হৃদয় রেখেছি জমা পর্ব:১১

0
653

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১

পরেরদিন সকালে মাহমুদের ঘুম ভাঙ্গার আগেই মেহরিন বেরিয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠে মাহমুদ অবাক! মেহরিন নেই। মনে মনে খুব রাগ হলো তাঁর! নিশ্চয়ই তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না বলে খুব সকালে বেরিয়ে গেছে মেহরিন? মেহরিন শারাফাত! দ্যা হরিবল লেডি! একটাবার সরি বলারও প্রয়োজন মনে করে নি? এত রাগ মাহমুদের প্রতি! অথচ মাহমুদ সারারাত জেগে ছিলো। সে ভেবেছিলো মেহরিন একবার হলেও তাঁকে সরি বলতে আসবে। কিন্তু না মেহরিন আসে নি।আশায় আশায় জেগে থেকে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সেই ফাঁকেই বেরিয়ে গেছে মেহরিন।ফ্রেশ বিচ্ছিরি একটা মেজাজ নিয়ে অফিসের রওনা দিলো মাহমুদ।

ইরফান সাহেবের রুম থেকে ফাইল নিয়ে একত্রে বেরোচ্ছিলো সোহাগ এবং মেহরিন। মাহমুদকে দেখে সোহাগ হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,’কি খবর মাহমুদ ভাই? জ্বর সেরেছে?’

মাহমুদ জবাব দিলো না। চুপচাপ নিজের কাজে ডেস্কে গিয়ে বসলো। মেহরিন আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মনোযোগ দিলো মাহমুদও।

সোহাগ মনে মনে বেশ অবাক হলো। হঠাৎ করে কি হলো মাহমুদের? তবে গতকাল আবার ঝগড়া হয়েছে মেহরিনের সঙ্গে? কিন্তু সে তো মেহরিনকে ঘুমে দেখে এসেছিলো। তাহলে ঝগড়াটা হলো কখন? যাই হোক এখন আর বেশি ঘাটালো না। সুযোগ মত মেহরিনকে জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিলো।

সেদিন আর মেহরিনের সঙ্গে মাহমুদের তেমন কথাবার্তা হলো না। মেহরিনও বললো না। এভাবে আরো দুই দিন কেটে গেলো। মুখোমুখি দুচার দেখা হলেও সম্পূর্ণ ভাবে পাশ কাটিয়ে গেলো মেহরিন। চতুর্থ দিন আবারো দুজনের একসঙ্গে কাজের দায়িত্ব পড়লো। ইরফান সাহেব দুজনকে একসঙ্গে কাজ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কোন রকম বাক্য বিনিময় ছাড়াই কাজ করলো দুজনে। এবারেও মাহমুদ আশায় ছিলো মেহরিন হয়ত একা পেয়ে তাকে সরি বলবে। কিন্তু মেহরিন বরাবরের মতই চুপচাপ রইলো। কোন রকমের কোন অনুতাপ প্রকাশ পেলো না তাঁর কাজেকর্মে। মনে মনে হতাশ হলো মাহমুদ! এত রাগ একটা মানুষের কি করে হতে পারে!
কাজ শেষে একসঙ্গে নিচে নামলো দুজনে। মেহরিনের গাড়ি ঠিক হয়েছে। পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিলো সে এমন সময় মাহমুদ গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেলো মেহরিনের। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো সে ,’কি?’

-‘স্যে সরি!’, গম্ভীরমুখে জবাব দিলো মাহমুদ।

-‘বেহায়া!’, পাশ কেটে যাচ্ছিলো মেহরিন। সে ভাবতেই পারে নি মাহমুদ নিজে থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসবে। যদিও সেদিনের পর থেকেই মনে মনে অনুতাপে ভুগছিলো সে কিন্তু এই বাহানায় মাহমুদ দূরে সরে থাকবে ভেবে চুপ করে ছিলো। কিন্তু মাহমুদ এভাবে এসে তাঁকে সরি বলতে বলবে এটা তাঁর কল্পনার বাইরে।

ফের পথ আটকালো মাহমুদ। পূর্ববৎ গম্ভীর গলায় বললো,’ইউ হ্যাভ টু স্যে সরি! আই অ্যাম ইউর সিনিয়র!’

-‘সিনিয়র?’

-‘ইয়েস সিনিয়র!’

-‘হোয়াট টাইপ অফ সিনিয়র ইউ আর? জুনিয়রকে বুলেয়িং করা সিনিয়র? তোমার কি ধারণা তুমি আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করবে আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো? কখনো না। এত যদি সিনিয়র সাজার ইচ্ছে হয় তাহলে সবার আগে নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করো। লার্ন টু বিহেভ ইউরসেল্ফ!’

-‘ঠিক আছে আমি আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি। আই অ্যাম সরি। এবার তোমার পালা।’

-‘বলবো না সরি! কি করবে তুমি?’

অবাক হলো মাহমুদ। একটু আগে তাকে ভাষণ দিয়ে এখন নিজেই সরি বলবে না বলছে?
ঠিক আছে মাহমুদও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে যখন সরি বলেছে তখন মেহরিনকেও সরি বলতে হবে। চট করে মেহরিনের হাতে থাকা গাড়ির চাবিটা কেড়ে নিলো সে। হাতের মুঠোয় নিয়ে হাসিমুখে বললো,’ইউ হ্যাভ টু রেসপেক্ট ইউর সিনিয়র!’

-‘চাবি দাও!’

-‘নো। আগে সরি, তারপর চাবি। তোমার মনে রাখা উচিৎ ছিলো তুমি মাহমুদ সিদ্দিকির গালে চড় মারছো!’

-‘ঠিক আছে লাগবে না আমার চাবি। আমি টেক্সিতে করেই যাবো!’

নিমিষেই মুখ কালো হয়ে গেলো মাহমুদের। এমন ইগোয়িস্টিক, ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে সে জীবনে আর দুটো দেখে নি!

মেহরিন অলরেডি গেটের দিকে হাঁটা ধরেছে। মাহমুদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে চাবি দিয়ে বললো,’এই ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য তোমার কপালে দুঃখ আছে মেহরিন। বিয়েশাদী জীবনেও হবে না।’

-‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি নিজের বিয়ের কথা ভাবো।’

-‘আমার বিয়ে তো কোন ব্যপারই না। আমি চাইলে এইমুহূর্তেই বিয়ে করে ফেলতে পারি। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করবে কে? তোমার যা স্বভাব তাতে তো কবুল বলার আগেই তালাক হয়ে যাবে।’

-‘হলে হবে। তোমার কি?’

-‘আমার আবার কি? আমি তো শুধু সত্যিটা বলেছি!’

-‘কে চাইছে তোমার সত্যি শুনতে? ডোন্ট ইউ হ্যাভ আ গার্লফ্রেন্ড? যাও না তাঁকে গিয়ে এসব শোনাও। আমাকে কেন আমাকে বিরক্ত করছো?’

‘গার্লফ্রেন্ড?’ অবাক হলো মাহমুদ। পরোক্ষনেই মুচকি হেসে বললো,’তার কারণ গার্লফ্রেন্ডকে বিরক্ত করা যায় না। গার্লফ্রেন্ডকে শুধু ভালোবাসতে হয় তাই!’

মেহরিনের মুখের ভাব কঠোর হয়ে গেলো। থমথমে গলায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’চাবি দাও! আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

-‘উঁহু! যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের কথা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তুমি চাবি পাবে না।’

-‘কিসের কথা?’

-‘তোমার বিয়ের। যাইহোক, সেটা যখন হচ্ছে না তখন থাক। আমরা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি!’

-‘সহ্যের কিন্তু একটা সীমা আছে বলে দিচ্ছি।’

-‘ তোমার সবকিছুই সীমাহীন। কেবল বুদ্ধি আর ধৈর্য ছাড়া। সুতরাং সেই প্রসঙ্গে না গেলেই ভালো। এনিওয়ে, তুমি যাকে আমার গার্লফ্রেন্ড ভেবে ভুল করছো সে কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। সে আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু।’

-‘বন্ধু?’ খানিকটা তাচ্ছিল্য মেহরিনের গলায়।

-‘হ্যাঁ বন্ধু। সোহাগ যেমন তোমার বন্ধু তেমনি এনাও আমার বন্ধু।’

-‘মোটেও তেমন নয়। আমার এবং সোহাগের বন্ধুত্ব তোমাদের চাইতে আলাদা। আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে একটা লিমিট আছে। কিন্তু তোমাদের ব্যপারটা পুরোপুরি লাগামছাড়া!’

-‘তোমার এবং সোহাগের বন্ধুত্বের মাঝে লিমিট কেবল তোমার কারণে। তোমার দিক থেকে যদি সেরকম কোন পজিটিভ সাইন থাকতো তাহলে তোমাদের বন্ধুত্বটাও আরো গভীরে যেতে পারতো। তুমি সোহাগকে সেরকম কোন সুযোগ দাও নি তাই তোমাদের বন্ধুত্বটা আর বেশিদূর আগায় নি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে যখন বন্ধুত্ব তৈরী হয় তখন কমফোর্ট জোন তৈরীর ব্যপারটা একটা মেয়ের ওপরেই নির্ভর করে। মেয়েটা ঐ ছেলেটাকে তাঁর কতটুকু কমফোর্ট জোনের ভেতরে ঢুকতে দেবে সেটা মেয়েটাকেই নির্ধারণ করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে তোমার সঙ্গে এনার হয়ত কিছুটা তফাৎ আছে। ওর কমফোর্ট জোন তোমার চাইতে অনেক বেশি! ও একটু বেশিই ফ্র‍্যাঙ্ক! কিন্তু তারমানে এই নয় যে ওর সঙ্গে আমার অন্য কোন সম্পর্ক আছে। এনা আমার বন্ধু। আমি ওকে বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসি।’

অফিসে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই ইরফান সাহেবের সঙ্গে এনার সম্পর্কের কথা জেনে যায় সবাই। তার মা ইরফান সাহেবকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে এই খবর ফাঁস হওয়ার পর অফিসের কেউই খুবই একটা ভালো চোখে দেখতো না তাঁকে। বেচারি দারূন ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। একমাত্র মাহমুদই সেই সময়টাতে আন্তরিকতার সহিত কো-অপারেট করে তাঁর সঙ্গে। সেই থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় দুজনের। যে কোন সমস্যার কথা নির্দ্বিধায় মাহমুদকে খুলে বলতে পারে সে। অবশ্য মাহমুদের কিলার টাইপ এটিচিউড আর বন্ধুবৎসল ব্যক্তিত্বের কারনে যদিও মনে মনে সে মাহমুদকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু মাহমুদের দিক থেকে সেরকম কোন প্রকাশ না থাকায় বলে উঠতে পারে নি।

কিন্তু মেহরিনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় নি। সে-ও মাহমুদকে ভালোবাসে। এনার চোখেও সেই একই ভালোবাসা! নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর অসহ্য রকমের জ্বালাপোড়া হয় মেহরিনের! অথচ সে নিজেই চায় মাহমুদ নতুন করে শুরু করুক। সুখী হোক। সংসারী হোক! কিন্তু তবুও তাঁর কষ্ট হয়। না পাওয়ার বেদনায় নিরবে ছটফট করে সে!
মাহমুদের কথার জবাবে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গম্ভীর গলায় বললো,’এসব আমাকে কেন বলছো? তোমার সঙ্গে এনার সম্পর্ক যাই হোক না কেন আমার কাছে সেটা একেবারেই ম্যাটারই করে না। আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার!’ কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাহমুদ নিরব দর্শকের মত তাঁর চলে যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো কেবল! এত নিষ্ঠুর!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here