#হৃদয়_মাঝে ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৬>
তবে সেদিনের পর যখন প্রিয়মদের বাড়ি ফিরেছিল হিয়া , সেই রাতে একটা অন্য ঘটনা ঘটেছিলো হঠাৎ | হিয়া ঠিক মেলাতে পারেনি এই নতুন ঘটনাটার কারণ ! আসলে হিয়া সেই রাতে রোজের মতন মাটিতে চাদর পেতে বালিশটা নিয়ে শুতে যাচ্ছিলো , তখনই দরজা দিয়ে প্রিয়ম এসেছিলো নিশ্চুপে | অন্য দিন হলে প্রিয়ম ওই রকমই চুপ্চাপভাবে উল্টোদিকের সোফাটায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরে নিজের মতন | হিয়ার সঙ্গে কথা তো দূরে থাক , তাকায়ও ঠিকভাবে না | কিন্তু আজ সবটা বদলে দিয়ে প্রিয়ম ওর সামনে এসে আচমকা বলে উঠলো ,
————- ” তুমি খাটে শোও | এইভাবে চাদর পেতে মাটিতে শোয়ার কোনো দরকার নেই |”
হিয়া কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েছিল প্রথমে | তারপর কিছু কথা সাজিয়ে আস্তে গলায় বলেছিলো ,
————- ” না , ঠিক আছে | অসুবিধা নেই |”
তারপর নিজের মনে শুতে যাচ্ছিলো , কিন্তু প্রিয়ম ওকে থামিয়ে নিজেই আবার বলে উঠেছিল জোর দিয়ে ,
————– ” আমি বলছি তো ! তুমি আজ থেকে খাটে শোবে | আর আমার যা লাইফ কমপ্লিকেটেড হওয়ার হয়ে গেছে এই বিয়েটা করে ! এরপর এইভাবে মাটিতে শুয়ে তুমি আলাদা করে তো কিছু ঠিক করতে পারবে না | আর এছাড়াও আমি অনেক ভেবে দেখেছি | সব দোষ তো তোমার না ! যা হয়েছে তার কারণ তো আমার বাবাও | আর কিছুটা আমি নিজেও | টাকার লোভ ছাড়তে পারিনি বলেই তো প্রপার্টির জন্য এই বিয়েটা করেছি | তাহলে তোমার এইভাবে মাটিতে শোয়ার , আমার কাছে রোজ রোজ কথা শোনার তো কোনো মানে নেই ! তাই বলছি , খাটে ঘুমোও | প্লিজ |”
প্রিয়ম প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো ওকে | হিয়া কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ এইসব শুনে ! আসলে শুরুর দিন থেকেই তো এই ছেলেটা ওর সঙ্গে বাজেভাবে কথা বলেছে ! ওকে লোভী , খারাপ , যা মনে এসেছে বলেছে | রাগ দেখিয়েছে | যেটা তবে খুব অস্বাভাবিক না | প্রিয়মের জায়গায় অন্য কেউ হলেও ওকে এই ব্যবহারটাই ফিরিয়ে দিতো | আর হিয়া কিরকম যেন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো এই খারাপ কথাগুলোর সঙ্গে | তাই আজ হঠাৎ এই ‘প্লিজ’ ওয়ার্ডটা , আস্তে গলায় বলা কথাগুলো কানে লাগলো খুব | তাও কয়েক সেকেন্ডে চুপ থেকে নিজে কিছুটা ধাতস্ত হয়ে বললো ,
————– ” এটা হয় না | এই ঘরটা তোমার | আমি জানি তুমি আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবো , যে টাকার জন্য এইভাবে জোর করে একটা বিয়ে করেছে ! তবে তুমি আমাকে যেরকম ভাবো , আমি সেটা নোই | আর আমার পক্ষে এইভাবে খাটে শোয়া সম্ভব না , যেখানে এই ঘরটা যার , সে নিজে সোফায় ঘুমোচ্ছে রোজ ! সরি |”
কথাটা বলে হিয়া এবার এগিয়ে গেল ওর মাটির বিছানার দিকে | কিন্তু প্রিয়মও ভীষণ জেদি | ও নিজের কথা না শুনিয়ে ছাড়বে না আজ | তাই হিয়াকে থমকে একটু জোর দিয়েই বলে উঠলো নিজে , ———— ” ঠিক আছে | তাহলে তুমি যখন খাটে শোবেই না তাহলে এরপর আমি আর সোফাতেও ঘুমোবো না আজ থেকে | আমিও মেঝেতে চাদর পেতে ঘুমোবো | মিটে গেলো |”
কথাটা শুনে এই মুহূর্তে হিয়া ফিরে তাকালো প্রিয়মের দিকে | তারপর সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো , ——— ” না না , এ বাবা ! এটা হয় না | তুমি কেন মাটিতে শোবে ?”
প্রশ্নটার উত্তরে প্রিয়ম কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায়ই বললো , ———- ” সেই উত্তর তোমাকে কেন দেব ! তুমি যদি মাটিতে শোও , আমিও মাটিতেই ঘুমোবো |”
কথাটা বলেই ও আলমারির দিকে এগোলো চাদর নেয়ার জন্য | কিন্তু হিয়া আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না | অন্ধকার মুখে নিজের বালিশটা তুলে এবার খাটের ওপর রাখলো | তারপর আস্তে গলায় বলে উঠলো , ————- ” এইসবের কোনো দরকার নেই | আমি খাটেই ঘুমোচ্ছি |”
প্রিয়মের কথাটা শুনে শান্তি হলো এবার | হিয়ার আড়ালে ওর মুখে অল্প হাসিও চলে এলো হঠাৎ | আসলে এতদিন ওর ভেতরে কোথাও একটা অল্প খারাপ লাগা ছিল ! হাজার হলেও , হিয়া একটা মেয়ে | ওর এইভাবে মেঝেতে শোয়াটা ঠিক লাগতো না ! কিন্তু এই মেয়েটার জন্য মনে অনেক রাগ জমে আছে বলেই এই ব্যাপার নিয়ে নিজে থেকে কিছু বলেনি এ-কদিন | তবে হিয়াদের বাড়ি গিয়ে ওর বাবার ঘটনাটা শুনে , সব কিছু দেখে সত্যি ভীষণ খারাপ লেগেছে | ওর মায়ের শুকনো মুখটা , ওর বাবার জীর্ণ ক্লান্ত শরীর টুকু, শুধু তো এটাই চায় , ওদের মেয়েটা ভালো থাকুক ! আর সেদিন যেন ওদের নিঃস্তব্ধ চোখ এই আর্জি নিয়েই প্রিয়মকে দেখছিলো ! অতো যত্ন করে খাবার আয়োজন করা , প্রিয়মের যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় , সেটার বার বার খেয়াল রাখা , এইসব তো ওই একটাই কারণে ! যাতে ওদের মেয়েটা ভালো থাকে ! মেয়েটা এই যত্নের , এই খেয়ালের কিছুটা ফেরত পায় জামাই এর কাছ থেকে | না , প্রিয়মের পক্ষে এতো কিছু যদিও করা সম্ভব না কখনো | হিয়াকে ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা ! ওকে বন্ধু ভাবাটাও হবে না কখনো | কিন্তু শুধু খারাপ কথা বলে , অপমান করে , ওকে খারাপ লাগবে না আর এরপর | এটা প্রিয়ম ঠিক করে নিয়েছে নিজের মনে |
যাইহোক , এইভাবে দিনগুলো আস্তে আস্তে কাটছিলো ওদের | মন খারাপ , কম্প্রোমাইজ , আর না পাওয়ার যন্ত্রণার ভিড়ে , সবার আড়ালে | এর মধ্যে শহর থেকে তিনটে সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে | আজ চোদ্দই আগস্ট | প্রিয়ম আর হিয়ার বিয়ের এক মাস হলো আজ | অন্য স্বামী স্ত্রী হলে এই দিনটা সবার থেকে আলাদা লাগতো ওদের ! একটা না বলা আনন্দ থাকতো মনে | হয়তো রাতে কোথাও একটা ডিনার , অথবা দুজনের একসঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটানোর প্ল্যানও হয়ে যেত সকাল থেকে ! কিন্তু প্রিয়ম আর হিয়া তো অন্য | ওদের এই কম্প্রোমাইজ বিয়ের এক মাস কাটার মধ্যেই মনে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি এসে জমা হয়েছে | বেশি করে প্রিয়মের | এই জোর করে একজনের সঙ্গে লোক দেখানো বিয়েটা আস্তে আস্তে কেমন মনে পাথরের মতন চেপে বসছে ওর | সত্যি আজকাল মনে হয় , সেদিন অরুণিমার কথা না শুনলেই ভালো হতো | টাকার জন্য এইভাবে নিজের মনকে শেষ করা যায় না ! অরুণিমার মতন প্র্যাকটিকাল ও কিছুতেই হতে পারবে না | এটা প্রিয়মের আগে বোঝা উচিত ছিল | আর আজকাল তো অরুনিমা ওকে সারাদিনে আধ ঘন্টা সময় পর্যন্ত দেয় না ঠিক ! মডেলিং এসাইনমেন্ট , ফটো শুট , এইসব নিয়ে এতো ব্যস্ত , যে প্রিয়মকে নিজে থেকে মনেও পরে না খুব একটা ওর | এই যেমন কালই , প্রিয়ম সারাদিন বাদে রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে দু তিনবার কল করলো অরুনিমা কে , মেসেজ করলো ফোন এ | কিন্তু বার বারই রিং হয়ে কেটে গেলো ফোনটা | মেসেজেরও কোনো রিপ্লাই নেই | প্রিয়ম কাল রাত দুটো অব্দি অপেক্ষা করেছিল অরুণিমার একটা কল এর | কিন্তু তারপর সেই অপেক্ষার ভিড়েই কখন চোখের পাতা বুঁজে এসেছিলো খেয়াল করেনি ! তবে এইরকম ঘটনা শুধু আজকের না | অনেকদিনের | প্রিয়ম মাঝে মাঝে ভাবে তাই , যে ব্যস্ত তো ও নিজেও | সারাদিন অফিস , মিটিংস , ব্যবসার এতো এতো কাজ , সময় তো ওরও চোখের পলকে কেটে যায় | কিন্তু তাও তো প্রিয়ম ঠিক কিছু মিনিট সেকেন্ড খুঁজে বার করে নিজে জীবনে ! শুধু অরুণিমাকে মনে করার জন্য | ওকে একবার একটা কল , একটা মেসেজ করার জন্য ! সত্যিই কি ব্যস্ততা কোনো অজুহাত হতে পারে মনের সম্পর্কগুলোর কাছে ! যাকে ভালোবাসি , তাকে কাছে পেতে কি আদেও কোনো আলাদা সময়ের প্রয়োজন হয় ! একটা ফোন কল , একটা মেসেজ কখনো জোর করে করতে হয় না | মনের টানে সেটা আপনাআপনিই হয়ে যায় | কথাগুলো আজও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রিয়মের বার বার মনে হচ্ছিলো , ওর ওই নিঃস্তব্ধ মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে | তবে অফিসে যাওয়ার পথেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো | এস.এম.এস | একটা দু লাখ টাকার ট্রান্সাকশন হয়েছে ব্যাংক থেকে | প্রিয়ম এস.এম.এস টা দেখেই গাড়িতে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো মাঝ রাস্তায় | তারপর আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে অরুণিমাকে কল করলো | ও ভালো করে জানে , এইরকম হুটহাট টাকা অরুনিমাই ওর একাউন্ট থেকে তোলে মাঝে মাঝে ! আগে তো তাও বলে নিতো | আর এখন তো একেবারে না বলেই ! কথাটা ভাবতে ভাবতে একটা হালকা রাগ এসে জমা হলো মনে | আর এর মাঝেই অরুনিমা ফোনটা রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বললো |
প্রিয়ম এবার কোনো রকম কথা না ঘুরিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলো ওকে , ————- ” তুমি দু লাখ টাকা উইড্র করেছো আমার একাউন্ট থেকে ?”
অরুণিমার এর উত্তরে একটুও ভনিতা না করে স্ট্রেটকাটই বললো , ———— ” হ্যাঁ , তুলেছি | তো ? আমার কয়েকটা পার্টিতে যাওয়ার আছে এই উইক এ | দুটো ব্র্যান্ডেড ড্রেস লাগতো | আর এইসব পার্টিগুলোতেই তো নিজের কনেকশন বাড়ানো যায় | ভালো বিজনেসম্যানের নজরে আসতে পারলে কাজ পাবো আরো | তাই তুলেছি |”
প্রিয়মের কথাগুলো শুনে এখন বেশ বিরক্তি লাগলো যেন | সারাক্ষন এতটা অবুঝ হলে চলে ! কথাটা ভেবেই ও বললো ,
—————- ” অরুনিমা , ওই একাউন্টে শুধু আমার পার্সোনাল টাকাই থাকে না ! অনেক সময় অনেক ক্লাইন্ট পেমেন্টও থাকে আমার কাছে | তুমি এইভাবে কিছু না বলে টাকা তুললে আমার প্রব্লেম হয়ে যেতে পারে , এটা বোঝো না ? ”
কথাটার উত্তরে অরুনিমা এই মুহূর্তে নিজের পারদটা চড়িয়েই বললো , ————– ” মাত্র দু লাখ টাকার জন্য এতো কথা শোনাচ্ছ ? এখন আমার রিসেন্ট কাজগুলোর পেমেন্ট ঢোকেনি বলে তোমাকে ফেরত দিতে পারছি না ! কদিন বাদে দিয়ে দেব টাকাটা | আর তুমি তো নিজেই বলেছিলে আমাকে , যে আমাদের দুজনের টাকা সেম | তাই অন্য কারোর কাছ থেকে না চেয়ে শুধু তোমার কাছ থেকেই টাকা নিই আমি | আর এটা তো নতুন কিছু না ! এর আগেও তো তোমার একাউন্ট থেকে টাকা নিয়েছি আমি | তখন তো এই টোনে কথা বলোনি আমার সাথে ? তাহলে আজ কি হলো ? না কি ওই মেয়েটা , কি যেন নাম ! হিয়া | ও তোমাকে এইসব শিখিয়ে দিয়েছে বলার জন্য ?”
কথাগুলো এবার খুব লাগলো প্রিয়মের হঠাৎ | আর এইভাবে হিয়ার নামটা কোনো কারণ ছাড়াই উঠতে প্রিয়মের বিরক্তির লেভেলটাও বেড়ে গেল ভীষণ | ও আর কোনো কথা না বাড়িয়েই ফোনটা কেটে দিলো নিজে থেকে | অরুনিমা কি কখনো ওর কারণগুলো বুঝবে না এই জীবনে ! নিজের জেদ , নিজের ঠিকগুলোকেই চালিয়ে যাবে ওর ওপর দিয়ে ! এই বিয়েটাও তো অরুণিমার কথাতেই করতে রাজি হয়েছিল প্রিয়ম | সারাক্ষণ একটা মানুষ এতো টাকা টাকা করে কি করে কে জানে ! আর হিয়া ! ওর নামটা টানার কি দরকার ওদের কনভার্সেশনের মাঝে ! এই এক মাস হলো তো মেয়েটাকে দেখছে রোজ , কখনো বাড়তি একটা কথা বলতে যায় না হিয়া কোনো ব্যাপারে | এক মাস হলো বিয়ে হয়েছে , বাবা তো ওকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়েছিলো নিজে থেকে বৌভাতের দিন | প্রিয়ম খোঁজ নিয়ে দেখেছে , হিয়া ওই কার্ড থেকে একটা টাকাও খরচা করেনি কখনো | উল্টে মেয়েটার মুখটা তো সারাক্ষণ অন্ধকারই থাকে চিন্তায় , ওর বাবাকে নিয়ে | প্রিয়ম অনেক সময়ই দেখেছে হঠাৎ কখনো ঘরে ঢুকতে গিয়ে , হিয়া একা ঘরে ওর বাবার মেডিক্যাল রিপোর্টের ফাইলগুলো নিয়ে বসে আছে চুপচাপ ! যেন অনেক কিছু ভাবছে নিজের মনে ! তো কখনো কোনো নতুন ডাক্তারের খোঁজ পেলে তার সাথে যোগাযোগ করা , এপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করা, এইসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে | অনেক সময় রাতে নিজে খায় অব্দি না | তবে সেই সব নিয়ে আজ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলতেও যায় না হিয়া | কিরকম নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে চিন্তাগুলোকে | গুমরে থাকে ভেতরে | এইসব দেখতে দেখতে প্রিয়ম নিজেও কখনো হিয়াকে কিছু বলতে যায় না এই বিয়েটা নিয়ে | আগে মেয়েটার জন্য মনে অনেক রাগ থাকলেও , আজকাল সেইসব কিরকম মুছে গেছে ভেতর থেকে | এখন হিয়াকে দেখলে ওর খারাপ লাগে ! একটা মেয়ে নিজের বাবাকে হারানোর ভয় নিয়ে যেন কাটাচ্ছে প্রত্যেকটা দিন ! এই কথাটা ভাবলে প্রিয়মও থমকে যায় মনে মনে | আর সত্যি , সেই মেয়েটাকে নিয়ে অরুণিমার মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে ভীষণ রাগই হচ্ছে এখন | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও সেদিন অফিস এসে পৌঁছেছিল | তবে এরপর দুদিন অরুনিমা যতবার ওকে কল করেছে , প্রিয়ম ফোনটা ধরেনি আর | কিছুতেই ঠিক মন চায়নি আসলে প্রিয়মের , অরুণিমার সাথে কোনো রকম কথা বলার|
<৭>
সেদিন এরপর প্রিয়মের জন্য তবে আরেকটা ঘটনা অপেক্ষা করছিলো বাড়িতে | হিয়া একটা পেপার নিয়ে রেডি ছিল আজ | প্রিয়ম অফিস থেকে ফিরতেই অন্যদিনের মতন চুপ না থেকে হিয়া নিজে থেকেই ওর কাছে গিয়ে বলে উঠলো ,
————- ” এই পেপারটা দেখে নাও | আর এখানে তোমার একটা সাইন চাই | ”
প্রিয়ম হঠাৎ এইসব দেখে ঠিক বুঝতে না পেরে ওর দিকে একটু অবাকভাবেই তাকিয়েছিলো ,
হিয়া তখন নিজেই আবার বলে উঠলো , ————— ” মিউচুয়াল ডিভোর্সের জন্য আমি এপ্লাই করবো ভেবেছি | এটা সেই এপ্লিকেশনেরই প্রিন্ট | তুমি একটা সাইন করে দিলে আমরা একসঙ্গে এপ্লাই করতে পারবো | আর এখানে লেখা আছে , আমার কোনো এলিম্যানি লাগবে না | তাই আমার মনে হয় তোমার আপত্তি করার মতন কিছু নেই | আসলে কোর্টের ব্যাপার তো ! প্রসিডিং হতে অনেক টাইম লাগবে | এখন এপ্লাই করলে সেপারেশনে গিয়ে ডিভোর্স পেতে পেতে এক দেড় বছর কেটে যাবে ! আর ততদিন আমার বাবা আর বেঁচে থাকবে না আমি জানি | সাত দিন আগে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে , কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট যেহেতু করা হচ্ছে না , তাই আর বড়োজোর তিন চার মাস ! তাই ভাবলাম তোমাকে এইভাবে ঝামেলার মধ্যে আর না রেখে ডিভোর্সের জন্য এপ্লাইটা করেই দিই ! দেখে নাও প্লিজ একটু এপ্লিকেশনটা | কিছু চেঞ্জ করতে হলে বোলো |”
কথাগুলো কিরকম শান্তভাবে বলে গেলো হিয়া ! যেন এই কথাটা বলার জন্য ও অনেকদিন ধরেই তৈরী ছিল ! প্রিয়ম এই মুহূর্তে কিছুই ঠিক বুঝতে না পেরে ওই অবাক চোখে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে উঠলো , ————- ” মানে ! তুমি ডিভোর্স চাও আমার থেকে ? তাও কোনো টাকা পয়সা ছাড়া ! তুমি কি পাগল ! তুমি তো সবই জানতে ! তাহলে ডিভোর্স নেয়ার জন্য শুধু শুধু বিয়ে করলে কেন ?”
কথাটা শুনে হিয়া ওই শান্ত গলাতেই বললো এবার, ————– ” আমাকে তুমি যেরকম ভাবো , আমি সেরকম নোই | আমি তোমার লাইফটা শেষ করে কখনোই এই বিয়েটা করতে চাইনি ! আর সেদিন রাতে আমি মা বাবাকে সব বলে দেব ভেবেছিলাম | কিন্তু বলতে পারিনি | কারণ বাবাকে সেই রাতেই হসপিটালে এডমিট করতে হয়েছিল | একটা মাইল্ড এট্যাক হয়েছিল বাবার | কিডনির প্রব্লেম থেকেই হার্টে চাপ পড়তে শুরু করেছিল আসলে ! আর সেই রাতেই ডাক্তার বলে দিয়েছিলো , আমার বাবা আর বেশিদিন থাকবে না | দুটো কিডনিই ভীষণভাবে ড্যামেজ হয়ে গেছে | ডায়ালিসিসও নিতে পারবে না এরপর | সেদিন মার্ মনের অবস্থা , বাবার শরীর , সব কিছু দেখে আমি বাধ্য হয়েছিলাম স্বার্থপর হতে | তোমার কথা না ভেবে আমার মা বাবার কথা ভাবতে | কিন্তু সত্যি বলছি , আমি সেদিন বিয়ে করার ডিসিশনটা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্সের ডিসিশনটাও নিয়েছিলাম | আমি এই বিয়েটা শুধু আমার বাবাকে এই শেষ দিনগুলোতে একটু শান্তি দেয়ার জন্য করেছি | আর মা কে ও কদিনের মিথ্যে শান্তিই দিতে চেয়েছি | বাবাকে নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় এমনিই মা শেষ হয়ে যাচ্ছে ! এই সময়ে বিয়ে ভাঙার খবরটা যদি বলতাম , তাহলে আমার মা টা ও বাঁচতো না ! ”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলেছিলো হিয়া | আর কথাগুলোর সঙ্গে কিরকম কান্না জরিয়ে এসেছিলো ওর গলায় | চোখ দুটোও ভিজে গেছিলো হঠাৎ | প্রিয়ম নির্বাক হয়ে দেখছিলো সেইসব কিছু | কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে কারোর সামনে আর ভাঙতে না দিয়ে একটু সময় নিয়ে আবার বলে উঠলো ,
—————— ” আমি তোমাকে বিয়ের আগে এই কথাগুলো অনেকবার বলার চেষ্টা করেছিলাম | তোমাকে অনেকবার ফোন করেছি , দেখা করার চেষ্টা করেছি | কিন্তু তুমি কখনো কোনো রেসপন্স করোনি বলে আমাকে সবটা না জানিয়েই বিয়ে করতে হয়েছে ! তারপর বৌভাতের দিন রাতেও আমি বলতে চেয়েছিলাম সব কারণগুলো | কিন্তু সেদিন আমার কিছু বলার আগেই তুমি অনেক কথা বলে দিলে আমাকে ! আমি সেদিন বুঝেছিলাম , আমি তোমার কাছে এতটাই খারাপ লোভী একটা মেয়ে হয়ে গিয়েছি , যে আমি মুখে বললে তুমি কখনোই আমার কোনো কথায় বিশ্বাস করবে না আর ! তাই এতদিন চুপ ছিলাম | যাইহোক , আমি সত্যি তোমাকে সরি বলছি | তোমার জীবনের এতগুলো মাস আমি এইভাবে শেষ করে দিলাম ! নিজের স্বার্থপরতার জন্য | আমি জানি না অন্য কেউ আমার জায়গায় হলে কি করতো এই পরিস্থিতিতে ! কিন্তু আমি মা বাবাকে ছাড়া সেদিন আর সত্যি কিছুই ভাবতে পারিনি ! আর আমি তোমাকে প্রমিস করছি , আমার বাবা যেদিন শেষ হয়ে যাবে , তার পরের দিনই আমি এই বাড়িটা ছেড়ে দেব | দরকার হলে আমি এই স্টেটমেন্টটা কোর্ট পেপারে সাইন করেও দিতে পারি তোমাকে ! আর ডিভোর্সের এপ্লিকেশন তো এখনই করে দিচ্ছি | মিউচুয়াল ডিভোর্স পরে তখন পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না | কিন্তু শুধু মাঝের এই তিন চার মাস , যত দিন আমার বাবা আছে , ততদিন আমাকে এখানেই থাকতে হবে | এই বিয়েটা যে সত্যি , এটা প্রিটেন্ড করতে হবে | তুমি এই কটা মাস একটু এডজাস্ট করে চলো ! আমি এটা রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে | তারপর আমি সত্যি কোনোদিন, কখনো ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে ! আর এই বিয়েটারও কোনো এগজিসটেন্স থাকবে না কোথাও | শুধু এই কটাদিনের জন্য আর একটু এডজাস্ট করে নাও , প্লিজ | ”
কথাগুলো শেষ করেই সামনে থাকা স্টাডি টেবিলটায় এপ্লিকেশনটা রেখে হিয়া বেড়িয়ে এলো প্রিয়মের সামনে থেকে এখন | আসলে কান্নাটা আর নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারছে না ও | ভেতর থেকে নিজেকে নিঃস্ব লাগছে খুব | এতটা অসহায় মনে হচ্ছে যে দম বন্ধ হয়ে আসছে ! আসলে একটু ফাঁকা জায়গার দরকার এই মুহূর্তে ওর | যেখানে গিয়ে গলা ভেঙে কাঁদতে পারবে কিছুক্ষণ ! নিজেকে ভাঙতে পারবে পুরোপুরিভাবে | এই শক্ত হয়ে থাকার খোলসটা খুলে নিজের আসল আমিটাকে কাছে টেনে নিতে পারবে কিছুক্ষণের জন্য অন্তত | কথাগুলো ভেবেই সেদিন খোলা ছাদে গিয়েছিলো হিয়া | তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল কান্নায় | বাবা মা কে এতদিন ধরে মিথ্যা বলা ! প্রিয়মকে এইভাবে একটা মিথ্যা সম্পর্কের মধ্যে জরিয়ে ফেলা ! আর নিজের এই ভাঙাচোরা অসুম্পর্ণ গল্পটার জন্য এতদিনের জমে থাকা কষ্টটা যেন আঁকড়ে ধরেছিলো কিরকম ওকে | কান্না ছাড়া হয়তো এটা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় নেই ! এই ভাবনার ভিড়েই ঝাপসা চোখে দাঁড়িয়েছিল হিয়া , একলা , একরাশ অন্ধকারে ঘেরা ছাদের মধ্যে |
কিন্তু সেদিন হঠাৎই ওই অন্ধকারের আড়াল থেকে একটা চেনা গলার স্বর ওর কানে ভেসে এসেছিলো কেমন | হিয়া থমকে গেছিলো প্রিয়মকে দেখে ওই আবছা চোখে ! আসলে এই জলটা ওর খুব নিজের | এটা কারোর সামনে আসুক , হিয়া চাইতো না ঠিক |কিন্তু না চাইতেও সেদিন প্রিয়ম এসেছিলো ওর কাছে | ওকে খুঁজে বার করেছিল সারা বাড়ি ঘুরে এই অন্ধকার ছাদে | আসলে ডিভোর্সের এপ্লিকেশনটা ওকে যেন ধাক্কা দিয়েছিলো একটা ! কাউকে ভুল বোঝার ধাক্কা ! তার গল্পটা না শুনেই তার সম্বন্ধে নিজের মনে নিজের মতন করে একটা গল্প তৈরী করে নেয়ার ধাক্কা | এতটা ভুল যে প্রিয়ম হতে পারে , এটা আজ হিয়ার ওই আস্তে গলার আওয়াজ , ওর কথার মাঝে থমকে থাকা অসহায় মুখটা বুঝিয়ে দিয়েছিল খুব স্পষ্টভাবে | সেই জন্য ও নিজে থেকেই হিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিল নিচু গলায় ,
———— ” আই এম সরি .. আমি এতটা ভুল বুঝেছি তোমাকে ! একবারও তোমার কথাগুলো শোনার চেষ্টা করিনি ! আমি আসলে কিছু না জেনে এতটা রেগে ছিলাম ! আমি তখন শুধু নিজের প্রব্লেমটার কথা ভাবছিলাম | নিজের লাইফ ছাড়া তাই অন্য কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামাইনি | আই এম রিয়ালি সরি … ”
হিয়া কথাগুলো শুনে কিছুটা অবাক হয়েছিল হঠাৎ | প্রিয়ম যে ওর কাছে এসে সরি বলবে , এটা ঠিক এক্সপেক্ট করেনি ও ! তবে সেই মুহূর্তে তাড়াতাড়ি চোখটা মুছে ফেলেছিলো হিয়া | ও কাঁদছে . এটা আসলে দেখতে চায়নি নিজে | তাই কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে হিয়া বলে উঠেছিল কিছু কথা সাজিয়ে ,
——————-” না , সরি বলার তো কিছু নেই ! যেই পরিস্থিতি তে বিয়েটা হয়েছিল সেই সময়ে আমাকে খারাপ ভাবাটাই স্বাভাবিক | অন্য কেউ হলেও একই ভাবে রিয়্যাক্ট করতো | যাইহোক , ডিভোর্সের এপ্লিকেশনটা সাইন করে দিয়ো , আমি কাল জমা দিয়ে আসবো উকিলের কাছে |”
কথাটার উত্তরে প্রিয়ম এবার বেশ দৃঢ় গলায় বললো অন্য কথা | ও আসলে এই ব্যাপারে নিজের ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে | তাই খুব সোজাসুজিই বললো হিয়াকে ,
—————– ” না | এখনই ডিভোর্সের এপ্লিকেশন কোথাও দেয়ার দরকার নেই | আমি জানি তোমাদের ফ্যামিলির ওপর এখন খুব চাপ চলছে | তার ওপরে যদি কেউ একবার এই ডিভোর্সের কথা ভুল করেও জানতে পারে , তাহলে খুব বাজে হবে ! আমার এখন ডিভোর্সের দরকার নেই | আগে তোমার বাবা সুস্থ হোক | তারপর এইসবের মধ্যে যাবো আমরা | ”
কথাগুলো শুনে হিয়া এবার আর একটু বেশি অবাক হলো ! প্রিয়ম নিজেরটা ছেড়ে ওর বাড়ির কথা ভাবছে ! এই এক্সপেক্টেশনটাও ছিল না ঠিক | তাও ও আরেকবার বলে উঠলো,
—————– ” আমার বাবা আর ঠিক হবে না | আমরা সবাই এই সত্যিটা মেনে নিয়েছি | আর এপ্লিকেশন করলে কেউ এই মুহূর্তে জানতে পারবে না | অসুবিধা হবে না কোনো |”
প্রিয়ম কথাগুলো শুনে তখন একইভাবে দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো , ————– ” না হিয়া | এখন না | ডিভোর্স নেয়ার জন্য এটা ঠিক সময় না | আর এই নিয়ে এই পরিস্থিতিতে আলাদা করে ভাবারও কিছু নেই | আর এটাই ফাইনাল | আর একটা কথা | তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে এতটা নেগেটিভ কেন ভাবছো ! আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে | অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছে শহরে | তাদের কাছে গেলে উনি হয়তো ঠিক হয়েই যেতে পারে ! আচ্ছা , তোমার বাবার নেক্সট এপয়মেন্ট কবে ডাক্তারের ?”
কথাগুলো প্রিয়ম এক নিঃশ্বাসে বললো | হিয়া কিরকম স্থির হয়ে গিয়েছিলো এই সময়ে | কেউ যে ওর পরিস্থিতিটাকে এতটা মন থেকে বুঝবে , এটা সত্যি আসলে ভাবেনি ! তাই কিছু না বলে শুধু শেষ প্রশ্নের উত্তরটাই দিলো নিজের মনে , ————— ” পরের সপ্তাহে বুধবার | কেন ?”
প্রিয়ম কথাটা শুনে এক কথায় বলে উঠলো এবার , ————- ” কারণ আমি যাবো তোমার সঙ্গে | তাই |”
হিয়া এই মুহূর্তে চোখটা বড়ো বড়ো করে বললো যেন আপনাআপনি , ———– ” না না | সেইসবের দরকার নেই | তুমি আমার ফ্যামিলি প্রব্লেমে জড়াবে কেন ! আর এমনিতেও আমার জন্য তোমাকে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে | ”
কথাটা শেষ হতেই প্রিয়ম এবার বেশ জোর দিয়ে বলে উঠলো , ——– ” কম্প্রোমাইজ এর এই বিয়েটা তো তুমি একা করোনি | আমিও তো করেছি , আমার বাবার টাকার জন্য | তাই এই নিয়ে শুধু নিজেকে ব্লেম করে লাভ নেই | আর তোমার মা বাবা মিথ্যে হলেও , আমাকে তো নিজের জামাই ভাবে | ছেলের মতন করে দেখে | তারা যতদিন না সত্যিটা জানছে , ততদিন তো পাশে থাকতেই পারি ! আর তোমার বাবার শরীরের যা অবস্থা শুনলাম , ওনার মেন্টাল পিস্ – টা এখন সবার আগে দরকার | তাই আমার সঙ্গে যাওয়াটা উচিত | অন্তত উনি এটা যখন দেখবেন যে তোমার আর আমার মধ্যে রিলেশন একদম ঠিকঠাক আছে , তখন মনের দিক থেকেও তো শান্তি পাবেন , তাই না ?”
না , এই কথাটার আর কোনো উত্তর দিতে পারেনি হিয়া সেই সময়ে | প্রিয়মের কথাগুলো তো সত্যি ! বাবা ওদের একসঙ্গে দেখলে শরীরের এতটা কষ্টের মধ্যেও কিছুটা শান্তি পাবে মনে | তাই প্রিয়মকে না বলতে পারলো না হিয়া | কিন্তু এতদিনের মধ্যে প্রথমবার মনে হলো ও প্রিয়মকে এতটা কাছ থেকে চিনছে | এতদিন একসঙ্গে থেকে শুধু ওকে দেখেছে , ওপর থেকে | ওর ভেতরের এই মানুষটাকে আজ প্রথমবার চিনলো ও |
যাইহোক , এরপর আর ওই অন্ধকার ছাদটায় দাঁড়ায়নি হিয়া একা একা | ফিরে এসেছিলো ঘরে প্রিয়মের সাথে | আর আজ প্রথম এই ঘরে ও শান্তিতে ঘুমিয়েছিলো নিজে | আসলে ওই কারোর ভুল বুঝে থাকার পাথরটা সরে গেছিলো মন থেকে | কারোর চোখে ছোট হয়ে থাকার কষ্টটা আজ আর ছিল না হিয়ার | সেই জন্য হয়তো ঘুমটা শান্তিতে হয়েছিল খুব |