হৃদয়ের_রং_জানে_না < দ্বিতীয় পর্ব> #ঈপ্সিতা_মিত্র

0
150

#হৃদয়ের_রং_জানে_না < দ্বিতীয় পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
আসলে কিছু কিছু ঘটনা , কিছু কিছু দিন এমন আসে জীবনে ! যেটা চাইলেও ভুলে যাওয়া যায় না কখনো | বরং সেই ঘটনাগুলো , দিন গুলো দাগ কেটে যায় মনে | আর মনে হয় এই জিনিসটা না হলে হয়তো বোঝাই হতো না , নিজের আসল জায়গাটা ! রূপকথার জীবনেও এরকম কিছু দিন এসেছিলো দু বছর আগে , বেশ কয়েকবার | এমন কিছু ঘটেছিলো যেটা ওকে এক সেকেন্ডে বুঝিয়ে দিয়েছিলো অনন্তর জীবনে ওর জায়গাটা ঠিক কত টুকু | আর তখনই রূপকথা সরে এসেছিলো মন থেকে , অনেক দূরে !
এখনো মনে আছে ওর, খুব স্পষ্টভাবে ,একটা দিনের কথা | দূর্গা পুজোর অষ্টমী | সকাল থেকেই চারিদিকটা সাজো সাজো ! ঢাকের তালে , মায়ের মন্ত্রে জমজমাট | রূপকথা সেবার অঞ্জলি দিয়ে অনন্তদেরই বাড়িতে গিয়েছিলো জলখাবার খেতে | সেদিনের লুচি আলুর দমটা রূপকথাই বানিয়েছিল , নিজের হাতে | তারপর প্লেটে সাজিয়ে এসেছিলো অনন্তর ঘরে , ——– ” দ্যাখো খেয়ে , কেমন বানিয়েছি ? লুচি আর আলুর দম |”
অনন্ত কথাটা শুনেও বিশেষ কান না দিয়ে ওর হাত থেকে লুচির প্লেটটা নিয়ে টেবিলে রেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওকে অন্য একটা কথা বলে উঠেছিল হঠাৎ , ——- ” ওসব ছাড় | তোকে আজ আমার সাথে একটু শপিংয়ে যেতে হবে , বুঝলি | লুচিটা শেষ করেই বেড়িয়ে পরবো | ওকে .. ”
রূপকথা আচমকা এই শপিং এর ব্যাপারটা শুনে একটু অবাক হয়েছিল সেদিন ! এই ছেলের মুখে কেনাকাটার কথাটা সত্যিই নতুন ! ওর তো বরং শপিং এ এলার্জি , চিরকাল | পুজোর শার্টটাও মা পছন্দ করে কিনে না আনলে পুরোনো জামা পরেই কাটিয়ে দেবে চারদিন | কোনোই বিকার নেই ! সে হঠাৎ আজ এতো একসাইটেড হয়ে কেনাকাটি করতে যাবে বলছে ! যাই হোক , রূপকথা কথাগুলো মনের মধ্যে রেখেই ঘাড় দুলিয়ে হাসি মুখে বলেছিলো , ——– ” ঠিক আছে | যাবো শপিং এ | হয়েছে | এখন তো খাও |” ..
কথাটা শুনে এবার অনন্তর মুখে স্বস্তির হাসি এসেছিলো | এরপর সেদিন নিউ মার্কেটের একটা শাড়ির দোকানে গিয়েছিলো ওরা | রূপকথা তো প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো অনন্ত মায়ের জন্য কোনো শাড়ি কিনবে ! কিন্তু কথাটা মিললো না যখন অনন্ত দোকানদারকে বললো , —– ” একটু কলরফুল শাড়ি দেখান, এই চব্বিশ পঁচিশ বছরের মেয়ের জন্য |”, তারপর রূপকথার দিকে তাকিয়ে বললো , —– ” নে , পছন্দ কর |”
কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য রূপকথা সেদিন একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ ! অনন্ত তার মানে ওর জন্য শাড়ি কিনতে এসেছে ! ভেবেই মুখে একটা হাসি এসে গিয়েছিলো আনমনে | তাহলে কি এতদিনের অপেক্ষার শেষ এই দূর্গা পুজোতে হবে ! অনন্ত কি কিছু বলবে ওকে এরপর ! মানে ও যা শুনতে চায় সেগুলো কি তাহলে আজই ! ভাবনাটা পূরণ হতে না দিয়েই অনন্ত ওকে ধাক্কা দিয়েছিলো , —- ” কিরে ? কি ভাবছিস এতো ? পছন্দ কর একটা শাড়ি | দ্যাখ কালার গুলো ?” …
না , এরপর আর চুপচাপ বসে থাকলে তো হবে না | কেউ যখন এতো করে বলছে , তখন তো নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতেই হবে | ভেবেই কখনো কমলা , তো কখনো লাল , আবার একটু হলুদ সবুজ মেশানো শাড়িগুলো ও নিজের গায়ের ওপর তুলে নিচ্ছিলো বার বার , তারপর দোকানের আয়নার দিকে তাকিয়ে একবার নিজেকে দেখছিলো , তারপর অনন্তকে দেখছিলো | ওর চোখ দিয়ে ভালো খারাপটা বিচার করার চেষ্টা করছিলো | আসলে সেটা জানাই তো সব থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট | কারণ রূপকথা তো অনন্তর চোখ দিয়েই নিজেকে দেখতে চায় !
তবে বেশ কয়েকটা শাড়িতেই অনন্তর মুখের এক্সপ্রেশন কেমন ” না , এটা ঠিক মানাচ্ছে না !, ” , ” এটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না ” টাইপের ছিল | তবে ওই নীল রঙের শাড়িটা রূপকথা গায়ে তুলে নিতেই অনন্তর মুখে একটা হাসি চলে এলো হঠাৎ | ও নিজে থেকেই বলে উঠলো , —– ” এই শাড়িটা দারুন !”…. ব্যাস , রূপকথাও আর এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে দোকানদারকে বললো, ——- ” দাদা , এই শাড়িটা প্যাক করে দিন তাহলে |” ….. অনন্ত এবার বেশ হাসি মুখেই ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো , ——– ” থ্যাঙ্ক ইউ রূপকথা | সিরিয়াসলি , এমনি এমনি কি তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ! আজ যে কত বড়ো একটা হেল্প করলি আমাকে , কি বলবো ! নইলে এইসব শাড়ি টারির ব্যাপারে আমি কি বুঝি ! যাই হোক , আই থিঙ্ক এই শাড়িটা মিথিলার ভীষণ পছন্দ হবে | আর আমার মনে হয় ওকে নীল রংটা সব থেকে বেশি মানাবে |”
রূপকথার এবার ধাক্কা লাগলো একটা ! হাসি মুখটা হঠাৎ কেমন অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো যেন | কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে উঠলো ও, ——– ” মিথিলা ! তুমি এই শাড়িটা তার মানে ! ”
ওর কথাটাকে কমপ্লিট করতে না দিয়েই অনন্ত বলতে শুরু করলো এবার , ——– ” হ্যাঁ, মিথিলা | বলিনি তোকে ? আমাদের সাথেই এম.ডি করেছিল | এখন আমরা একই হসপিটাল এ আছি | ও পিডিয়াট্রিশিয়ান | খুব ভালো মেয়ে | একদম আলাদা সবার থেকে | একচুয়ালি কাল ওর জন্মদিন | আমাকে স্পেশালি ইনভাইট করেছে বাড়িতে | তাই এই শাড়িটা কিনতে এলাম ! ভালোই গিফ্ট হয়েছে বল , নিশ্চয়ই পছন্দ হবে ওর !”
এইসব শুনে রূপকথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসলেও মুখে একটা মিথ্যে হাসি নিয়েই উত্তর দিলো , —– ” নিশ্চই পছন্দ হবে | পছন্দ না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই ! শাড়িটা সত্যিই খুব ভালো দেখতে |” …..
এবার অনন্তও হাসি মুখে বলে উঠলো , ——– ” বুঝলাম | তবে ক্রেডিটটা কিন্তু তোর | তুই না এলে পছন্দ করতেই পারতাম না | যাই হোক, এতো হেল্প করলি, চল এবার |আইসক্রিম খাওয়াবো তোকে | ”

না , এর উত্তরে রূপকথা আর আজ ‘হ্যাঁ’ বলতে পারলো না | দু সেকেন্ড ভেবে কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ——– ” না , আজ থাক | আসলে বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে | মামী আজ রান্না করতে বলেছে আমাকে দুপুরে | তাই |” ..
অনন্ত এবার আর কথা না বাড়িয়ে বললো , —– “ওহ , ঠিক আছে ! তাহলে বাড়িই চল এখন | তবে আইসক্রিমটা কিন্তু ডিউ রইলো তাহলে | ” …
না ,এরপর আর রূপকথাও কোনো কথা বাড়ায়নি অনন্তর সঙ্গে | আসলে হঠাৎ যেন মনে হচ্ছিলো তখন যে অনেক কথা হয়তো মনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে ওর | সারাটা রাস্তা একটা অদ্ভুত একাকীত্বতা এসে ঘিরে ধরছিল সেদিন ওকে | এই প্রথম মনে হচ্ছিলো , যেই ছেলেটা পাশে বসে আছে , সে হয়তো আর বেশিদিন এইভাবে পাশে থাকবে না | নতুন লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাবে কোথাও | চোখের পলকেই , অনেক দূরে !
সেই অষ্টমীর রাতে , যখন সারা শহর ঢাকের তালে , লোকের ভিড়ে জমজমাট ছিল , আনন্দে মেতেছিলো , তখন রূপকথা একা নিজের ঘরে বসেছিল , ভিজে চোখে | আজ যেন সত্যি মনে হচ্ছিলো কেউ নেই সঙ্গে | কেউ নেই যে নিজের |
<৪>
এরপরে পুজো শেষ হয়ে বিসর্জনের দিন পেরিয়ে কোজাগরী পূর্ণিমা এসেছিলো ঘরে ঘরে | অনন্তদের বাড়িতে প্রত্যেকবারই এই পুজোটা হয় | রূপকথা সকাল থেকেই তাই ওদের বাড়িতেই পরে থাকে আজকের দিনে | হাতে হাতে কাকিমার সঙ্গে পুজোর কাজ করে দেয়া , ভোগ রান্না করা , এগুলো ওর অভ্যাস হয়ে গেছে ছোট থেকেই | এইবারও একই | নিজের হাতে পুজোর জায়গায় আল্পনা দিয়েছে রূপকথা | তারপর নাড়ু বানানো , পায়েস তৈরী এইসবও করেছে | আর তার ওপরে সারাদিনের উপোস | সন্ধ্যে সাতটার পর অঞ্জলি শেষ হয়ে একটু প্রসাদ খেলেও শরীরে ক্লান্তি ছড়িয়ে ছিল তখনও | তবে , সেই সময় বুঝতে পারেনি , আজ শরীরের সঙ্গে মনেরও একটা ধকল যাবে | আজই একদম সামনাসামনি অনন্তর জীবনের বাস্তবটাকে ও দেখতে পাবে , খুব কাছ থেকে | আসলে অনন্ত এই লক্ষি পুজোতে মিথিলাকে ইনভাইট করেছিল ওদের বাড়ির | সন্ধ্যের পর সেই দিনের অনন্তর গিফ্ট করা নীল শাড়িটাতে সেজেই এসেছিলো মিথিলা | আর রূপকথা এক মুহূর্তের জন্য হলেও যেন থমকে গেছিলো ওদের একসঙ্গে দেখে ! এরপর সেইদিন অনন্তদের বাড়ি জুড়ে শুধুই মিথিলা ছিল | আর সত্যি সুন্দরী দেখতে মেয়েটাকে | যেমন রূপ , সেরকম গুণ | অনন্ত তো মায়ের কাছে প্রশংসা করে করে শেষ করতে পারছিলো না যেন | তারপর কথায় কথায় যেই অনন্ত বলে উঠলো , মিথিলা না কি খুব ভালো গান জানে , ব্যাস , তারপর তো অনন্তর মা ও আর গান শোনার লোভ সামলাতেই পারলো না | অবশ্য মিথিলাও রিকুয়েস্ট শুনে না রেখে পারেনি | কখনো ” খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি” , তো কখনো ” শ্রাবণের ধারার মতন ” , একের পর এক গান গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলো সন্ধ্যেটা |
আর রূপকথা ঘরের একটা কোণায় দাঁড়িয়ে সব দৃশ্যগুলোই দেখছিলো চোখ ভোরে | লক্ষী পুজোয় সত্যি লক্ষি এসেছে অনন্তদের বাড়িতে | তাই আজ রূপকথার আর কোনো জায়গা বাকি নেই এখানে | অনন্তর চোখে মিথিলার জন্য মুগ্ধ দৃষ্টি , অনন্তর মার্ মিথিলাকে দেখে হাসি মুখ, এই সব কিছুই যেন স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছিলো রূপকথার জীবনের সত্যিটা , যে এই বাড়িতে ওর আর কোনো আলাদা জায়গা নেই | রূপকথা শুধু পাশের বাড়ির মেয়ে ছাড়া আর কেউই না ওদের মাঝে | অনন্তর মন , অনন্তর ভালোবাসা , এইসবের কোনো ভাগ পাবে না রূপকথা কখনো | এতো বছর ধরে যেই ভাগটা পাওয়ার কথা ও ভেবে এসেছে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস , আজ সেই ভালোবাসাটা মিথিলার | অনন্ত মিথিলার | কথাগুলো সেদিন মনে হতেই রূপকথা চুপচাপ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলো ওই বাড়ি থেকে | আসলে আজ হঠাৎ নিজেকে খুব বেমানান লাগছিলো সবার মাঝে | চোখটা ভারী হয়ে আসছিলো বার বার , জলে | আর সেই জল তো আবার কাউকে দেখানোর নয় | এই নতুন কষ্টগুলো , যন্ত্রনা গুলো একদম ওর নিজের |
এইসবই ভাবছিলো ছাদের রেলিংটায় ভর দিয়ে , একা একা দাঁড়িয়ে | এখন রাত সাড়ে দশটা | আকাশে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ জোৎস্না ছড়িয়ে চারদিকটা রুপোলি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে এই মুহূর্তে | আর তার মাঝে অনেক বাড়ি থেকেই কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে একটু পর পরই | এখনো তার মানে অনেক বাড়িতেই পুজো চলছে ! তবে এতো উৎসব , এতো আওয়াজের ভিড়েও রূপকথার ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে যেন | সব শেষ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা এসে ঘিরে ধরেছে ওকে | বুঝতে পারছে না যেইভাবে এই দুদিনে নিজের মধ্যে ভেঙে চুরে গেছে ও , সেই টুকরোগুলোকে আবার জুড়বে কি ভাবে ! কিভাবে ভুলে যাবে নিজের ফিলিংসগুলোকে , অনন্তকে ! কিন্তু এই যন্ত্রণার ভিড়েই হঠাৎ একাকী ছাদে সেই ছেলেটা এসে হাজির , সঙ্গে টিফিন কৌটো ভর্তি ভোগের খিচুড়ি | অনন্তর মা পাঠিয়ে দিয়েছে রূপকথার জন্য | তবে এই মুহূর্তে রূপকথা একা থাকতেই চেয়েছিলো | সব সময় জোর করে হাসি , জোর করে কথা আসে না আসলে | কিন্তু ও যা ভাবে তা মেলে না কখনো | তাই অনন্তকে দেখে অবাক হলেও বেহিসেবি হয়নি | বরং চোখের জলটাকে চেপে রেখেই খুব নরমাল গলায় জিজ্ঞেস করলো সেইদিন ,
” তুমি এখন এখানে ! মিথিলা চলে গেছে বাড়ি ?”
অনন্ত কিন্তু প্রশ্নটা শুনে উত্তর না দিয়ে নিজেই একটা প্রশ্ন করে উঠলো , —— ” সেসব ছাড় | তুই বল , ব্যাপারটা কি ! ঐভাবে চুপচাপ কাউকে না বলে চলে এলি যে ? আমি তো খেয়ালই করিনি |” ……
এই কথাটা শুনে রূপকথার মুখে এবার আলতো হাসি | হঠাৎ মনে হচ্ছে ‘ তুমি আর কবেই বা খেয়াল করলে আমাকে ! ‘ … কিন্তু মনের কথা মনে রেখেই একটা বানানো কথা সাজিয়ে বললো ,
” এমনি , আসলে সারাদিন উপোস করে একটু টায়ার্ড লাগছিলো | আর মিথিলা অতো সুন্দর গান করছিলো | তার মাঝখানে থামিয়ে ‘আসছি’ বললে খারাপ দেখাতো | তাই ! ”
উত্তরটা শুনে অনন্ত ভ্রুটা একটু উপরে তুলে বললো , ——– ” বাবা ! এতো ভদ্রতা কবে শিখলি ! ওটা কি কোনো বাইরের লোকের বাড়ি ! না কি মিথিলা ভি.আই.পি গেস্ট যে ওর গান থামানো যাবে না ! ” …
কথাটা শুনে এবারও রূপকথা অল্প হেসে ফেললো | ‘সেই ! মিথিলা তো কোনো গেস্ট না | ও তো ওই বাড়ির একদম নিজের লোক | অনন্তর সব থেকে কাছের মানুষ |’, তবে এবারও কথাটা মনেই রাখলো , আর নিরুত্তর হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো অনন্তর সামনে | তখন অনন্তই আবার বলে উঠলো , ——— ” যাই হোক , এই টিফিন কৌটোটা ধরে আমি আর কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো শুনি ! এটা তুই ঘরে রেখে তাড়াতাড়ি ছাদে আয় আবার | আমি ওয়েট করছি এখানে | একচুয়ালি তোকে খুব ইম্পরট্যান্ট কিছু শেয়ার করার আছে | বুঝলি |”
অনন্ত কথাটা শেষ করে একটু হাসি হাসি মুখ করে তাকালো ওর দিকে | আর রূপকথার বুঝতে বাকি রইলো না | কি শেয়ার করতে চায় অনন্ত ! ওর মনের ফিলিংস | মিথিলার জন্য জমিয়ে রাখা সমস্ত ভালোবাসা | রূপকথা কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথাটা ভেবেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন | হঠাৎ মনে হলো চলার শক্তিটা পা দুটো হারিয়ে ফেলেছে | চোখটা আবার ভারী হয়ে আসছে | জল এসে ভিড় করছে সেখানে | কিন্তু না , এখন ভাঙলে তো চলবে না | শক্ত হয়ে সবটা শুনতে হবে ওকে | তারপর একটা মিথ্যে হাসিও হাসতে হবে অনন্তর সামনে | সেই ছোট থেকে এতদিন অব্দি যা করে এসেছে , আজও তাই করতে হবে ওকে , অনন্তর জন্য খুশি হতে হবে ওকে | কথাগুলো ভেবেই রূপকথা আবার একটু শক্ত হলো | তারপর টিফিন কৌটোটা ঘরে রেখে এসে অনন্তর সামনে দাঁড়ালো | আর অনন্ত এবার সেই হাসি মুখটা নিয়েই বলতে শুরু করলো , —– ” একচুয়ালি আজকের ব্যাপার স্যাপার দেখে নিশ্চই বুঝেছিস , তোকে কি নিয়ে বলবো এখন | জানি , তোকে আলাদা করে বলার দরকার নেই আমার | তুই তো আমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে সেই ছোট থেকেই সব বুঝে যাস | মানে ঠিক কবে কখন মিথিলাকে এতো পছন্দ হয়ে গেলো , সত্যি বুঝতে পারলাম না জানিস ! এতো মেয়ের সাথে স্কুল কলেজে আলাপ হয়েছে , কিন্তু মিথিলা না সবার থেকেই একদম আলাদা | ভিড়ের মধ্যেও আলাদা | ওর গান , ওর হাসি , ওর তাকানো , সব কিছু | যাই হোক , তবে একটাই প্রব্লেম , এখনো কিছু বলে উঠতে পারলাম না | আসলে আমি জানি আমি কি ফিল করি ও সেটা বোঝে | কিন্তু একটা ঠিকঠাক প্রপোজাল তো ও এক্সপেক্ট করবেই , স্বাভাবিক | তাই তোর হেল্প চাই |”
এতো কথা শুনে রূপকথা কিছুক্ষন মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল | সত্যি মনে হচ্ছে ভেতরটা আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যাচ্ছে ওর | তবে তা ও পাথরটাকে সঙ্গে নিয়েই জিজ্ঞেস করলো একটু অবাক হয়ে , ——– ” আমার হেল্প ! আমি কি হেল্প করতে পারি এখানে ?”
প্রশ্নটা শুনে অনন্ত একটু যেন লাফিয়ে উঠলো এবার | তারপর হাসি মুখে উত্তর দিলো , —– ” আরে , তুই ই তো পারিস | তুই বাংলার স্টুডেন্ট | কত বড়ো এডভ্যান্টেজ এটা জানিস … ”
রূপকথা এবার সত্যি কিছু বুঝতে পারলো না ! খুব অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো অনন্তর দিকে | এটা দেখে অনন্ত একটু বেশি জোরে হেসে ফেললো এবার | তারপর একটু সময় নিয়ে বললো , — ” আসলে মিথিলা আমার মতন মেডিক্যালের স্টুডেন্ট হলেও কবিতা গল্প এইসব পড়তে খুব ভালোবাসে | শুনেছি টুকটাক লেখেও | তাই ভাবছিলাম ওকে যদি প্রপোজটা সেই আগেকার দিনের মতন কিছু লিখে করা যায় ! তাহলে বেশ অন্যরকম হবে ব্যাপারটা | তবে আমার প্রব্লেম হচ্ছে রোগ , আর ওষুধের নাম ছাড়া আমি সত্যি আর কিছু লিখতে জানি না | মানে ঐসব কবিতা টবিতা তো মাথাতেই আসে না কখনো | তাই তোকে বলছি | প্লিজ একটু হেল্প করবি ? যদি কিছু লিখে দিতিস আমাকে | ইউ নো , সামথিং এবাউট লাভ , ট্রু ফিলিংস | আমি নিজের নাম দিয়ে চালিয়ে দিতাম মিথিলার কাছে | ও তাহলে ভীষণ ইমপ্রেস হয়ে যেত আর কি !”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো সেদিন অনন্ত | আর রূপকথা নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবটা শুনেছিলো এক মনে | আর কিছু বলতে পারেনি সেইদিন ও | শুধু কয়েকটা শব্দই এসেছিলো মুখে .. ” ঠিক আছে , দেব লিখে | ভালোবাসা নিয়ে যা বুঝি , যত টুকু বুঝি ,সেটাই লিখবো | ” ..
না , এসব শুনে অনন্তও আর কথা বাড়ায়নি | হাসি মুখে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলো | কিন্তু রূপকথা ; ও এক পা ও এগোতে পারেনি তারপর ! ওর এতদিনের ফিলিংসগুলো যে এইভাবে রেপ্লিকা হয়ে ফিরে আসবে জীবনে, সেটা কল্পনাও করেনি কখনো ! এতগুলো দিন ধরে যাকে ভালোবেসে শব্দের পর শব্দ জুড়ে নিজের ডাইরির পাতাগুলোকে ভর্তি করেছে , আজ তাকেই শব্দ সাজিয়ে দিতে হবে , অন্যের জন্য | কথাটা ভেবেই ওর পা এর সব শক্তিগুলো যেন নিথর হয়ে আসছিলো সেই মুহূর্তে | কান্না এসে ঝাপসা করে দিচ্ছিলো চারিদিকের ছবিটা | একলা ছাদ , আর একটা একাকী চাঁদই যেন ছিল শুধু সঙ্গে | রূপকথার কান্নার সঙ্গী হয়ে |

সেদিন এরপর সারা রাত জেগে কয়েকটা লাইন লিখতে পেরেছিলো রূপকথা | নিজের মনের সমস্তটা উজাড় করে সাজিয়েছিল কথাগুলো | যা কখনো বলতে পারেনি , যেটা কখনো আর বলা হবে না , সেই সমস্ত কথা , সমস্ত জমাট ভালোবাসা লেখা ছিল সেই লাইনগুলোতে | ………
” ভালোবাসার আড়াল থেকে
হঠাৎ তুমি সামনে এলে |
মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর
একলা সে মন স্বপ্ন চেনে |
হঠাৎ বৃষ্টির আজ এক দিন
ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো |
আমার মনেও জল জমেছে
শুধু তোমারি জন্য | ”
এরপর খামে মুড়ে লেখাটা পরের দিন দিয়ে এসেছিলো অনন্তকে | অন্য একজনের জন্য |
কখনো কখনো জীবন এইভাবেই হিসেবের বাইরে চলে আমাদের | বেহিসেবি ভাবনাদের লাগাম টেনে হঠাৎ বাস্তবের কাছেই ফিরে যেতে হয় তখন | শুধু চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে , এই যা | বাকিটা সহ্য হয়েই যায় | কথাটা ভাবতেই বর্ধমান স্টেশনে এসে গাড়িটা থামলো আবার | গ্রামের একাকী স্টেশনগুলোর থেকে এই স্টেশন একদম আলাদা | ভিড়ে ঠাসা | রূপকথা হঠাৎ ঘড়ির দিকে খেয়াল করলো এবার | আর দু ঘন্টা | তারপর দু বছরের দূরত্ব শেষ করে আবার সামনাসামনি দেখা হবে অতীতের সঙ্গে | তবে অতীত কি কখনো আদেও ছেড়েছে ওকে ! জায়গা বদলালেও স্মৃতিগুলো কি বদলাতে পারলো জীবনের ! আজও তাই ঘুরে ফিরে মাঝে মাঝেই সেই লাইনগুলো মনে পরে যায় হয়তো ! সেই জন্যই ওই কোজাগরী পূর্ণিমার একলা রাতের কাছে ফিরে যায় রূপকথা | আসলে শুধু চোখ বন্ধ করার অপেক্ষা | সবটা স্পষ্ট দেখতে পায় তারপর |
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে কাল। এইরকম নানান স্বাদের ভালোবাসার গল্প পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার সম্পূর্ন নতুন দুটি উপন্যাস ‘ শহরের উষ্ণতম দিনে ‘ এবং অগোছালো মন। দুটো বই এর পিডিএফ সংগ্রহ করলে মূল্য ১০০ টাকা। আর যে কোনো একটি বই এর পিডিএফ সংগ্রহ করলে মূল্য ৫০ টাকা মাত্র। পেমেন্ট ডিটেলস জানার জন্য এবং বইয়ের পিডিএফ সংগ্রহ করার জন্য মেসেজ করতে পারেন আমার হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার 089103 33272 তে। পেমেন্ট করে একটা স্ক্রিন শট পাঠিয়ে দিলে বইয়ের পিডিএফ পাঠিয়ে দেয়া হবে হোয়াটস অ্যাপে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here