হৃদয়হীনা
পার্ট ৪
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
শায়েরী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসার নাম-গন্ধ তার মধ্যে নেই। সে নিষ্পলক চাউনিতে বাইরের দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত। নিকষ আঁধারে তার মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে। প্রচুন্ড উদাসীনতা মনের মধ্যে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। এমন সময় তার রুমে কারো পদচারণ ঘটে। সে বারান্দা থেকেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ঠাওর করে ফেলে। যে ব্যক্তি রুমে এসেছে সে বেশ দ্বীধায় ভুগছে। রুমে ঢুকেই ফোন চার্জে দিয়ে একবার বারান্দায় উঁকিঝুকি মেরে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে। দরজা লাগানোর আওয়াজ শায়েরী বারান্দায় থেকে স্পষ্ট শুনতে পেল। সে গুটিগুটি পায়ে রুমে এসে দাঁড়ালো। মনটা অশান্ত হয়ে আছে তার। রুমে এসে দাঁড়াতেই এই রুমটার সাজসজ্জা চোখে এড়ালো না। তার কাজিনরা বেশ সুন্দর করেই রুমটা সাজিয়ে দিয়েছে। সাদা গোলাপ দিয়ে সম্পূর্ণ রুমটা সাজানো হলেও বেডকভারে লাল গোলাপের পাঁপড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। মাঝে সার্কেল একে, “এস প্লাস এ” ও লেখা। যেটা দেখামাত্র লজ্জায় সে শিটিয়ে যায়। শরমে মাথা উঁচু করে রাখতে পারছে না সে। একবার মনে হলো ফের বারান্দায় চলে যাবে। যেই না পা এগাবে ওমনি খট করে বাথরুমের দরজা খুলে গেল। পুনরায় তারা সম্মুখীন হলো একে অপরের। চোখে চোখ পড়তেই শায়েরীর জড়তা দ্বিগুণ পরিমাণে বৃদ্ধি পেল। আহনাফের মুখ-হাত ভেজা। বোঝাই যাচ্ছে বেচারার শীতে মরি-মরি অবস্থা। হাত ধুতে গিয়ে সে নিজের শার্টটাও আংশিক ভিজিয়ে ফেলেছে।
শায়েরী চেয়ারে ঝুলে থাকা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিল। আহনাফ তা চটজলদি হাতে তুলে নিতে গিয়ে শায়েরীর হাতের সঙ্গে তার হাতটা লেগে গেল। মুহুর্তের মধ্যে শায়েরী পিলে চমকে উঠে। দুজনের চোখাচোখি হলো একবার।
এরপর নিরবেই আহনাফ হাত-মুখ মুছে টাওয়াল খানা তাকে ফেরত দিয়ে বলে, আমি ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো।
–” না, ঘুমাই নি।”
— তাই তো দেখছি। এসো বসি। আজ অনেকক্ষণ তোমার সাথে গল্প করব।
আহনাফ বিছনায় গিয়ে বসে পড়ল। এরপর নিজ থেকেই বলা শুরু করলো, তুমি কী কোন কারণে আমার উপর রেগে আছো?
এ প্রশ্নে সামান্য ভড়কালো যেন শায়েরী। সে রাশভারী কণ্ঠে বলে, “না।”
— তা ঠিক! রাগ করার মতো আমাদের সম্পর্কটা এখনো মজবুত হয়নি। শরীর কি এখনো খারাপ?
–” না, আমি একদম ঠিক আছি।”
— মন খারাপ তাহলে?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শায়েরী বিপাকে পরে যায়। আসলেই কি তার মন খারাপ নয়?
আবারো তার উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছোঁড়া হলো, তাহলে ধরে নিব যে মন খারাপ তোমার?
— হ্যাঁ।
আহনাফ গা এলিয়ে বসে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, মন খারাপ থাকা ভালো না। আমার কাছে মন ভালো করার কিছু টেকনিক আছে।শুনবে?
যদিও বা শায়েরীর খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল কি সেই টেকনিক গুলো কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে বলে, উহু।
— দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো পাশে এসে বস। দূর থেকে গল্প আর ভালোবাসা জমে না।
ভালোবাসা শব্দটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র শায়েরীর বুক কেঁপে উঠে। কেমন অস্বস্তি এসে ভীড় জমালো মনের অন্দরমহলে। সে ধীর পায়ে এসে তার মুখোমুখি বসলো। আহনাফ হালকা হেসে বলে, তুমি নিজের সম্পর্কে কিছু বলো! শুনি আমি।
— আমার নিজের সম্পর্কে বলার কিছু নেই। ছোটবেলা থেকে স্কুল যাওয়া-আসা আর সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসতে বসতে সময় গড়িয়ে গেল। তবে একটা বিশেষ গল্প আছে, ক্লাস ফাইভে থাকতে স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া আমার নিজের আর কোন গল্প নেই।
— আই সি। আমার জীবনটা কিন্তু তোমার জীবনের মতো এতো সুন্দর, সিকিউর, গোছালো ছিল না। প্রথম থেকেই বড্ড অগোছালো আমার জীবন। এক জীবনে চারবার স্কুল বদলেছি। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। এরপর দু’বছর নানা বাসায় রাজশাহীতে। তারপর ঢাকায় আসলাম। ঢাকা শহরটা প্রথম দিকে আমার কাছে বিষাক্ত লাগত।
এবারে শায়েরী তার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। এতোবড় সেলিব্রিটির জীবন কাহিনি কে না শুনতে চাইবে?
আহনাফ হালকা উষ্ণ কিন্তু উদাসীন গলায় বলে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকতে বাবা ব্রেইন স্টোক করে মারা যান। এরপর দুনিয়া চিনতে লাগলাম আমরা মা-ছেলে। এতোকাল একটা সুরক্ষিত ঝিনুক যেন আমাদের খোলাস দিয়ে আবৃত করে রেখেছিল। হুট করে খোলাস ভেঙে গেল। আমাদের উপর দিয়ে ভয়ংকর ঝড়-ঝাপটা বইতে লাগলো। নিজের চাচারা ভিটে মাটি ছাড়তে বাধ্য করল। এরপর মা আমাকে নিয়ে নানুবাড়ি আসলো। সেখানেও সমস্যা। দুই মামা জায়গা,সম্পত্তি ভাগ করে নিজের মতো সংসার করছেন। তাদের ঘরে আমাদের জায়গা নেই। তবুও দু, দুটো’ বছর মা আমাকে নিয়ে সেখানেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকল। এক সময় অসহ্য হয়ে আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে। ঢাকা আসলেই কি সব সমাধান হয়? ঢাকায় তো আর টাকার গাছ নেই। বরং এখানে বুঝি নিশ্বাস ফেলার জন্যও ভ্যাট দিতে হয়। দুর্দশায় কাটতে থাকে দিন। বস্তির মতো একটা বাসায় সাবলেট হিসেবে ভাড়া থাকতে শুরু করি। মা আমাকে একটা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দেন। বলতে বাধ্য আমার মা একজন সংগ্রামী মহিলা। কোন ঝড়ই তাকে উড়িয়ে দিতে পারেনি।
শায়েরী মৃদ্যু গলায় বলে, আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। বাদ দিন।
আহনাফ উঠে দাঁড়ালো এবং নিজের ফোন চার্জার থেকে খুলে ফেলে বারান্দায় চলে যায়।
শায়েরী চুপচাপ বসে আছে। আহনাফের চোখে জল দেখে সে হতবিহ্বল। একটা মানুষ এতো নরম মনের কীভাবে হতে পারে? এইটুকু বলতেই কাঁদতে হবে?শায়েরী তখন দিব্যি চোখ তুলে না তাকিয়েও টের পাচ্ছিল, মানুষটা কাঁদছে। চোখে পানি তার! ওই মুহূর্তে তার বুকটা হুহু করে উঠে। বড্ড মায়া লাগছে সদ্য স্বামী হওয়া মানুষটার জন্য তার। শায়েরী টিভিতে আহনাফের এক ইন্টারভিউতে শুনেছিল যে তার শৈশব-কৈশোর মোটেও সুন্দর কাটেনি। কিন্তু আজ সরাসরি তার মুখে শুনে খুব খারাপ লাগছে। নিজের বুকটাও ভার-ভার লাগছে। কেন যেন ওনার চোখের কান্না তার অসহ্য লাগছিল।
সে উঠে বাথরুমে গেল এবং চোখে-মুখে পানির ছিঁটা দিল।কাপড় চেঞ্জ করে, বাথরুম থেকে ফেরত এসে সে একদম বিড়াল ছানার মতো বিনা শব্দে, বারান্দার দিকে যেতেই চকিতে উঠে।
আহনাফ দেয়ালে ঠেস দিয়ে, সিগারেট ফুঁকছে।তা দেখে শায়েরীর মনে হোঁচট খাওয়ার মতো অবস্থা!এরকম একটা কল্পনা সে ক্লাস এইটে থাকতে দেখত যে আহনাফ হাসানের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। দুজনের একটা বাবু হবে। ইশ! এখন এসব ভাবতেই তার লজ্জায় মুখশ্রীতে লালাভ আভা ছেয়ে যাচ্ছে। এতো ছেলেমানুষ কেন ছিল সে? হুট করে তার মাথায় একটা চিন্তা হামাগুড়ি দিতে লাগলো। আহনাফ হাসান তার মতো সাধারণ একটা মেয়ের খোঁজ কীভাবে পেল? আর এতো এতো মেয়ের মধ্যে থেকে তাকেই বা কেন এতো সাদামাটা ভাবে বিয়ে করলো। উত্তর জানা নেই তার। সে যে নিঃশব্দে আহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এটা বোধহয় এখনো সে খেয়াল করেনি। তাইতো বিনা সংকোচে একধ্যানে সিগারেটে সুখটান দিয়েই যাচ্ছে। আয়েশ করে টান মেরে পিছে ঘুরতেই পুনরায় দুইজনের সাক্ষাৎকার ঘটে। এতে যেন বেশ বিব্রতবোধ করতে লাগে আহনাফ। সে বুঝে পাচ্ছে না যে এইরকম সিচুয়েশনে কী করবে? হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন নেভাবে তাতেও বিপত্তি ঘটলো। সিগারেট ব্যাটা এতো ঘাড়ত্যাড়া যে নিভতেই চাচ্ছে না।
তার কাণ্ড-কারখানা দেখে শায়েরী শব্দ করে খিলখিল করে হেসে ফেলে। খিলখিল করে হাসির শব্দে আহনাফ মাথা তুলে তাকাতেই একটা বড়সড় হুমড়ি খায়৷ শায়েরীর হাসিমাখা মুখ দেখে তার মনে অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে যায়৷ শায়েরীর পরনে গোলাপি ফুলের কাজ করা একটা সুতির শাড়ি। চুল গুলো পেছনের দিকে দিয়ে খোলা রাখলেও শীতের মৃদ্যু বাতাসে, উড়াউড়ি করছে। চাঁদের ঝলমলে আলোয় মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তা বর্ণনা করা আহনাফের মতো মানুষের জন্য দুষ্কর। কোন কবি শায়েরীকে এই অবস্থায় দেখলে নিশ্চয়ই কবিতা লিখত পাতায় পাতায়!
আহনাফ খুব সাহস করে শায়েরীর গাল ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে, শায়েরী সরে এসে পেছন দিকে মুখ করে রুমে ফেরত যায়।
যা দেখে আহনাফ কবি হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে বলে,
এই যে হরিণী চোখের কন্যা,
এতো হৃদয়হীনা কেন তুমি গো?
বুকে দহন জ্বালিয়ে দিয়ে,
কোন চান্দের দেশে পালাও গো?
কি হতো একটু ছুঁয়ে দেওয়ার অনুমতি দিলে?
এতো হৃদয়হীনা কেন তুমি গো?
★★★
শায়েরী বারান্দা থেকে ছুট লাগিয়ে এসে বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে৷ আহনাফের ওইরকম দৃষ্টি দেখেই সে ঠাওর করে ফেলে যে ছেলেটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে।ঘোরের মধ্যে পড়ে মানুষ অনেক ভুল-ভাল কাজ করে বসে।
মানুষটা তার মায়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে। পায়ের আওয়াজ কানে আসতেই সে কম্বল শক্ত করে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান ধরে৷
“শায়েরী ঘুমিয়ে গেলে?” প্রশ্নটা করেও, আহনাফ যুতসুই জবাব না পেয়ে, সে হতাশ হয়ে চুপচাপ তার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। অনেক অপ্রকাশিত কথা না বলেই সে নিরবে, নিভৃতে শায়েরীর পাশে শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে বেশ দেরি করে উঠে শায়েরী। ঘুম থেকে উঠে পাশের জায়গাটা ফাঁকা দেখে হচকচিয়ে যায় সে। চোখ বুলিয়ে বাথরুমটা দেখলো। বাথরুমেও কেউ নেই। দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাজ পড়ে গেল।
উঠে দাড়াতেই ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ছোট সাদা কাগজ দেখলো সে।
চলবে।