#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১২)
#নাহার
·
·
·
শীতের রাতে কুয়াশা পড়ায় আকাশের তারাগুলো ঠিক দেখা যাচ্ছে না। আজকে আকাশে চাঁদ নেই। এখনো বারোটা বাজেনি তাতেই কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারিদিক। সামনে দুইহাত দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাকলা হালকা হিম শীতল বাতাস শরীর ছুতেই হাড় কেপে উঠে। নিরা এতোক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে এখন রুমে প্রবেশ করেছে।
খুব বেশি শীত লাগছে নিরার। তাই সুয়েটার গায়ে দিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না কোনোমতেই। বারবার কেমন যেনো এক উত্তেজনা আর ভয় কাজ করছে। আর কিছুক্ষণ পরই তুহিন ফোন দিয়ে বলবে ছাদে যেতে। তুহিনের কথামতো ছাদে যাবে কি যাবে না সেই দ্বিধায় আছে নিরা।
সচরাচর এমন দেখা যায় প্রেমের কোনো ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটলে আমরা কোনোকিছুতেই মন বসাতে পারি না। আর সেটা যদি হয় পড়ালেখা তাহলে তো কথাই নেই। সেই সময়টা পড়ালেখা যেনো নিলামে উঠে। আসলে পড়ালেখা নিলামে উঠে না। আমাদের ক্যারিয়ার নিলামে উঠে যায়। এইযে, মনে করুন আপনি ভালোমতো পড়েননি। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার আসেনি। তাই ভালো কোনো পজিশন বা ভালো কোথাও চাকরি পাননি। আর আপনার জায়গায় অন্যকেউ কাজ করছে এটাই হলো নিলামে উঠা। যেখানে আপনার থাকার কথা সেখানে অন্যকেউ। আর আমরা জানি অনার্সের সময়টা হলো একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সোনালি সময়। এই সময়টার পরেই আপনি সিদ্ধান্তে যাবেন আপনি ভবিষ্যতে কোথায় থাকবেন। সে যাই হোক, এখন এসব কথা বাদ।
নিরা রুমের মধ্যে খুব পায়চারি করছে। কোনোমতেই একটা সিন্ধান্তে আসতে পারছে না। সে তুহিনের সাথে কথা এবং দেখা করতে ছাদে যাবে কি যাবে না। নিরা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে দেখছে আর গভীর চিন্তায় আয়নায় তাকিয়ে আছে। নিজে নিজেই বলে উঠলো,
— আচ্ছা তুহিন এখন কেনো ফিরে এসেছে? এর আগে আমি তার পেছনে ছ্যাচড়ার মতো যখন পড়েছিলাম কই তখন তো আমার প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা দেখিনি। তাহলে কি তুহিন কোনোকিছুর প্রতিশোধ নিতে এমন করছে? আচ্ছা, আমিতো তার কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে প্রতিশোধটা আসলে কিসের ভিত্তিতে নিবে? ক্ষতিতো সে আমার করেছে। সবার সামনে আমাকে দুশ্চরিত্ররা প্রমাণ করেছে। কই আমার মনে তো প্রতিশোধ নেবার বিন্দু মাত্র খেয়াল আসেনি।
নিরা আবার রুমের মধ্যে পায়চারি শুরু করেছে। মেয়ে মানুষ গুলো খুবই অদ্ভুত হয়। অনেক কঠিন থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত খুব সহজে নিয়ে নেয়৷ আর সামান্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই হিমশিম খায়। আর বয়স যদি হয় আঠারোর কাছাকাছি তাহলে তো কথাই নেই। এই বয়সে মেয়েরা সবসময় কনফিউশনে বেশি ভোগে। এই মূহুর্তে নিরাকে দেখেই বোঝা যায়। নিরা আবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে আবার বলতে শুরু করে,
— আচ্ছা আমি নেগেটিভ ভাবছি কেনো? এমনও তো হতে পারে তুহিন ওর সব ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই গিলটি ফিল করছে এবং সেই সুবাদে ফিরে এসেছে। আচ্ছা গিলটি ফিল করলে সে যা করলো তার জন্য আমাকে সরি কেন বললো না? হয়ত আমাকে রাফিন ভাইয়ার সাথে দেখে জেলাস হয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে আমাকে ভালোবাসে। আচ্ছা তুহিনের কি কোনো খারাপ মতলব আছে? হয়ত আছে। আচ্ছা নাও তো থাকতে পারে। উফ! আমি এতো বকবক করে নিজেই নিজেকে পাগল বানিয়ে ফেলছি।
নিরা আর ভাবতে না পেরে বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। হাত পা মেলে শুয়ে আছে। এই মুহুর্তে তার শীত লাগছে না বরং গরম এবং অস্বস্তি হচ্ছে খুব। কি একটা দোটানায় পড়ে গেলো। চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবনার জগতে গিয়ে সেখান থেকে আছড়ে পড়েছে ঘুমের রাজ্যে।
——————————————————————————–
রাত আড়াইটা,,,,
ফোনে বারবার ভাইব্রেট হচ্ছে। ফোন ভাইব্রেশন মুডে থাকলে আরেক ঝামেলা। মনে হয় পুরো রুমে ভুমিকম্প চলছে। নিরার ফোন বেডেই ছিলো। তাই বেড কেপে কেপে উঠছে বারবার। নিরা বিরক্ত হচ্ছে৷ ফোনটা শান্ত হয়ে গেলে আবার আরাম করে ঘুমায়। আবার ভাইব্রেট হতেই নিরা হচকচিয়ে উঠে আশেপাশে তাকায় ভালো করে। বিছানার চারপাশে হাতিয়ে বেড়াচ্ছে। আচমকা এমন ভাবে বেডটা কেনো কাপছে তা বুঝতে। প্রথমে ভাবলো ভুমিকম্প যাচ্ছে। পরে ভাবলো ভুমিকম্প হলে বাসার সবাই চিল্লাফাল্লা এতোক্ষণে শুরু করে দিতো।
নিরা নিজের মাথায় গাট্টা মেরে মোবাইল হাতে নেয়। মোবাইল হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
— নিরা ঘুমের ঘোরে তোর মাথাটা একদম গেছে।
চোখ কচলিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মুহূর্তেই একরাশ বিষাদ, বিরক্তি,উত্তেজনা আর ভয় মনের মধ্যে ভিড় করে। নিরা কলটা রিসিভ করতেই অপাশ থেকে বলে,
— কি করছো জান?
নিরা আরেক দফায় চমকে যায়। তুহিনের মুখে জান শব্দটা শুনে খুব বেশি অবাক হয়েছে।
— কি হলো কথা বলছো না যে? আর কোল রিসিভ করতে এতো লেইট হলো কেনো? কি করছিলে?
— এই শীতের মধ্যে কাপড় খুলে নাচতেছিলাম।
— হ্যালো কি বললা বুঝি নি।
— আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম তাই।
— আচ্ছা। ছাদে আসো আমি অপেক্ষা করছি।
— এই শীতের মধ্যে ছাদে আসবো?
— প্লীজ বাবু তুমি না আসলে কিন্তু আমি তোমার রুমে চলে আসবো। তোমার বেলকনির পাইপ বেয়ে আর না হয় ছাদের সিড়ি দিয়ে নেমে।
— ছাদের গেইট খোলা?
— হ্যাঁ।
নিরা হাত দিয়ে মোবাইল চেপে ধরে। বিরক্তি নিয়ে বলে,
— এই শীতের মধ্যে তার ভেতরে মজনু উদয় হইছে। যত্তসব।
নিরা মোবাইল কানে লাগিয়ে বলে,
— আচ্ছা আসছি।
— আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার লক্ষী বাবুটা। তাড়াতাড়ি আসো। আমি অপেক্ষায় আছি।
তুহিন ফোন কেটে দেয়। নিরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনে পানি ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঠান্ডায় পানি ধরতে ইচ্ছে করছে না। একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা পানি ঝাপটে মুখে মারে। মুহুর্তেই পুরো শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে আসে। নিরা বিরক্তি নিয়ে বলে,
— ওরে আল্লাহ পানি বরফের মতো ঠান্ডা।
পানির ছিটকা দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে তাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। হঠাৎ কেমন যেনো লাগছে নিরার। নিরা বলে উঠলো,
— আচ্ছা আমি না তুহিনকে ভালোবাসি? তাহলে তার ডাকে আমার এতো বিরক্তি লাগছে কেনো? ভালোবাসলে তো প্রিয় মানুষটার প্রতি বিরক্তবোধ আসে না তাহলে আমার কেনো আসছে? তাহলে আমার ভালোবাসায় কি কোনো খুত আছে?
নিরা অবাক হলো নিজের এমন কান্ডে। কথা গুলো ভেবে নিরা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে বললো,
— হয়ত তুহিনের এমন অবহেলায় তার প্রতি বিরক্তি জমে গেছে। না না, আমার ভালোবাসায় আমি কোনো খুত রাখবো না।
নিরা তাড়াতাড়ি করে ছাদে গেলো। ছাদে আসতেই দেখলো তুহিন দাঁড়িয়ে আছে। কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে। নিরাকে দেখে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। নিরা এগুতে এগুতে মনে মনে ভাবলো,
— এতো রাতে কার সাথে কথা বলছে? কোনো মেয়ে নয়তো? উমম! হয়ত কোনো বন্ধু হবে। না না, এখন রাত সাড়ে তিনটার থেকে বেশি এতো রাতে কোন বন্ধু জেগে আছে?
এওসব ভাবতেই ভাবতে নিরা তুহিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিরা এখনো ওইসব ব্যাপারে ভাবছে। নিরাকে অন্যমনস্ক দেখে তুহিন নিরার সামনে তুড়ি বাজালো। এতে নিরার ধ্যান ভাঙলো। তুহিন নিরাকে বললো,
— কি হলো বাবু কোথায় হারিয়ে গেলে? আমিতো এখানেই আছি তাহলে তুমি কার মাঝে হারিয়ে গেলে?
— কই কিছু না। কিছু বলবেন?
— বিরক্ত হচ্ছো?
নিরা আসলেই বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করলো না। কেনো বিরক্ত হচ্ছে সেই কারণ সে নিজেও খুজে পাচ্ছে না। যার কাছে একটা সময় পায়ে পড়ে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইলো এখন তাকে খুব বিরক্ত লাগছে। ব্যাপারটা নিরার কাছে আসলে অদ্ভুত লাগছে।
— কি ব্যাপার তুমি আবার কোথায় হারালে?
— না আসলে বিরক্ত হচ্ছি না।
— দ্যাটস মাই গার্ল। নাউ টেল মি হাউ মাচ উ লাভ মি বেব?
নিরা হতভম্ব, বেকুব হয়ে গেলো। কানের কাছে বার বার হাউ মাচ হাউ মাচ শব্দটা একবার নয় বারবার রিপিট হচ্ছে। ভালোবাসা মাপা যায়? কোন যন্ত্রে মাপা যায়? আসলেই কি মাপা যায়? হয়তো যায় তাইতো তুহিন নিরাকে জিজ্ঞেস করলো কতখানি ভালোবাসে। তবে নিরার মাথায় নেই কোন যন্ত্রে মাপা যায়। আর নিরা জীবনে এমন যন্ত্রের নামও শুনেনি। নিরা কৌতুহলের বসে তুহিনকে জিজ্ঞেস করলো,
— ভালোবাসা মাপার যন্ত্রের নাম কি?
তুহিন ভেটকি মাছের মতো ভেটকিয়ে হাসছে। তুহিনের হাসি নিরার গায়ে কাটা দেয়ার মতো লাগছে। তাও যে কেনো দাঁড়িয়ে তুহিনের বকবকানি শুনছে সে নিজেও জানে না।
( বাস্তবে ভেটকি নামের কোনো মাছ আছে নাকি আমিও জানি না।)
তুহিন নিরাকে হাত ধরে টেনে আরেকটু সামনে আনে। নিরার ডান গালে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বলে,
— ভালোবাসি নিরা। তুমি আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। প্লিজ আমাকে এবার তাড়িয়ে দিও না। অনেক ভুল করেছি। অনেক অন্যায়ও করেছি তোমার সাথে। প্লিজ ফরগিভ মি এন্ড এক্সেপ্ট মাই প্রপোজাল।
নিরা কিছু বললো না। চুপ করে ছিলো। এতোক্ষণ বিরক্ত লাগলেও এখন ভালোলাগছে। তুহিন নিরাকে সরি বলেছে সব কিছুর জন্য। আচ্ছা সরিতেই সব শেষ হয়ে যায়? একটা পাঁচ শব্দের ওয়ার্ড বললেই কি সব দুক্ষ, সব কষ্ঠ, গ্লানি চলে যায়? একটা মানুষ যা হারিয়েছে সব আবার ফিরে আসবে এই সরি শব্দে? নিরার জানা নেই। আপাতত তুহিনের সরি সে এক্সেপ্ট করে নিয়েছে।
অনেক্ক্ষণ গল্পগুজব করে তুহিন চলে যায় এবং নিরাকেও বাসায় যেতে বলে। নিরা তুহিনের কথামতো সিড়ি দিয়ে নেমে রুমেই যাচ্ছিলো। ছয়টা সিড়ি নামতেই নিরা খুব ভয় পেয়ে যায়। এখন কি বলবে সে? এতোরাতে ছাদে কেন এসেছে এটার কি উত্তর দিবে সে? ভয়ও লাগছে আবার খুশিও লাগছে কারণ তুহিন সত্যিই ফিরে এসেছে তাই। নিরার সামনে এই মূহুর্তে রাফিন দাঁড়িয়ে। রাফিনের চোখে মুখে কোনো রাগ নেই। তবে চোখে আছে হারানোর বেদনা। যেটা নিরা এখন দেখতে পারছে না। রাফিন নিরাকে জিজ্ঞেস করে,
— এতো রাতে এখানে কি করছো তুমি?
— না মানে আসলে,,,,
নিরা বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান হাতের তালু ঘষছে। চোখে লজ্জা। ঠোঁটে হাসি। রাফিন এসব দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিরালে উদ্দেশ্য করে বললো,
— অনেক রাত হয়েছে রুমে যাও।
— হু।
নিরা চলে যায়। রাফিন আজ রাগ দেখাতে গিয়েও দেখায়নি। অধিকার দেখাতে গিয়েও দেখায়নি। রাফিন ছাদে উঠে আসে। রেলিংটাকে খামছে ধরে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে যত দূর যায় দৃষ্টি তত দূরেই নিয়ে যাচ্ছে। খুব ঠান্ডা হাওয়া ছাদে। হাড় কাপানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কিন্তু রাফিন একটা টি শার্ট পড়ে আর টাউজার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কনকনে শীতের মধ্যে। বুকের মাঝে উথাল পাতাল চলছে তার। এর মধ্যেই ফজরের আযান পড়ে গেছে। পাখিরা জেগে উঠতে শুরু করেছে। হালকা হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির এখন বেড়েই গেছে। প্রকৃতির নতুন ঋতু খুশিতে বরণ করে আনন্দে মেতে উঠেছে সব পাখির দল। আনন্দ নেই শুধু রাফিনের মনে। খুব কাছে গিয়ে সেখান থেকে খালি হাতে ফিরে আসার ব্যাথাটা কেমন হয় সেটা যে অনুভব করে শুধু সেই বুঝতে পারে। রাফিন বুঝতে পারছে খুব করেই বুঝতে পারছে সে নিরাকে হারাতে চলেছে।
·
·
·
চলবে……………………..