হৃদয়ের কোণে পর্ব ১৩

0
802

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১৩)
#নাহার
·
·
·
ভোর পাঁচটায় নিরার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে জানালার গ্রিল পেরিয়ে দৃষ্টি দেয় বাহিরের দিকে। এখনো আলো ফুটেনি। জানালার কাচে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আছে। নিরা বেড থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে কাচের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি মুছে দেয়।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে বেলকনিতে দাঁড়ায়। অনেকদিন বেলকনিতে থাকা গাছের পরিচর্যা করা হয় না। নিরা ফুল গাছ গুলো পরিষ্কার করার জন্য গাছে পাশে বসে। শিশিরের বিন্দু গাছের পাতায়, ফুলের উপর জমে আছে। গাছের উপরে জমে থাকা বিন্দু পানি নিরা হাতে নেয়। চোখের সামনে এনে দেখে মুক্তোর দানার মতো লাগছে। মুচকি হাসে নিরা। উঠে দাঁড়িয়ে বেলকনির রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকায়। হালকা আলো ফুটে উঠেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিরার।

সবকিছু আছে নিরার, পরিবার, বন্ধু -বান্ধব, নিরার ভালোবাসা তুহিন। সব আছে তাও কেনো যেনো নিজেকে শূন্য মনে হয়। কেউ একজন নেই। তার শূণ্যতা নিরা খুব করে অনুভব করে শুধু বুঝতে পারে না সেই মানুষটা কে।

কিছুক্ষণ পড়তে বসে নিরা। কালকে কলেজ থেকে আসার সময় একটা ডায়েরি কিনেছে নিরা। তিনশ টাকা দিয়ে কালো মোটা ঢালের ডায়েরিটা। অল্প কিছুক্ষণ পড়ে নিরা ডায়েরিটা হাতে নেয়। কলম হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় লিখে,

” সবকিছু থেকেও শূণ্যতায় ডুবে আছি। একজন অচেনা প্রমিকের শূণ্যতায় ভুগছি। একজন অচেনা প্রেমিক মনেহয় যার অস্তিত্ব মিশে গেছে আমার সাথে।”

এতোটুকু লিখেই ডায়েরিটা রেখে দেয়। উঠে দাঁড়ায় কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিতে। বোরকা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় হিজাব বাধার জন্য। হিজাব বেধে ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে আসে বের হওয়ার জন্য। হুট করে দাঁড়িয়ে যায় নিরা। আবার আয়নার সামনে যায়। কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠে। নিজেকে সামলে নেয়। নেকাব বেধে নিচে নেমে আসে সকালের নাস্তার জন্য। খেয়ে মিসেস শায়েলাকে বলে বের হয়ে যায় নিরা।

নিরা হেটেই যাচ্ছে কলেজে। আজ তিন দিন হলো রাফিন চলে গেছে। রাফিন তার ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে। নিরার মা অনেকবার মানা করেছে না যেতে। কিন্তু রাফিন এটা সেটা অযুহাত দিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে। নিরা হাটছে আনমনে আর বারবার শুধু সেই একজনের কথা ভাবছে। কে সে? যার জন্য নিরার মন কাঁদে।

নিরার ভালোবাসা তুহিন তো আছেই তাও কেনো এতো শূন্যতা? ঘুরাঘুরি করা, নামি দামি রেস্টুরেন্ট এ যাওয়া, দামি দামি গিফট উপহার দেয়া সবই ঠিকাছে তারপরেও সব থেকেও কোথায় যেনো কিছু একটা নেই।

নিরা কলেজে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। নিরার বন্ধুবিরা এটা সেটা নিয়ে কথা বলছে হাসাহাসি করছে কিন্তু নিরার সেদিকে খেয়াল নেই। এমন সময় ঝুমুর দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে নিরার কাছে গিয়ে বলে দোস্ত একটা কথা বলবো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরা বললো,
— হ্যাঁ বল। কি কথা?

— দোস্ত আমি আসার সময় তুহিনকে দেখলাম একটা মেয়েকে নিয়ে বসে আছে পার্কে। খুবই ক্লোজ ভাবে বসে আছে। ওদের দেখেই মনে হচ্ছে ওরা কাপল।

— তুই হয়ত ভুল দেখেছিস।

— আরে ভুল না ঠিকই দেখছি। বিশ্বাস কর।

প্রভা আর নুপুর ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর ইশারায় বললো সে মিথ্যে বলছে না। নুপুর নিরার কাছে গিয়ে বললো,
— দেখ হয়ত কাজিন হতে পারে। তুই মাইন্ড করিস না।

প্রভা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। ঝুমুর ধপাস করে সামনে বেঞ্চে বসে পড়লো। নুপুর বললো,
— কিরে নিরা তুই চুপ করে আছিস কেনো?

— তুহিন আমাকে ধোকা দিচ্ছে নাতো?

— না না। নিজ থেকে ফিরে এসেছে ধোকা কেন দিবে।

প্রভা এগিয়ে এসে বললো,
— শুন আমরা তো তোর খুব ভালো বান্ধুবি তাই না। তুই যখনই তুহিনের সাথে কোথাও ঘুরতে যাবি আমাদের বলে যাবি। ঠিকাছে?

— হুম।

নুপুর আর ঝুমুর প্রভার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। ক্লাশ শেষে নিরা তুহিনের সাথে দেখা করতে যায়। নুপুর প্রভাকে জিজ্ঞেস করে,
— তুই তখন এ কথা কেন বললি?

— আমার তুহিনকে মোটেও সুবিধার মনে হয় না। আর নিরা বারবার ওই তুহিননার কাছে ছুটে যায়। ইচ্ছে করে থাপড়াই ওরে। হুদাই রাফিন ভাইরে দূরে ঠেলে দিছে।

— দেখিস ও ঠিক বুঝতে পারবে রাফিন ভাইয়ের ভালোবাসা।

— হ্যাঁ। সেজন্যই বলছি যেখানেই যাবি আমারে বলবি তাহলে বুঝবো নিরাকে কখন কোন সময়ে বিপদে ফেলে তুহিন।

ওরা বাসায় চলে যায়। নিরা তুহিনের সাথে পার্কে দেখা করে। নিরা তুহিনকে জিজ্ঞেস করে,
— আজকে সকালে কোথায় ছিলে?

— এখানে পার্কেই ছিলাম।

— কেনো?

— আমার একটা কাজিনের সাথে দেখা করতে এসেছি তাই।

— ওহ আচ্ছা।

নিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঝুমুর ভুল বুঝেছে তুহিনকে। ওরা অনেকক্ষণ গল্প করে। তুহিনের একটা কাজ আছে এই বলে চলে যায়। নিরা একা একা বাসায় চলে আসে। এভাবে করে এক সপ্তাহ চলে যায়।

আজকেও তুহিনের সাথে ঘুরেফিরে এসেছে নিরা। খুব খুশি খুশি মেজাজে উপরে উঠে আসে। তিনতলায় উঠে নিরা থমকে দাঁড়ায়। রাফিনের রুমের দিকে নজর পড়তেই কেমন যেনো কান্না আসছে। নিরা ধীর পায়ে রাফিনের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। নিরা মনে মনে ভাবে, এই বুঝি চোখ খুললে খালি গায়ে রাফিনকে দেখতে পেয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেবে। আর রাফিন মুচকি হেসে চোখ ছোট ছোট করে নিরার দিকে তাকিয়ে বলবে,
— এভাবে একা একটা ছেলেকে টিজ করতে তোমার লজ্জা করে না?
কথাটা বলেই রাফিন দুষ্ট হাসি দিবে। আর নিরা ভয়ে পালাবে।

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। চোখ খুলে দেখলো রাফিন নেই। কেমন যেনো বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে উঠলো। পড়ার টেবিলের সামনে যায় যেখানে রাফিন বসে পড়ত। কোনো কিছুই নেই রাফিনের। বেডের উপর রাফিনের একটা শার্ট দেখতে পায় নিরা। তাড়াতাড়ি গিয়ে শার্টটা হাতে নেয়। নাকের কাছে আনতেই একটা ঘ্রাণ নাকে বারি খায়। হ্যাঁ, এটা রাফিনের গায়ের ঘ্রাণ। নিরা শার্টটা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। অস্পষ্ট ভাবে বলে,
— প্লিজ ডাক্তার ফিরে আসুন। প্লিজ। আপনাকে ছাড়া ভালো লাগে না। প্লিজ ডাক্তার ফিরে আসুন।

রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন মুচকি হেসে চলে যায়।

——————————————————————————–
প্রতিদিনের মতো নিরা একাই কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে। ফুটপাতের উপরে উঠে আস্তে আস্তে হেটে আসছে বাসায়। নিরার বাসায় ফিরতে আর দশ মিনিট লাগবে। নিরা দেখলো একটা ছেলে এবং মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাতে। এখন মধ্য দুপুর তাই রাস্তায় মানুষজন কম। তারা দুইজন কিছু কথা বলছে। নিরা হাটতে হাটতে ওদের কাছে চলে আসে। ওদের কাছে আসতেই ছেলেটার কথা শুনতে পায় যা সে কেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলো,
— শুনো আমার লাজুকলতা বাসায় গিয়ে ফোন দিবে ঠিকাছে? সময়মতো খাবে। একদম অনিয়ম করবে না। গত পরশুদিন কতটা দুর্বল ছিলে দেখেছো তোমার এই অনিয়মের কারণে? আর হ্যাঁ, ঠান্ডা কিছু খাবে না এই শীতে। যদি ঠান্ডা লাগে এবার মাথায় তুলে আছাড় মারবো। মনে থাকবে?

মেয়েটা এক শব্দের জবাব দিলো,
— হু।

নিরা তাড়াতাড়ি হেটে আসে বাসায়। রাফিনও নিরাকে এভাবে কেয়ার করতো। নিরাকে লজ্জাবতী বলে ডাকতো। আজ সবকিছু খুব মিস করছে।

নিরা রুমে এসে ব্যাগটা ফ্লোরে ছুড়ে মারে। বেডের পাশে ধপাস করে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— প্লিজ ডাক্তার ফিরে আসুন। প্লিজ।

রুমের বাহিরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে নিরার সব কথা শুনে মুচকি হেসে চলে যায়।

নিরা তুহিনের কাছ থেকে এমন কেয়ার একবারো পায়নি। তুহিন এরকরম বেখেয়ালি হয়ে থাকে। যতক্ষণ নিরা তুহিনের সাথে থাকে ততক্ষণ খবর নেয়। এরপর আর ফোন দেয় না। বাসায় আসলে ফোন দিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করেনি বাসায় ঠিকঠাক মতো পৌছেছে কিনা। নিরা তুহিনকে যেমন করে চায় তুহিন তেমন নয়। অন্যমনস্ক হয়ে থাকে সবসময়।

খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমাতে চলে যায়। রাফিন চলে যাওয়ার পর থেকে কেউই নিরার সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কৌশিক তো একেবারেই না। ভাই বোন সবাই কেমন যেনো এরিয়ে চলে নিরাকে।

রাফিন চলে গেছে সেটার জন্য নয়। নিরা তুহিনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে তাই কেউ ঠিকমতো কথা বলে না। তুহিনকে কেউই সহ্য করতে পারে না। আর নিরা সেই মানুষটার সাথেই সম্পর্কে আছে।

রাত সাড়ে বারোটায় তুহিন নিরাকে ফোন দেয়। নিরা ফোন রিসিভ করতেই তুহিন বলে,
— হ্যালো বাবু কি করছো?

— কিছু না। ঘুমাতে যাচ্ছি।

— আচ্ছা। শুনো তোমাকে একটা কথা বলবো।

— হুম।

— তোমাকে আমার খুব আদর করতে ইচ্ছে করে এ কদিন। তাই ভাবছি কাল তোমাকে খুব আদর করবো। তাই তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো।

— তোমার বাসা তো এখানেই। নিয়ে যাওয়ার কি দরকার? আমি নিজেই আসতে পারবো।

— আরে এটা না।

— তো?

— বাবা আমাকে একটা ফ্ল্যাট গিফট করেছে। কাল তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো। রেডি থেকো তুমি। ঠিকাছে?

— হুম।

— আর শুনো কাল বোরকা পড়বে না। বোরকায় তোমায় ভালো লাগে না। জিন্স এবং টপস পড়বে। ওকে?

–হুম।

— আচ্ছা এখন রাখছি। ঘুমাও তুমি।

তুহিন ফোন রেখে দেয়। নিরার রাফিনের কথা মনে হয়। মনে মনে বলে,
— আমি বোরকা পড়ে রাফিন ভাইয়ার সামনে গেলে এক মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। বাসায় সবাই বলেছে আমি বোরকা পড়লে দেখতে পুতুল পুতুল লাগে। আর তুহিনের নাকি ভালো লাগে না।

নিরা আরো কিচ্ছুক্ষণ ভাবে। তারপর ওদের চার বন্ধুবির ফেসবুকে যে কনভারসেশন গ্রুপ আছে সেখানে মেসেজ দিয়ে জানায় কালকের কথা। মেসেজ দিয়েই নিরা ঘুমিয়ে পড়ে।

মেসেজ পাওয়ার পর নুপুর, ঝুমুর এবং প্রভা ভাবছে কি করা যায়। তিনজন গ্রুপ কলে আসে। প্রভা বললো,
— কি করা যায়? কালকে কিন্তু বড় কোনো বিপদে ফেলবে তুহিন নিরাকে।

নুপুর বললো,
— তাহলে যেই ধামাকার জন্য এতোদিন ওয়েট করছি সেটা করা যাক।

ঝুমুর হাসতে হাসতে বললো,
— আমার ঘুম আসছে। আল্লাহ হাফেয

প্রভা রেগে যায়। রেগে ঝুমুরকে বলে,
— তোর সবসময় সিরিয়াস মোমেন্টে এতো ঘুম আর হাসি কই থেকে আসে?

— আল্লাহ দিছে আমি কিরুম?

— লাথি না খাইলে প্ল্যানে সামিল হো।

— এভাবে কস কে? আমি কি প্ল্যানের বাইরে নাকি?

নুপুর চেচিয়ে বললো,
— তোরা থামবি? দাড়া আমি কাজ সেরে আসি। একটা ইমপোর্টেন্ট কল।

নুপুর কল রিসিভ করে বলে,
— তুহিন নিরাকে ওর ঞ্জ্জের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবে কাল।

——-

— আচ্ছা ঠিকাছে। সব রেডি।

——

— আপনি সিউর তুহিন ওকে মানা করবে? যদি না করে?

—–

— ওকে তাহলে ফাতেমাকে জানাতে হবে।

নুপুর কল কেটে প্রভাকে এবং ঝুমুরকে বলে,
— এভরিথিং ডান। কাল রাত আটটার পর হবে ধামাকা।

সকালে তুহিন ফোন করে বলেছে দুপুরে বের হবে। নিরাকে রেডি হয়ে থাকতে বলেছে। নিরা তুহিনের কথামতো জিন্স আর টপস পড়েনি। একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে। বেবি পিংক কালারের কামি। নিরা বান্ধুবির বাসায় যাওয়ার নাম দিয়ে বের হবে৷ অথচ এখন সকাল পেরিয়ে দুপুর। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো তুহিনের কোনো খবর নেই। কিছুক্ষণ পর তুহিন ফোন দেয় নিরাকে…..
·
·
·
চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here