হৃদয়_মাঝে ( ষষ্ঠ পর্ব ) #ঈপ্সিতা_মিত্র

0
398

#হৃদয়_মাঝে ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>

এই মুহূর্তগুলোর মাঝে অবশেষে হিয়ার বাবার অপারেশনের ডেটটাও এসে হাজির হলো ক্যালেন্ডারের পাতায় | হিয়ার মুখটা সেদিন সারাদিন ধরে অন্ধকার ছিল | মা কে দেখে কষ্ট হচ্ছিলো ভীষণ | বাবাকে এইভাবে ছুঁড়ি কাঁচির মাঝে স্যালাইন আর অক্সিজেনের সঙ্গে নিজের জীবনটাকে নিয়ে লড়তে দেখে মা যে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে , এটা হিয়া বুঝেছিলো মনে মনে | মায়ের ওই বিদ্ধস্ত চেহারা , ক্লান্ত শুকনো মুখটা দেখে হিয়াও কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছিলো ভেতরে | তার ওপরে ডাক্তার তো প্রথম থেকেই বলেছে , ওর বাবা এই অপারেশন এর ধকলটা নাও নিতে পারে ! শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ | 70 % সারভাইব করার চান্স আছে | হিয়ার কথাটা ভেবেই কিরকম বুকটা শুকিয়ে আসছিলো তাই | হাত পা কাজ করছিলো না | আর মার্ তো আবার সেই সকাল থেকেই চিন্তায় মাথা ঘুরছে | হসপিটালের চেয়ারে কিরকম চুপচাপ , এলোমেলো চিন্তা নিয়ে বসে আছে মা | হিয়া এই মুহূর্তে মা কে ছেড়ে ঠিক কোথাও যেতেও পারছে না | তবে এই খারাপ সময়ে একজন এতটা শক্তভাবে পাশে আছে বলেই বাবাকে ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না ওদের ! ব্লাড অরেঞ্জ করা থেকে ওষুধ ইনজেকশন কিনে আনা , নার্সিং হোমের বিল পেমেন্ট থেকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা , সবই প্রিয়ম করছে সকাল থেকে | এমনকি পাঁচদিন আগে বাবাকে ও নিজেই চন্দননগর থেকে নিয়ে এসে এডমিট করেছে কলকাতার এই নার্সিংহোমটায় | হিয়া আসলে অফিসের কিছু কাজে ব্যস্ত ছিল খুব | চন্দননগর যাওয়ার সময় করতে পারছিলো না সেইদিন | মা তাই বলেছিলো একাই বাবাকে নিয়ে আসবে কলকাতা | কিন্তু প্রিয়ম কথাটা শুনে আর দেরি করেনি | নিজেই বেড়িয়ে পড়েছিল চন্দননগর , ওদের আনতে | হিয়া এইসব দেখে ঠিক মেলাতে পারে না আগের দিনগুলোর সাথে ওকে | প্রথম বিয়ের সময় এই ছেলেটাই তো কতটা দূরে ছিল ওর ! ওর সঙ্গে কথা বলা তো অনেক বেশি কিছু , একসঙ্গে বসে খেত অব্দি না | হিয়ার তখন মনে হতো এর সঙ্গে এই দূরত্বটাই ঠিক | অকারণে কথা না হওয়াই ভালো | কিন্তু আজকাল , সব বদলে গেছে | এখন মনে হয় প্রিয়মকে কিছু না বললে , কোনো কথা শেয়ার না করলে , দিনটা হয়তো ইনকমপ্লিট রয়ে যাবে | আসলে প্রিয়ম এতটা বদলে গেছে হিয়ার জন্য যে ভালো না বেসে আর কোনো উপায় নেই | তবে ও জানে না প্রিয়মের মনে কি আছে ! প্রিয়ম হয়তো আজও মনে মনে অরুণিমাকেই চায় | আসলে ছেলেটা খুব ভালো | তাই হয়তো এইভাবে পাশে থাকে হিয়ার | ওর নেচারটাই হেল্পফুল | তাই হিয়ার ক্রাইসিসে ওকে একলা ছাড়ে না ! তবে মাঝে মাঝে আনমনে , অকারণে ওর এটাও মনে হয় , প্রিয়ম কি একটু হলেও ওর জন্য ফিল করে না ! ওর এতো কেয়ার , এতো চিন্তা , সবই কি শুধু স্বভাবের জন্য , না কি কিছুটা মনের টানেও ! হিয়ার আজও হঠাৎ আনমনে এই কথাটা মনে হলো | প্রিয়মকে হসপিটালের ফার্মাসিতে লম্বা লাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে | হিয়া কিন্তু নিজে যেতে চেয়েছিলো ওষুধ আনতে | তবে কথাটা শুনে প্রিয়ম ওকে আটকে দিয়েছিলো তখনই | নিজের মনেই বলে উঠেছিল ছেলেটা , ————- ” কাকিমার সঙ্গে থাকো তুমি | উনি একটু জোর পাবে মনে | আর এতটা লাইনে এইরকম টেনশন নিয়ে দাঁড়ানোর কোনো দরকার নেই এখন | আমি যাচ্ছি |”

কথাটা শুনে হিয়া কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল , ————– ” তুমি আর কত করবে ? একটু রেস্ট নাও | এই তো ব্লাড নিয়ে এলে ! আমি যাচ্ছি এখন , অসুবিধা নেই কোনো |”

হিয়ার কথাটার উত্তরে প্রিয়ম এবার একটু গম্ভীর মুখে অর্ডার দেয়ার মতন করে বলেছিলো , ————– ” হিয়া , বসো চুপচাপ | কোথাও যেতে হবে না এখন | ”

কথাটা শেষ করেই ও হাঁটতে শুরু করেছিল ফার্মেসির দিকে | হিয়া এরপর আর কিছু বলে উঠতে পারেনি প্রিয়মকে মুখের ওপর | তবে এই প্রথম কারোর বারণ শুনতে খারাপ লাগেনি হিয়ার ! সেদিন এরপর প্রায় দু ঘন্টা বাদে অপারেশন শেষ হয়ে হিয়ার বাবাকে আই.সি.ইউ তে দেয়া হয়েছিল | ডাক্তার বলেছিলো এখন কয়েক ঘন্টা কন্ডিশন ক্রিটিক্যালই থাকবে | রাতে বাড়ির কেউ একজন যেন থাকে ! হয়তো ব্লাডের দরকার লাগতে পারে আবার ! কথাগুলো শুনে হিয়ার মার্ মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেছিলো যেন | আসলে এতোক্ষণ ধরে এতটা টেনশনে ছিল ! এবার মনের সঙ্গে শরীরও আর ধকলটা নিতে পারছে না তাই | প্রিয়ম ওর মায়ের অবস্থা দেখে হিয়াকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজেই বলে উঠেছিল এরপর , ———- ” তুমি কাকিমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও এখন | একটু চেঞ্জ দরকার ওনার | নইলে অসুস্থ হয়ে পরবে | আমি রাতে থাকছি |”

কথাটা শুনে হিয়া একটু চিন্তা নিয়েই বলেছিলো , ———– ” তুমি সারাদিনে একবারও বাড়ি যাওনি | আর তারপর অসুধ আনা , ব্লাড এরেঞ্জ সব তো করলে | তোমারও তো একটু রেস্টের দরকার | আমি এখানে রাতে থাকছি | তুমি মা কে নিয়ে বাড়ি চলে যাও | কাল এস |”

কথাটার উত্তরে প্রিয়ম এবার জোর দিয়েই হিয়াকে বুঝিয়েছিল ,———- ” এটা হয় না | কাকিমার এখন সব থেকে বেশি তোমার সঙ্গে থাকাটা ইম্পরট্যান্ট | ওনার মনের অবস্থা ভালো নেই | আর যতক্ষণ না তোমার বাবাকে ডাক্তার আউট অফ ডেঞ্জার বলছে ততক্ষণ উনি ঠিক হবেন না ভেতরে ভেতরে | এই সময়ে তুমি কাকিমাকে খাওয়াতে পারবে | বোঝাতে পারবে একটু ঘুমোনোর জন্য | আমি সেটা করতে পারবো না | তাই বলছি , প্লিজ , তুমি কাকিমাকে নিয়ে বাড়ি যাও | আমি আছি এখানে , কোনো অসুবিধা নেই |”

কথাগুলোর মধ্যে এতটা আন্তরিকতা ছিল প্রিয়মের যে হিয়া আর কোনো প্রত্যুত্তর করতে পারেনি | তবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো ওর দিকে নিশ্চুপভাবে | হঠাৎ মনে হচ্ছিলো কোথায় ছিল এই ছেলেটা আগে ! কেন এতটা দেরি করে এলো ওর জীবনে ! কেন আর কিছুটা সময় আগে থেকে পেলো না হিয়া প্ৰিয়মকে !

সেদিন নার্সিংহোম থেকে বেড়িয়ে মা কে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হিয়ার মনে অদ্ভুত একটা শান্তি ছিল যেন | মনে হচ্ছিলো যা খারাপ হওয়ার , সেটা হয়ে গেছে | এরপর সব ঠিক হওয়ার সময় শুরু হয়েছে ওদের | বাবারও আর এরপর কিছু হবে না | সুস্থ হয়ে যাবে | কারণ প্রিয়ম আছে ওদের জীবনে | অদ্ভুত একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে | যাকে পেড়িয়ে আর কোনো কষ্ট , কোনো খারাপ লাগা আসতে পারবে না ওদের কাছে | সেদিন গাড়িতে বসে কথাটা ভাবতে ভাবতেই চলন্ত শহরের রাস্তাগুলো দেখতে দেখতে আনমনে কয়েক ফোঁটা জল এসে জড়ো হয়েছিল ওর চোখে , আর সেই আবছা চোখে প্রিয়মের ছবিটা খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল হিয়ার সামনে | ও বুঝেছিলো সেই মুহূর্তে , ভালোবাসতে শুরু করেছে ও এই ছবিটাকে | প্রিয়মকে |
<১৩>

এরপরের দিন রাতে প্রিয়ম বাড়ি ফিরেছিল নার্সিংহোম থেকে | হিয়ার বাবাকে আর একটা দিন আই.সি.ইউ তে রেখে কাল জেনারেল এ দিয়ে দেবে | এখন মোটামুটি স্টেবল | টেনশনের খুব একটা কারণ নেই | ডাক্তারের মুখে এই কথাগুলো শোনার পরই ফিরেছিল প্রিয়ম সেইদিন | হিয়ার মা ও আজ চন্দননগর চলে গেছে সন্ধ্যের পর | প্রিয়ম তা ও কিছুক্ষন নার্সিংহোম এ ছিল | ডাক্তারের কিছু পেমেন্টস করার ছিল আজই | সেইসব করে যখন বাড়ির রাস্তা ধরলো তখন ঘড়িতে সাড়ে ন-টা | তবে আজ সকালের পর থেকেই শরীরটা ঠিক নেই ওর | মাথাটা ধরে আছে খুব | ক্লান্ত লাগছে যেন | কপালে হাত দিয়ে দেখেওছে কয়েকবার , আস্তে আস্তে টেম্পারেচরটা বাড়ছে ওর | জ্বর আসছে মনে হয় | দুবার তো করিডোরে মাথাটাও ঘুরে গেছিলো হঠাৎ করে | কিন্তু এইসব কিছু হিয়াকে বলেনি ও সকাল থেকে | আসলে এখন এই মেয়েটার জন্য অনেক বেশি ভাবনা এসে জড়ো হয় মনে | হিয়ার ব্যাপারে যত ও জেনেছে , যত কাছ থেকে এই মেয়েটাকে দেখেছে , ততই এই ভাবনাগুলো বেড়ে গেছে মনে মনে | প্রিয়ম আর সত্যি চায় না , হিয়া কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট পাক , চিন্তা করুক | এই যেমন আজই , এই শরীর খারাপের ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই বলেনি কারণ জানে হিয়া জানতে পারলেই ওকে কিছুতেই আর হসপিটালে থাকতে দেবে না | বাড়ি পাঠিয়ে দেবে | তারপর নিজে ওষুধ আনা , এই করিডোরটায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা , ইনজেকশন আনার জন্য ফার্মেসিতে লাইন , ব্লাড এরেঞ্জ , সব করবে | আর মেয়েটার মাথায় তো এমনিতেই বাবাকে নিয়ে বিশাল বড়ো একটা চিন্তা আছে সারাক্ষণ ! সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে একা একা এতো কিছু করতে গিয়ে , কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায় ! যদি হিয়ার মাথাটা ঘুরে যায় ভিড়ের মধ্যে ! তাহলে প্রিয়ম কি করবে ! কথাটা ভেবেই চুপ ছিল তাই | আসলে আজকাল ও হিয়াকে আগলে রাখতে চায় , সেফ রাখতে চায় , বাইরের সমস্ত আঘাত থেকে | হয়তো নিজের জন্যই ! কারণ এই মেয়েটা ওর কাছে ভীষণ দামি হয়ে গেছে ! ঠিক কবে থেকে খেয়াল নেই ! তবে হিয়ার ভালো খারাপ থাকার ওপর প্রিয়মেরও ভালো খারাপ থাকাটা নির্ভর করে আজকাল ! সেই জন্যই | তবে হিয়া আজ সকালে প্রিয়মের চোখ মুখ দেখে বুঝেছিলো হয়তো কিছু | তাই জিজ্ঞেস করেছিল নিজে থেকে , ———— ” তোমাকে এতটা টায়ার্ড লাগছে কেন ? চোখ মুখটা বসে গেছে ! শরীর ঠিক আছে ?”

কথাটা শুনে প্রিয়ম আলতো হেসে বলেছিলো , ———– ” হ্যাঁ , একদম ঠিক আছে | কিছু হয়নি , ডোন্ট ওরি ..”

কিন্তু ওর এই লাইনগুলোতেও হিয়া ঠিক সহজে মানেনি কথাটা | উল্টে একটু টেনশন নিয়েই বলে উঠেছিল এক নিঃশ্বাসে ,

———” আমার মনে হয় তোমার একটু রেস্টের দরকার এখন | আর কাল সারা রাত ধরে নার্সিং হোম এ ছিলে ! এমনিতেও স্ট্রেস গেছে খুব | তুমি বাড়ি যাও প্লিজ | ঘুমোও একটু |”

হিয়ার কথাগুলো শুনে প্রিয়ম একটু জোর দেখিয়েই বলেছিলো , ————- ” হিয়া , আমি একদম ঠিকঠাক সুস্থ আছি | আর আমি এখনই বাড়ি যেতে পারবো না | আরো দু বোতল ব্লাড লাগবে কাকুকে দিতে | আর কাকুর ব্লাড গ্রূপ তো রেয়ার , o নেগেটিভ , সেটা নার্সিংহোমের ব্লাডব্যাংক এ তো থাকে না ! আমাকে আনতে যেতে হবে বাইরে থেকে | আমি বেরোবো এখন |”

হিয়া ওর কথার উত্তরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছিলো , ———— ” তুমি ব্লাড ব্যাংকের এড্রেসটা দাও আমাকে | আমি নিয়ে আসছি | তুমি বাড়ি যাও এখন |”

তখন প্রিয়ম আরেকবার আলতো হেসে হিয়ার কাঁধ দুটো শক্ত করে ধরে বলেছিলো , ———– ” তুমি কোথাও যাবে না | এই মন নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর কোনো দরকার নেই | কাকিমার সঙ্গে থাকো | আমি যাবো | আর এটা ফাইনাল |”

না , কথাটার উত্তরে হিয়া আর ওকে না বলতে পারেনি | শুধু প্রিয়মের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়েছিলো কয়েক মুহূর্ত | যেন অন্য কোনো চোখে দেখছিলো ওকে ! যেইভাবে আগে কোনোদিনও তাকায়নি !

যাইহোক , সেদিন রাতে তবে বাড়ি পৌঁছে প্রিয়ম আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি হিয়ার কাছ থেকে | মাথাটা ঘুরে গেছিলো ওর হিয়ার সামনে | দেয়ালটা ধরার চেষ্টা করলেও পারেনি ঠিক | তবে হিয়া এসে সঙ্গে সঙ্গে এসে ওর হাতটা ধরে ফেলেছিলো খুব শক্তভাবে | তারপর ওর হাতের উষ্ণতাটা ফিল করে অবাক চোখে তাকিয়েছিলো প্রিয়মের দিকে ! চোখটাকে বড়ো বড়ো করেই বলে উঠেছিল ও , ———- ” তোমার এতো জ্বর ? তুমি তো সকালেও কিছু বললে না আমাকে ?”

প্রিয়মের কথাটা শুনে এই জ্বরের মধ্যেও যেন একটা ভালো লাগা এসে ভিড় করছিলো মনে | হিয়ার মুখে ওর জন্য এতটা কনসার্ন দেখে ভালো লাগছিলো অদ্ভুত ! মনে হচ্ছিলো মাঝে মাঝে এরকম জ্বর হয় তাহলে ভালোই ! যাইহোক , কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও ওই শরীরেও বলে উঠেছিল ,——– ” ঠিক আছি আমি | এমন কিছু জ্বর না ! ”

কথাটা শুনে হিয়া যেন একটু রেগেই উত্তর দিয়েছিলো , ———— ” সেটা তো থার্মোমিটার দেখলেই বোঝা যাবে |”

তারপর থার্মোমিটারে জ্বরটা যখন চেক করেছিল হিয়া , তখন প্রিয়ম কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল জ্বরের ঘোরে | ১০৪ দেখাচ্ছিল আসলে | হিয়ার তো কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছিলো যেন | বাড়িতে আজ আবার কেউ নেই | প্রিয়মের বাবা বিজনেসেকের কাজে চেন্নাই গেছে | ওর দাদাও গেছে সঙ্গে | আর বৌদি বাচ্চাটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি | এখন রাতে যদি জ্বর বাড়ে তাহলে কাকে ডাকবে ! কার কাছ থেকে হেল্প চাইবে ! কিছু ভেবে পাচ্ছিলো না হিয়া | সব আসলে এতটা স্ট্রেস নেয়ার জন্য হয়েছে | হিয়ার বাবার জন্য প্রিয়ম প্রায় দুদিন টানা হসপিটালে ছিলো | এতো ঘোরাঘুরি করেছে ছেলেটা ! রাতে ঘুমোয় পর্যন্তনি কাল | সেই জন্যই এইভাবে শরীরটা খারাপ করলো ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও রান্না ঘরে গেলো | এখন শুধু ওষুধে হবে না | টেম্পারেচার কমানোর জন্য জলপট্টি দিতে হবে | ওর জ্বর হলে মা যেমন ওকে দেয় | হিয়া যদিও এর আগে কখনো কাউকে জলপট্টি দেয়নি | তবে টেকনিকটা জানে | এই ভেবেই এক বাটি জল আর একটা রুমাল নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল প্রিয়মের সামনে | মাঝ রাত অব্দি তারপর ভিজে রুমালটা মাথায় রেখে রেখে ওর জ্বর কমানোর চেষ্টা করেছে হিয়া | প্রিয়ম আজ ওর খাটেই শুয়েছিল তবে | হিয়ার ভীষণ কাছে | হিয়া আসলে ওকে সোফার দিকে যেতেই দেয়নি | কিন্তু এইসবের মাঝে আজ প্রথম হিয়া প্রিয়মকে অনেক কাছ থেকে পেলো যেন, ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো জলপট্টি দিতে দিতে | ছেলেটা জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়েছিলো যখন , হিয়া প্রথম তখন ওর হাতটা ধরেছিলো নিজে থেকে , আনমনে | কিরকম একটা না দেখা দূরত্বের জল এসে জমা হয়েছিল সেই সময় হিয়ার চোখে | মনে হচ্ছিলো এতো কাছাকাছি থেকেও খুব কাছে আসা হয়নি প্রিয়মের ওর | না দেখা কাঁচের দেয়াল শুরু থেকে আজ অব্দি যেন রয়েই গেছে মাঝে | মন খুলে বলা হয়নি হিয়ার যে ‘ভালোবাসি’|

আজ অসুস্থ প্রিয়মকে এইভাবে নিস্তেজ হয়ে পরে থাকতে দেখতে ভালো লাগছিলো না ঠিক একদম হিয়ার | মনে হচ্ছে কখন ছেলেটা চোখ খুলবে ! আবার আগের মতন কথা বলবে ! এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই রাতটা পেরিয়েছিলো সেইদিন | ভোরবেলা তিনটের সময় হিয়া যখন থার্মোমিটারে টেম্পারেচার চেক করলো , তখন ১০১ দেখাচ্ছে | হিয়া যেন নিশ্চিন্ত হলো সেই সময়ে | তবে এরপর ওর চোখেও ক্লান্তি এসে জমা হলো | সারাদিন আজ হসপিটালে ছিলো , তারপর মা কে চন্দনগর ছাড়তে গেছিলো , এসে আর খাওয়াও হয়নি ঠিক ! প্রিয়ম তখনই যেইরকম জ্বর নিয়ে ওর সামনে এলো ! ওর খিদে তৃষ্ণা মাথায় উঠেছিল ! চিন্তায় চারিদিকটা আবছা হয়ে আসছিলো কেমন | এতক্ষণ এতটা টেনশনের মধ্যে কেটেছিল ওর এই একা বাড়িতে ! তাই এখন যখন প্রিয়মকে একটু সুস্থ দেখছে , তখন মাথা থেকে চাপটা সরলো যেন ! একটা চিন্তার কালো মেঘ কেটে গেছে বলে মনে হলো হঠাৎ | তাই শরীরটা হালকা লাগলো খুব | এই ভোররাত্রে , চারিদিকে যখন পাখিরা ডেকে উঠেছে শব্দ করে , হিয়া তখন ঘুমিয়ে পড়লো প্রিয়মের পাশেই | ওর হাতে মাথা রেখে কিরকম নিজের অজান্তেই স্বপ্নের দেশে চলে গেলো হিয়া , এই ভোরের শহরে |

প্রিয়মের তবে ঘুমটা ভেঙেছিল সকাল ছটায় একবার | তবে ও চোখ খুলে বেশ অবাক হয়েই তাকিয়েছিলো হিয়ার দিকে ! হিয়া ওর হাতে নিজের মাথা রেখে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন | প্রিয়ম বুঝেছিলো মেয়েটা সারা রাত জেগে তারপর আনমনে ঘুমিয়ে পড়েছে ওর পাশে | তবে এই প্রথম হিয়াকে এতটা কাছে পেয়ে প্রিয়মের মুখেও একটা হাসি চলে এলো বিনা নোটিশে | এতো সুন্দর মিষ্টি একটা সকাল হতে পারে জীবনে , এটা আসলে এর আগে ঠিক জানা ছিলো না প্রিয়মের | হিয়া আসলে একই ঘরে থাকলেও ওদের মাঝে সারাক্ষণ একটা দূরত্ব মেপেই চলতো প্রথম থেকে | কিন্তু আজ মনে হলো ওর আচমকা জ্বরটা হওয়ার জন্যই সেই দূরত্বটা আলগা হয়ে গেছে ওদের মধ্যে, আর হিয়া ওর এতটা কাছে এসে হাজির হয়েছে | প্রিয়মও তবে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো না | বরং ইচ্ছে করে হাতটা আলতো করে সরিয়ে হিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিলো আর একটু | তারপর ওর ঘুমন্ত মুখটাকে খুব কাছ থেকে দেখলো প্রথমবার | অদ্ভুত শান্তি লাগলো সেই মুহূর্তে মনে | ‘মনের মানুষকে’ কাছে পাওয়ার শান্তি | প্রিয়ম এরপর আবার চোখের পাতা বন্ধ করলো | এই নতুন সকালে নতুন একটা স্বপ্ন দেখার জন্য | হিয়ার সঙ্গে |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here