হৃদয়ের ওপারে তুমি ❤ পর্ব-৩৫অন্তিম পর্ব)

0
3077

#হৃদয়ের_ওপারে_তুমি
#গল্প_ভাবনায়_ফারজানা_ইয়াসমিন_রিমি (আপু)
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৩৫(অন্তিম পর্ব)

৬ বছর পর…….

-ছয় বছর! আল্লাহ আমি বেঁচে আছি কি করে? হাও ইজ ইট পসিবল?ছয় ছয়টা বছর কেটে গেলো, এই ছয়টা বছর আমার এমন ভাবে কেটেছে যেনো আমার গলার মধ্যে বিষ আটকে আছে।মানুষ কি করে হতে পারে এমন নিষ্ঠুর?ঠিক আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? আমি বুড়ি হয়ে গেলে দেশে ফিরবেন আপনি?ভাই তুমি একটা বারের জন্য দেশে আসো আমার পেটে একটা বাচ্চা দিয়ে যাও তোমাকে আর লাগবে না, আমি আমার বাচ্চা নিয়ে সময় পার করে দিবো।
-আহা!এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো?
আরে আমার কি করার আছে!যে ডিগ্রীর জন্য এতো অপেক্ষা করলাম এতো বছর সেই ডিগ্রী না নিয়েই এখন এসে পড়বো?
-কি এমন ডিগ্রী নিতে গেছেন এখনো পাচ্ছেন না। আরে আমি ফুল এতো ন্যাবর ড্যাবর স্টুডেন্ট আমি কত্ত রিল্যাক্সে ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট করে, একাউন্টিং নিয়ে অনার্স কমপ্লিট করলাম শুধু মাত্র আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে ওহ সরি আপনার মুখ তো ছয় বছর ধরেই দেখি না শুধু ভিডিও কলে দেখেই পার করলাম। আপনার কথার মান রাখতে গিয়ে নিজেকে নিজেই ধরে বেঁধে পড়াশোনা করাচ্ছি,পড়াশুনা শেষের দিকে আমার।আর আপনি বলছেন এখনো আপনার ডিগ্রী নেয়া হয় নি!নিকুচি করেছে অমন ডিগ্রীর, লাগবে না আপনি দেশে ফিরে আসেন বাড়ির সামনে ওষুধের ডিসপেনসারি খুলে দেবো ওটাই চালাবেন।

ফুলের কথায় অভ্র উত্তর না দিয়ে ফোনের ওপাশে চুপ করে রইলো।ফুল থেমে গিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
-আচ্ছা সত্যি করে বলুন আপনি! বাই এনি চান্স আপনি তো ওখানেই কোনো বিদেশীকে বিয়ে করে সংসার করছেন না তো?
-কি আবোল তাবোল বলছো ? এটা সম্ভব কোনো ভাবে? এক বউ থাকতে আরেক বিয়ে! তাও আবার এমন সুন্দরী বউ রেখে আমি অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো এটা তুমি ভাবতে পারলে হুর!সম্ভব এটা বলো?
-হতেই পারে,অসম্ভবের কোনো অপশনই দেখছি না আমি। যদি এরকম কিছু নাই ই হয় আপনি এটা বলুন এই যে ছয়টা বছর কেটে গেলো এই ছয় বছরে আপনি একটা বারও দেশে আসেন নি। ভিডিও কলময় জীবন আর কতকাল? সেই যে সেদিন এয়ারপোর্টে ছিলো সামনা সামনি শেষ দেখা ।একটা বার ভেবে দেখুন দেশে থাকতে এরকমটা হয়েছে কখনো?কোনো না কোনো ভাবে না হলেও ছয়মাসে একবার দেখা হয়েছে আমাদের! আর সেখানে ছয় বছর পার করলাম! । শুধু ছবি আর ভিডিও কল নিয়েই কাটাচ্ছি!এমনি এমনিই কি সেদিন এয়ারপোর্টে আমি বলেছিলাম “কেনো জানি আমার মনে হচ্ছে আজই আপনার সাথে আমার শেষ দেখা”ঠিক তাই ই হলো যা মন গাইছিলো।
কেনো এমন করছেন আমার সাথে বলুন তো? খুব জানতে ইচ্ছে করছে আমার।

-উনিশ শতকের বউরা তাদের প্রবাসী স্বামীর সাথে মাসে -ছয়মাসে চিঠিতে কথা বলতো স্বামীরা দশ বারো বছর পর স্বামীরা দেশে ফিরতো ।আমি তারই কিঞ্চিৎ ফিল নিতে চেয়েছিলাম আর কি, বেশি কিছু না।
-দেখুন ফাইজলামকি বাদ দিয়ে সোজা কথা বলুন।
-ঠিক আছে এতোই যখন ফোর্স করছোই, তাহলে বলছিই কারণ।
-বলুন বলুন বলুন!
-দেখো যদি এখন আমি দু একদিনের জন্য তোমাকে দেখতে আসি, তাহলে তোমাকে দেখে তোমার কাছে থেকে যেতে ইচ্ছে হবে, মন আনচান করবে।ফিরে আসার পর যতবার মনে হবে আমি অনেক দূরে আছি ততোবার তোমার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু এগুলোর একটাও আমার সাধ্যের মধ্যে নেই।এতো বছর ধরে এতো কষ্ট করে পড়াশুনা করে সব ফেলে যাওয়া কি সম্ভব? মাঝখান থেকে খামোখা কষ্ট পাওয়া। তাই আমি ভেবে চিন্তে দেখলাম আমি তো দেশে আমার ছোট্ট হুর বউকে রেখে এসেছি,কয়েক বছর পর আমার হুর বউ অনেক বড় হবে আগের থেকে আরো বেশি গ্ল্যামার কিউট সুইট হবে অনেক চেঞ্জ হবে,ভিডিও কলে তো আর স্পষ্ট বুঝা যায় না বাস্তবের মতো । যদি আমি আমার হুরের অই নতুন রূপটা দেখতে চাই তাহলে আমার এখন হাজার কষ্ট হলেও সামনা সামনি না দেখে থাকতে হবে।যদি দেশে যাই দুদিন পর পর তাহলে সব কিছু আগের মতোই লাগবে ।
তাই এই ইন্টারেস্টিং পার্ট টা ফিল করার জন্যই এমনটা করা।

দুজনে সমান হৃদস্পনদন আকাঙ্ক্ষা তৃষ্ণা নিয়ে একে অপরের ভালোবাসার মানুষ গুলোকে মন ভরে দেখবো।
তাই ভালোবাসা গুলো জমিয়ে রাখছি যেনো আমি তোমার কাছে যেদিন ফিরবো সেই ভালোবাসা গুলো নিয়ে ফিরবো আর তোমায় আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে নিজের করে নেবো।

ফুল শান্ত স্বরে বললো,
-তাহলে কবে দেখা হচ্ছে আমাদের?
-একদম বিয়ের দিন।
-মানেহ!তাহলে কবে বিয়ে আমাদের?একজীবনে কয় বিয়ে করবো?বিয়ে করে লাভ টা কি যদি জামাই ই না থাকে!
দেখুন আপনাকে আমি ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি যদি এবছর আপনি দেশে না আসেন আমি কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবো বলে দিলাম ।
-হ্যাঁ এটাও করতে পারো আপাততো একটা বিয়ে করে নাও,আমি দেশে ফেরার পর আবার আমার কাছে চলে এসো।
-ফাজিল, অসভ্য, ইতর, বাঁদর!
-ইশসসস এভাবে রেগে যেও না তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে খুব।
-ফালতু একটা! ফোন রাখেন আপনার সাথে কথা বললে আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়!

রাগ করে ফুল ফোনটাই কেটে দিলো ওপাশে অভ্র কানে থেকে ফোন সরিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

সময়ের গতি ঘড়ির কাটার মতো করে কেটে যেতে যেতে ছয় বছর হয়ে গেছে,আর এই ছয় বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু।ফুল টাংগাইলের ন্যাশনাল ইউনিভারসিটি থেকে গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে। পাব্লিকে পড়ার কোনো ইন্টারেস্ট ফুলের ছিলো না, ইন্টারমিডিয়েটের পর সবাই পাব্লিকের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললে ফুল জানায় বাড়ির লোক ছেড়ে কোথাও যাবে না। টাংগাইলে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আর টাংগাইল মেডিকেল ছাড়া আর কোনো পাব্লিক ভার্সিটি নেই,যেখানে পড়তে হলে অবশ্যই সাইন্সের স্টুডেন্ট হতে হবে। সবাই ঠিক করেছিলো ফুল যদি ঢাকার পাব্লিকে চান্স পায় তাহলে অভ্রদের বাড়ি থেকে পড়াশুনা করাবে কিন্তু ফুল বাড়ির মানুষকে স্পষ্ট করে বলে দেয় “স্বামী থাকতে শ্বশুর বাড়ি যাই নি এখন তো প্রশ্নই আসে না, আমার পরিবার ছাড়া আমি থাকতে পারবো না “একটু ন্যাকা কান্না করে বুঝায় ব্যাপারটা, আর সবাই গলে যায়। কিন্তু ফুল আসলে এই কারণে এরকমটা করে নি,পাব্লিকে পড়তে হলে অনেক বেশি পড়াশুনা করতে হবে আগের থেকে, এটা ভেবেই এই চাল চেলেছে। অভ্রও ওকে কোনো চাপ দেয় নি।

বর্তমানে ফুল মাস্টার্স করছে। সময়ের সাথে যেমন ম্যাচিউর হয়েছে তেমন চিকন দুষ্ট বুদ্ধিও বেড়েছে।কখনো কোনো দুষ্টুমি করলে এখন আর বাড়িতে বিচার আসে না , সেভাবেই দুষ্টুমি করে।ভার্সিটির ম্যাক্সিমাম ছেলে ফুলকে মাস্তান উপাধি দিয়েছে, কোনো ছেলে ইভটিজিং করলে তাকে ফুল আর ওর আট বান্ধুবীর গ্যাং মিলে সাইজ করে দেয়।

এদিকে অভ্র কানাডা থেকে এমডি ডিগ্রী নিয়েছে,কানাডার একটা হাসপাতালে দেড় বছর প্র্যাক্টিস করে এখন দেশে আসছে।
বর্তমানে অভ্র হার্ট স্পেশালিস্ট ( কার্ডিওলজিস্ট) এমডি ।

দেশে নিজস্ব ক্লিনিকের পাশাপাশি গরীবদের জন্য ফ্রিতে উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য আরেকটা হসপিটাল উদ্ভাবন করেছে।আর ওর বন্ধুরা তো আছেই।

অনু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস্টার্স করছে। আকাশ টাংগাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি করছে।
পলাশের বিয়ের পর আকাশ আর অনুর এংগেজমেন্ট হয়ে গেছে।অভ্র আর ফুলের বিয়ের পরই অনু আকাশের বিয়ে হয়ে যাবে।

অভ্র দেশে ফিরে আসছে ফুল জানেও না। কারণ সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। সবার সাথে প্ল্যান করেই অভ্রর পার্মানেন্ট দেশে ফেরা হচ্ছে, দেশে ফেরার পরের সপ্তাহের শুক্রবার ওদের বিয়ে।

ফুলকে কেউ কিচ্ছু বুঝতে দেয় নি।
অভ্রদের বাড়িতে অলরেডি বিয়ের তোড়জোড় লেগে গেছে।
আর ফুলদের বাড়িতে ফুলকে না জানিয়েই আয়োজন হচ্ছে। একদম বিয়ের দু তিন দিন আগে জানানো হবে ওকে।ফুলকে না জানিয়েই ওবাড়িতে প্রস্তুতি চলছে ওর বিয়ের।

ঘুম থেকে উঠতেই ফুল নিজের রুমটাকে চিনতে পারছে না, বিছানায়, টেবিলে চেয়ারে, টি টেবিলে সাইড বক্সের উপর অনেকগুলো শপিং ব্যাগ আর বড় বড় বক্স এগুলো দিয়ে পুরো ঘর ভর্তি করা হয়েছে। ফুল বুঝতে পারছে না এগুলো খুলে দেখবে নাকি বাড়ির মানুষকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে কি এগুলোতে, আর কার এগুলো।

ফুল জোরে চিৎকার দিয়া মা বলে ডাক দিলো, ডাক দেয়ার সাথে সাথে রুমে প্রবেশ করলো ফুলের ছয় ভাবী একসাথে। ফুল খানিকটা বিষ্মিত হলো ডাক দিলো মাকে আর ভেতরে এলো ভাবীরা। কি আশ্চর্য!

-মা কোথায়?
ভাবীরা একসাথে উত্তর দিলো।
-কি বলতে চাও আমাদের বলো ।

ফুল ওর চারপাশে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো,
-এসব কি?
-এগুলো সব তোমার বিয়ের শপিং!

মুখ প্যাঁচার মতো করে বললো,
-মানেহ! আমার বিয়ের শপিং? কবে বিয়ে আমার? আর কার সাথে? এই তোমরা আমাকে কয়টা বিয়ে দিতে চাও?আমার রাজপুত্র দেশে নেই বলে সুযোগ নিচ্ছো?যেখানেই বিয়ে দাও না কেনো আমার রাজপুত্র আমাকে তুলে নিয়ে যাবে হাজার হলেও সে আমার প্রথম স্বামী।
-ওরে ননদিনী থামো,আমাদের বলতে দাও।বিয়ে তোমার রাজপুত্রের সাথেই হতে যাচ্ছে।
-আমাদের কি এবার অনলাইনে বিয়ে হবে?ভিডিও কনফারেন্স?ভালোই হবে একবার ধর্মমতে তিন কবুলে বিয়ে করেছি এবার অনলাইনে করবো,তারপর আবার কোর্ট ম্যারিজ করবো, আরো যত প্রকার বিয়ে আছে সব করবো। মোট কথা যতভাবে বিয়ে করা যায়।

ফুলের কথায় সবাই হাসতে হাসতে বললো,
-হাইরে প্রবাসীর বউরে, জামাইকে না পাওয়ার বিরহে মাথা পুরোই গেছে।তোমার রাজপুত্র এখন তার রাজ্যে অবস্থান করেছে।এসব শপিং তোমার রাজপুত্রই তোমার জন্য পাঠিয়েছে।
-উনি দেশে এসেছেন!কবে কখন?আমি বউ হয়ে কিচ্ছু জানি না, আর তোমরা জানো?
এগুলো কে দিয়ে গেছে?
-এগুলো নিয়ে তোমার উকিল বাপ এসেছেন গত রাতে। আর অভ্রর প্ল্যান মতো তোমাকে কিছু জানানো হয় নি, যেনো সারপ্রাইজ দেয়া যায়, অভ্র এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে আসে।আর কালকের পরের দিন তোমাদের গায়ে হলুদ শুক্রবার বিয়ে।
-আমার তো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না!মাথা ঘুরাচ্ছে!
-এখনি মাথা ঘুরাচ্ছে কেনো?বিয়ের পর ঘুরালে ঠিক আছে।
-আরে ধেত আমি বলি কি আমার সাড়িং শুনে কি।আমার মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি না তো?
-স্বপ্ন হলেও ক্ষতি কি?ভালো স্বপ্নই।চলো এবার সব প্যাকেট খুলো।আমরা সব কিছু আগে থেকে জানলেও এটা কিন্তু জানি না প্যাকেট আর বক্স গুলোর ভেতর কি কি আছে।এখন তুমি এগুলো খুলে উদ্বোধন করো।

ফুল কথা না বাড়িয়ে সব গুলো শপিং ব্যাগের ভেতরে যা যা আছে বের করে বিছানায় পালা দিলো,আর বক্স গুলোও খুললো।

ফুলের বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে আগামী আনুমানিক দু তিন বছর কোনো জামা কাপড়, জুতো,কসমেটিক্স না কিনলেও চলবে সেরকম শপিং পাঠিয়েছে।

এমনকি একটা বড় বক্সে অনেকগুলো শাড়ী যেগুলো ফুলের বাড়ির লোকদের জন্য পাঠানো হয়েছে কার কোন শাড়ী সেগুলোতে লিখেও দিয়েছে।বাড়ির সব ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবী পাঠানো হয়েছে।
ছোটো ছোটো বাচ্চা গুলোও বাদ যায় নি।

শপিং দেখে তো সবাই খুব খুশি!

ফুলের বিয়ের শপিং গুলো কানাডা থেকেই করা হয়েছে, অভ্র, অয়ন, অয়নী, কাব্য, আর কাব্যর দুই বোন মিলে পছন্দ করে শপিং করেছে।

ফুলের বিয়ের গহনা গুলোও খুব বেশি নজর কাড়া সুন্দর! সবাই খুব পছন্দ করছে একদম ইউনিক ডিজাইন প্রতিটা জুয়েলারীর।

ফুলদের বাড়িটা সাজানো শুরু হয়ে গেছে সকাল থেকে।
দূর দুরান্তের সমস্ত আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে আজ বিকেল থেকেই।

-কাজটা কি ঠিক হলো বলুন?
-কোন কাজের কথা বলছেন?
– দেশে এসেছেন ভালো কথা,আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে বিয়ের ডেট ফিক্সড করেছেন সেটাও আরো ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে আমাকে একটা বার জানালেনও না আপনি দেশে এসেছেন!
-যদি ব্যাপারটাতে কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে সরি।
-কষ্ট পাই নি।শুধু বিস্মিত হচ্ছিলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিলো না, ভেবেছিলাম সবাই মজা করছে। তবে হ্যাঁ একটা কারণে আমি খুব খুশি।অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে!
-হ্যাঁ হবেই তো, আমারও পূরণ হচ্ছে।তুমি আমাকে পাবে আমি তোমাকে।
– আরে ভাই পুরো কথা শুনেন ,আপনাকে পাওয়া নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখি না,অপেক্ষা করতে করতে আমি হাঁপিয়ে গেছি, এখন তো শান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে এই বুড়ি বয়সে জামাইয়ের ঘরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।
-তাহলে কি আপনার স্বপ্ন?
-পড়াশুনায় ফুলস্টপ! আহ ভাবতেই কি শান্তি লাগছে ভেতরে!
-হুম এখন পড়াশুনা না করলেও চলবে তাই না?
-আবার জিগায়!
-তবে বিসিএস টা ট্রাই করতে পারো।তোমার অনার্সের রেজাল্ট ভালো আছে, কটা দিন একটু কষ্ট করে পড়ে তুমি জাস্ট ভালো মতো পড়ে এক্সামটা দাও।ভাইবা বোর্ডে আমার লোক আছে। একবার বিসিএস ক্যাডার হলে লাইফ পুরো সেট।

ফুল ঝাড়ি মেরে বললো,
-আমি বলেছি না চাকরী বাকরী তো দূরে থাক লেখাপড়াও করবো না আমি।আমি বিয়ের পর সংসার করবো।
-সংসার করতে হলে কি কি করতে হয়?
-আপনাদের বাড়িতে তো আর কাজ করে খেতে হবে না কটা দিন খাবো ঘুমাবো ঘুরবো ফিরবো তারপর দু একটা প্যা-পু বাচ্চা নেবো সারাদিন বাচ্চা নিয়ে খেলবো।

-ওকে এজ ইউর উইশ ম্যাডাম।আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।
-ধন্যবাদ।আরেকটা কথা,
-বলেন,
– আমি কি আপনার ব্যাংক জব টা পেতে পারি?আমি কিন্তু একাউন্টিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস গ্র‍্যাজুয়েট।আপনি বলেছিলেন সার্টিফিকেট দেখাতে, আমার কিন্তু আছে সার্টিফিকেট। এখন অন্য এক্সকিউজ দিবেন না।

অভ্র হো হো করে হেসে দিয়ে বললো,
-আমার ব্যাংকে জব করতে হবে না,আপনিই ব্যাংক খুলবেন আমি টাকা রাখবো।
ফুল হেসে দিয়ে বললো,
-ওকে রাজপুত্র !
-আমার সব কিছুই তোমার,আমি নিজেই তো তোমার।আর কি চাওয়ার আছে?
-না গো আমার এতো কিছু লাগবে না, শুধু আপনার টাকা গুলো পেলেই হবে।

অভ্র মন মরা হয়ে বললো,
-ঠিক আছে তাহলে বিয়ের কি দরকার!যেভাবে আছি সেভাবেই থাকি শুধু মাস শেষে টাকা পাঠাবো।
– অই আপনি কি রাগ করলেন?আমি তো মজা করছিলাম।আমার শুধু আপনাকে চাই আর কিছু লাগবে না। আমাকে
যেভাবে রাখবেন সেভাবেই থাকবো,শুধু চাওয়া একটাই মিস করার আগে যেনো আপনাকে পাশে পাই।
-এই না হলে আমার বউ!
-আই লাভ ইউ হুর।
-আই লাভ ইউ টুওওওও রাজপুত্র !

অবশেষে দুজনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে।

দুই বাড়িতে বিয়ের আমেজে ভরপুর !

বিয়ের আগে প্রতিটা মেয়ের চেহারাতে একটা অন্যরকম মায়াবী সুন্দর্য্য কাজ করে।ফুলেরও তেমনি হচ্ছে। আগের থেকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে, এতো বছর পর অভ্র সামনা সামনি ফুলকে এই রূপে দেখলে প্রথম দেখায় ই নেশা লেগে মাতাল হয়ে যাবে সোজা কথা।
আবহাওয়ার প্রভাবে কানাডাতে এতো বছর থেকে অভ্রর চেহারার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এসেছে।আগের থেকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে।

এতো বছর পর একে অপরকে পাওয়ার তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ করতে যাচ্ছে দুজনে অতি শীঘ্রই। এ ছয়টা বছরে দুজনের মাঝে পুরোনো স্মৃতি গুলো আঁকড়ে ছিলো। নতুন করে নতুন ছন্দে একে অপরের প্রেমের অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে।

ফুলের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের দিন সকালে সব বান্ধুবীরা এসে গেছে।ফুলের সব বান্ধুবীই বিবাহিত, আর ফুলের বেস্ট ফ্রেন্ড মিনা ওর তো কথায় নেই,ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার পর ই বিয়ে হয়ে যায়।

খুব ধুমধাম করেই আয়োজন করা হয়েছে ফুলের বিয়ের।রোজ প্যাটেলের একমাত্র রোজের বিয়ে বলে কথা।

একদিকে ফুলকে বিদায় দেয়ার বেদনা আরেক দিকে ফুলের নতুন জীবনের সূচনার আনন্দ, দুটোই বিরাজ করছে এ বাড়ির মানুষদের ভেতর। প্রায় ই তারা কেঁদে দিচ্ছে মেয়েকে জড়িয়ে, আর একটা রাত পেরুলেই মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে। ফুলেরও একই অবস্থা এক পাশে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনা আরেক পাশে তার রাজপুত্রকে কাছে পাবার আনন্দ।

আর একটা রাত কেটে গেলেই অভ্র তার হুরকে পেতে যাচ্ছে, তার হুরকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে নতুন রূপে?আজ গায়ে হলুদের সাজে তাকে বেশ সুন্দর লাগছে,সামনা সামনি আরো লাগছে হয়তো।
অভ্র কল্পনা করছে সামনা সামনি ও ওর হুরকে দেখতে পাচ্ছে ওর দেয়া গায়ে হলুদের শাড়ী পড়ে সারা গায়ে কাঁচা ফুল দিয়ে সেজেছে,চোখে মোটা করে কাঁজল আর লাল টকটকে লিপস্টিক।

নানান রূপে কল্পনায় সাজাচ্ছে তার হুরকে। কাল ই বা দেখতে কেমন লাগবে ওকে! সব থেকে বড় কথা ছয় বছর পর কেমন লাগবে! অভ্র কল্পনা করছে সেই ষোলো বছর বয়সী ফুলকে যেদিন ওকে প্রথম দেখেছিলো, তারপর কথা বলা,দুষ্টুমি করা ফুলের কাছের মানুষ হয়ে উঠা । আঠারোতে পা রাখার আগেই তাকে রেখে চলে যাওয়া, এখন তো ওর বয়স ২৪+,আগের থেকে অনেক বদলে গেছে।

নানান রকম কল্পনা জল্পনা করতে করতে রাত কেটে গেলো অভ্র আর ফুলের।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই ভেতরে ভেতরে খুব নার্ভাস ফিল হচ্ছে, আর কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা তারপরেই তার রাজপুত্রকে দেখতে পাবে! আর এদিকে ফুলের ভাবীরা আর বান্ধুবীরা ফুলের নার্ভাসনেস আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বাসর ঘরের উল্টা পাল্টা কথা বলে। কিন্তু ফুল বেশি নার্ভাস আছে কখন সময় ফুরাবে আর দেখতে পাবে রাজপুত্রকে!

এগারোটার দিকে মেকআপ আর্টিস্ট এসে গেছে ফুলকে সাজানোর জন্য, ফুলকে গোসল করিয়ে সাজানো শুরু করে দিয়েছে।

শেরোয়ানি পড়ে বিয়ের বর সেজেগুজে রেডি অভ্র, নিজেকে আজ অন্য রকম বলে আবিষ্কার করছে, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা,তারপরই প্রতিক্ষার প্রহর শেষ!

বরযাত্রী বারোটার আগেই টাংগাইলের পথে রওনা হয়, কারণ এতো দূরের রাস্তাতে যদি মাঝ রাস্তায় জ্যামে পড়তে হয় তাহলে শেষ!আর যোহরের নামাজ রাস্তাতেই কোনো এক মসজিদে পড়ে নেবে বলে ঠিক করেছে ।

অভ্র যে গাড়িতে যায় সে গাড়িতে ওর সাথে কাব্য আর সমুদ্র যায়।
ড্রাইভারের পাশের সীটে অভ্র বসেছে আর পেছনে কাব্য সমুদ্র একসাথে।

বরের গাড়িটা ফুল দিয়ে ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।

রাস্তাতে আজান দেয়ার পর সবাই নামাজ পড়ে আবার গন্তব্যর দিকে যেতে লাগলো,

লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে ফুল আয়নার সামনে যেতেই লজ্জায় চেহারাটা লাল হয়ে যায়। নিজেকে চেনা ভার হয়ে গেছে, ভেবে পাচ্ছে না তার রাজপুত্রের সামনে যাবে কি করে,লজ্জায় একদম শেষ হয়ে যাবে! অভ্রর চেহারাটা কল্পনা করতে পারছে না,খুব লজ্জা লাগছে অভ্রকে দেখতে কেমন লাগছে সেটা ভাবার চেষ্টা করছে।

বরযাত্রীর ম্যাক্সিমাম গাড়িই অভ্রদের গাড়ি ছাড়িয়ে গেছে,শুধু ফ্রেন্ড সার্কেলদের গাড়িটা অভ্রদের থেকে একটু পেছনে।

গাড়ি যাচ্ছে আপন গতিতে,কাব্য সমুদ্র খুব জ্বালাচ্ছে পেছন থেকে,বড় হলেও একেক জন দুষ্টু আছে সেই আগের মতোই।

গাড়ি ঢাকার বাইরে বের হতেই একটা তিন রাস্তার মোড়ে গাড়ি আসতেই ডান দিক থেকে হঠাৎ করে তীব্র গতিতে একটা মালবাহী ট্রাক এসে কিছু বুঝে উঠার আগেই অভ্রদের গাড়িটাকে ধাক্কা দেয়,ড্রাইবার আর অভ্র দুজনেই চেষ্টা করে ওদের গাড়িটাকে বাঁচানোর কিন্তু তার আগেই ট্রাকের সংঘর্ষে গাড়িটার সামনের অংশ সামনে থেকে চাপা দিয়ে পিষিয়ে দেয়।

গাড়ির সংঘর্ষের প্রকন্ড শব্দ,সময়টা যেনো থেমে যায়। অভ্র বুঝতে পারে ওর অবস্থা খারাপ, সময়টা শেষের দিকে। দুচোখে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে, কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না, হাত পা সহ পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। পাশে তাকিয়ে দেখছে ড্রাইভারের শরীর রক্তাক্ত।পিছন ফিরতে পারছেনা। কিন্তু বুঝতে পারছে কেউ ভালো নেই, সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

অভ্রর চোখের সামনে মা বাবা আপনজনদের ছবি ভাসছে,সাথে তাঁর হুরের ছবিটা,শেষ দেখা টা আর হলো না। সেদিন ফুলের মন ঠিকি গায়ছিলো শেষ দেখাটা সেদিনই ছিলো। নিজের করে নিয়েও পারলো না তার হুরকে কাছে পেতে।আর হবে না কোনোদিন দেখা,হবে না পাওয়া।
-হয়তো হুর দেখতে পাবে আমার মৃত লাশ টা,কিন্তু আমি পারলাম না,ভালো থেকো হুর বউ,ক্ষমা করে দিও তোমার রাজপুত্রকে!

লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে,মনে নানান রকম স্বপ্নের জাল বুনছে,কিন্তু এখন একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে বিকেল চারটার বেশি বাজে বরযাত্রীর আসার নাম নেই।

ঘরে ফুল একা,কেউ এসে বলছেও না বর এলো কিনা,ফুল অভ্রকে কল দিচ্ছে ফোন অফ দেখাচ্ছে বার বার ট্রাই করলো,ফুল ভাবলো,
– হয়তো আবার নতুন কোনো সারপ্রাইজ দিতে চলেছে এই রাজপুত্র। ওহ আল্লাহ এই ছেলেকে নিয়ে করি আমি,কবে যেনো এর সারপ্রাইজের ঠেলায় আমার দম বেরিয়ে যায় । আমার থেকে এই লোকটার ই জ্ঞান কম।
বেলা পেরিয়ে সন্ধ্যে নামবে কোথায় উনারা!

ফুলের মতো ওর বাড়ির মানুষ গুলোও দুশ্চিন্তায় ভুগছে। দু ঘন্টা আগেও যোগাযোগ হয়েছে, কিন্তু এখন কারো সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।কারো ফোন অফ দেখাচ্ছে তো কারো ফোন ব্যস্ত।
অনেক্ষণ সময় চলে যাওয়ার পর আকাশের ফোনে কল এলো,
ফোন রিসিভ করে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মোবাইলে যা শুনেছে তা ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা, আবার মানতে কষ্ট হচ্ছে। মাথা ঘুরে উঠলো, পড়তে পড়তে সামলে নিলো। বড়রা সবাই দৌড়ে আসলো ওর কাছে। আকাশ অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলো
-পরী কই ফুপা?
ফুপি বললো
– উপরে ওর রুমে। কিন্তু কি হয়েছে বল বাবা।

সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে কি হয়েছে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কেউ খেয়াল করেনি দোতালার সিঁড়ির গোড়ায় ফুল বধু বেশে আরো অনেক আগেই দাঁড়িয়ে আছে।

আকাশ কাঁদতে কাঁদতে বললো -এক্সিডেন্ট করেছে ফুপা, মেসিভ এক্সিডেন্ট। খুবই গুরুতর অবস্থা।অভ্র হয়তো আর বেঁচে নেই!
– এই কথা শুনে সবাই আঁতকে উঠলো।

ফুলের বাবা বুক চেপে ধরে বসে পড়লো। মা জ্ঞান হারালো। কতক্ষন থম মেরে সবাই বুঝার চেষ্টা করলো আসলে কি শুনেছে।

আয়মান আশিক একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই তৎক্ষণাৎ ফুলের রুমের দিকে ছুটলো। কারন ওদের মনে হলো এখন ওদের একটাই কাজ, বোনকে বুকে জড়িয়ে রেখে সকল বিপদ – ভয় – চিন্তা থেকে বাঁচিয়ে রাখা।

কিন্তু ওরা বুঝতে পারেনি ওরা দেরি করে ফেলেছে। অর্ধেক সিঁড়ি পার হয়ে দেখলো তাদের পুতুল বোন ওদের পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ছে। দুই ভাই চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে ফুলকে জড়িয়ে ধরলো।

একটা উৎসবমুখোর বিয়ে বাড়ি হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। হাসি- আনন্দের বদলে চিৎকার আর কান্নায় ভরে গেলো।

কিছু ভালোবাসা প্রকৃতির কাছে হেরে যায় অসমাপ্ত নামক রেখা টেনে, প্রকৃতি এর সমাপ্তি দিলেও ভালোবাসা গুলো স্বার্থক গুঞ্জনই গায়।

এভাবেই হয়তো হাজারো অভ্র ফুলের ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে।চলে যায় হৃদয়ের ওপারে!

_______শেষ হয়েও সমাপ্তি রেখা টানলো না_________
(আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক পাঠিকা।হতাশ হবেন না, শান্ত্বনা স্বরূপ খুব শীঘ্রই একটা সাসপেন্স থ্রিলার নিয়ে আসছি।আশা করি রাগ অভিমান ভুলে পাশে থাকবেন পরবর্তীতেও ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন,ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here