির্দিষ্ট অংকের ভাতা পাবে আবার প্রশিক্ষণ শেষে নিজের দক্ষতার পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি চাকরিতে জয়েন করবে। মিশুর এই বুদ্ধিটা আকাশ আহমেদের পরিচিত অনেকেই পছন্দ করেছেন। মেঘালয়ের স্ত্রী’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে।

আজকে এক দলের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। তাদের পরীক্ষা নেবে স্বয়ং মিশু। মেঘালয় চেয়েছিলো কোনো পরীক্ষার ঝামেলায় না গিয়ে সরাসরি জয়েনিং লেটার দিয়ে দিতে। কিন্তু মিশু স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ‘দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কাউকে আর নিয়োগ দেয়া হবে না। তাছাড়া প্রত্যেকে প্রশিক্ষণ শেষে ভাতা পাচ্ছে এটাই বা কম কিসে?’

ওর যুক্তিতে মেঘালয় আর কথা বাড়ায় নি। পড়াশোনার জন্য ফ্যাশন ডিজাইনিং কে বেছে নিয়েছে মিশু। পড়াশোনা শেষ করে নিজস্ব একটা পোশাক কারখানা খোলার ইচ্ছে ওর। যাতে শুধুমাত্র নিজের ডিজাইন করা জামাকাপড় থাকবে।

যারা প্রশিক্ষণ শেষ করেছে তাদের অর্ধেকের সাক্ষাতকার নেয়া শেষ। সন্ধ্যে হয়ে আসায় আজকে বাসায় যেতে হবে। মেঘালয় মিশুকে বলেছে পিকমি রাইডে বাসায় চলে যেতে। ওর নাকি কোথায় একটা জরুরি মিটিং আছে। মিশু নিশ্চিন্তে বাসায় ফিরলো ঠিকই কিন্তু রাত বেড়ে গেলেও মেঘালয় কোনো ফোন করলো না দেখে ও অবাক হয়ে গেলো। প্রথমে ভাবলো হয়ত সে ব্যস্ত আছে। পরক্ষণে আবার মনে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধতে লাগলো।

ধীরেধীরে রাত সারে এগারোটা বেজে গেলো। মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। এবার দুশ্চিন্তা আরো জোরে চেপে ধরলো। নাম্বার বন্ধ হবে কেন! হয়ত ফোনে চার্জ নেই, একটু পরেই বাসায় ফিরবে – এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো মিশু।

রাত বাড়তে লাগলো। মেঘালয়ের নাম্বারও বন্ধ, বাসায় ফেরারও নামগন্ধ নেই। ড্রাইভারকেও সাথে নিয়ে যায় নি। বাবা মা কেউ বলতে পারছেন না মেঘালয় কোথায় আছে!

দুশ্চিন্তায় রাতে খেতে পারলো না মিশু। সারা রাত মেঘালয়ের নাম্বারে কল দিয়ে গেলো। নাম্বার বন্ধ!
মিশু টেনশনে পুরো বাড়ি ছোটাছুটি করছে। বাড়ির বাকি মানুষ গুলোকেও ঘুমাতে দিচ্ছে না। মেঘালয়ের সব বন্ধুদের বাসায় খোঁজ নেয়া হয়েছে, কেউ ওর খোঁজ জানে না।

মিশুর চোখ ফেটে জল আসছে। বিছানায় শুয়ে কতক্ষণ কাঁদলো নিজেও জানেনা। মেঘালয় কোথায় গেলো কিছু না বলে! ওর কোনো বিপদ হলো না তো?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here