#হৃদয়ের_রং_জানে_না <ষষ্ঠ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল আস্তে আস্তে | রূপকথার এখন কলকাতায় এসে প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে | নেহাত প্রিন্সিপাল ওর চেনা, সেই কলেজের ম্যাম| আর তার ওপর ওকে খুব ভালোও বাসে |তাই এতদিনের লিভ নিতে পেরেছে| ওরা এখন পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালাচ্ছে | কিন্তু এর জায়গায় অন্য কোনো স্কুল হলে রূপকথার চাকরিটা আর থাকতো না | তবে সে যাই হোক, রূপকথার মনে এখন শান্তি| ওর যেই কারণে কলকতায় আসা , এতদিনের দূরত্ব ভেঙে এই পুরোনো শহরে বসবাস, সেটা আজ সফল| অনন্ত এখন ঠিক আগের মতন হয়ে গেছে | সেই পুরোনো হাসি খুশি চঞ্চল একটা ছেলে , যার জীবনে হুইল চেয়ারটা অতীত | ওর নিথর পা দুটো আর রূপকথাকে দেখতে হয় না আজকাল | আর তার ওপরে উপরি পাওনা হলো অনন্তর লেখা বইটা, ‘ঘরে আর বাইরে’ | হ্যাঁ, শব্দগুলো রূপকথার | কিন্তু এক্সপিরিয়েন্স , ঘটনা , ছবি সবই তো অনন্তর| আজ সন্ধ্যেবেলায়ই বুক রিলিজের অনুষ্ঠানটা প্রেস ক্লাবে | রূপকথা বেশ একটা নামি পাবলিশার্সই খুঁজে এনেছিল এই বইটার জন্য | অনন্ত তো শুনে অবাক! আসলে ও কল্পনাও করেনি যে ওর তোলা ছবি , এক্সপিরিয়েন্স , এইসবের এতো দাম আছে! তবে অনন্ত না কল্পনা করুক , রূপকথা করেছিল , প্রথম থেকেই| সেই ওর মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় প্রথম একা একা ডুয়ার্স যাওয়া | জঙ্গল যে এতো সুন্দর হয়, রূপকথা সেইবার প্রথম জেনেছিলো | অনন্তর ক্যামেরা দেখে | তারপর কত ফেস্টিভ্যাল , এক্সজিবিশন ,কম্পিটিশনেই তো ছবি পাঠাতো অনন্ত | ওটা তো বেশ একটা সাইড ইনকামের মতন হয়ে গিয়েছিলো ওর কলেজ লাইফে | যার জন্য আবার কত ট্রিটও দিতো রূপকথাকে | তবে সেইসব ছবি যে একদিন একটা বইয়ের ঠিকানা ঠিক জোগাড় করে নেবে এটা রূপকথা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলো | যাই হোক, এইসব ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পরে গেলো| বিকেল পাঁচটা বাজে| সন্ধ্যে সাতটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু | এবার রেডি হতেই হবে| নইলে দেরী হয়ে যাবে | এই ভেবেই ও আলমারি থেকে শাড়ি বার করতে যাবে তখনই মোবাইলটা রিং হলো হঠাৎ| স্ক্রিনে আননোন একটা নাম্বার | কে আবার এখন ফোন করলো ওকে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ফোনটা তুলে হ্যালো বললো | আর ওপার থেকে ভেসে এলো সেই পুরোনো অনেক দিন আগের একটা চেনা গলা,
” হ্যালো , রূপকথা | আমি মিথিলা বলছি |”
সেইদিন প্রায় আধঘন্টা কথা বলে রূপকথা ফোনটা কেটেছিল| না, আজ আর আগের মতন এলোমেলো লাগছে না নিজেকে| দু বছর বাদে রূপকথা জানে ওর জায়গাটা কি | আর ও আগের মতন হিসেবের বাইরে ভাবে না তাই | বরং এই ফোনটা পাওয়ার পর বেশ খুশি লাগছে ওর | মিথিলা আর অনন্তর ভাঙাচোরা লাভস্টোরিটা যদি জুড়ে যায় তাহলে অনন্তর এক্সিডেন্টের পর হারানোর লিস্টে যা যা ছিল , সবটাই ফেরত পাওয়া হয়ে যাবে| আর কোনো কষ্ট, আক্ষেপ থাকবে না ওর মনে |
হ্যাঁ, অনন্তর জন্য বোলপুরে ফেরার আগে রূপকথাকে এই শেষ কাজটা করতেই হবে| নিজের গল্পটাকে তো কখনো মনের মতন করে সাজাতে পারেনি! কিন্তু অনন্তর গল্পটাকে ঠিক সাজিয়ে দেবে| হয়তো এখন অনন্তর মনে মিথিলার জন্য অনেক রাগ জমে আছে | তবে ও অনন্তকে চেনে| মিথিলাকে সামনাসামনি দেখলে অনন্ত আর পুরোনো কথা মনে রাখতে পারবে না | আর মিথিলাও কিছু মনে রাখতে দেবে না| কারণ ও ভালোবাসে অনন্তকে | তাই তো আজ ঐভাবে ফোন করলো ! এখনো মিথিলার কথাগুলো কানে বাজছে যেন ওর ,
” প্লিজ রূপকথা , আমাকে একটু হেল্প করো| অনন্তকে আমি বেশ কয়েকদিন ধরে ফোন করছি | কিন্তু ও আমার আর ফোন ধরে না এখন| তাই তোমাকে কল করলাম | আমি জানি, অনন্তর বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি এই কমাস তুমি অনন্তকে কিভাবে সাপোর্ট করেছো| যেই টাইমটায় আমার সব থেকে বেশি ওর পাশে থাকার কথা ছিল ,আমি থাকতে পারিনি | কিন্তু তুমি ছিলে | আজ অনন্তর লাইফে সব কিছু ঠিক শুধু তোমার জন্যই হয়েছে| এন্ড এই এম রিয়ালি সরি … আমি জানি আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম | তুমি চলে যাওয়ার পর রিয়ালাইজ করলাম , যে তুমি কখনো আমাদের মাঝে আসতেই চাওনি| তাই তুমি নিজের ফোন নাম্বারটাও অনন্তকে দিয়ে যাওনি | তবে অনন্তর লাইফে তুমি সব সময় খুব ইম্পরট্যান্ট | আমি জানি ও তোমার কথা কখনো না করতে পারবে না | প্লিজ তুমি ওকে একটু বোঝাও আমার হয়ে| তুমি বললে ও আমার সাথে ঠিক দেখা করবে | মা বাবা ওই সময় এতো ঝামেলা করেছিল বলেই আমি ব্রেকআপটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম | কিন্তু এখন আমি মা বাবাকে বোঝাতে পেরেছি | আমি জানি তুমি অনন্তর সব থেকে কাছের বন্ধু| তুমি বোঝালে ও ঠিক আবার আমার কাছে ফিরে আসবে| প্লিজ , এই হেল্পটা আমাকে করো |”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেছিলো মিথিলা | ওর গলাটা শুনেই রূপকথা বুঝতে পারছিলো যে ও যা কিছু বলছে সেটা মিথ্যে না | মন থেকে বলছে | আর এতকিছু শোনার পর রূপকথা সত্যি চেষ্টা করবে| মিথিলার থেকেও বেশি অনন্তর জন্য চেষ্টা করবে | ওর জীবনের এই হারিয়ে যাওয়া খালি জায়গাটা পূরণ হলেই সব কিছু আবার আগের মতন হয়ে যাবে | এইসবই ভাবছিলো চলন্ত রাস্তাটা দেখতে দেখতে | বুক রিলিজের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে ন-টা বেজে গেছে | রাতের এই সময়টা রূপকথার খুব ভালো লাগে | মনে হয় সকালের ভিড়ে ঠাসা খোলসটা ছেড়ে একলা একটা শহর জেগে উঠেছে হঠাৎ| এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই অনন্তর কথা কানে এলো ওর,
“কি এতো ভাবছিস চুপচাপ ? এখন যেন তুই একটু বেশিই নিজের মধ্যে থাকিস| এরকম কেন বল তো ?”
প্রশ্নগুলো শুনে রূপকথা ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না | তা ও আলতো হেসে বললো,
” কারণ আমার আর কেউ নেই | শুধু একটা খুব নিজের’আমি’ আছে , তাই|”
অনন্ত কথাটা শুনে এক সেকেন্ড চুপ থেকে একটু দৃঢ় গলায় বলে উঠলো হঠাৎ ,
” কেন ? আমি তোর কেউ নোই ?”
আচমকা এরকম প্রশ্ন রূপকথা এই মুহূর্তে একেবারেই এক্সপেক্ট করেনি| তাই ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | অনন্ত যে ওর সঙ্গে আছে সেটা ও জানে| তবে বন্ধু তো আর ও অনন্তকে ভাবতে পারবে না কোনোদিন | ভালোবাসলে তো আর শুধু বন্ধু থাকা যায় না| তখন মন অন্য কিছুই চায় | যাই হোক , এতো কথা রূপকথার মুখ ফুটে আর কখনোই বলা হবে না | তাই প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে জোর করে একটু হাসলো শুধু| তারপর নিজেই একটা অন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
” তুমি কাল বিকেলে ফ্রি আছো ? তোমার সঙ্গে একটা কফিশপে যেতাম |”
অনন্ত এবার কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেলো | রূপকথা নিজে থেকে কফি শপে যাওয়ার কথা বলছে অনন্তকে ! বিশ্বাস হচ্ছিলো না ঠিক| মানে এই কয়েক মাসে যে অদ্ভুত একটা দূরত্ব রেখে চলতো রূপকথা , সেটা কি তাহলে ভাঙতে চায় ও এখন! কথাগুলো হঠাৎ মাথার মধ্যে এসে ভিড় করলো অনন্তর | তখনই রূপকথা ওর হাতটা ধরে বলে উঠলো আবার ,
” কি হলো ? বলো কিছু ? যাবে না আমার সাথে কফি শপে ?”
অনন্ত এবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো প্রায় লাফিয়ে ,
” যাবো না কেন! অবশ্যই যাবো | তুই কোন কফিশপে যেতে চাস একবার বল| একদম ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবো |”
এসব শুনে রূপকথা এবার হেসে ফেললো অল্প | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো,
” ওটা সারপ্রাইজ | কোন কফিশপ বলবো না এখন | গেলেই সব জানতে পারবে |”
অনন্তর এসব শুনে খুব অদ্ভুত লাগছে এখন | এতদিন বাদে কি তাহলে রূপকথা ওদের মাঝে থাকা অদৃশ্য কাঁচের দেয়ালটা ভাঙতে চায় ! সেই না দেখা দূরত্বটাকে দূর করে দিতে চায় ! আবার সেই আগের মতন সহজ হতে চায় অনন্তর সামনে ; নইলে কেন হঠাৎ কফিশপে যাওয়ার কথা বলবে ! এই কমাসে তো শুধু ডাক্তারের এপয়মেন্ট , ফিজিওথেরাপি সেশন , এইসব দরকার ছাড়া অনন্তর সঙ্গে বেড়োনোর কথা কখনো ভুলেও বলেনি রূপকথা| আর শুধু তাই না , অনন্ত ঠিক হয়ে যাওয়ার পর নিজে রূপকথাকে কতবার ট্রিট দিতে চেয়েছে, ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে চেয়েছে , কিন্তু তাতেও নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে ‘না’ ই বলে দিয়েছে ও| আলাদা করে কখনো কোনো সময় কাটাতে চায়ইনি অনন্তর সঙ্গে| তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো ! আর কাল কি এমন সারপ্রাইজ রেডি করে রেখেছে রূপকথা ওর জন্য ! কথাগুলো এক মনে ভাবতে ভাবতেই রাত বারোটা বেজে গেছে | ঘুমটা যেন কিছুতেই আর আসতে চাইছে না আজ| অদ্ভুত একটা ভালো লাগা জাগিয়ে রাখছে ওকে সারাক্ষন | এইসব ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ ফোনে একটা মেল্ ঢুকলো | একটা প্রাইভেট নার্সিংহোম থেকে ওকে রেসপন্স করেছে | সামনের সপ্তাহে জয়েনিং ডেট| তার মানে প্র্যাকটিস শুরু করতে পারবে আবার অনন্ত | মেলটা পড়েই আর নিজেকে ও সামলাতে পারল না এবার আনন্দে| উঠে বসলো খাটে একসাইটমেন্টে | তাহলে কি ঈশ্বরও ওকে গ্রিন সিগন্যালটা দিয়ে দিচ্ছে এখন ! কালই কি তার মানে সেই দিনটা , যেদিন রূপকথাকে ও নিজের মনের সব কথা বলে দিতে পারবে ! কাল কফিশপে অনন্তও কি তাহলে রূপকথাকে সারপ্রাইজ দেবে ! নিজের ভালোবাসার কথা সাজিয়ে গুছিয়ে বলে দেবে ওকে! নইলে এই মুহূর্তে এই মেলটা তো আসার কথা নয়| অনন্তর জীবনে কি তাহলে অবশেষে এমন একটা কাল আসবে, যখন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে! রূপকথা সারা জীবনের মতন ওর হয়ে যাবে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একটা নতুন ভোর উঁকি দিলো ওর ঘরের জানলায়| সারাটা রাত নির্ঘুম থেকে অনন্ত ঠিক এই ভোরটারই অপেক্ষা করছিলো এতক্ষন | আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে সব পেয়েছির দেশ হয়তো একটা সত্যি আছে ! যার ঠিকানা আজ ও খুঁজে পেয়েছে |
<১৩>
সেইদিন ঠিক বিকেল পাঁচটায় অনন্ত রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিলো ড্রইং রুমে | আজকে কফিশপে গিয়ে পরের সপ্তাহে নতুন নার্সিংহোমে জয়েন করার কথাটাও শেয়ার করবে রূপকথাকে | এসবই ভাবছিলো , তখনই রূপকথা নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো| একটা লাল রঙের শাড়ি , চুলটা খোলা, কপালে একটা ছোট্ট টিপ্ | অনন্ত এতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো ওর দিকে | রূপকথা খেয়াল করলো ব্যাপারটা | আজকাল মাঝে মাঝে এইভাবে তাকায় কেন অনন্ত ! প্রশ্নটা ওর মনে এসেই মিলিয়ে গেলো | ধুর , যতসব ভুলভাল ভাবছে | অনন্ত কখনো ওর দিকে আলাদা করে তাকাতেই পারে না | এটাই সত্যি | কথাটা যেন আবার জোর করে নিজের মনকে বোঝালো এখন | তারপর কিছু কথা সাজিয়ে অনন্তকে বলে উঠলো আলতো হেসে ,
” আজ একেবারে বিফোর টাইমে রেডি ! কি ব্যাপার ? এরকম তো হয় না কখনো|”
অনন্তও এবার এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে উত্তর দিলো,
” তুই আজ নিজে থেকে আমার সাথে দরকারি কাজ ছাড়া এমনি কফি খেতে চেয়েছিস | এরকমও তো হয়নি এতদিনে ! তাই আজ বিফোর টাইমে|”
রূপকথা এসব শুনে এই মুহূর্তে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | তাই কথা ঘোরানোর জন্য অনন্তকে এবার তাড়া দিয়ে বললো ,
” আচ্ছা , বুঝলাম | এবার চলো তাড়াতাড়ি | নইলে দেরি হয়ে যাবে|”
অনন্ত কথাটা শুনে একটু অবাক হলো! হঠাৎ এতো তাড়াহুড়োর কি আছে ! যাবে তো ওরা দুজনই| আসতে ধীরে গল্প করতে করতে গেলেই হয় ! যাই হোক, এইসব ভাবনার ভিড়ে অনন্ত আর কথা বাড়ালো না | রূপকথার সাথে পা মেলালো শুধু | আর মেন্ রোডে উঠেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেছে ওরা | একদম অপেক্ষা করতে হয়নি | অনন্তর তো ট্যাক্সিতে উঠে মনে হচ্ছে সব দিক থেকে যেন আজ ঈশ্বর সহায় ওর ওপরে | এগুলো সব ওপরওলারই সিগন্যাল |
যাই হোক, আধঘন্টার মধ্যে শহরের জ্যাম, ভিড় রাস্তা কাটিয়ে অনন্ত আর রূপকথা কফিশপে এসে পৌঁছলো অবশেষে | তবে
অনন্ত তো প্রথমে জায়গাটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো ! এটা তো সেই পুরোনো কফিশপটা! স্কুল লাইফে বাবার সাথে এখানে মাঝে মাঝেই আসতো | কত পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে জায়গাটা জুড়ে| এখানে বসে বাবার সেই পুরোনো হাসি মুখটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওর , আনমনে | এখন বুঝতে পারছে রূপকথা কাল ঠিক কি সারপ্রাইজের কথা বলছিলো| এই জায়গাটার ব্যাপারে শুধু মা আর রূপকথাই তো জানতো| তাই আজ ওকে বেছে বেছে এই কফিশপটায়ই নিয়ে এসেছে| এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই অনন্ত বলে উঠলো ,
” বুঝলাম এতক্ষনে | তোর সারপ্রাইজটা কি ! সত্যি অনেক বছর বাদে আজ এখানে এলাম| বাবা মারা যাওয়ার পর তো আর আসাই হয়নি |”
রূপকথা কথাটা শুনে আলতো হেসে বললো,
” জানি | তবে পুরোনো জায়গাগুলোতে মাঝে মাঝে আসা উচিত | তাহলে পুরোনো সময়টাকে খুব কাছ থেকে ফিল করা যায় | যাই হোক , এটা তো একটা সারপ্রাইজ | আর একটাও আছে | কিছুক্ষন পরই জানতে পারবে|”
অনন্ত এসব শুনে এখন একটু অবাক হয়ে গেলো ! নিজের মুখে বিস্ময়টা নিয়েই বললো ও ,
” বাবা ! আরো একটা সারপ্রাইজ ! বিশাল ব্যাপার তো ! যাই হোক, আমারও কিন্তু আছে কিছু বলার | প্রথমটা শুনে হয়তো তুই সত্যি সারপ্রাইজ হয়ে যাবি | আর সেকেন্ডটা তুই নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরেই জানিস | ”
রূপকথা এবার একটু কৌতূহল নিয়েই বললো,
” আমার জন্যও সারপ্রাইজ ! কি শুনি একটু?”
” আমি নেক্সট উইক থেকে আবার প্র্যাকটিস শুরু করবো | বেশ কয়েকটা প্রাইভেট নার্সিংহোমে এপ্লাই করেছিলাম | একটা থেকে কাল রিপ্লাই এসেছে |”
হাসি মুখে কথাগুলো বলে গেলো অনন্ত, আর খেয়াল করলো রূপকথার মুখটা | হঠাৎ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এখন | ও হাসি মুখে এবার বলে উঠলো ,
” সত্যি ! এই কথাটা তুমি এতক্ষন বাদে বললে আমায় ? সকালেই তো বলতে পারতে| তাহলে তোমায় সকালেই মিষ্টি খাওয়াতাম |”
অনন্ত এবার দু সেকেন্ড চুপ থেকে বললো ,
” মিষ্টির দরকার নেই| তার বদলে আমার একটা উত্তর চাই| আসলে তোকে কিছু কথা !”
না , আর কথাটা শেষ করতে পারলো না অনন্ত | কারণ এই কথার মাঝখানেই ওর কফিশপের দরজার দিকে চোখটা চলে গেলো , আর হঠাৎ এই মুহূর্তগুলো থমকে গেলো জীবনের | মিথিলা এখানে কি করছে! প্রশ্নটা মনে আসতেই রূপকথা বলে উঠলো,
” আর এটা ছিল আমার সেকেন্ড সারপ্রাইজ |”
কথাটা শুনে অনন্তর মাথায় যেন একটা বাজ পড়লো | চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেলো হঠাৎ ! এর মাঝেই মিথিলা ওদের টেবিলের সামনে এসে হাজির| অনন্তর কিছু বোঝার আগেই এই মুহূর্তে রূপকথা বলে উঠলো,
“প্লিজ রেগে যেও না অনন্ত | তোমাকে প্রথমে মিথিলার কথা বললে হয়তো তুমি এখানে আসতেই না! কিন্তু আজ তোমাদের দেখা হওয়াটা জরুরি ছিল | মিথিলা সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে | আর ও ফিরে আসতে চায় |’
রূপকথার কথাগুলো শুনে অনন্তর এবার ঘোরটা কেটে গেছে প্রথমের| আর এখন ভেতরে একটা যন্ত্রনা , রাগ সবকিছু এসে জড়ো হয়েছে এক সঙ্গে| রূপকথা নিজে মিথিলাকে ফিরিয়ে আনলো ওর কাছে ! মানে ও অনন্তকে নিজের করে পেতেই চায় না! কথাগুলো মনে হতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না | টেবিলটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,
” তুই ভাবিস কি নিজেকে ! যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবি ? আমার পারমিশন না নিয়ে আমার লাইফের সব ডিসিশন নিয়ে নিবি ! তুই বুঝিস না আমি কি চাই ?”
কথাগুলো শুনে এবার রূপকথায় উঠে দাঁড়ালো, তারপর একটু দৃঢ় গলায় বললো ,
” বুঝি আমি তুমি কি চাও | তাই মিথিলা যখন নিজে থেকে ফোন করে আমাকে বললো তোমার সাথে দেখা করতে চায় , তখন আমি না বলিনি | আমি জানি যেই রাগটা এখন তোমার ওর ওপর আছে সেটা বাইরের | ভেতরে ভেতরে তুমি মিথিলাকেই ভালোবাসো |”
অনন্ত এবার রাগে অভিমানে জ্বলে উঠলো ভেতর থেকে | তারপর কিছু না ভেবেই বলে ফেললো ,
” ভালোবাসা ! রিয়ালি ! তুই বুঝিস কিছু এই ফিলিংটার ব্যাপারে ? ভালবেসেছিস কখনো কাউকে যে বলছিস |”
কথাটা শুনে রূপকথার হঠাৎ ভেতর থেকে একটা ধাক্কা লাগলো এখন | এই প্রথম অনন্তর এই প্রশ্নে ও আজ চুপ থাকলো না | কঠিন গলায় উত্তর দিলো,
” বেসেছি ভালো একজনকে| খুব মন থেকে একতরফা | তাই জানি এই ফিলিংটা ঠিক কি | কিন্তু তোমার আর মিথিলার ব্যাপারটা তো আলাদা | তোমরা দুজনই দুজনকে ভালোবাসো | তাই এই খারাপ লাগা , কষ্টটা নিয়ে না হয় না ই বাঁচলে |”
কথাগুলো শোনার জন্য অনন্ত ঠিক এই মুহূর্তে একদম তৈরী ছিল না | ও থমকে গেলো হঠাৎ| ওর ভেতরের সমস্ত রাগ , কষ্টগুলো যেন এখন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ! আর সেই এক হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো নিয়েই ও জিজ্ঞাসা করে উঠলো ,
” তুই ভালোবাসিস ! কাকে? তার জন্যই কি এই দু বছর মাঝখানে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলি না? কলকাতা ছেড়ে দিলি?”
এতগুলো প্রশ্ন যে একসঙ্গে হঠাৎ করে বসবে অনন্ত , রূপকথা এটা ভাবেনি | আর এই সময় ও মিথিলার মুখটাও খেয়াল করলো , কেমন অন্ধকার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এখন | ও কি ভাবছে রূপকথা দু বছর আগের সব সত্যি অনন্তকে বলে দেবে ! এতো সহজে নিজের আড়ালটা শেষ করে দেবে !
কখনোই না | যে ওকে কখনো ভালোইবাসেনি , তার ওর ভালোবাসার ব্যাপারে জানার সত্যি কোনো দরকার নেই| এই ভেবেই রূপকথা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,
” তুমি তাকে চিনবে না | আছে একজন| আর ঠিকই , তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যই আমি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম | তবে মন থেকে কখনো দূরে যেতে পারিনি | যাই হোক, তোমার লাইফের ডিসিশন তুমিই নিও | আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করবো না | তবে পারলে মিথিলাকে আর একটা সুযোগ দিও | আমি আসছি |”
কথাটা শেষ করেই রূপকথা আর পেছনে ফিরে তাকালো না| অনন্ত আর মিথিলাকে একা করে দিয়ে কফিশপের দরজার বাইরে বেড়িয়ে এলো , আবার একটা একলা শহরে| চোখগুলো জ্বালা করছে এখন ওর | না চাইলেও বুকের জমাট বাঁধা কান্নাটা বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে এই মুহূর্তে | কিন্তু রূপকথা জোর করে নিজেকে আটকালো | হাতের মুঠোটা শক্ত করে জলটাকে থামানোর চেষ্টা করলো চোখের | রোজ রোজ তো কাঁদতে ইচ্ছে করে না| অনন্ত যার প্রথম থেকে ছিল , সব সময় তারই থাকবে| ওর মনের গোপন তো জানার দরকার নেই কারোর | এই লুকোচুরিটাই সত্যি রূপকথার জীবনে |