হৃদমোহিনী
সূচনা পর্ব
মিশু মনি
.
১.
-“হেই সুইট ডার্লিং, কাম অন। তন্ময় নেই তাতে কি বেবি? আমিতো আছি। লেটস এনজয়।”
লোকটার বিশাল থাবা এগিয়ে এলো মিশুর দিকে। ভয়ংকর দুটো চোখ এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে চোখ দুটো। মিশুর গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে হাতুরি পিটতে লাগলো। নিজের ভূলেই নিজে ফেঁসে গেছে। লোকটা বিদঘুটে হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো কাছে। মিশু ভয়ে লোক বন্ধ করে ফেললো। লোকটা মিশুর মাথার পিছন দিকে একহাত দিয়ে শক্ত করে মাথাটা ধরে কাছে টেনে নিলো। মিশুর খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। বাকশক্তি বন্ধ হয়ে গেছে বোধকরি। লোকটা মিশুকে দুহাতে জাপটে ধরে বিছানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। শয়তানটার বিশাল দেহের নিচে পড়ে মিশুর ছোট্ট শরীরটা কেবলই একটু মুক্তির জন্য হাসফাস করছে। আর মনেমনে প্রার্থনা করছে, “হে আল্লাহ আমায় রক্ষা করো। আমায় রক্ষা করো মাবুদ।”
মিশু গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে লোকটাকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না। ক্রমশই ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। লোকটা শরীরের এখানে সেখানে হাত দিচ্ছে আর কি বিশ্রী সেই আচড়, মিশুর শুধু মনেহচ্ছে আগামীকাল পত্রিকায় বুঝি ওর প্রাণহীন নিথর দেহের একটা ছবি বের হবে। আচ্ছা,আব্বু খুব কষ্ট পাবেনা ছবিটা দেখে? আব্বুর কত স্বপ্ন ওকে নিয়ে,সব এই একটা রাতের মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? মিশু সুইসাইড করলে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে কে? বাবার কথা মনে হতেই একটা অন্যরকম মনোবল পেয়ে গেলো সে। গায়ের জোরে দাঁত বসিয়ে একটা কামড় দিলো হিংস্র লোকটার কাঁধের উপর। কামড়ের চোটে একটু সরে যেতেই উঠে দাঁড়ালো মিশু।
কিন্তু পালাতে পারলো না। লোকটা আবারো লম্বা হাতটা বাড়িয়ে ধরে ফেললো ওকে। একহাতে মিশুর গলাটা টিপে ধরে কাছে টেনে নিলো। এই মুহুর্তে আর কিছুই ভাবতে পারছে না মেয়েটা। এখানে কেউ ওকে বাঁচাতে আসবে না, নিজেকেই বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। মনোবল হারালে চলবে না। মিশু ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে, ওর চোখে আগুন ঝরতে লাগলো। গাল, মুখ শক্ত হয়ে উঠলো নিমেষেই। লোকটা ওর গলা টিপে ধরে আছে,মিশু ওর সামনে দাঁড়িয়ে ডান পা তুলে সোজা লোকটার পুরুষাঙ্গ বরাবর একটা লাথি দিয়ে বসলো। জায়গামত আক্রমণ করেছে একেবারে। শয়তান লোকটা ওখানে দুইহাতে চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে, এক ধরণের গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। মিশুর ইচ্ছে করলো শুয়োর টাকে পারলে খুন করে ফেলতে। কিন্তু রিস্ক নেয়া যাবেনা, খুন করার সাধ্য ওর নেই। এখন দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। দ্রুত, একটা সেকেন্ড ও দেরি করলে চলবে না। মিশু একটু এগিয়ে এসে হাতের কনুই দিয়ে গায়ের জোরে মারলো লোকটার মাথার উপর। পশুটার আর ওঠার শক্তি নেই। মিশু বড় আঘাত দিয়ে ফেলেছে মগজ বরাবর।
দরজা একটানে খুলে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করলো মেয়েটা। যত দ্রুত পারে ওকে পালাতে হবে,এই বাড়ির বাইরে গেলে অনেকটাই বিপদমুক্ত সে। শুধু মনেহচ্ছে পায়ে একটুও জোর নেই। স্বপ্নে দৌড়ালে যেমন রাস্তা একটুও এগোয় না,এখনো সেরকম মনেহচ্ছে। তবুও বারবার আব্বুর স্বপ্নের কথা ভেবে মনের শক্তি বাড়িয়ে নিতে লাগলো। সিঁড়ি দিয়ে ছুটে সাত তলা থেকে নিচে নেমেও কোথাও একদণ্ড দাঁড়ালো না। ছুটতেই থাকলো, কোনদিকে ছুটে কোথায় যাচ্ছে তা সে জানেনা, শুধু একটাই চিন্তা এখান থেকে পালাতে হবে। পায়ে যেন এতটুকুও জোর নেই, কেবল মনের জোরেই ছুটে চলেছে মেয়েটা।
২.
মেঘালয় ওর বন্ধুরা সহ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। এদিকে সিএনজি আসেনা, সিএনজির জন্য মেইন রোডে যেতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধু পূর্ব’র জন্য।
এমন সময় দেখতে পেলো একটা মেয়ে খুব জোরে ছুটতে ছুটতে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে জোরে জোরে হাফাতে লাগলো। মেয়েটি কয়েকবার জোরে শ্বাস নিতে নিতেই অজ্ঞান হয়ে রাস্তার উপর ধপ করে পড়ে গেলো। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো ওদের সবার। মেয়েটির দৌড়ের গতি দেখে মনেহচ্ছিলো সে কোনো ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তির জন্য ছুটছে, চোখেমুখেও সাংঘাতিক ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। মেয়েটি রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে আর একটু নড়াচড়াও করছে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ওরা সবাই ছুটে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালো। সকলে উপুড় হয়ে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলো সদ্য কৈশোর পেড়িয়ে তারুণ্যে পা দেয়া মেয়েটির দিকে। চেহারায় লাবণ্য আর মায়া যতটা আছে তারচেয়ে দূরন্তপনাই বোধহয় বেশি। দেখেই মনেহচ্ছে ঝরনার মত উচ্ছল একটি মেয়ে। ওরা সবাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
মেঘালয় ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে কয়েকবার ছিটা দিলো মেয়েটির মুখে। কয়েকবার চোখ পিটপিট করেই চোখ মেলে তাকালো মেয়েটি। মুখের উপর এতগুলো ছেলের মুখ দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো একেবারে। গলায় একটুও জোড় নেই তবুও চিৎকার করার বৃথা চেষ্টা করতে যাবে এমন সময় দেখলো দুটো মেয়ের মুখও দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ে খুবই সুন্দরী দেখতে। ওর মাধুর্যভরা মুখটা দেখে ভয়টা কেটে গেলো একটু। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
সায়ান বললো, “এই মেয়ে, এভাবে ছুটছো কেন? কি হয়েছে?”
মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো সায়ানের দিকে। চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। জোরে শ্বাস নিতে নিতে ঢোক গিললো। কথা বলার মত শক্তিও পাচ্ছেনা। সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ওর দিকে। প্রত্যেকের চোখে প্রশ্ন, কি হয়েছে?
মেঘালয় মেয়েটির পাশে বসে কানের কাছে কিছু বলতে যেতেই মেয়েটি ভয়ে কেঁপে উঠলো। মেঘালয় বুঝতে পেরেছে সে খুব ভয় পেয়ে এভাবে ছুটছে। তাই ভয় কাটানোর জন্য বললো, “ভয় পেওনা। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। কি হয়েছে আমাদের বলো?”
মেয়েটি তাকালো মেঘালয়ের চোখের দিকে। চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। হেডলাইটের আলোয় ছেলেটার চোখ দুটো কত পবিত্র দেখাচ্ছে। এত পবিত্র চাহনি কোনোদিন দেখেনি ও। কত বিশুদ্ধভাবে চেয়ে আছে, সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ সে দৃষ্টি। অথচ একটু আগে যে জানোয়ার গুলোর হাতে পড়েছিলো ওদের.. মিশু আরেকবার কেঁপে উঠলো ভয়ে।
মেঘালয় ইশারায় ওর বান্ধবী রোদকে বোঝালো মেয়েটিকে ধরার জন্য। রোদ মিশুকে দুহাতে ধরে টেনে তুলে দাড় করিয়ে দিতেই রাস্তার উপর রক্তের দাগ চোখে পড়লো ওদের। সবাই অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটির পায়ের দিকে। হয়ত কোথাও কেটে গেছে। পায়জামা বেয়ে রক্তের স্রোত নেমেছে। ওরা কৌতুহলী চোখে তাকালো মেয়েটির দিকে। যেন জানতে চাইছে,কি হয়েছে? কোথায় কেটে গেছে?
মিশু চোখ বন্ধ করে ফেললো। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হবে ভাবেনি। এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে কিভাবে বলবে কথাটা? ওর পিরিয়ড চলছে, সাত তলা থেকে ছুটে নিচে নেমে আবার এক কিলোমিটারের মত দৌড়ে আসার পর শরীরের অবস্থা মারাত্মক খারাপ।খুবই ব্লাড আসছে। একটা প্যাড আর কতক্ষণ কুলোয়? কিন্তু এটা কিভাবে বলবে ওদের? ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে ফেললো ও।
রোদ ওকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে পারলো মেয়েটি কাঁপছে। ও মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কার ব্যাগে চাদর আছে?”
সায়ান ব্যাগ থেকে চাদর বের করে দিলো। মেঘালয় ওটা মেয়েটির গায়ের উপর পেঁচিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ধরে রাস্তার ধারে এনে বসালো। সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, কাঁপছে রীতিমত। মেঘালয় বললো, “সায়ান আমার ব্যাগে স্যালাইন আছে একটু পানিতে গুলিয়ে ওকে খেতে দে।”
সায়ান কথামত স্যালাইন বের করলো। আর মেঘালয় মিশুর সামনে বসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “আমার চোখের দিকে তাকাও তো। পলক ফেলবে না।”
মিশু তাকালো ওর চোখের দিকে। আশ্চর্যের ব্যাপার ওর চোখের দিকে তাকাতে একটুও ভয় লাগছে না। মেঘালয় চেষ্টা করছে ওকে একটু হিপনোটাইজড করতে। যেহেতু মেয়েটি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ,এখন সম্মোহন করার চেষ্টা করে যদি একটু কথা বের করা যায়। এর আগে মাত্র একবার একজনকে সম্মোহিত করেছিলো মেঘ,কতটা কার্যকর হবে জানা নেই।
মেঘালয় একদম মিশুর মুখের সামনে এগিয়ে এসে বললো, “আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে থাকো।”
মিশু কিছুই বুঝতে পারছে না। কোথায় আছে,কি করছে, কি হচ্ছে ওর সাথে সবকিছু কেমন দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। তবুও মেঘালয়ের চোখের দিকে চেয়ে রইলো অপলক ভাবে। মেঘালয় ওর চোখের দিকে একটানা অনেক্ষণ চেয়ে রইলো। ওর বন্ধুরা সবাই চারিদিকে ঘিরে ধরে দেখছে ওর কাণ্ড। মেঘালয় একটা আঙুল এগিয়ে এনে মিশুর কপাল বরাবর ধরে কিসব যেন বললো। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। মেঘালয় হুট করেই কি যেন করলো, মেয়েটি একেবারে রোবটের মতন হয়ে গেলো। চোখে অসম্ভব ঘোর, কোনো নড়াচড়া করছে না,এমনকি কাঁপুনিও বন্ধ হয়ে গেছে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কে তুমি?”
মেয়েটি একদম পাথরের মত স্তব্ধ। কিন্তু ঠোঁট দুটো অদ্ভুত ভাবে নড়ে উঠলো, “আমি মিশু।”
সবাই রীতিমত অবাক! মেঘালয়ের তাহলে হিপনোটাইজ কাজে লেগে গেছে। ওরা বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেঘালয় আবারো জিজ্ঞেস করলো, “বাসা কোথায়?”
-“রংপুর।”
-“এভাবে ছুটছিলে কেন?”
মেয়েটি যেন রিমোট কন্ট্রোল পুতুল হয়ে গেছে। মেঘালয় যা জিজ্ঞেস করছে একদম শুধু সেটার ই উত্তর দিচ্ছে। মেঘালয় আবারো জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছিলো তোমার সাথে?”
-“আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলো।”
মেয়ে তিনজন শিউড়ে উঠলো কথাটা শুনে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কারা মারতে চাইছিলো?”
-“একটা খারাপ লোক।”
-“তুমি এখানে কোথায় থাকো?”
-“আমি রংপুরে থাকি।”
-“এখানে কেন এসেছিলে?”
-“আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে।”
-“তোমার বয়ফ্রেন্ড কোথায়?”
-“আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
মেঘালয় ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপাতত আর কিছু জানার দরকার নেই। এখন ওর কাছে ওর বাবার নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন দিয়ে কথা বলে জানাতে হবে ব্যাপারটা।”
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হুম। সেটাই কর।”
দুপুর বললো, “এখন একে নিয়েই আমরা পড়ে থাকবো? আমাদের ট্রেন মিস হয়ে যাবেনা?”
আরাফ রেগে কটমট করে তাকালো দুপুরের দিকে, “এইজন্যই মেয়েদেরকে আমি সহ্য করতে পারিনা। একটা মেয়ের জীবন মরণের প্রশ্ন আর সে আছে ট্রেন জার্নি নিয়ে।”
দুপুর মুখটা কাচুমাচু করে বিড়বিড় করে বললো, “জানতাম কিছু একটা ঘটবেই। জানতাম আমাদের যাওয়া হবেনা। আমি যখনই কোনো কিছু নিয়ে বেশি লাফালাফি করি লাস্ট অব্দি সেখানে যাওয়াই হয়না আমার। আজকেও যাওয়া হবেনা আমি শিওর।”
সায়ান রেগে বললো, “আরাফ ওর গালে একটা বসা তো। মানুষ হবেনা ও জীবনে।”
দুপুর মুখটা বাঁকা করলো।
মেঘালয় আবারো মিশুর চোখে চোখ রেখে বলল, “তোমার বাবার নাম্বার বলতে পারবা?”
মিশু মাথা দুদিকে নাড়লো। এই মুহুর্তে হয়ত মনে করতে পারছে না। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার গায়ে কোথাও কেটে গেছে?”
-“না।”
-“ব্লাড?”
-“অনেক্ষণ ছুটেছি। পিরিয়ডের রক্ত।”
মেঘালয় মাথাটা নিচু করে ফেললো। সায়ান ও আরাফ ও অন্যদিকে তাকালো। মেঘালয় রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “প্যাড আছে?”
রোদ বললো, ‘হুম আছে। কিন্তু এখানে ওয়াশরুম কোথায় পাবো?”
-“সেটা ব্যবস্থা করা যাবে। এখন ওর হিপনোটাইজ কাটাতে হবে।”
কথাটা বলেই কষে থাপ্পড় লাগালো মিশুর গালে। মিশু মাথাটা ঝাড়া দিয়ে কেঁপে উঠলো আবারো। ভয়েই কুঁকড়ে গিয়ে মেঘালয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরলো মেঘালয়কে। মেঘালয় একহাতে মিশুকে শক্ত করে ধরে আরেকহাতে বোতলটা নিয়ে মিশুর মুখে ধরে বললো, “স্যালাইন, খেয়ে নাও।”
মিশু তবুও কিছু বললো না। কাঁপতে লাগলো। মেঘালয় ওর মুখে বোতলটা ধরে একটু স্যালাইন খাইয়ে দিলো ওকে। তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে রইলো বুকে। চাদরটা গায়ে ভালোমতো পেঁচিয়ে দিয়ে বললো, “শীত করছে?”
মিশু দুদিকে মাথা নাড়লো। মেঘালয় আর এই অচেনা মানুষগুলোর ওর প্রতি এমন সহানুভূতি দেখে ওর অবাক লাগছে। এত ভালো মানুষ ও দুনিয়ায় আছে! কিন্তু এতক্ষণ কি হয়েছিলো ওর? মিশু চোখ পিটপিট করতে লাগলো। একটু আগে ওর কিছু একটা হয়েছিলো, কিন্তু কি হয়েছিলো বুঝতে পারছে না সেটা।
এমন সময় পূর্বকে দেখা গেলো। ও দুলতে দুলতে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
রোদ গিয়ে ওকে ধীরেধীরে সবটা খুলে বললো। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে মিশুকে ধরেই জিজ্ঞেস করলো, “হাঁটতে পারবা কিছুদূর?”
মিশু মাথাটা আস্তে করে নাড়ালো। উত্তর হ্যা নাকি না বোঝা গেলো না। মেঘালয় সবার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, “এখানে তো রিক্সাও পাওয়া যাবেনা। আমরা তাহলে রাস্তার দিকে এগোই?”
সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হুম চল।”
মেঘালয় মিশুর প্রতি এক অন্যরকম সহানুভূতি অনুভব করছে। কত বাচ্চা একটা মেয়ে! ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছে। ও মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার তো হাঁটার ও শক্তি নেই দেখছি। আমি কোলে নিলে কি সমস্যা হবে?”
মিশু চমকে উঠলো। যদিও এই মুহুর্তে ওর বিস্মিত হবার মত অবস্থা নেই। তবুও এতটুকু বোধ আছে যে ওর পায়জামা আর পায়ে রক্তের ঢাল নেমেছে, এই অবস্থায়ই ছেলেটা ওকে কোলে তুলতে চাইছে! এত সুন্দর একটা মানুষ সত্যিই কি দুনিয়াতে আছে? নাকি আল্লাহ ওর জন্য ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন? সত্যিই হয়ত ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মিশু এসব ভাবছে আর এই সম্পূর্ণ অচেনা ছেলেটা ওকে কোলে নিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলেছে। ওর বন্ধুরাও পাশে হাঁটছে ওদের সাথে।
মেইন রোডে পৌছে মেঘালয় একটা সিএনজিতে মিশুকে বসিয়ে দিয়ে রোদকে বললো, “চেঞ্জ করে দে ওকে।”
তারপর ড্রাইভারকে বললো, “মামা আপনি একটু বাইরে আসেন তো।”
ড্রাইভার অবাক হয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। মেঘালয় ওকে সিটে বসানোর সময়েও মিশু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো ওর মুখের দিকে। আর মনেমনে ভাবছিলো, সত্যিই কোনো ফেরেশতা হবে। আজীবন প্রত্যেকটা মেয়ে পিরিয়ডের সময় ছেলেদের থেকে লাঞ্চিত হয়েছে, হাসির পাত্র হয়েছে। অথচ এরা কত সুন্দর! আর কিছু ভাবার মত সক্ষমতা এখন মিশুর নেই।
মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওরা কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী মিলে একসাথে পঞ্চগড় যাচ্ছে এক বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াতে। অবনীর বিয়ে। অবনী ওদের ই দলের একজন ছিলো। ওর বাসা পঞ্চগড়ে আর ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করতো। সবাই মিলে ওর বিয়েতে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে, পূর্ব’র বাসার আগেই একটা গলিতে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনই মিশুকে দেখতে পায় ওরা।
রোদ সিএনজি থেকে ডাকলো ওদের। মিশুর নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে। কেননা ওর কেবল মস্তিষ্ক টাই সচল আছে যেটা সবকিছু ভাবতে পারছে। তাছাড়া আপাতত আর কিছুই করতে পারছে না ও।
মেঘালয় এসে সিএনজিতে মিশুর পাশে বসে ওর মাথাটা কাঁধে নিলো। মিশুর পিঠের পিছন দিক দিয়ে একটা হাত দিয়ে একহাতে শক্ত করে ধরলো ওকে। তারপর ডানহাতে রুটি গরম চায়ে চুবিয়ে ওর মুখে তুলে দিলো। একটু নরম খাবার পেয়ে আস্তে করে গিলতে চেষ্টা করলো মিশু। মেঘালয় একহাতে মিশুকে ধরে আছে,আরেকহাতে রুটি চায়ে চুবিয়ে খাওয়াচ্ছে। সায়ান চায়ের কাপ হাতে সিএনজির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘালয় পারতো রোদ কিংবা মৌনিকে বলতে যেন মিশুকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েদেরকে বলে কতটা লাভ হবে জানা নেই। তাছাড়া মেঘালয় নিজ দায়িত্বে যতটুকু সেবা করবে, অন্যকেউ সেটা করবে না। সেজন্যই ও অন্যকারো উপর ভরসা করতে পারেনি।
অনেক্ষণ সময় নিয়ে একটা রুটির অর্ধেকটা খাইয়ে দিলো মিশুকে। তারপর স্যালাইন মেশানো পানি আর সাথে দুটো জ্বর ও ব্যাথার ট্যাবলেট খাইয়ে মিশুর মাথাটা নিজের বুকের উপর নিয়ে বললো, ‘এবার ঘুমাও। এরপর দেখবে আর কোনো বিপদ নেই।”
মিশু কিছু বলতে পারলো না। মেঘালয়ের বুকের উষ্ণ স্পর্শে ও সত্যিই একবার চোখ বোজার চেষ্টা করলো। আরেকটা সিএনজি নিয়ে সবাই দুটোতে উঠে পড়লো স্টেশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মেঘালয় ঠিক করে ফেললো, যেহেতু মেয়েটির বাসা রংপুরে আর ওরাও সেদিকেই যাচ্ছে। কাজেই এখন ওকে জাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুক, তারপর না হয় ওর বাবার নাম্বার নিয়ে ফোন দেয়া যাবে। মিশুর চুলে দুবার হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা।
বন্ধুরা মেঘালয়কে নিয়ে খুব গর্ববোধ করে। এরকম ফেরেশতার মতন মানুষ সত্যিই আজ দূর্লভ। মেঘালয়ের মানবতা আর নিঃস্বার্থ সেবা, সহানুভূতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর মমত্ব সত্যিই মুগ্ধ করে সবাইকে। মিশু ঘুমে ঢলে পড়েছে মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় চেপে ধরে রইলো ওকে। চাদরটা ভালোভাবে টেনে দিলো গায়ে। এদিকে দশটা পেরিয়েছে,ট্রেন সাড়ে দশটায়। শেষ অব্দি ট্রেন পাবে কিনা সেটাই এখন ভাব্বার বিষয়।
চলবে..