হৃদয়ের কোণে পর্ব ৩৭

0
659

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩৭)
#নাহার
·
·
·
কাশফি এবং তূর্যের বউভাত এর অনুষ্ঠান নিয়ে তুহিন আজ সারাদিন ব্যস্ত। খুব সুন্দর ভাবে এই অনুষ্ঠান করতে চায় তুহিন। তুহিনের বাবা কোনো কমতি রাখতে চায় না। সাথে তুহিনও চায় না কোনো কমতি থাকুক। তুহিনের বাবা তূর্যকে নিজের ছেলে হিসেবেই দেখে। তাই খুব তোড় জোড় চলছে অনুষ্ঠানে। এদিকে তুহিনের মা জ্বলে যাচ্ছেন এসব দেখে। উনার একটাই কথা পরের ছেলের জন্য এতো খরচ করার কি দরকার? কিন্তু তুহিন এখন আর তার মায়ের কথায় নাচবে না।

বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকার সময় তুহিনের মা বাধা দিয়েছিলেন। উনার কথা তূর্য এবং তার বউ কখনোই এই বাড়িতে থাকতে পারবে না। তূর্য চেয়েছিলো চলে যেতে কাশফিকে নিয়ে। কিন্তু তুহিন হাঙামা করেছে তার মায়ের সাথে। তুহিন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে- “তোমার যদি সমস্যা হয় আমার ভাই আর ভাবিকে নিয়ে তাহলে তুমি থাকো এ বাড়িতে। আমি আমার ভাই ভাবিকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে যাবো।” তুহিন চলে যাবে শুনে তুহিনের মা দমে গেলো। এদিকে তুহিনের বাবা রেগে বললেন,- “তোমার সমস্যা হলে তুমি যাও না কেন? আমার ছেলে এবং ছেলের বউ এখানে এই বাড়িতে আমাদের সাথেই থাকবে।” আর কিছু বলেননি তুহিনের মা।

কাশফিকে লাল আর কালো পাড়ের একটা সিল্কের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। থ্রি কোয়াটার হাতের ব্লাউজ। দুই হাত ভর্তি লাল এবং কালো কাচের চূড়ি। কাশফি প্রথমে চুল ছাড়া রেখেছিলো কিন্তু তূর্যের কড়া নির্দেশে লাল হিজাব বেধেছে। তূর্যের একটাই কথা – “আমার বউ এর চুল শুধু আমি দেখবো আর কেউ নয়।” কাশফিও খুশি মনে হিজাব বেধে নিয়েছে। কাশফির সাথে মিলিয়ে তূর্য কালো পাঞ্জাবি পড়েছে। কালো পাঞ্জাবির গলার দিকে লাল সূতার এমব্রয়ডারির কাজ। দুইজনকে পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে। তুহিনের সাথে সাথে তুহিনের বাবাও খুব খুশি। নতুন বউ ঘরে এসেছে খুশি হবেই না বা কেনো।

পুরো বাড়ি কাশফির পছন্দের ফুল চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। লাল এবং সাদা চন্দ্রমল্লিকার সমরোহে পুরো বাড়ি যেনো ফুলের বাড়ি মনে হচ্ছে। কাশফি নিচে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো সাজানোটা। তূর্য চুপিসারে এসে কাশফির হিজাবের উপর একটা সাদা চন্দ্রমল্লিকা পিন দিয়ে লাগিয়ে গালে টুপ করে চুমু দিয়ে আবার চলে গেলো। কাশফি গালে হাত দিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো মানুষজন তেমন আসেনি তাই কেউ দেখেনি।

আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান শুরু হলো। কাশফির বাড়ির সবাই এলো। কাশফির বাড়ির মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে কাশফির বাবা মা এবং নিরার বাবা মা। মিসেস তানজুম এবং মিসেস শায়েলা এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। মিসেস রেহানা কাশফির থুতনি ধরে বললো,
— তা স্বামী শ্বশুর বাড়ি কেমন লাগছে মামনি? আমাদের জামাই বাবাজি আদর করে তো নাকি?

কাশফি খানিকটা লজ্জা পেলো। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নিলো। তূর্য এসে সবাইকে সালাম দিলো। কাশফির ছোট চাচিকে বললো,
— আপনাদের মেয়েকে আদর করতে গেলেই শুধু আমাকে বকে।

ঠোঁট উলটে কথাটা বললো তূর্য। কাশফি চেতে গিয়ে বললো,
— আমি কই বকলাম? চাচি ও মিথ্যে বলছে। ও নিজেই আমাকে ঝাড়ি মেরে বললো ঘুমাও। আমার কি দোষ।

তূর্য চোখ বড়বড় করে কাশফির দিকে তাকিয়ে আছে। ইশ্ মেয়েটার জ্ঞান বলতে কিছু নেই। বাসর রাতের কথা এখানে বলা লাগে? তূর্য কাজ আছে বলে চলে গেলো। নিরা এসে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
— বাহ্ বেশ তো। তারপর কি হয়েছে?

বড়রা সরে গেছে সেখান থেকে। নিরা, ফাতেমা এবং কৌশিক কাশফিকে ঘিরে ধরেছে। কৌশিক বললো,
— তো বনু কেমন লাগলে প্রথম রাত? হিহি।

কাশফি কৌশিকের পেটে ঘুষি মেরে হনহন করে অন্যদিকে চলে গেলো। আফিয়া বললো,
— একদম ঠিক হয়েছে। কারো পারসোনাল কিছু জিজ্ঞেস করতে তোমার লজ্জা লাগে না?

কৌশিক আফিয়ার কানে ফিসফিস করে বললো,
— আই এম ফিলিং কিসিইইইই! উম!

আফিয়াও কৌশিকের পেটে কনুই দিয়ে ঢু মেরে চলে গেলো। নিরা হাসছে খুব। কৌশিক চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— যেদিন তোমার আর রাফিনের বিয়ে হবে সেদিন দেখিস তোর কপালে শনি আছে। হাহা।

কৌশিক চলে যেতেই নিরা চুপ হয়ে গেলো। সামনে তাকাতেই রাফিনকে দেখলো। মনে মনে বললো,
— লোকটা দিন দিন কেমন যেনো অসভ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন দেখো কেমন করে তাকিয়ে আছে। হুহ!

নিরা সামনে রাফিনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙাতেই রাফিন ফ্লাইয়িং কিস ছুড়ে দিলো। নিরা মনে মনে বললো,
— এই বউভাতে সবাই কেমন অসভ্যতা শুরু করেছে। হুহ।

অনুষ্ঠানে সবাই খুশি হলেও তুহিন অনেকটা মনমরা ছিলো। যতবার সে রাফিন এবং নিরাকে দেখেছে ততবার ভেতর থেকে একটা আপসোস আর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছে। আজকে রাফিনের জায়গায় সে থাকতো যদি সেদিন সেই জঘন্য সিনক্রিয়েট না করতো। কিন্তু কি আর করার।

——————————
কাশফির বিয়ে হয়েছে প্রায় একমাস হয়ে গেছে। নিরাদের বাড়ির সবাই বেশ খুশি কারণ কাশফি সেখানে অনেক সুখে আছে। এদিকে রাফিন এবং নিরার বিয়ের কথাও চলছে। মোটামুটি একটা বিয়ের সিজন চলছে বাড়িতে। ফাতেমা আপেল কামড়ে খাচ্ছে আর নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। নিরা মুখ নামিয়ে চোখ বাকা করে বললো,
— এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

— ভাবছি তোর পরে কি আমার সিজন আসবে নাকি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে?

একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে ফাতেমা বলল,
— আমার জামাইটা কেমন হয় আল্লাহই জানে। কিউট হলে ভালো হবে।

নিরা বালিশ ছুড়ে মেরে বললো,
— ভাগ এখান থেকে।

দরজার পাশে মালিহা দাঁড়িয়ে মনে মনে বললো,
— আজকের রাতে তোমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে নিরা।

——————————
রাফিনের মায়ের রুমের সামনে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় কেমন একটা হালকা চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলো নিরা। উৎসুক হয়ে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকবে কি ঢুকবে না দ্বিধায় পড়ে গেছে। এর ফাকে রাফিনের আওয়াজ শুনা গেলো। রাফিনের মা বললো,
— আমি আর মানি না এই বিয়েটা। আমি চাই না এই বিয়েটা হোক। কিসব দেখছি এসব। ছি ছি। রাফু তুই আমার সাথে এবার অস্ট্রেলিয়া যাবি। এরা বাড়ি শুদ্ধ উঠে পড়ে লেগেছে তাদের এই চরিত্রহীন মেয়েকে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিতে।

নিরার বুকটা কেঁপে উঠলো। ভয় পাচ্ছে সে এক অজানা আশংকার। হাত মোচড়ামুচড়ি করেই যাচ্ছে। রাফিনের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। রাফিন বললো,
— তুমি কতটুকু জানো নিরার সম্পর্কে যে এতো কিছু বলে ফেলছো? কি করেছে ও?

— কি করেনি এই মেয়ে? বিয়ের আগে একবার অন্য ছেলের সাথে ছিহ! এসব ঢাকতে ওই তুহিনের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে। সব যখন জানাজানি হলো তখন বিয়ে ভেঙে গেছে। আর তুই কিনা এই মেয়ের পিছনে পড়ে আছিস। আবার আরেক ছেলের সাথে এসব কুকর্ম।

— মা! কিসব উলটা পালটা বলছো তুমি?

— মালিহার কাছে প্রমাণ আছে দেখ। তারপর বিশ্বাস করবি।

মালিহা মোবাইল থেকে ছবি গুলো বের করে দিয়ে রাফিনের মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
— আমার তো প্রথমেই সন্দেহ হিয়েছিলো যখন মেহরাব নিরার পেছনে যাচ্ছিলো আর নিরা চুপ করে ছিলো। সবাই চলে আসায় মেহরাবের উপর সব দোষ দিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। অনেক গুটিবাজ এই মেয়ে।

ছবিগুলো দেখে রাফিনের মাথায় বাজ পড়লো। সে একবার ছবির দিকে তো একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। রাফিনের মা রাফিনকে ধরে বললো,
— প্লিজ বাবা আমার সাথে অস্ট্রেলিয়া ফিরে চল।

রাফিন ধপ করে বিছানায় বসে পরে। আস্তে করে তার মাকে বলে,
— ঠিকাছে।

নিরা সব শুনে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠে। রাফিন চলে যাবে তাকে ছেড়ে, সে নিরাকে ভুল বুঝেছে। এসব ভাবতেই নিরা আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজায় টোকা দেয়। রাফিনের মা দরজা খুলে দিয়ে রাফিনের কাছে এসে হাত শক্ত করে চেপে ধরে। রাফিন একবার নিরার দিকে তাকিয়ে আবার মোবাইলের দিকে তাকায়। তারপর আস্তে করে উঠে এসে নিরার বরাবর দাঁড়ায়। নিরা সরাসরি রাফিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিন কিছুক্ষণ নিরার দিকে তাকিয়ে থেকে সজোড়ে একটা থাপ্পড় মারে নিরার গালে। নিরা ছিটকে মেঝেতে পড়ে যায়। রাফিন বললো,
— এতোকিছুর পর লজ্জা লাগছে না আমার সামনে এসে দাঁড়াতে? আমার চোখে চোখ রাখতে? তোর আসলেই লজ্জা নেই। তুই নির্লজ্জ একটা মেয়ে। তোকে অনেক ভালো করার চেষ্টা করেছি আমি কিন্তু কে জানতো তুই যে কোনোদিন ভালো হবি না।

——————————
বেডের চারেপাশে সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। ডাক্তার আনা হয়েছে। ডাক্তার চেকাপ করে বললো,
— অতিরিক্ত টেনশনের কারণে এ অবস্থা হয়েছে।

নিরা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দেখে সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে। নিরা কৌশিকের কাছে এসে ওর হাত ধরে বলে,
— ভাই জানিস আমি একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি। খুব বাজে স্বপ্ন। দেখলাম আমার ডাক্তার সাহেব আমাকে ভুল বুঝে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কি ভয়ংকর স্বন ছিলো।

কৌশিক নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিরাকে কোলে শুয়ে দিয়ে বললো,
— নিরু ওইটা স্বপ্ন ছিলো না। সত্যিই রাফিন চলে গেছে। রাফিন অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।

নিরা উঠে বসে। হেসে বলে,
— মজা করছিস তাই না?

— মোটেও না।

নিরা একদম চুপ হয়ে যায়। একবার কৌশিকের দিকে তাকায়। আবার বাড়ির সবার দিকে তাকায়। সবার মুখ গম্ভীর। সবার মুখের অবস্থা দেখে নিরা বুঝে গেছে তার ডাক্তার সাহেব তাকে ছেড়ে চলে গেছে। চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনোদিন দেখা হবে না সেই প্রিয় মুখটা। আর কেউ তাকে শাসন করবে না, ভালোবাসবে না। চলে গেছে সে, চলে গেছে তার ডাক্তার সাহেব। হাজার মাইল দূরে চলে গেছে। যাকে হাত বাড়ালেই আর ছুতে পারবে না।

নিরা বালিশে মাথা রেখে বললো,
— তোমরা সবাই যাও আমি একটু ঘুমাবো। টেনশন করো না আমি ঠিক আছি। কাশফি আপু তুই তূর্য ভাইয়ার কাছে যা। আমি একদম ঠিক আছি।
·
·
·
চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here