#হৃদয়_মাঝে ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>
এইসবের পর কটা দিন কিরকম মন খারাপের ঘোরের মধ্যে কেটে গেলো প্রিয়মের | ওর খারাপ লাগাটা আসলে নিজেকে নিয়ে ছিল এখন | নিজের ওপর রাগ হচ্ছিলো ভীষণ মাঝে মাঝে | এতটা বোকা , এতটা টেকেন ফর গ্র্যান্টেড করে দিলো ও নিজেকে অরুণিমার কাছে ! কি করে এই ভুলটা করলো ও ! অন্ধের মতন ভালোবাসলো মেয়েটাকে ! আর ইউজড হলো দিনের পর দিন ! আসলে এই মাঝের কদিনে ও ব্যাংক স্টেটমেন্টগুলো মিলিয়ে একটা হিসাব বার করেছে , অরুনিমা এই লাস্ট দু বছরে ওর থেকে টোটাল পয়ঁত্রিশ লাখের মতন টাকা নিয়েছে , যেটা ফেরত দেব বলেও দেয়নি কখনো ! ওর ডিজাইনার ড্রেস , জুয়েলারি , ফ্ল্যাট এর ই.এম.আই , গাড়ির ডাউন পেমেন্ট , সবের টাকা নিয়েছিল তো প্রিয়মের কাছ থেকেই | আর প্রিয়মও কিছু না ভেবে বিশ্বাস করে দিয়ে গেছিলো টাকা যতটা সম্ভব ওর পক্ষে | এতদিন এতো বিজনেস করেছে ও ! এতো এতো ক্লাইন্টস হ্যান্ডেল করেছে কোম্পানির ! ওর জয়েনিং এর পর প্রফিট মার্জিন ও বেড়েছে এই ব্যবসার | কিন্ত সেই ও ই এতটা ঠগলো একটা মেয়ের কাছে ! এমনই ভালোবাসলো যে সত্যিটা দেখতেই পেলো না এই দু বছরে ! অরুনিমা জাস্ট ওকে ভালো ভালো কথায় ভুলিয়ে দিনের পর দিন নিজের কেরিয়ার , আর লাইফস্টাইলের জন্য ইউজ করে গেলো , আর প্রিয়মও হাসি মুখে ইউজড হলো ! কথাগুলো আজকাল দিনরাত মনে হয় ওর | কিরকম দম বন্ধ হয়ে আসে চারিদিকটা তারপর | খেতে বসলেও ঠিকভাবে খেতে ইচ্ছা করে না , ঘুম আসলেও সেটা শান্তির হয় না | সকালে ঘুম ভাঙলেই চারিদিকটা ফাঁকা লাগে ভীষণ ! মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট সব সময় যেন জমাট বেঁধে থাকে দিনরাত | মনে হয় মাঝে মাঝে এই আগের দু বছরটা যদি কোনোভাবে জীবন থেকে মুছে দিতে পারতো ! কোনোভাবে একটা ডিলিট বটন প্রেস করে দিয়ে সবটা শেষ করে দিতে পারতো ! তাহলে হয়তো শান্তি পেতো খুব | তবে এর মাঝে অরুনিমা ওকে কল করেছে অনেকবার | মেসেজ করে বোঝাতে চেয়েছে অনেক কথা | কিন্তু এইবার প্রিয়ম আর সেইসবের কোনো উত্তর দেয়নি ওকে | কল রিসিভ করেনি একবারও | হ্যাঁ , ভালোবেসেছিলো ও মেয়েটাকে ভীষণ এটা সত্যি | কিন্তু তার মানে ও স্বস্তা , খুব সহজ ওকে পাওয়া , এটা ভুল | প্রিয়ম যদি একবার মনে করে সরে আসবে , তাহলে ওকে আর কেউ আটকে রাখতে পারে না সেই জায়গায় | সেইদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই ও চুপচাপ বসেছিল একাকী ছাদটায় | আগে অফিস থেকে এসে ড্রইং রুমে দাদা বৌদির সাথে আড্ডা দিতো প্রিয়ম | কখনো বাবার ঘরে গিয়ে দরকারি অদরকারি কথা বলতো | কিন্তু আজকাল আর এইসব ভালো লাগে না | প্রয়োজনের বেশি একটা শব্দও খরচ করতে ইচ্ছে করে না ঠিক | নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে মন চায় সারাক্ষণ | তাই এসে বসেছিল ছাদে , অন্ধকারের মাঝে | তখনই হিয়া হাজির | একলা সন্ধ্যের ভিড়ে হঠাৎ কিছু প্রশ্ন নিয়ে |
হিয়া সেদিন এসে প্রিয়মের পাশে বসেছিল নিঃস্তব্ধে | প্রিয়ম ওকে খেয়াল করে যেন একটু ইতঃস্তত হয়েছিল | আসলে ও ঠিক এই সময়ে কারোর সঙ্গে কথা বলতে চায় না | কিন্তু হিয়া এটা বুঝলেও আজ ওকে একা ছাড়েনি | উল্টে প্রশ্ন করে উঠেছিল নিজে , ———– ” কি হয়েছে তোমার ? অরুণিমার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে ঝামেলা চলছে ?”
প্রিয়ম এই প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হয়েই তাকিয়েছিলো হিয়ার দিকে | তারপর আপনাআপনিই বলে উঠেছিল , ———– ” তুমি কি করে !”
হিয়া কথাটাকে কমপ্লিট করে আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিলো ওর , ——– ” বুঝলাম ! তাই তো ? আসলে আমারও তো একটা সময়ে এইসব হতো ! ভালোবাসলে এই রাগ , খারাপ লাগা এইগুলো খুব স্বাভাবিক | তখন মনে হয় কেন আছি এই মানুষটার জন্য ! কি পেলাম থেকে ! কিন্তু তারপর কিছুদিনের মধ্যে যখন সব ঠিক হয়ে যায় , তখন এই মন খারাপটাও কেটে যায় |”
কথাগুলো শুনে প্রিয়ম অন্ধকার মুখেই বলে উঠেছিল , ————- ” সব সময় এতটা সহজে হয় না কিছু ঠিক | ভুলটাই তখন জীবনে থেকে যায় | কিন্তু তুমি কেন বললে একটা সময় তোমার সঙ্গে এইসব হতো ? তোমার কোনো রিলেশন ছিল আগে ?”
প্রশ্নটা শুনে হিয়া একটু থমকে গেলো এবার | তারপর কিছু কথা ভেবে বললো , ————- ” কিছু না | এমনি বললাম | ”
প্রিয়ম এবার খেয়াল করলো হিয়ার আলতো হাসিটা মিলিয়ে গেছে কোথাও ! তাই নিজেই বলে উঠলো , ———— ” বুঝেছি | চিট করেছে তাই তো ? নিশ্চই তোমার বাবার শরীর খারাপ শুনে ক্রাইসিসের টাইমে কেটে পড়েছিল ! না কি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলো তোমাকে ছেড়ে ? আসলে এটাই নর্মাল | ভালোবাসা ব্যাপারটা তো আর কোথাও এগজিস্টই করে না ! সবটাই মিথ্যে হয় প্রথম থেকে |”
হিয়া কথাগুলো শুনে হঠাৎ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে গেছিলো নিজে | না চাইতেও চোখে সেই পুরোনো জলটা এসে ভিড় করেছিল কেমন | আর ওই আবছা চোখে অনেকদিন আগের সেই ছেলেটা ছবি হয়ে এসেছিলো সামনে | হালকা দাঁড়ি , ফর্সা মুখ , আর গভীর দুটো চোখের সেই ছেলেটা ! আকাশ | কিন্তু এই সময়ে প্রিয়ম ওর চোখে জল দেখে বুঝতে পেরেছিলো এমন কিছু হয়তো বলেছে , যেটা বলা উচিত হয়নি | তাই নিজেই বলে উঠেছিল আবার , ————- ” আই এম সরি হিয়া .. প্লিজ তুমি হার্ট হয়ো না | আমি তোমাকে কষ্ট দেব বলে কিছু বলিনি !”
হিয়া ওর কথাগুলো শুনে এরপর নিজেকে কিছুটা সামলে চোখটা মুছে বলেছিলো আস্তে গলায় , ————- ” আমি হার্ট হইনি | এমনি মনে পরে গেলো একজনকে ! ওর নাম আকাশ ছিল | আমাদের কখনো ব্রেক আপ হয়নি | ও আমাকে কোনোদিন ঠকায়নি ! যতদিন ছিল , শুধু ভালোবেসেছে | সব সময় সঙ্গে থেকেছে | ”
প্রিয়ম এই মুহূর্তে হিয়ার কথাগুলো ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিল , ———— ” মানে ? তাহলে এখন কোথায় ছেলেটা ! ”
হিয়া এই কথাটার উত্তরে আরেকবার থমকে গিয়ে বললো , ————- ” আর বেঁচে নেই | তিন বছর আগে মারা গেছে , একটা একসিডেন্টে | ”
কথাটা শুনে এবার প্রিয়মও থমকে গেলো ! ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না এখন ! তবে হিয়া আস্তে গলায় বলেছিলো নিজে নিজে , অনেক পুরোনো কথা | যেগুলো হয়তো এর আগে কাউকে বলা হয়নি কখনো ! ও যেন কিরকম নিজের মনেই বলেছিলো , ————— ” আমার তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার ছিল | ও আমাদের কলেজের সিনিয়র ছিল , থার্ড ইয়ার | প্রথমবার দেখেই কেন জানি না , অন্য রকম লেগেছিলো সবার থেকে ! আসলে সবার খুব হেল্প করতো আকাশ , নিজে থেকে | কলেজে কারোর পরীক্ষার ফিজ জমা না দিতে পারলে , সেই টাকা জোগাড় করে দেয়া , তো নিজের পুরোনো বইগুলো কোনো নিডি স্টুডেন্টকে দিয়ে দেয়া , হাসি মুখে করতো এইসব | আমাকেও তো , কত নোটস দিয়ে হেল্প করেছে পরীক্ষায় ! কিছু পড়া বুঝতে অসুবিধা হলেই আলাদা করে নিয়ে বসতো | ইউনিভার্সিটিতে ড়্যাঙ্ক ছিল ওর | আজ বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক বড়ো চাকরি করতো কোথাও ! সব কিছূই ঠিক চলছিল আমাদের , শুধু যদি আমার ওই একটা কথা শুনতো সেদিন ! ওই একটা কথা !”
কিরকম যেন ঘোরের মধ্যেই কথাগুলো বলে গেলো হিয়া | তারপর একটু থামলো নিজের মনে | প্রিয়ম এবার ওর ওই ঘোরের মাঝেই জিজ্ঞেস করে উঠলো ,
———— ” কি বারণ শোনেনি ও তোমার ? কি হয়েছিল ?”
হিয়া প্রশ্নটা শুনে আবার যেন সম্ভিত ফিরে পেলো নিজের | তারপর ওই থমকে থাকা গলায়ই বলে উঠলো ,
————- ” আকাশের সব ভালো ছিল | শুধু একটা জিনিস ছাড়া | ওর এডভেঞ্চার খুঁজে বেড়ানোর একটা নেশা কাজ করতো সারাক্ষণ ! বলতো জীবনে এমন কিছূ করতে চায় , যেই এক্সপিরিয়েন্সগুলো সারা জীবন মনে রাখতে পারবে ! পাহাড় ভালোবাসতো খুব | আর খুব ভালো ফটোগ্রাফার ছিল ! অনেক একজিবিশন নিজের তোলা ছবি পাঠাতো | তাই মাঝে মাঝেই পাহাড়ে চলে যেত | ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্যারাগ্লাইডিং , রিভার রাফটিং এইসব করতো প্রত্যেকবার | আমি বারণ করতাম | ভয় লাগতো আমার খুব | বলতাম ওকে , জীবনটা অনেক দামি | সেটা নিয়ে এইভাবে খেলা ঠিক না ! কিন্তু আকাশ শুধু এই একটা ব্যাপারে আমার কথা শুনতো না কখনো ! সেইবারও অনেকবার বারণ করেছিলাম ফোন এ | বর্ষার শুরু ছিল সেই সময়ে | জুন মাসের ফার্স্ট উইক | একটা ফটো একজিবিশন ছিল সামনেই | তাই গেছিলো সিকিম ও | ফেরার পথে তিস্তায় রিভার রাফটিং করবে বলে একদিন বেশি ছিল সিকিমে সেইবার | আমি সেদিন সকালেও আকাশকে ফোন এ অনেকবার বারণ করেছিলাম ! বলেছিলাম দরকার নেই এইবার রিভার রাফটিং করার | কিন্তু শুনলো না ও | চলে গেলো | বললো ‘কিছূ হবে না’ | আসলে আকাশ একটা কথা বুঝতো না কখনো , ওর জীবনটা শুধু ওর একার ছিল না ! আমারও ছিল | ”
কথাগুলো যেন খুব ক্লান্ত গলায় বলেছিলো হিয়া | প্রিয়ম কিরকম নিস্পলকভাবে শুনছিলো সব কিছূ | তারপর নিজের মনেই বলে উঠেছিল ও ,
———– ” তারপর ? কি হয়েছিল আকাশের ?”
হিয়া প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে কেমন থমকে থাকা গলায় উত্তর দিয়েছিলো প্রিয়মকে ,
——— ” ও খুব ভালো সাঁতার জানতো | কিন্তু ওই স্রোতের মধ্যে হঠাৎ পরে গিয়ে কিছূ করতে পারেনি আর ! লাইফ জ্যাকেট ছিল | কিন্তু স্রোতটা এমনভাবে টেনে নিয়ে গেলো ! আমি সেদিন সারাদিন ধরে ফোন করেছিলাম আকাশকে | কিন্তু সুইচ অফ বললো প্রত্যেকবার | তারপরের দিন সকালে নিউপেপার দেখে জানতে পেরেছিলাম খবরটা ! ব্যাস , ওই শেষ | তারপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমাদের | আর কোনোদিন হবেও না !”
কথাগুলো বলে হঠাৎ হিয়া কেঁদে ফেলেছিলো কেমন সেই মুহূর্তে | অনেকদিনের পুরোনো কান্না এসে যেন জড়ো হয়েছিল ওর গলায় | যেই সময়ের কথা কেউ জানে না , যেই পুরোনো সম্পর্কটার কথা কাউকে কখনো বলেনি হিয়া ! সেই হারানো মানুষটার জন্য এতদিনের জমে থাকা যন্ত্রনাটা কেমন যেন বেহিসেবিভাবে হঠাৎ এসে ভিড় করেছিল চোখে , আর হিয়া ভেঙে পড়েছিল একদম | পুরোনো সময়ের মাঝে একেবারে একা হয়ে ভেঙে পড়েছিল ও কান্নায় | কিন্তু তখনই ও যেন একটা নতুন স্পর্শ খুঁজে পেলো ওই যন্ত্রণার মাঝে ! প্রিয়ম হঠাৎ খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ওকে এখন এই নিঃস্তব্ধ ছাদটায় | কিছূ না বলে কেমন যেন হিয়াকে নিজের কাছে আগলে নিলো ও | কোনো স্বান্তনা না দিয়ে , কোনো শব্দ না বলে , চুপচাপ ওকে বুঝিয়ে দিতে চাইলো যেন , যে আর কেউ না থাক , প্রিয়ম আছে | আর ও থাকবে |
এই সময়ে খুব খারাপ লাগছিলো আসলে ওর | হিয়ার কষ্টটা যেন ভেতর থেকে প্রিয়মকেও কিরকম নাড়িয়ে দিয়েছিলো ! হঠাৎ প্রিয়ম বুঝেছিলো , কাউকে ছেড়ে দেয়া , আর কারোর ছেড়ে চলে যাওয়া, এইভাবে কোনো কারণ ছাড়াই , এই দুটো কষ্ট একদম আলাদা | প্রথমটায় খারাপ লাগা থাকে , আর দ্বিতীয়টায় যন্ত্রণা থাকে ! একটা দম বন্ধ করে দেয়া যন্ত্রণা | আর হিয়া এই যন্ত্রনাটা অনেকদিন ধরে একা একা নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে | ওর থেকে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা ভালোবেসে | অন্য ধরণের কষ্ট ! কাউকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট !
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই নিঃস্তব্ধ ছাদে কেটেছিল ওদের বেশ কিছুক্ষণ | তারপর হিয়া নিজেকে সামলে চোখের জল মুছে আস্তে গলায় বলেছিলো প্রিয়মকে ,
———- ” আমার গল্পটা তো শেষ | কিন্তু তোমারটা তো সেরকম না ! তাই যদি কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে থাকে , সেটাকে মিটিয়ে নাও | অরুণিমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রেখো না |”
কথাটা শুনে প্রিয়ম এবার কয়েক মুহূর্তে সময় নিয়ে বলেছিলো কিছুটা দৃঢ় গলায় ,
———– ” মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি আমার | বরং এতদিনে ওকে ঠিক বুঝেছি আমি | সেদিন অরুণিমার ওর ফ্ল্যাটে অন্য একটা লোকের সঙ্গে ফিজিক্যালি ইনভল্ব ছিল | আমি হঠাৎ ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে সবটা দেখতে পেয়েছিলাম | আর তারপর অরুনিমাও সবটা স্বীকার করেছে ! ও কাজের জন্য ওই বিজনেসম্যানটার সাথে কম্প্রোমাইজ করছিলো , ফিজিক্যালি | আর এতে ওর কোনো আফসোস নেই |আর সেই রাতে আমার সবটা জেনে আর বাড়ি ফেরার মন ছিল না ঠিক | দু বছরের রিলেশন ছিল আমাদের ! মনে হচ্ছিলো এই কলকাতা শহরের কোনো রাস্তায় যদি আমি হারিয়ে যাই তখন , তাহলে হয়তো এইভাবে ঠকে যাওয়ার কষ্টটা থেকে মুক্তি পাবো !”
কথাগুলো শুনে হিয়াও হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়েছিলো প্রথমে | ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না | ও আসলে ভাবতে পারেনি কারণটা এতটা ভয়ঙ্কর হবে প্রিয়মের ! আসলে ভেবেছিলো হয়তো ছোটোখাটো কোনো ঝগড়া হয়েছে অরুণিমার সাথে ! তাই এ-কদিন চুপ করেছিল প্রিয়ম ! কিন্তু কারণটা যে এইরকম এটা বোঝেনি ! তাও এই মুহূর্তে কিছূ কথা সাজিয়ে ও বলে উঠলো ,
————- ” আমি ভাবতে পারছি যে কেউ এরকম কিছূ করতে পারে ! অরুনিমা সত্যি খুব বড়ো ভুল করেছে | আর তোমার বেশি খারাপ লাগছে এটা ভেবে , যে ওর সেই ভুলটার জন্য কোনো রিগ্রেট , কোনো রিয়ালাইজেশন নেই ! তবে এটা ও একদিন ঠিক বুঝবে | একজন সত্যিকারের মানুষকে হারিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকতে পারে না ! সেদিন অরুনিমা আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে | মন থেকে সরি বলবে তোমাকে | আবার তোমার সঙ্গে থাকতে চাইবে |”
যন্ত্রণা থাকে ! একটা দম বন্ধ করে দেয়া যন্ত্রণা | আর হিয়া এই যন্ত্রনাটা অনেকদিন ধরে একা একা নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে | ওর থেকে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা ভালোবেসে | অন্য ধরণের কষ্ট ! কাউকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট !
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই নিঃস্তব্ধ ছাদে কেটেছিল ওদের বেশ কিছুক্ষণ | তারপর হিয়া নিজেকে সামলে চোখের জল মুছে আস্তে গলায় বলেছিলো প্রিয়মকে ,
———- ” আমার গল্পটা তো শেষ | কিন্তু তোমারটা তো সেরকম না ! তাই যদি কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে থাকে , সেটাকে মিটিয়ে নাও | অরুণিমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রেখো না |”
কথাটা শুনে প্রিয়ম এবার কয়েক মুহূর্তে সময় নিয়ে বলেছিলো কিছুটা দৃঢ় গলায় ,
———– ” মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি আমার | বরং এতদিনে ওকে ঠিক বুঝেছি আমি | সেদিন অরুণিমার ওর ফ্ল্যাটে অন্য একটা লোকের সঙ্গে ফিজিক্যালি ইনভল্ব ছিল | আমি হঠাৎ ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে সবটা দেখতে পেয়েছিলাম | আর তারপর অরুনিমাও সবটা স্বীকার করেছে ! ও কাজের জন্য ওই বিজনেসম্যানটার সাথে কম্প্রোমাইজ করছিলো , ফিজিক্যালি | আর এতে ওর কোনো আফসোস নেই |আর সেই রাতে আমার সবটা জেনে আর বাড়ি ফেরার মন ছিল না ঠিক | দু বছরের রিলেশন ছিল আমাদের ! মনে হচ্ছিলো এই কলকাতা শহরের কোনো রাস্তায় যদি আমি হারিয়ে যাই তখন , তাহলে হয়তো এইভাবে ঠকে যাওয়ার কষ্টটা থেকে মুক্তি পাবো !”
কথাগুলো শুনে হিয়াও হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়েছিলো প্রথমে | ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না | ও আসলে ভাবতে পারেনি কারণটা এতটা ভয়ঙ্কর হবে প্রিয়মের ! আসলে ভেবেছিলো হয়তো ছোটোখাটো কোনো ঝগড়া হয়েছে অরুণিমার সাথে ! তাই এ-কদিন চুপ করেছিল প্রিয়ম ! কিন্তু কারণটা যে এইরকম এটা বোঝেনি ! তাও এই মুহূর্তে কিছূ কথা সাজিয়ে ও বলে উঠলো ,
————- ” আমি ভাবতে পারছি যে কেউ এরকম কিছূ করতে পারে ! অরুনিমা সত্যি খুব বড়ো ভুল করেছে | আর তোমার বেশি খারাপ লাগছে এটা ভেবে , যে ওর সেই ভুলটার জন্য কোনো রিগ্রেট , কোনো রিয়ালাইজেশন নেই ! তবে এটা ও একদিন ঠিক বুঝবে | একজন সত্যিকারের মানুষকে হারিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকতে পারে না ! সেদিন অরুনিমা আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে | মন থেকে সরি বলবে তোমাকে | আবার তোমার সঙ্গে থাকতে চাইবে |”
প্রিয়ম কথাগুলো শুনে এবার আলতো হেসে ফেললো নিজের মনে যেন | তারপর দৃঢ় গলায় বললো ওকে ,
————- ” কিন্তু ও ফিরলেই যে আমি ফিরিয়ে নেবো , এটার তো কোনো মানে নেই ! আমি কিছূ শেষ করলে , সেটা সারা জীবনের হয় | যাইহোক , ছাড়ো , বাদ দাও অরুণিমার কথা | তুমি ডিনার করবে না ? অনেক রাত হয়েছে | আজকে আমরা একসাথে খাবো | চলো |”
কথাটা বলেই ও উঠে দাঁড়ালো এবার | তারপর হিয়ার হাতটা ধরে বেড়িয়ে এলো এখন , ওই নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা অন্ধকার ছাদটা থেকে | হয়তো একটা নতুন বন্ধুত্বের শুরু নিয়ে !
<১১>
সেই রাতের পর থেকে প্রিয়মের মনের খারাপ লাগাটা আস্তে আস্তে হালকা হতে শুরু করেছে | এখন ও হিয়ার বাবার শরীরটা নিয়ে বেশি চিন্তায় থাকে | ও হিয়াকে না বলে এর মধ্যে কিডনির ডোনারের খোঁজ করতে শুরু করে দিয়েছে ! হাতে তো বেশি সময় নেই ! কখন কি হয়ে যায় ! প্রিয়ম তবে সবটা দিয়েই চেষ্টা করছে , কোনোভাবে যদি মানুষটাকে বাঁচানো যায় ! আর হয়তো কেউ মন থেকে কিছু চাইলে ঈশ্বরও আড়ালে বসে শোনে তার কথা , আর সেই জন্যই অবশেষে একদিন ডক্টর চ্যাটার্জির ফোনটা চলে এলো প্রিয়মের কাছে | ডোনার জোগাড় হয়ে গেছে | তবে সে নিজের কিডনিটা বিক্রি করছে ! সাত লাখ টাকা ডিম্যান্ড করেছে | প্রিয়ম কথাটা শুনে এক কথায়ই রাজি হয়ে গেলো লোকটাকে টাকা দিতে ! যাক , কিছু টাকা দিয়ে যদি একজনের প্রাণ বাঁচে , তাহলে আর কোনো হিসাবের জায়গা থাকে না সেখানে | সেদিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রাতে হিয়ার কাছে এসে প্রিয়ম বলেছিলো কথাটা | ও আলতো হাসি নিয়ে হিয়াকে বলেছিলো ,
———– ” একটা ভালো খবর আছে | আমি ডোনারের খোঁজ করছিলাম তোমার বাবার জন্য এতদিন ! আজ ডক্টর ফোন করে বললো একজনকে পাওয়া গেছে | আমার মনে হয় এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে | জানি , কাকুর শরীর এখন খুবই উইক , কিন্তু একটু চান্স তো আমাদের নিতেই হবে ! একজনকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখাটাও তো ঠিক না !”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিলো প্রিয়ম | কিন্তু এরপর খেয়াল করেছিল হিয়ার মুখে কোনো আসার আলো নেই ! উল্টে এক রাশ চিন্তা নিয়েই অন্য কথা জিজ্ঞেস করে উঠলো ও ,
————– ” ডোনার কত টাকা চেয়েছে ? আর এই পুরো অপারেশনের জন্য কত খরচ পড়বে বলেছে ডক্টর ?”
কথাটা শুনে প্রিয়ম এবার আস্তে গলায় উত্তর দিয়েছিলো , ———- ” ডোনার সাত লাখ চেয়েছে | আর অপারেশন আর বাকি এক্সপেনসেস নিয়ে দেড় লাখ মতন হয়তো হবে আলাদা | ”
কথাটা শুনে হিয়া থমকে গেছিলো | তারপর নিজের মনেই বলে উঠেছিল , ———— ” এই জন্য আমরা কখনো ডোনার খুঁজিনি | এতো টাকা নেই আমাদের কাছে প্রিয়ম খরচ করার মতন | সম্ভব না এখনই এতগুলো টাকা জোগাড় করা ! আর বাবা যা জমিয়েছিল সেটা তো তিন বার ড্যায়লিসিস , আর বাকি ট্রিটমেন্টেই প্রায় শেষ | এরপর এই অপেরেশনটা করানো আমাদের পক্ষে সত্যি সম্ভব না ! সরি | আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা করে এই ডোনারের ব্যবস্থা করেছিলে ! কিন্তু আমাকে টাকার ব্যাপারটা আগে জানালে আমি নিজেই না বলে দিতাম তোমাকে | রিয়ালি সরি..”
কথাগুলো শুনে প্রিয়ম এই মুহূর্তে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলো | এতো ভালো একটা খবর শুনেও লোকে টাকার কথা ভাবে ! প্রিয়ম কথাটা ভেবেই বেশ জোর দিয়ে বলেছিল
————– ” হিয়া , আমি তো আছি | আমি টাকাটা দিয়ে দিচ্ছি এখন | তুমি টাকার জন্য এতো বড়ো একটা ডিসিশন নিও না ! পরে না হয় ধীরে ধীরে মিটিয়ে দেবে | আগে তো তোমার বাবার শরীর |”
কথাটায় হিয়া এবার সঙ্গে সঙ্গেই না বলেছিল প্রিয়মকে | ও ক্লান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলো , ———– ” এটা হয় না প্রিয়ম | এইভাবে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি বাবার ট্রিটমেন্ট করতে পারবো না ! আর এতো টাকা সত্যি হয়তো সারা জীবনেও আমরা শোধ দিতে পারবো না ! আমি জানি , তুমি আমার বাবার ভালোর কথা ভেবেই বলছো | কিন্তু বাবা নিজেও এইভাবে কারোর থেকে টাকা নিয়ে নিজের অপারেশন করাবে না | আমি চিনি বাবাকে |”
হিয়ার কথাগুলো শুনে প্রিয়ম এবার কিছুক্ষণের সময় নিয়েছিল মনে মনে | তারপর হঠাৎ টপিকের বাইরে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠেছিল হিয়াকে ,
———— ” তোমার সাবজেক্ট কি ছিল কলেজে ? তুমি কমার্স নিয়ে পড়েছো না ? মাস্টার্স , তাই তো ? বাবা বলেছিল একবার |”
হিয়া এই সময়ে এই কথাবার্তার মধ্যে ঠিক এই প্রশ্নটার কোনো মানে খুঁজে পেলো না যেন ! তাও এক কোথায় উত্তর দিলো ,
————— ” হ্যাঁ , এম.কম.. কিন্তু এখন এইসব বলছো কেন ?”
প্রশ্নটা করে হিয়া দেখলো প্রিয়মের মুখে আলতো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে | ও এবার একটু দৃঢ় গলায়ই বললো ,
—————- ” প্রব্লেম সল্ভড .. আমাদের দুজনেরই | আমি কদিন ধরে নতুন পি.এ খুঁজছিলাম আমার একজন | যে একটু একাউন্টসটাও হ্যান্ডেল করছে | পেয়ে গেলাম তোমাকে | আর তুমি আমাদের অফিসে চাকরি করে যেই স্যালারিটা পাবে , সেটা দিয়েই আমার টাকাটা শোধ করে দেবে | ব্যাস , মিটে গেলো সমস্যা |”
কথাটা প্রিয়ম এতটা সহজভাবে বললো যে হিয়াও অবাক হয়ে গেলো যেন এখন ! তারপর গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো ,
————– ” সিরিয়াসলি ! মানে আমি তোমার অফিস থেকে টাকা নিয়ে তোমাকেই ফেরত দেব ? এটা কখনো সম্ভব ! এইভাবে হয় না |”
প্রিয়ম হিয়ার কথা শুনে এবার আরো জোর দিয়ে বলে উঠলো ,
————– ” কেন হয় না ? তুমি তো ফ্রি তে টাকা নিচ্ছ না আমাদের কোম্পানি থেকে ! তুমি কাজ করে টাকাটা রোজগার করছো | আর কোনো বাইরের কাউকে নিলেও তো আমাকে তাকে একটা স্যালারি দিতেই হতো | দেন হোয়াই নট ইউ ! আর তুমি তো এই জবটার জন্য পারফেক্টলি কোয়ালিফাইড | আমি তো কোনো কম্প্রোমাইজ করছি না কাজে ! হিয়া , তোমার বাবার জীবনটা সব থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট এখন | তার ওপরে আর কিছু নেই | আর একবার সময় চলে গেলে , তারপর আর হাজার ভেবেও তুমি কিছু ঠিক করতে পারবে না ! তোমার বাবার অপারেশনটার এখন সব থেকে বেশি দরকার | কিছু টাকার জন্য এটাকে এইভাবে ফেলে রেখো না ! অনেক কষ্টে একটা ডোনার পাওয়া গেছে | প্লিজ , আই রিকোয়েস্ট…”
হিয়া প্রিয়মের এতগুলো কথা শোনার পর আর ঠিক কোনো কথা বলে উঠতে পারেনি ওকে ! যেই মানুষটা এইভাবে , এতটা মন থেকে ওর বাবার জন্য ভাবছে , তাকে কি করে না বলবে মুখের ওপর ! তাকে এইভাবে না বলে অপমান করতে পারবে না ও ! তাই চাকরিটা করার জন্য রাজি হতেই হলো | তবে ওর এই একটা হ্যাঁ শুনে প্রিয়মের মুখে যেই হাসিটা দেখেছিলো হিয়া , সেটা দেখে কিরকম নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো নিজে ও হঠাৎ ! কেউ এতটা অন্যের জন্য ভাবতে পারে , এইভাবে অন্যের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে ! এটা দেখে নিজের মনেই একটা ভালো লাগার রেশ তৈরী হলো আজ আনমনে প্রিয়মের জন্য | আসলে ও কোনোদিন এই ছেলেটার কাছ থেকে এতো কিছু এক্সপেক্টই করেনি ! ভেবেছিলো ওদের বিয়েটা তো কিছুদিনের | যেখানে কোনো মনের টান , কোনো ভালো লাগা নেই | দুজনেই বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে | সেই হিসাবি সম্পর্কের মধ্যে যে কোনোদিন হিয়া এতটা ভালো বন্ধু খুঁজে পাবে হঠাৎ , সেটা আসলে ও ঠিক কল্পনা করেনি কখনো ! আর আজকের পর থেকে তো আস্তে আস্তে গল্পটাই বদলে যেতে থাকলো ওদের মাঝে ! হিয়া এখন প্রায় সারাদিন প্রিয়মের সঙ্গেই থাকে | সকালে অফিস , রাতে বাড়িতে | প্রিয়ম ওকে কখনো অফিসে একজন এমপ্লয়িয়ের মতন ট্রিট করেনি শুরু থেকেই ! ও নিজে লাঞ্চ বক্স নিয়ে এসেছিলো হিয়ার ডেস্ক এ , একসঙ্গে খাবে বলে | হিয়া তো বেশ ইতঃস্ততই হয়েছিল প্রথমদিকে | বাকি সব এমপ্লইয়ের মাঝে অফিসের বস একজন সাধারণ পি.এর সঙ্গে লাঞ্চ করছে ! কিন্তু প্রিয়মকে কিছুতেই যেতেও বলতে পারছিলো না ! তবে প্রিয়ম হয়তো ওর না বলা মনের কথাটা বুঝেছিলো সেইদিন | তাই নিজে থেকেই বলে উঠেছিল , ———— ” এতো ওকোয়ার্ড হওয়ার দরকার নেই | এই অফিসে সবাই জানে যে আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ .. বরং আমি যদি তোমার সাথে বেশি প্রফেশনালি বিহেভ করি এখন , তাহলে লোকজন আমাকে নিয়ে খারাপ ভাববে ! ভাববে লোকটা খুব খারাপ , বৌটাকে বাড়িতে অফিসে সারাক্ষণ শুধু খাটায়, কাজ করায় ! তাই রিল্যাক্স .. আমরা এরপর রোজই একসঙ্গে লাঞ্চ করবো এইভাবে |”
কথাটা শুনে হিয়া হেসে ফেলেছিলো অল্প | তবে আজ প্রথম প্রিয়মের মুখে এই হাজবেন্ড ওয়াইফ কথাটা শুনে যেন খুব অন্যরকম লেগেছিলো ওর ! আসলে কখনো এইভাবে তো নিজেদের ভেবে দেখেনি ! সত্যি তো , ও যে রোজ সিঁদুর পরে , হাতে শাখা পলা , সেগুলো তো সব এই ছেলেটার জন্যই ! সত্যিটা যাই হোক , লোকের চোখে তো ওরা স্বামী স্ত্রী-ই ! তবে আজ এই লোকের চোখ দিয়ে ভেবে দেখতে খারাপ লাগলো না যেন ! বরং হঠাৎ এই লোকের চোখকেই সত্যি ভাবতে ইচ্ছে করলো খুব , মন থেকে |
সেদিনের পর ওরা অফিসে রোজ একসঙ্গে যেত , আবার একসঙ্গে বাড়ি ফিরত | এর মধ্যে প্রিয়মের আবার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে | হিয়ার হাতের রান্না খাওয়ার অভ্যাস | কিছু একটা আলাদা আছে ওর হাতে, যার জন্য নরমাল ডাল তরকারিও কিরকম স্পেশ্যাল হয়ে যায় ! আগে তো চিকেন , ফিশ , এইসব ছাড়া কোনো সবজি ছুঁয়েও দেখতো না প্রিয়ম ! কিন্তু এই হিয়া আসার পরই বাঁধাকপি , ফুলকপি , মোচা , থোড় , ধোঁকা এইসব বাঙালি সবজি তরকারিগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে ওর | আর অবস্থা বর্তমানে এমন এসে দাঁড়িয়েছে যে রোজ হিয়াকে একটা না একটা কিছু রান্না করতেই হবে এই ছেলেটার জন্য ! নইলে প্রিয়ম হয়তো ডিনার লাঞ্চ না খেয়েই বসে থাকবে ! তবে শুধু রান্না না , হিয়া তো এখন বেশ কদিন হলো রোজ ওর জন্য নিজের পছন্দ মতন শার্ট বার করে প্রেস করে রেখে দেয় খাটে | এক একদিন এক একটা পছন্দ মতন কলর এর শার্ট বার করে প্রিয়মের জন্য | আর প্রিয়মও কিছু না বলে সেটা পরে অফিস চলে আসে নিজের মনে | তবে প্রিয়মও মাঝে মাঝে হিয়ার আলমারিতে উঁকি ঝুঁকি দেয় আজকাল | অফিসে ও কোন শাড়িটা পরে যাবে , সেটা মাঝে মাঝে ও আনমনে বলে দেয় হিয়াকে | কখনো যেমন বলে ওঠে , ———- ‘ তোমাকে লাল রংটা বেশ মানায় | ওই কালোটা না পরে লাল শাড়িটা পরো |’ , বা কখনো নিজেই আলমারি থেকে কোনো পছন্দের শাড়ি বার করে হিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় হঠাৎ , তারপর ভ্রুটাকে নাচিয়ে বলে , ——— ” এটা পরো , ভালো লাগবে |”
আর হিয়াও ওর কথাগুলো চুপচাপ শুনে নেয় এখন | এই মুহূর্তগুলোতে নিজেকে কেমন কারণ ছাড়াই খুব ভালো লাগতে শুরু করে ওর | নিজেকে সুন্দরী মনে হয় | মনে হয় প্রিয়মের চোখ দিয়ে ও নিজেকে দেখছে ! এইরকম মনে হওয়া অনেক বছর আগে ওর আকাশের জন্য হতো | তারপর আকাশ চলে যাওয়ার পর থেকে কোনোদিন কারোর জন্য আর এইভাবে আলাদা করে সাজতে ইচ্ছে করেনি হিয়ার ! কিন্তু আজকাল মনে হয় | প্রিয়মের জন্য মনে হয় | রোজ ওর এতো কাছে থাকতে থাকতে , ওকে এতটা গভীরভাবে চিনতে চিনতে , হিয়া হয়তো জরিয়ে পড়েছে ! প্রিয়মের সঙ্গে মন থেকে জরিয়ে পড়েছে | হয়তো ভালোবেসে ফেলেছে ছেলেটাকে ! মায়ায় আটকে গেছে ও | আর প্রিয়মও তো ওকে রোজ সেই জায়গাটা দিয়েছে , নিজের কাছে আসার ! ওর ওয়ালেট থেকে টাই , সবের ঠিকানা নিজে না জানলেও হিয়াকে জানিয়ে রেখেছে ঠিক | ওর রোজের ছোট বড়ো কথা , ওর পছন্দের সিনেমা , শহরে ওর মন খারাপের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জায়গাটা থেকে গঙ্গার ধার , কফিশপের কোনার ওই ছোট্ট টেবিল , কি না জানিয়েছে হিয়াকে ! রোজ একটু একটু করে দূরত্বটাকে শেষ করে কাছে এসেছে হিয়ার | বেহিসাবভাবে ওদের হিসাবি সম্পর্কের মধ্যে মুহূর্তদের এনেছে প্রিয়ম | তাই হিয়াও যেন কিরকম হারিয়ে গেছে এই সময়টার মধ্যে , মুহূর্তগুলোর মধ্যে | ভুলে গেছে ওদের সম্পর্ক শুরুর সত্যিটা | ভুলে গেছে বিয়েটা প্রয়োজনের ছিল ! বরং এখন মনে হয় এই বিয়েটাই হয়তো ওর জীবনের ডেসটিনি ছিল ! একটা রূপকথা অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য | তাই সেদিন অনিন্দজেঠু এই সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছিলো হঠাৎ ওদের বাড়িতে | সেই জন্যই হয়তো প্রিয়ম এসেছিলো ওর জীবনে ! হিয়াকে পুরোনো সময় ভুলিয়ে নতুন কিছু মুহূর্ত উপহার দেবে বলে |