ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
চতুর্থ_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
আবীর চুপ করে আছে।
মৃদুলা আবার বললো, কাল বিকেলে তুমি অসুস্থ ছিলে, বাসায় ফিরছো, অথচ আমাকে ফোন করে ব্যপারটা জানানোও তুমি প্রয়োজন বোধ করোনি। জানতে পারি কেন?
জানাতে পারিনি কারণ তোমার জানার কোন আগ্ৰহ ছিলোনা। আবীর সরাসরি বললো। কন্ঠটা বেশ কঠিন।
মানে? মৃদুলা অবাক!
কাল আমি অনেক অসুস্থ ছিলাম, তোমার কাছেই এসেছিলাম, অথচ বাড়ি ফিরে দেখলাম, তুমি বাসায় নেই। তোমাকে ফোন করলাম, মোবাইল বন্ধ। তাহলে কি করে জানাবো বলো! বুয়াকে ফোন করে শুনলাম, তুমি তোমাদের বাসায় গিয়েছো, রাতের আগে ফিরবে না। তারপর আমি কি বা করতে পারতাম?
-সরি। মোবাইলে চার্জ ছিলোনা,অবনী গেম খেলতে খেলতে চার্জ শেষ করে ফেলেছিলো, পরে ও নিজেই চার্জে লাগায়, কিছুক্ষণ পর আমি গিয়ে দেখি, মোবাইল বন্ধ অবস্থায় চার্জ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অন করে চার্জে দেই। হয়তো আমি মোবাইল অন করার আগেই তুমি ফোন করছো, তাই মোবাইল বন্ধ পেয়েছো।-তা আবীর, আমাদের বাসায় তো আমার ফোনটা ছাড়াও আরো ফোন আছে, আম্মু আব্বুর ফোন আছে, বাসার ল্যান্ড ফোন আছে, তুমি তো যেকোন একটাতে করলেই পারতে।
-তর্ক করবেনা। জানো আমি কি অবস্থায় ছিলাম, শরীর দুর্বল, মাথায় ভীষণ ব্যথা, প্রচন্ড খিদে, খাওয়ার কিছু নেই, তুমি বাসায় নেই, এ অবস্থায় আমার মাথা কাজ করছিলো না। তাছাড়া তূমি তোমাদের বাসায় যাচ্ছো, কথাটা কি আমাকে বলে গিয়েছো? নিজেকে প্রশ্ন করো তো, তুমি কি এমন ছিলে, আগে কি এমন করতে মৃদুল? আমি কি কষ্ট পাবো না? নুডুলস যেটুকু খেয়েছি, শুধু ট্যাবলেট খেতে হবে দেখেই খেয়েছি। খেয়েই শুয়ে পড়েছি।
-সরি, সরি। ভীষণ কষ্ট হয়েছে তাইনা?
এখন এ কথা আর বলে কি লাভ! তূমি কি আমাকে বুঝতে চাও? তূমি একটু আগেই বললে, তোমার সাথে আমি আমার কষ্ট গুলো ভাগ করে নেইনা কেন? একবার ভেবে দেখো তো, সেই সুযোগ কি আমি পাই? যখনই বাসায় ফিরি, তখনই তোমাকে দেখে মনে হয়, আমার উপর ভীষণ রেগে আছো! কেন কি অপরাধ আমার? তোমাদের একটু সুখের জন্য নিজের স্বস্তি ভুলতে বসেছি এটা কি অপরাধ? মনে হচ্ছে যেন তুমি এটাকে মহা অন্যায় ধরে বসে আছো! কি করে নিজের কষ্টের কথা তোমাকে বলবো?
মৃদুল, তোমার একটা সূবিধা আছে, তুমি যখন তখন রেগে যেতে পারো,হুট করে কেঁদে ফেলতে পারো। তোমার মনটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু আমি তো তা পারিনা, চাইলেই ঝগড়া শুরু করতে পারিনা, চিৎকার করতে পারিনা, কেঁদে ফেলতে পারিনা, আমার মনের কষ্টগুলো মনেই চাপা পড়ে থাকে। যার ফলে মনটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। এবং প্রতিদিন সে ক্ষতটা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে।
-তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো? মৃদুলা অবাক হয়ে বললো।
-কেন আমরা কি হৃদয় নেই, ইমোশনস নেই? তুমি শুধু নিজের কষ্টের কথাই বলে যাও, একবার কি ভেবে দেখেছো, আমি কতটা চাপে আছি, প্রতিদিনের চরম ব্যস্ততায় আমার যে দিন গুলো কেটে যাচ্ছে, জীবনের সেই স্বর্নালী দিন গুলো কি আমার জন্য আর ফিরে আসবে? প্রতিদিন তোমাদের সাথে কত হাসি আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি, সেই কষ্ট কি আমাকে পীড়া দেয় না? আর সবকিছু যদি বাদও দেই, কিন্তু অবনীর ছোটবেলাটা কি আমার জন্য বসে থাকবে? ওর ছোট থেকে বড় হওয়াটা কি আমি উপোভোগ করতে পারছি? যখন ও আরো ছোট ছিলো, তখনো আমার হাতে সময় ছিলো, কিন্তু নতুন চাকরি হওয়ার পর থেকে আজ প্রায় দু’বছর ওর জন্য আমার হাতে তেমন কোন সময় নেই।
অবনী বড় হয় যাচ্ছে, ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝতে শিখেছে, ওর ছোট্ট মনে বাবার জন্য না জানি কত ক্ষোভ জমা হয়ে আছে! মেয়েটা আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে, যতক্ষণে বাসায় ফিরি ততক্ষণে ও ঘুমিয়ে পড়ে, সকালেও সময় দিতে পারিনা। যন্ত্রনাটা আমার ভেতর সুইয়ের মতো ফোঁটে। এর তুমি কি বুঝবে? ও তো সারাক্ষণ তোমার কাছেই থাকে, চাইলেই আদর করতে পারো, আমার কথাটা একটু ভাবো!
মৃদুলা চুপ করে আছে। কি বলে আবীরকে বোঝাবে বুঝতে পারছেনা।
আবীর বললো, তুমি ভাববে কি? সে অবসর তো তোমার নেই। সুযোগ পেলেই আমাকে অভিযুক্ত করতেই ভালোবাসা! পরশু রাতে কি করে তুমি বললে যে, আমি একা একা বাইরের পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছি, তাই আমার বাসায় ফিরতে ভালো লাগেনা, ইচ্ছে করেই দেরি করে ফিরি! কখনো তো ভাবিনি, তুমি এভাবে বলবে! তোমাদের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য আমি দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছি, আমার স্বপ্ন সাধ গুলো রোজ অবহেলিত হচ্ছে, তার এই মূল্যায়ন?
-সরি আবীর।
না, না, এতে সরির কি আছে! কাল রাতের কথাই দেখোনা, খাবার জন্য তুমি মাত্র একবার আমাকে সেধেছো, আমি না বলাতে ঝট করে উঠে চলে গিয়েছো, তুমি একবারও আমাকে জোর করোনি, বুঝতেও পারোনি আমি কতটা অসুস্থ, কিংবা কতটা খিদে লেগেছে! কতটা বদলে গিয়েছো তুমি মৃদুল! তবে তুমি ভুলে গেলেও আমার মেয়ে কিন্তু আমাকে ভুলে যায়নি। ও ঠিকই আমাকে নিতে এসেছে। এটাই আনন্দের।
মৃদুলা মনে মনে ভাবছে, আবীর আর অবনীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। একজন বয়সে শিশু, অন্যজনের অভিমান শিশুসুলভ! অভিমান আবীরের চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ও ভাবতেই পারছেনা অবনীকে পাঠালো কে? অবনীর এখনো সেই বয়স হয়নি যে স্বয়ং সিদ্ধান্ত নেবে। আবীর এসব কিছুই চিন্তা করেনি। উল্টো মৃদুলাকে ভুল বুঝে বসে আছে। মৃদুলা সে ভুল ভাঙানোর চেষ্টাও করলো না, একটা ভূল ধারণার ভিত্তিতে যদি আবীরের মনে হয় অবনী ওকে কাছে টেনে নিয়েছে, আস্তে আস্তে ফ্রি হচ্ছে, তবে তাতে ক্ষতিই বা কি! এতে আবীরের মনের কষ্টটা একটূ হলেও কমবে। এর জন্য যদি মৃদুলার প্রতি আবীরের মনে জমে থাকা অভিমান আরো একটু বেড়ে যায়, তাতেও দুঃখ নেই মৃদুলার।
ও এসব ভেবে আপন মনে হাসছিলো, আবীর বললো, ও্হ! এখন তাহলে আমার কষ্টের কথা শুনে তোমার হাসি পায়? বাহ্ কি পরিবর্তন!
সরি, সরি, সরি! মৃদুলা হেসে বললো। আবীর কোন উত্তর দিলো না। তবে চেহারা দেখে মৃদুলার বুঝতে কষ্ট হলো না, চরম আঘাত পেয়েছে সে।
দেখেছো কি কান্ড! তুমি তো একটুও কফি খাওনি। তোমার পাল্লায় পড়ে আমার কফিটাও ঠান্ডা হলো।
-আর খাওয়া!
মৃদুলা বুঝতে পারছে, আবীরের মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
ও আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো, আজ এত বেলা হয়ে গেলো, অফিসে যাবেনা?
-না, শরীরটা ভালো লাগছেনা। দুর্বল লাগছে। কালই আমি দুদিনের ছুটি নিয়েছি।
মৃদুলার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ও বললো,আর রাশেদ, ওকে কিছু বলোনি?
-হ্যাঁ বলেছি, দু তিন দিন আসতে পারবোনা।
সত্যি? মৃদুলা চিৎকার করে উঠলো। বললো, সত্যি বলছো! তুমি পুরো দুদিন বাসায় থাকবে?
-আমার বাসা, আমি দুদিন বাসায় থেকে রেস্ট করতে চাইছি, এতে মিথ্যে বলার কি আছে?
মৃদুলা আনন্দের আতিশয্যে আবীরের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললো, আবীর তুমি না একদম অদ্ভুত! বুঝতে পারছো না, আমি খূশি হচ্ছি!
আবীর ওর চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছেনা। আসলে ওর কথা শুনে মৃদুলার হেসে ওঠাটা এখনো ভুলতে পারেনি।
মৃদুলা বলে যাচ্ছে, তুমি সেই কখন থেকে এ কথা ও কথা বলছো, অথচ আসল কথাটা বলোনি! এই কথাটা বলা উচিত ছিলো সবার আগে। মৃদুলা ঝট করে বিছানা থেকে নামলো। বললো, তুমি একটু রেস্ট করো, ইচ্ছে হলে টিভি দেখো, আমি আসছি। ও পা বাড়িয়েই থেমে গেলো। বললো, আচ্ছা শোন, নাশতা দিতে একটু সময় লাগবে। তুমি নাহয় কফি খাও, বিস্কিট দিয়ে। গরম করে নিয়ে আসি?
-বিস্কিট লাগবে না। শুধু কফিটা দিয়ে যাও।
-আচ্ছা, নিয়ে আসছি।
মৃদুলা বেরিয়ে গেলো।
আধঘন্টা পর আবীর রুম থেকে বের হলো। কফি খাওয়ার পর ও কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলো। দুর্বলতা কাটছে না আসলে। আবীর ডাইনিং রুমে এসেই মৃদুলাকে দেখতে পেলো, পরোটা বানাচ্ছ। আজ ও একটা হালকা হলুদ রঙের স্যালোয়ার কামিজ পড়েছে। চূল গুলো বাধা। বেশ ঘেমে গেছে, গাল আর কপালে ময়দা লেগে আছে । কিন্তু ওকে অপরুপ লাগছে।
মৃদুলা আবীরকে দেখে বললো, আর দুটো মিনিট অপেক্ষা করো, ভেজে দিচ্ছি।
-সমস্যা নেই, ধীরেসুস্থে করো।
-আচ্ছা আবীর, তুমি টেবিলে বোসো, আমি জিনিসপত্র নিয়ে রান্নাঘরে যাই নাহয়।
-এখানেই থাকো না সমস্যা কি?
-না, না তুমি খেতে বসে যাও। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। রান্না ঘরে গিয়ে বানালে আরো তাড়াতাড়ি হবে, তাছাড়া সঙ্গে সঙ্গে ভেজে দিতে পারবো।
আবীর কিছু বলার আগেই মৃদুলা জিনিসপত্র নিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা হয়ে গেলো। একটু পর গরুর ঝাল গোশতের ভুনা তরকারি আর সেমাই নিয়ে ফিরে এলো সে। ওগুলো পাশের চেয়ারে ঢেকে রেখে টেবিল মুছলো। এরপর খাবার গুলো তুলে রাখলো টেবিলে।
আবীর বললো,আজ এত আয়োজন কেন মৃদুল?
মৃদুলা হেসে ফেললো। বললো, প্রতিদিন বাটার, পাউরুটি, ডিম, কলা খেতে খেতে তোমার অরুচি হয়ে যাচ্ছে। জানিতো, তুমি একঘেয়ে খাবার বেশি দিন খেতে পারো না, তাই ঝাল গোশত যখন আছে ভাবলাম, একটু পরোটা আর সেমাই করে দেই। এটাতো তোমার ভীষণ প্রিয় নাশতা, তাইনা?
আবীর হাসলো।
চলবে
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/4330460883665738/