#হৃদয়_মাঝে ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৬>
সেদিন হিয়া আনমনে বাড়ির দরজাটা খুলেছিল । এমনিতেও সেদিন হসপিটালে ওই দৃশ্যটা দেখার পর থেকে মনটা আর ওর সঙ্গে নেই ! সারাক্ষণ যেন একটা অন্ধকার, কালো মন খারাপের পাহাড় ঘিরে থাকে ওকে চারিদিকে । যাইহোক, সেই মন খারাপকে সঙ্গী করেই হিয়া দরজা খুলেছিল সেইদিন ; আর থমকে গেছিল হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে ! কলকাতায় ফেলে আসা সেই মুখটা এখন ওর সামনে । শান্ত দুটো চোখে স্থিরভাবে হিয়ার দিকে তাকিয়ে । হিয়া এই মুহুর্তে ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না প্রিয়মকে । মনে হলো শব্দগুলো যেন সব শেষ । তখন প্রিয়মই ওর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে উঠলো ,
———— ” ভেতরে আসতে পারি ? না কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো ? ”
কথাগুলো যে প্রিয়ম হিয়াকে শুনিয়ে বলেছিল এটা হিয়া স্পষ্টভাবে বুঝেছিল । কিন্তু এই কথার আজ আর কোনো উত্তর দিল না হিয়া ! চুপচাপ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো শুধু । আসলে হঠাৎ অল্প রাগ হলো ছেলেটার ওপর এখন। কি দরকার ছিল এখানে আসার ওর ! ওদের হিসাবের সম্পর্কটা তো আজ শেষ । অরুণিমা ফিরে এসেছে । প্রিয়ম ও ওকে দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । আগলে ধরেছিল নিজের কাছে । তাহলে এতো কিছুর পর ওর চন্দননগরে আসার কি মানে ! হিয়া তো জোর করে নিজের অধিকার কখনো ফলাতে যায়নি এরপর ! এমনকি যত টুকু সম্ভব টাকা ফেরত ও দিয়ে দিয়েছে প্রিয়মকে । তাহলে এখানে এসে কি লাভ হলো ওর !
কথাগুলো সেদিন মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছু বলেনি হিয়া । আসলে কিছু রাগ , চাপা কষ্ট মনেরই থাকে ! মুখে আসে না । সেই জন্য হিয়া সব জমানো কথা মনে রেখে প্রিয়মকে নিয়ে এসেছিল ওর মা বাবার ঘরে । হিয়ার মা বাবা তো হঠাৎ প্রিয় মকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলো যেন ! হিয়ার বাবা ব্যস্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে বলেছিল ,
————- ” প্রিয়ম তুমি ! কখন এলে ? আগে জানাওনি কেন ? তাহলে তোমার মা কিছু রান্না করে রাখতো !”
কথাটা শুনে হিয়ার মা ও বলে উঠলো একই সুরে ,
—————– ” সত্যিই তো ! কতদূর থেকে এসেছে ড্রাইভ করে এই সন্ধ্যেবেলা ! নিশ্চই খুব খিদে পেয়েছে ছেলেটার ! আচ্ছা আমি এক্ষুনি কিছু একটা বানিয়ে আনছি । একটু বসো বাবা ।”
প্রিয়ম এইসবের উত্তরে খুব সহজভাবে হেসে বললো, ———— ” প্লিজ আপনারা এত ব্যস্ত হবেন না । আমি কি বাইরের ছেলে না কি যে এত আপ্যায়ন করতে হবে ! আমি তো বাড়িরই লোক। আপনাদের দেখতে ইচ্ছে করছিল বলে চলে এলাম ।”
কথাগুলো শুনে হিয়ার বাবা মার মুখে একটা স্বস্তির হাসি হেসে ভিড় করলেও হিয়ার চারিদিকটা অন্ধকারই ছিল । প্রিয়ম যে ওদের নিজের লোক না, এটা আর কেউ না জানুক , হিয়া খুব ভালো করেই জানে !
তবে ওর এরকম এলোমেলো ভাবনার মাঝেই প্রিয়ম বলে উঠলো ,
———– ” আপনার নেক্সট ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টটা সামনের রবিবার | আমি আপনাকে নিয়ে যাবো | কথা হয়ে গেছে ডাক্তারের সঙ্গে | ”
কথাটা প্রিয়ম হিয়ার বাবাকে বললেও হিয়া নিজে থেকেই উত্তর দিয়ে দিলো ওকে ,
———— ” না না | তোমার নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই | মানে কলকাতা থেকে আর কতবারই বা আসবে ! চন্দননগর তো অনেকটা রাস্তা ! আমার বাবাকে আমিই নিয়ে যাবো |”
এরকম কিছু কথা যে ও প্রিয়মকে কাটানোর জন্য বলবে , এটা আসলে প্রিয়ম প্রথম থেকেই জানতো | তাই নিজে অন্য কথা বলে উঠলো অল্প হেসে ,
————— ” কে বলেছে আমাকে আসতে হবে নেক্সট রোববার ! আমি তো এখানেই থাকবো , তোমাদের বাড়িতে , এই মাঝের সাতদিন | একেবারেই কলকাতা ফিরবো রবিবার কাকুকে ডাক্তার দেখিয়ে |”
হিয়ার কথাটা শুনে এবার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো ! রাগটা যেন আরো দুগুণ বেড়ে গেলো এই ছেলেটার ওপর | প্রিয়ম চায়টা কি জীবনে ! অরুনিমা তো চলে এসেছে | তাহলে হিয়ার সঙ্গে নিজের ইচ্ছের বাইরে এইভাবে জোর করে থাকার মানেটা কি ! কথাগুলো ভেবেই ও বলে উঠলো ,
————— ” কিন্তু তুমি থাকবে কি করে ? তোমার তো অফিসে কত কাজ ! ব্যবসার কত কাজ !”
প্রিয়ম এর উত্তরেও অল্প হেসে বললো ,
———– ” কাজ মোটামুটি যা ইম্পরট্যান্ট ছিল , সেটা আমি মিটিয়েই এসেছি | আর লোকজন কি সারা বছর কাজ করবে না কি ! এই টুকু ব্রেক তো সবাই নেয় |”
প্রিয়মের কথাটা শুনে হিয়ার মুখটা এই মুহূর্তে আরো লাল হয়ে গেলো রাগে , একটা অদ্ভুত অভিমানে ! কিন্তু হিয়া কে কিছু বলতে না দিয়েই এবার হিয়ার বাবা বলে উঠলো ,
————- ” জামাই আমাদের বাড়িতে থাকবে কদিন ! এটা তো সত্যি খুব ভালো কথা | আর সত্যিই তো , সারা বছর কেউ কাজ করে না কি ! ”
কথাটার সঙ্গে তাল দিয়ে এই সময় হিয়ার মাও বলে উঠলো , ————– ” হ্যাঁ , সেই | না বাবা , তুমি খুব ভালো করেছো চলে এসেছো | এমনিও তো এখন তোমাদের বাড়ি ফাঁকা | অনিন্দদা আর তোমার দাদা তো মনে হয় পরের সপ্তাহে ফিরবে ! তুমি একদিন আমাদের বাড়িতেই থাকো |”
কথাটা শুনে প্রিয়মের মুখে এবার আলতো হাসিটা চওড়া হাসিতে পরিণত হলো | কিন্তু তখনই হিয়া একটু ভেবে বলে উঠলো ,
——————- ” না মা , ও এখানে থাকতে পারবে না ! আমাদের বাড়িতে তো এসি নেই | প্রিয়ম যেরকম লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত , ওর আমাদের এখানে ভালো লাগবে না | তার থেকে বরং ও কলকাতায় ফিরে যাক | ওটাই ওর নিজের জায়গা | আর জামা কাপড়ও তো আনেনি কিছু প্রিয়ম ! এখানে থাকলে পরবে কি এতদিন ! তাই না ?”
যুক্তিগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো হিয়া | তবে ওর মা বাবার কোনো উত্তর দেয়ার আগেই প্রিয়ম এবার উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে | তারপর বেশ দৃঢ় গলায় হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো , ————— ” সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট ছিলাম | ফিল্ডে থেকে রোদ , গরমের মধ্যে কাজ করার অভ্যেস আছে | ইভেন এখনো , আমাদের প্রোমোটারির ব্যবসায় অনেক সময় ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয় , সারাদিন ধরে | তাই এসির কোনো অভ্যেস নেই আমার | এটা কোনো রিজনই না , অসুবিধা হওয়ার | আর রইলো জামা কাপড় , সেটা তো আমি এনেছি নিজের | গাড়িতে সুটকেসটা রাখা আছে | আর কিছু ?”
না , হিয়াকে এবার আর কিছুই বলার সুযোগ দিলো না ওর বাবা | নিজেই জোর দিয়ে বলে উঠলো ,
—————– ” হিয়া , তুই এরকম কেন করছিস ? ছেলেটা একটু কটাদিনের জন্য থাকতে এসেছে ! এতো প্রশ্নের কি আছে ! ওরও বাড়ি এটা | ও থাকতেই পারে এখানে |”
হিয়া সেই মুহূর্তে কিছু বলতে গিয়েও আর ঠিক বলে উঠতে পারলো না যেন | বোঝাতে পারলো না বাবাকে যে যেই ছেলেটা এখন সামনে দাঁড়িয়ে আছে , সে অন্য একজনের , হিয়ার কেউ না | তবে মনে রাগটা থেকেই গেলো প্রিয়মের জন্য | হিয়ার সামনে এইভাবে থেকে ওকে নিজের মধ্যে জড়িয়ে দিচ্ছে কেন ছেলেটা কে জানে ! হিয়াকে তো এরপর সারাটা জীবন একাই কাটাতে হবে ! তাহলে এই সাতদিন সঙ্গে থেকে লাভ কি !
যাইহোক , সেইদিন এই সাদা কালো চিন্তার মাঝেই ধীরে ধীরে রাত নেমে এলো এই মফঃস্বল শহরটায় | হিয়া ইচ্ছে করেই বেশ রাত করে ঘরে ঢুকলো নিজের | ঘড়িতে তখন প্রায় একটা বেজে গেছে | প্রিয়ম নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে ! ওর সঙ্গে আর একলা থাকার ব্যাপার নেই ! কথাটা ভেবেই ঢুকেছিলো ঘরে , কিন্তু প্রিয়মকে বিছানার এক পাশে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হিয়া আরেকবার থমকে গেছিলো | ছেলেটা জেগে আছে এখনো ! কি হবে এবার ! কথা তো বলতেই হবে এখন ! কথাগুলো মনে হতেই প্রিয়ম বলে উঠলো ,
—————– ” আর একটু দেরি করে আসা যেত না ? মানে মাত্র একটা বাজে ! দুটো তিনটে করলে আমার ঘুমিয়ে পড়ার চান্সটা আরো বেশি ছিল !”
এর উত্তরে হিয়া এবার একটু কথা সাজিয়ে দৃঢ় গলায় বললো , ———- ” না , মানে সেরকম কিছু না ! আমার কাজ ছিল কিছু বাড়ির | তাই !”
কথাটা বলে হিয়া এবার ঘরের ভেতরে এগিয়ে এলো | প্রিয়ম তখন স্ট্রেটকাট জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
————- ” তাই ? তাহলে এই সাতদিন কি করছিলে ? আমার ফোনটা একবারও ধরনি কেন ? নিজে থেকে কল করা তো দূরে থাক !”
হিয়া এর উত্তরে সোজাসুজিই বলে উঠলো , ———— ” কারণ কোনো কথা নেই তাই | সব কথাই শেষ আমাদের |”
প্রিয়ম এটা শুনে একটু জোরেই বলে উঠলো এবার , ————- ” মানে ? কথা শেষ মানে ? এতো সহজ !”
হিয়া এর কোনো উত্তর না দিয়ে খাট থেকে বালিশটা তুলে মাটিতে শোয়ার জন্য চাদর বার করতে যাচ্ছিলো আলমারিতে | প্রিয়ম এসব দেখে এবার অসহ্য হয়েই জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
————– ” হিয়া , এইসবের মানে কি একটু বলবে ? তুমি কি মাটিতে শোবে এরপর !”
হিয়া তখন একটু জোর দিয়েই বললো প্রিয়মকে
———— ” হ্যাঁ , আমি মাটিতেই শোবো | আসলে কিছু তো করার নেই ! আমরা তো সাধারণ মধ্যবিত্ত | আলাদা ঘর নেই আর | তাই মাটিতে |”
কথাগুলো বেশ রাগ দেখিয়ে বলার পর খেয়াল করলো প্রিয়মের মুখটাও কিরকম লাল হয়ে গেছে এখন ! ও এবার নিজের মনেই বলে উঠলো , ——— ” বুঝলাম |”
তারপর হঠাৎ করে খাট থেকে একটা বালিশ উঠিয়ে নিয়ে সোজা দরজার দিকে যেতে শুরু করলো | হিয়া এই মুহূর্তে কিছু বুঝতে না পেরেই গলার আওয়াজ বাড়িয়ে প্রিয়মকে জিজ্ঞাসা করলো ,
————— ” আরে , অদ্ভুত তো ! কোথায় যাচ্ছ তুমি ? এতো রাতে !”
প্রিয়ম এবার থমকে দাঁড়িয়ে হিয়ার দিকে ফিরে উত্তর দিলো বেশ দৃঢ় গলায় , ———– ” ছাদে | ছাদে যাচ্ছি | আসলে তুমি এইভাবে মাটিতে শুলে আমার পক্ষে তো কখনোই একা একা খাটে ঘুমোনো সম্ভব না ! তার থেকে ছাদে মশাদের সঙ্গে ঘুমোবো ! ওটাই ভালো | আর তারপর সকাল সকাল যখন কাকু কাকিমা এসে দেখবে , যে তাদের একমাত্র জামাই সারা রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছে ! তখন ওরা কি বলবে তোমাকে , সেটা বরং তুমি বুঝে নিয়ে | ওকে , বাই ..”
শেষ কথাটা আলতো হেসেই বললো প্রিয়ম | তারপর আবার দরজার দিকে ফিরে যেতে যাচ্ছিলো বাইরে , কিন্তু হিয়া তখনই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো ,
———– ” খবরদার না ! একদম কোথাও যাবে না তুমি | ঠিক আছে , আমি খাটেই ঘুমোচ্ছি | কিন্তু তুমি এখন এই ঘর থেকে এক পা ও বেড়োবে না !”
কথাটা যেন বাধ্য হয়েই বললো হিয়া | তারপর যুদ্ধে হেরে যাওয়ার মতন মুখ করে খাটের একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো ও | প্রিয়মের এবার হাসিটা চলেই এলো আপনাআপনি | যাক , অন্তত একটা কথা নিজের শোনাতে পেরেছে মেয়েটাকে ! এক্সপ্লিনেশনটা না হয় দুদিন বাদেই বলবে | এখন মান অভিমানই চলুক |