#হৃদয়_মাঝে ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৮>
এইসবের পর দিনগুলো নিজের তালে কাটছিলো আপনাআপনি | প্রিয়মের জীবনে ছন্দটা ফিরে এসেছিলো আবার | হিয়ার সঙ্গে জোরের বিয়েটা আর ঠিক বোঝা হয়ে ঝুলছিলো না জীবনে | সেই জন্যই মনটা হালকা লাগছিলো ভীষণ | এর মধ্যে ও হিয়ার সঙ্গে ওর বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট এ ও গেছে | তবে সেখানে কিডনি ট্রান্সপ্লাটের কথাই বলেছে ডাক্তার আগের মতন | কিন্তু প্রিয়ম এখন মন থেকে চায় হিয়ার বাবাকে সুস্থ করতে | ও চায় না হিয়া ওর জীবন থেকে কিছু হারিয়ে যাক | ওর বাবাকে সুস্থ করে তারপর হিয়া এইসব ডিভোর্সে জরাক | আসলে মেয়েটার কথা ভাবলে আজকাল বেশ খারাপই লাগে প্রিয়মের | জীবনে কোন মেয়েই চায় একটা ভাঙা সম্পর্কে জরাতে ! নিজের হাতে ডিভোর্সের এপ্লিকেশন নিয়ে আসতে ! তাও মেয়েটা সব করেছে , শুধু নিজের মা বাবার জন্য | কিন্তু বাবাটাও যদি এরপর চলে যায় , তাহলে হিয়ার খুব বড়ো একটা ধাক্কা লাগবে জীবনে ! এতটা কষ্ট মেয়েটা পাক , এটা প্রিয়ম কিছুতেই চায় না | সেই জন্য ও কলকাতার খুব নামি নামি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে | যদি কোনোভাবে মানুষটাকে সুস্থ করা যায় ! সেদিন এইরকম একজন কিডনি স্পেশালিস্ট ডক্টর বোসের সঙ্গে কনসাল্ট করে ফিরছিলো প্রিয়ম সল্টলেকট থেকে | কিন্তু এই সময়ে বাড়ি না গিয়ে ওর হঠাৎ খুব অরুণিমাকে দেখতে ইচ্ছে করলো আজ | আসলে ওদের দেখা এখন খুবই কম হয় | অরুনিমা নিজের শুট নিয়ে বেশ কদিন খুব ব্যস্ত ছিল | সাত দিনের জন্য মুম্বাইতেও ছিল ও | তাই হিয়ার এই ডিভোর্স দিতে চাওয়ার ব্যাপারটা অরুণিমাকে বলা হয়নি আর প্রিয়মের | ও জানলে নিশ্চই রিলিফট হবে মনে মনে | আর প্রিয়মকে সাপোর্টও করবে ওর ডিসিশনের জন্য | অরুনিমা নিশ্চই বুঝবে প্রিয়ম এখনই কেন হিয়াকে ডিভোর্সের এপ্লিকেশন করতে দেয়নি কোর্টে ! বুঝবে ও হিয়ার পরিস্থিতিটা | আর অরুনিমাও তো একটা মেয়ে | হিয়ার সমস্ত কথা জেনে অরুনিমাও আর আগের মতন ওকে ভুল বুঝবে না | এইসব ভেবেই প্রিয়ম গেছিলো অরুণিমার ফ্ল্যাটে সেই রাতে | বেহালার কাছেই ওর ফ্ল্যাটটা | কেনার সময় প্রিয়মই পছন্দ করেছিল | ইন্টেরিয়র ডেকরেশনটাও প্রিয়মই করিয়েছিলো ওর ফ্ল্যাটের | যাইহোক , সেদিন আটটার সময় প্রিয়ম নানান ভাবনার মাঝে এসে হাজির হয়েছিল অরুণিমার ফ্ল্যাটের দরজায় | আজ অরুনিমাও ওকে দেখলে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে | প্রিয়ম নিজেও কলকাতায় আজ সকালে ফিরেছে | চেন্নাইতে গিয়েছিলো বিজনেসের কাজে | কথা ছিল কাল সকালে ফিরবে | কিন্তু তাড়াতাড়ি কাজ মিটে যাওয়ায় আজই ফিরেছে | আর তারপর সল্টলেকে এই এপয়েন্টমেন্টটাও ছিল ডক্টরের ! কিন্তু অরুনিমা তো এতো কিছু জানে না ! তাই হঠাৎ দেখলে অবাকই হবে | এইসব ভেবেই কলিংবেলটা টিপলো প্রিয়ম | কিছুক্ষণের মধ্যেই এরপর কাজের দিদি এসে দরজা খুলে দিলো ফ্ল্যাটের | প্রিয়ম এবার একটু হেসেই ঢুকলো ভেতরে | তবে ফাঁকা ড্রইং রুমটা দেখে থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো কাজের মেয়েটাকে , ——- ” অরুনিমা কোথায় ? ঘরে ?”
কথাটা বলেই ও খেয়াল করলো হঠাৎ সোফায় একজনের কোর্ট পরে | সেন্টার টেবিলেও দুটো কোল্ডড্রিঙ্কের খালি বোতল , সিগারেটের ছাই জমা | প্রিয়ম এইসব দেখে নিজের মনেই আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো এবার কাজের দিদিকে , ———– ” কেউ কি আছে ফ্ল্যাটে ? কেউ এসেছে ?”
কথাটা বলতেই কাজের দিদি এই মুহূর্তে কিরকম জড়োসড়ো হয়ে গেলো যেন | তারপর একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠলো , ———– ” না ! মানে , আসলে অনির্বান স্যার এসেছেন | ”
কথাটা শুনে প্রিয়মের কিরকম তাল কাটলো এখন | ও সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলো , ———— ” অনির্বান স্যার ! সে কে ! আর এসেছেন তো আছেন কোথায় ? ”
প্রিয়মের কথাটা শুনে এই মুহূর্তে কাজের দিদি কেমন চুপ করে গেলো নিজে | তখন প্রিয়ম একটু গলার জোর বাড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো , ———- ” কি হলো ? চুপ করে গেলে কেন ? কোথায় উনি ?”
কাজের দিদি এবার আর চুপ না থেকে আস্তে গলায় বলে উঠলো , ———— ” অরুণিমাদিদির ঘরে আছে |”
কথাটা এই মুহূর্তে প্রিয়মের কানে লাগলো একটু | ও এবার ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা অরুণিমার বেড রুমের দিকে এগোলো | আজ অরুণিমার ঘরের দরজা ভেজানো , লক করা না ভেতর থেকে | তাই প্রিয়মের এক ধাক্কায়ই বন্ধ দরজা খুলে গেলো ঘরের এক নিমেষে , আর অরুনিমা আর বয়স্ক মতন একটা লোকের ইন্টিমেট দৃশ্যটা ভীষণ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো প্রিয়মের সামনে | দুজনের গভীরভাবে একে অপরের সঙ্গে জরিয়ে থেকে কিস করার দৃশ্যটা যেন থমকে দিলো প্রিয়মকে | ও কেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একা , ঘরের বাইরে | এর মাঝে কয়েক সেকেন্ডের ভিড়ে অরুনিমা অন্যের শরীরে হারিয়ে যাওয়া অবস্থাতেই খেয়াল করলো হঠাৎ খোলা দরজার ওপারে ! প্রিয়মকে দেখে ও সঙ্গে সঙ্গেই ছিটকে গেলো অনির্বানের কাছ থেকে এই সময়ে | কিন্তু ততক্ষণে প্রিয়মও ছিটকে গেছে এতদিনের এই সম্পর্কটা থেকে ! অরুণিমার কাছ থেকে ! ও আর যেন দাঁড়াতে পারলো না তাই এখানে | তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো ওই দরজার ওপার থেকে | অরুনিমা তবে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসেছিলো খাট থেকে | প্রিয়মকে আটকাতে ড্রইং রুম অব্দি এসে হাজির হয়েছিল এলোমেলো অবস্থায় | তারপর বেশ জোর করে হাতটা ধরেছিলো প্রিয়মের | কিছু কথা সাজিয়ে বলে উঠেছিল নিজে থেকে ,
————– ” যাচ্ছ কোথায় তুমি ? আসবে যে আগে বলোনি তো ?”
প্রিয়ম এবার অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়েছিলো ওর দিকে | রাগে অভিমানে ও যেন কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছিলো আজ | নিজের হাতটা ও প্রায় ঝাঁকিয়েই ছাড়িয়ে নিয়েছিল অরুণিমার হাত থেকে | তারপর একটু চেঁচিয়েই বলেছিলো , ———– ” কেন ? জানলে ওই লোকটাকে আজ আসতে বলতে না ? না কি টাইমিং চেঞ্জ করে দিতে !”
অরুনিমা কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করে বলেছিলো , ————— ” কাম অন ! তুমি এইভাবে রিয়্যাক্ট করছো কেন ! অনির্বান একজন খুব বড়ো বিজনেসম্যান .. ওর সাথে আমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে কাজের জন্য | আর তুমি এমন করছো যেন তুমি খুব ক্লিন ? তুমি তো হিয়ার সঙ্গে এতদিন একই ঘরে থাকছো | কি ভেবেছো ! আমি বুঝিনি কিছু ! তোমরা নিশ্চই ইন্টিমেট হয়েছো | এতদিন ধরে অনেক কিছুই করেছো | টাকার জন্য দুজনে বিয়ে করলেও এই টুকু বেনিফিট তো তোমরা দুজনেই নিয়েছো ফিজিক্যালি .. কিন্তু আমি কখনো এইসব নিয়ে কোনো কোয়েশ্চেন করিনি ! বিকজ আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল একটা মেয়ে | আর তুমি ছেলে বলে তুমি যার তার সাথে শুতে পারো , তাও তুমি শুদ্ধ , আর আমি মেয়ে বলেই আমি খারাপ , ক্যারেক্টারলেস , এরকম স্টিরিওটিপিক্যাল চিন্তা রাখার তো কিছু নেই !”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অরুনিমা | কিন্তু এই মুহূর্তে প্রিয়মের ধৈর্যের সীমা শেষ | ও গলা তুলেই বললো এবার ,
————— ” শাট আপ , জাস্ট শাট আপ …. ইউ আর সিক …. মেন্টালি সিক ওম্যান .. তুমি নিজে যেরকম , তুমি অন্যদেরও তাই ভাবো | কিন্তু সবাই তোমার মতন হয় না | হিয়া তো না ই | ও এই বিয়েটা করেছিল নিজের বাবা মার্ কথা ভেবে ! আর আমি এই বিয়েটা করেছিলাম তোমার কথায় | আমার নিজের টাকা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না ! আমি তো সব ছেড়ে আসতে চেয়েছিলাম | কিন্তু তুমি ফোর্স করেছিলে আমাকে এই বিয়েটার জন্য | আসলে তোমার মতন মেয়েরাই পারে , টাকার জন্য নিজেকে , নিজের কাছের মানুষটাকে বিক্রি করে দিতে ! টাকাটা তোমার কাছে একটা নেশার মতন | তার সামনে রিলেশনশিপ , লয়ালটি এইসবের কোনো ভ্যালুই নেই ! কিন্তু আমি আর হিয়া ঠিক এইরকম মানুষ নোই | আমরা ভালোবাসলেই শুধু তার কাছে আসি | ফিজিক্যাল রিলেশনশিপটা কোনো খেলা না আমাদের কাছে ! তাই তোমার মতন যার তার সঙ্গে শুতে পারিনি কখনো | এনিওয়েজ , তোমাকে এইসব বলে কোনো লাভ নেই | কারণ সেটা বোঝার মতন বোধ বুদ্ধি , কোনোটাই তোমার নেই | আর টাকা ছাড়া তোমার কাছে এই পৃথিবীতে কোনো কিছুর যখন ইম্পর্টেন্স নেই, তখন আমাদেরও আর একসঙ্গে থাকার কোনো মানে হয় না | এরপর আর আমার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করার কোনো রকম চেষ্টা করবে না | ইট’স ওভার বিটুইন আস.. আর বাবাই আসলে তোমাকে ঠিক চিনেছিল | আমার চিনতে এতটা দেরি হয়ে গেলো ! মাই ফল্ট ..”
কথাগুলো বলে প্রিয়ম আর ফিরে তাকালো না অরুণিমার দিকে | পা দুটোকে যতটা সম্ভব জোরে চালিয়ে বেরিয়ে এলো ওই ফ্ল্যাট থেকে | অরুনিমা তবে শেষ চেষ্টা করেছিল ওকে আটকানোর | অনেকবার করে ডেকেছিল প্রিয়ম প্রিয়ম বলে | কিন্তু প্রিয়ম আর সেই ডাকে সাড়া দেয়নি | ওর ভেতরটা আসলে আজ শেষ | কিরকম খাঁ খাঁ শূন্যতায় ভর্তি ! কেউ ওকে এইভাবে ঠকালো ঠিক ভাবতে পারছে না ! কি দেয়নি ও অরুনিমা কে ! যখন যেটা চেয়েছে , যেই ড্রেস , যেই জুয়েলরি , অনেক সময় তো কিছু না বললেও এনে দিয়েছে ! সব সময় এই মেয়েটাকে নিজের কাছে আগলে রাখতে চেয়েছে প্রিয়ম ! বিয়ে করে সারাটা জীবন একসঙ্গে কাটাতে চেয়েছে ! কোনো কিছুর তো ফাঁক রাখেনি ও কখনো | তারপরেও এইরকম একটা কাজ করলো অরুনিমা ! একটা মডেলিং এসাইনমেন্টের জন্য ওই লোকটার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করলো ! নিজেকে বিক্রি করে দিলো ! কথাটা ভেবে নিজেকে এই সময়ে কেমন বোকা লাগছে প্রিয়মের | মনে হচ্ছে ওর গালে যেন কেউ খুব জোরে দু খানা থাপ্পড় মেরে গেলো ! অপমানে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে ওর | দেড় বছরের সম্পর্কের শেষটা যে এইভাবে হবে ! এই দৃশ্য দেখে যে ওকে একদিন বেরিয়ে আসতে হবে ওর নিজের সাজানো ফ্ল্যাট থেকে ! এটা আসলে কল্পনাও করেনি প্রিয়ম |
<৯>
সেদিন তাই রাস্তায় রাস্তায় অনেকক্ষণ ঘুরেছিল ও একা একা | মনে হচ্ছিলো এই একলা শহরে যদি কোথাও হারিয়ে যেতে পারে , কোনো না ফেরার ঠিকানায় চলে যেতে পারে , তাহলে হয়তো এই অপমান , এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবে | বার বার এই সময়ে ওই চলন্ত রাস্তার মাঝে অরুণিমার সঙ্গে কাটানো এতদিনের মুহূর্তগুলো ভেসে আসছিলো ওর চোখের সামনে | আগের বছরই তো এই সময়ে ওরা মানালিতে গেছিলো একসঙ্গে | পাহাড়ি শহরে দুজনে কিরকম এক হয়েছিল সারাক্ষণ ! ওই কটেজটার নিঃসঙ্গ বারান্দাটায় একে অপরের মধ্যে হারিয়েছিল ওরা | বাইরে তখন ঝুরো ঝুরো বরফ পড়ছিলো | স্নো ফলে সাদা হয়ে গিয়েছিলো চারিদিক | তার মাঝে প্রিয়ম আর অরুনিমা নিজেদের মধ্যে মিশেছিল যেন | এতকিছুর পর অরুনিমা পারলো কি করে একটা অন্য লোকের সঙ্গে ঐভাবে ইনভল্ভ হতে ! একবারও কি এই হিসাবি চিন্তার মাঝে ওর পুরোনো সময়ের কথা মনে এলো না ! এতটা টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নিলো প্রিয়মকে ! মনে হচ্ছে একটা ইউজ এন্ড থ্রো পেন এর মতন প্রিয়মকে ভেবেছে অরুনিমা | যতদিন দরকার শুধু নিজের জন্য কাজে লাগিয়েছে | ওর থ্রু দিয়ে তিনটে ফ্যাশন ইভেন্টে পার্টিসিপেট করতে পেরেছিলো অরুনিমা | তার সমস্ত ড্রেস , মেকআপ আর্টিস্ট , ডিজাইনারের খরচ দিয়েছিলো প্রিয়ম | তখন ভেবেছিলো অরুনিমা ওকে ভালোবাসে , নিজের ভাবে বলেই হেল্প চেয়েছে ! ভালোবাসলে তো এই টুকু ডিপেন্ডেন্স আসেই ! কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সবটা মিথ্যে ছিল | অরুনিমা এই লোকটার মতন ওকেও ইউজ করেছে , একটা সিঁড়ি হিসেবে | নিজের কেরিয়ার , নিজের ফিউচারে কয়েকটা স্টেপ এগিয়ে যাওয়ার মিডিয়াম হিসাবে |
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই রাত থেকে ভোর হয়েছিল শহরে | ঘড়ির কাঁটায় তখন তিনটে | হিয়া কিছুতেই সারা রাত আজ ঘুমোতে পারেনি ! একটা অদ্ভুত চিন্তা এসে ঘিরে ধরেছিলো ওকে | প্রিয়ম ঠিক আছে তো ! এইভাবে সারা রাত তো কোনোদিন বাড়ির বাইরে থাকে না ! কিছু হলো না তো ওর ! না চাইতেও আনমনে এইসব খারাপ চিন্তা এসে ভিড় করেছিল ওর মনে | কয়েকবার তাই মোবাইলে ট্রাই ও করেছে প্রিয়মের | কিন্তু ফোনটা সুইচ অফ বলেছে প্রত্যেকবার | আর এর মাঝে খেয়াল করেছিল মিনিট সেকেন্ডের হিসেব পার করে তিনটে বেজে গেছে শহরে | হিয়া তো এরপর ঠিক করেই নিয়েছিল , আর আধ ঘন্টা দেখবে | প্রিয়ম এরপর না ফিরলে ও বাড়ির সবাইকে ডাকবে ঘুম থেকে | প্রিয়মের বন্ধুদের নাম্বার , ওই গার্লফ্রেন্ড অরুণিমার নাম্বার নিশ্চই কারোর না কারোর কাছে আছে ! ওরা ঠিক খুঁজে বার করতে পারবে প্রিয়মকে | সেইদিন এইসব এলোমেলো চিন্তার মাঝেই এরপর হালকা ভোর হওয়া আবছা আলোর কলকাতায় কলিংবেলটা বেজেছিল বাড়ির | হিয়া সেটা শুনে প্রায় দৌড়ে গেছিলো ঘর থেকে দরজার কাছে | তারপর কয়েক সেকেন্ডে দরজাটা খুলে যেন অন্য রকম একটা শান্তি পেয়েছিলো মনে | প্রিয়ম ঠিকঠাক সুস্থভাবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে | হিয়া সেই সময়ে কিছু না ভেবেই একটু উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো , ———– ” তুমি কোথায় ছিলে সারা রাত ? এইভাবে কাউকে না বলে !”
কিন্তু হিয়ার কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রিয়ম সেই মুহূর্তে ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলো বাড়ির | তারপর একটু নিজের মধ্যে হারিয়ে এলোমেলো পায়ে ওদের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো চুপচাপ | হিয়া খেয়াল করেছিল এরপর প্রিয়মের ফ্যাকাসে মুখটা ! ওর থমকে যাওয়া চেহারাটা | বুঝতে পারছিলো না কি হলো হঠাৎ ! এতদিনে এইরকম ছন্নছাড়াভাবে ও কোনোদিনও দেখেনি প্রিয়মকে | তাই অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়েই ঘরে ঢুকেছিলো | প্রিয়ম ততক্ষণে সোফায় বসে | হিয়া সেই সময় নিঃস্তব্ধতা ভেঙে প্রিয়মের কাছে এসে আস্তে গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল , ————- ” তোমার কি কিছু হয়েছে ? ঠিক আছো তুমি ?”
প্রিয়ম এরপর যেন ঘোরটাকে ভেঙে এক পলক তাকিয়েছিলো হিয়ার দিকে | তারপর অল্প কথায় বলেছিলো , ————- ” না , কিছু হয়নি আমার | ঠিক আছি |”
হিয়া তখন আবার সেই আস্তে গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল , —————- ” কিছু খাবে ? এনে দেব ?”
প্রিয়ম তার উত্তরে ওর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বলেছিলো , —————- ” না , আমার খুব ঘুম পাচ্ছে | আমি খুব ক্লান্ত | ঘুমোবো জাস্ট …”
হিয়া এরপর আর কোনো কথা বাড়ায়নি | ও বুঝেছিলো কিছু একটা বড়ো ঘটনা হয়েছে প্রিয়মের সঙ্গে , যার জন্য ছেলেটা এরকম থমকে আছে | কিন্তু ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো ও সত্যি খুব ক্লান্ত | আর কিছু সময়ে মানুষের মনের ক্লান্তিটা খুব স্পষ্টভাবে ফুঁটে ওঠে মুখে | তখন হাজারটা প্রশ্ন না করে তাকে তার মতন করে ছেড়ে দেয়া উচিত | নিজের মনটাকে সামলানোর জন্য সময় দেয়া উচিত | এই ভেবেই ও চুপ করে গেছিলো এরপর | কিন্তু খেয়াল করেছিল প্রিয়ম বালিশ ছাড়াই সোফায় শুয়ে পড়তে যাচ্ছে ; তখন হিয়া তাড়াতাড়ি খাট থেকে একটা বালিশ নিয়ে এগিয়ে দিয়েছিলো প্রিয়মকে | তারপর প্রিয়ম কয়েক মিনিটের মধ্যেই খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিলো হিয়ার সামনে | কিন্তু হিয়ার হঠাৎ খুব খারাপ লাগছিলো এই সময়ে | বুঝতে পারছিলো না কি হলো ছেলেটার ! ও তো কোনোদিন বাইরের জামা কাপড় পরে ঘুমোয় না বাড়িতে | এতদিন দেখছে ! তাহলে আজ কেন কোনো খেয়াল নেই প্রিয়মের ! কেন এতটা ক্লান্তি ওর শরীরে ! আর সারা রাত কি ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলো ! ওর শুকনো মুখটা দেখে মনে হচ্ছে কিছু খায়ওনি হয়তো | কথাগুলো একসঙ্গে এসে ভিড় করেছিল হিয়ার মনে | তবে একটা স্বস্তিতেও ছিল ভেতরে | প্রিয়ম যে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে এসেছে , ওর সামনে আছে , ঘুমোচ্ছে , এটা দেখে মনের ভয়টা কেটেছিল এখন | তাই হিয়াও এরপর গিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজের মনে | প্রিয়ম আসেনি বলে ওর এতক্ষণ এতটা টেনশন হচ্ছিলো যে নিজেও কিছু খায়নি রাতে ! কিন্তু প্রিয়মের এই এলোমেলো চেহারাটা দেখে ওর আর এই সময়েও খেতে ইচ্ছে করলো না ঠিক | তাই কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো হিয়া | ততক্ষণে অবশ্য ভোরের আলো আরো একটু বেশি স্পষ্টভাবে শহরে উঁকি দিয়েছে |
সেদিনের এরপর প্রিয়মের ঘুম যখন ভেঙেছিল ,তখন সকাল এগারোটা | ব্রেকফাস্ট টেবিলে ও উঠে এসেছিলো এরপর | যদিও খাওয়ার কোনো মন ছিল না ! বুকের ভেতরে কালকে রাতের যেই চিনচিনে যন্ত্রণাটা করছিলো , সেটা আবার ঘুম ভাঙার সঙ্গে ফিরে এসেছে | তাই না চাইতেও কালকের ঘটনাটা , পুরোনো স্মৃতিগুলো, আনমনে অকারণে এসে ভিড় করছে মনে | তাই দুটো টোস্ট নিয়ে প্লেটে বসেই ছিল চুপচাপ | এই সময়ে হঠাৎ বাবা সামনে এসে বলে উঠলো প্রিয়মকে ,
————- ” কালকে রাতে কখন ফিরলি ? যখন ডিনার করতে নেমেছিলাম , তখনও তো বাড়িতে ছিলিস না দেখেছি | কোথায় গেছিলিস যে অতো দেরি হলো ?”
প্রিয়ম এতগুলো প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিলো না এখন | আর এই মুহূর্তে যা মনের অবস্থা , মিথ্যা বানানো কথাও ঠিক আসছে না ওর | তাই চুপ করেই রইলো | সেই সময়ে হঠাৎ হিয়া পাশ থেকে এসে ওর হয়ে বলে উঠলো ,
—————– ” বেশি দেরি করেনি ও ফিরতে বাবা | আপনারা সবাই খেয়ে গেলেন , ওই তারপর ১২টার মধ্যেই ফিরে গেছিলো বাড়ি | আসলে আমার বাবাকে কটা ওষুধ কিনে দেয়ার ছিল | কাল বেলার দিকে ডাক্তারের চেক-আপ ছিল না একটা ! ও গেছিলো তো সঙ্গে | তাই রাতে ওই অসুধগুলোই কিনে দিতে গেছিলো চন্দননগর | ফোনে চার্জ ছিল না বলে কাউকেই আর কিছু জানায়নি | ওই জন্যই দেরি হয়েছে | ”
কথাগুলো ভেবে ভেবে এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো হিয়া | প্রিয়মও এই সময়ে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ! আসলে হিয়া যে এইভাবে ওর কাল সারা রাত বাড়ি না ফেরার ঘটনাটা লুকোবে সবার কাছ থেকে , এটা আসলে ঠিক এক্সপেক্ট করেনি | এই সময়েই প্রিয়মের বাবা বলে উঠলো অন্য কথা ,
———— ” কিন্তু তুমি কাল রাতে তারপর খেয়েছিলে তো মা ? ও আসেনি দেখে তো আমাদের সঙ্গে খেতে বসলে না ?”
হিয়া এর উত্তরেও ঘাড় দুলিয়ে বললো , ———– ” হ্যাঁ , খেয়েছি আমরা তারপর | ”
না , এরপর প্রিয়মের বাবা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো সেদিন | কিন্তু প্রিয়ম ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো ,
———— ” তুমি খাওনি কাল আমি আসিনি দেখে ? কেন ? আর বাবাকে এতো কথা বানিয়ে বলতেই বা গেলে কেন আমার হয়ে ? আমাদের মধ্যে তো সেই সম্পর্ক নেই যে একে অপরের জন্য এতটা কনসার্ন আসবে !”
হিয়া এই মুহূর্তে ঠিক এই কথাগুলো শুনবে ভাবেনি ! তবে বুঝতে পারছিলো কাল রাতে এমন কিছু একটা হয়েছে , যেটা প্রিয়মকে এইরকম গম্ভীর আর হিসাবি করে দিয়েছে | তাই হয়তো এইভাবে ডিরেক্ট প্রশ্ন করছে ! তবে হিয়াও এর উত্তর সোজাসুজিই দিলো | কিছু কথা ভেবে আস্তে গলায় বলে উঠলো ,
————— ” প্রায় দেড় মাস হতে চললো একসঙ্গে থাকি আমরা | একই ঘরে | আর এতদিন একসঙ্গে থেকে এই টুকু কনসার্ন আসার জন্য কোনো সম্পর্কের দরকার হয় না ! আর তার ওপরে সেই মানুষটার জন্য , যে আমার বাবার শরীর , ট্রিটমেন্ট এইসব নিয়ে এতটা কনসার্ন দেখাচ্ছে নিজে থেকে | আর আমি জানি কাল কিছু একটা হয়েছে যেটা হয়তো হওয়াটা ঠিক হয়নি তোমার জন্য ! তাই এইভাবে সারা রাত বাড়ির বাইরে ছিলে | আর আমি এটাও জানি যে এরকম কিছু ঘটলে সব সময় উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না | একটু নিজের মতন থাকতে চায় মানুষ সেই সময়ে | তাই বাবাকে বানিয়ে বললাম এইসব | যাইহোক , খেয়ে নাও | কাল তো কিছু খাওনি ! ”
কথাটা বলে হিয়া রান্নাঘরে চলে গেলো এবার | তবে প্রিয়ম এখনো একটু অবাক হয়েই থমকে থাকলো কিছুক্ষণ | আসলে হিয়া ওকে এতো কম দিন দেখেও এতটা বুঝবে , এটা ঠিক মেলাতে পারছে না ! যে এতো বছর ওকে এতো কাছ থেকে পেলো , সেই মেয়েটা তো ওকে কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও হয়তো বোঝেনি ! আর হিয়া , যে এতটা দূরের , সে কিছু না বলতেই ওর মনটা পড়ে ফেললো এইভাবে ! এটা ভেবে খুব অদ্ভুত লাগলো এখন |